আর্কিমিডিয়ান স্ক্রু পাম্প
আর্কিমিডিয়ান স্ক্রু পাম্প

 

ইউরেকা শব্দটির সাথে আপনারা কমবেশি সবাই পরিচিত আর গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস এর নাম শুনেন নাই এরকম কাওকে পাওয়া আসলেই দুষ্কর। তিনি একই সাথে গনিতবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, জ্যোতির্বিদ এবং দার্শনিক ছিলেন। তার জন্ম খ্রিঃ পূর্ব ২৮৭ সালে বৃহত্তর গ্রিসের সিসিলি দ্বিপের সিরাকিউজ নামের বন্দর নগরীতে। খ্রিঃ পূর্ব ২১২ সালে পিউনিক যুদ্ধের সময় ৭৫ বছর বয়সে তিনি এক রোমান সৈন্যের হাতে নিহত হন।যুদ্ধে আর্কিমিডিসের ক্ষতি করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা থাকা স্বত্তেও তাকে এক সৈন্য তাকে হত্যা করে ফেলে। তার জীবন সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায়নি, তারপরেও যেটুকু জানা যায় তাতেই তাকে ক্লাসিকাল যুগের সেরা বিজ্ঞানী বলে বিবেচনা করা হয়।

archimedes
গ্রিক বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস গবেষনায় ব্যস্ত

গনিত, পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ইত্যাদিতে তার অসামান্য অবদান রয়েছে। আমি আজ তার প্রৌকশল কাজের একটি আপনাদের মাঝে তুলে ধরব যা আর্কিমিডিস এর স্ক্রু  নামে বিশেষ পরিচিত। গ্রিক লেখক অথেনিয়াস অভ নক্রেটিসের বর্ণনা অনুযায়ী, রাজা দ্বিতীয় হিয়েরো তাকে একটা বিশাল জাহাজ তৈরির দায়িত্ব দেন। আর্কিমিডিস সিরাসিউকা নামের এক জাহাজ তৈরি করেন যা ছিল ঐসময়ে সর্ব বৃহৎ। অথেনিয়াসের ধারণা মতে জাহাজে একসাথে ছয়শত যাত্রী বহন করা যেত। এতে সাজানো বাগান, ব্যামাগার, মন্দির ছিল। সিরাসিউকা প্রয়োজন আনুযায়ি প্রমোদতরী, রসদ সরবরাহকারী এবং রণতরী হিসেবে ব্যবহার করা যেত। কিন্তু জাহাজ তৈরির পর দেখা গেল এতে প্রচুর পানি চুইয়ে ঢুকছে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি আর্কিমিডিস এর স্ক্রু তৈরি করেন। এটি আসলে একটি সিলিন্ডারের ভেতর আবদ্ধ একটি স্ক্রু আকৃতির ঘূর্ণায়মান ধাতব ব্লেড যাকে হাত দিয়ে ঘুরানো হত। এই যন্ত্রটি তৎকালীন সময়ে খাল থেকে উচু জমিতে সেচের জন্যেও ব্যবহার করা হত। এমনকি বর্তমানকালেও এটিকে পানি, কয়লা, সিমেন্ট, শস্যদানা জাতীয় ক্ষুদ্রাকৃতির পদার্থ উত্তোলনের জন্য ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

আর্কিমিডিসের স্ক্রু
আর্কিমিডিসের স্ক্রু দিয়ে পানি পাম্প করা হচ্ছে
আর্কিমিডিসের স্ক্রু এর ব্যবহার
আর্কিমিডিসের স্ক্রু এর ব্যবহার
আর্কিমিডিসের স্ক্রু
আর্কিমিডিস এর স্ক্রুঃএনিমেশন
আরকিমিডিয়ান স্ক্রু পাম্প এর গঠন

আরকিমিডিয়ান স্ক্রু পাম্প এর গঠন খুবই সাধারণ। একটি সেমি সার্কুলার পাইপকে ৩০ ডিগ্রী কাত করে বসিয়ে এর মাঝে একটি ধাতব স্ক্রু সেট করা হয়। এরপর এই স্ক্রুটির ঘূর্ণনের মাধ্যমে নিচের অংশের পানি উপরে প্রবাহিত করা হয়ে থাকে। প্রবাহিত পানির পরিমাণ নির্ভর করে পাইপের ব্যাসার্ধ , স্ক্রুর পিচ সংখ্যা, ঘূর্ণন গতি এবং পাইপের এংগেলের উপর। পাইপের নিচের অংশ জমা পানিতে থাকে স্ক্রু ঘুরার কারণে পানি উপরের অংশে প্রবাহিত হয়। তৎকালীন সময়ে এই স্ক্রু হাত দিয়ে ঘুরানো হলেও এখনকার যুগে এটিকে উইন্ড পাওয়ার, সোলার পাওয়ার কিংবা বৈদ্যুতিক মটর দিয়ে চালানো হয়।

এই পাম্পের সুবিধাঃ

১। ধীরগতি, সাধারণ এবং শ্রমসাধ্য ডিজাইন।

২। পানির সাথে এটা ভারী এবং ভাসমান বস্তুকেও পাম্প করতে পারে, ব্লকেজ হবার কোন সুযোগ নাই।

৩। ইনলেটে পানি না থাকলেও এটি চলতে পারে, কখনো বন্ধ হবেনা।

৪। কোন কন্ট্রোল সিস্টেমের প্রয়োজন নাই।

৫। এটার ঘূর্ণন গতি এবং স্ক্রুর গ্যাপের কারণে মাছ কিংবা অন্য কোন প্রানি থাকলে তার কোন ক্ষতি করে না।

৬। রক্ষনাবেক্ষন খুব সহজ হওয়ায় কোন দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন নাই।

৭। এর লাইফ টাইম খুব বেশি, সাধারনত ২০-৪০ বছর ধরা হয়ে থাকে।

অন্যদিকে একই কাজে যদি প্রপেলার যুক্ত সেন্ট্রিফুগাল পাম্প ব্যবহার করা হয় তাহলে কি কি অসুবিধা হতে পারে দেখা যাকঃ

১। প্রপেলার যুক্ত সেন্ট্রিফুগাল পাম্প এর গতি অনেক বেশি হওয়ায় বালি ও অন্যান্য বস্তু দ্রুত ব্লকেজ তৈরি করে যা পাম্পকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং দ্রুত রিপেয়ারিং করতে বাধ্য করে।

২। পানিতে অন্যান্য হেভি সলিড থাকলে তা পাম্প করা যায় না।

৩। পানিতে ভাসমান বস্তু থাকলে তা পাম্প করা যায়না। ভাসমান বস্তু বাড়তেই থাকে।

৪। ইনলেটে জমা পানি না থাকলে পাম্প করা যায়না। পাইপকে সিলগালা বায়ুনিরোধক রাখতে হয়, রেগুলার রক্ষনাবেক্ষন করা প্রয়োজন।

৫। পাইপের মধ্যে ঘর্ষণের কারণে এনার্জি লস এবং পাইপের ক্ষয় হয়।

৬। দক্ষ কারিগরের প্রয়োজন। কিছুদিন পরপর রক্ষনাবেক্ষন করা প্রয়োজন।

প্রায় ২২০০ বছরের পুরানো টেকনোলোজি হলেও আজও এই টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে বিশেষ করে ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট, কৃষি সেচকাজ সহ বিভিন্ন জায়গায়। আপনারা চাইলে গুগল করে এর বিভিন্ন ব্যবহার দেখতে পারেন।

আর্কিমিডিসের স্ক্রু এর আধুনিক ব্যবহার
আর্কিমিডিসের স্ক্রু এর আধুনিক ব্যবহার

আরকিমিডিসকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে যার মধ্যে অনিয়মিত বস্তুর (সোনার মুকুট) আয়তন নির্ণয়, শত্রুপক্ষের জাহাজ আগুনে ভস্মীভূত করা, শত্রুপক্ষের জাহাজ উল্টিয়ে ( এটি আর্কিমিডিসের থাবা নামে সুপরিচিত) ফেলা ইত্যাদি। এগুলোর মধ্যে জাহাজকে ভস্মীভূত করার গল্পটি নিয়ে সন্দেহ থাকলেও বাকি গল্পগুলো সত্য বলেই মনে করা হয়। বলা হয়ে থাকে তিনি বলেছিলেন, “আমাকে একটি দাড়ানোর জায়গা দাও আমি পৃথিবীকে সরিয়ে দেব।“

এছাড়াও গনিতবিদ্যায় তার অসামান্য অবদান ছিল, তিনি পাই এর মান নির্ণয়, বর্গমূল, অসীম ধারার যোগফল সহ নানা ধারনার প্রবর্তন করেন। তিনি দশমিক ভিত্তির গননার পাশাপাশি মিরিয়াডের ভিত্তিতে গননার একটি সিস্টেমের প্রস্তাবনা করেন।এই প্রাচিন বিজ্ঞানীর অধিকাংশ গবেষণাই সংরক্ষিত হয়নি যেকারনে তার অনেক গবেষনাই আজও অজানা।

ধন্যবাদ সবাইকে।

ব্লগটি ভাল লেগে থাকলে আপনার ফেসবুকে শেয়ার করুন। নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটনে ক্লিক করে সহজেই শেয়ার করতে পারবেন। এছাড়াও আমার ব্লগে কমেন্ট করে আপনার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন। আর ফাইভ স্টার রেটিং দিয়ে আপনার ভালোলাগার বিষয়টি প্রকাশ করতে ভুলবেন না।

হোমপেজে ভিজিট করুন।

Previous articleকরোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব?
Next articleফুটন্ত পানিতে ব্যাঙের গল্প ও বাংলাদেশের করোনা ভাইরাস পরিস্থিতি
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।

4 COMMENTS