হযরত বেলাল (রাঃ)

আজকে আপনাদের কে ইসলামিক ইতিহাসের এক গৌরবমণ্ডিত সাহাবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেব। যিনি খুব অল্প বয়সেই অপহরিত হয়ে দাসত্ব বরণ করেন। আর প্রথম কাতারে ইসলাম গ্রহণ করে অমানবিক জুলুমের শিকার হন। দাস হিসেবে বিক্রি হওয়া এই বালকটি কিন্তু  আর কেউ নন, স্বয়ং বেলাল বিন রাবাহ আল-হাবশি। যিনি আমাদের কাছে হযরত বেলাল (রাঃ) নামেই বেশি পরিচিত

সুকণ্ঠের অধিকারী বিলাল বিন রাবাহ ছিলেন ইসলাম ধর্মের প্রথম মুয়াজ্জিন। আল্লাহর প্রতি তার ছিল একনিষ্ঠ আনুগত্য এবং ঈমানের প্রতি ছিল নিদারুণ দৃঢ়তা। ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব- হযরত বেলাল (রাঃ) সম্পর্কে আপনাদের জানাতেই  আমাদের আজকের আয়োজন- হযরত বেলাল (রাঃ) – ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব।

টাকা ছাড়াই সদকার সোয়াব হাসিলের শ্রেষ্ঠ পাঁচ উপায় জানতে নিচের ভিডিও দেখুন।

হযরত বেলাল (রাঃ) – ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর সঙ্গী হিসেবে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী হওয়ার অগ্রিম সুসংবাদ পাওয়া ব্যাক্তি হলেন হযরত বেলাল রাঃ। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখিত এই মহিমান্বিত ব্যক্তির জীবন সম্পর্কে না জানলেই নয়! আমাদের সাথে জেনে নিন ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব- হযরত বেলাল (রাঃ) সম্পর্কে-

হযরত বেলাল (রাঃ) কে ছিলেন? তার জন্ম পরিচয়

বেলাল (রাঃ) ৫৮০ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন  হেজাজের মক্কা নগরীতে।  তার বাবা রাবাহ ছিলেন একজন আরব দাস। অন্যদিকে তার মাতা হামামাহ ছিলেন একজন আবিসিনিয় রাজকুমারী।  হযরত বেলাল (রাঃ) এর মনিব ছিলেন উমাইয়া ইবনে খালাফ। হযরত বেলাল (রাঃ) ছিলেন অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রমী।  ফলে তিনি একজন ভাল দাস হিসেবে সহজেই পরিচিতি লাভ করেন।

এ কারণে তার কাছে আরবের পুতুলগুলোর ঘরের চাবির দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্ণবাদ  এর কারনে  সে সময় তিনি সমাজের উচু স্তরে যেতে পারেননি।

হযরত বেলাল (রাঃ) এর দাসত্বের করুন ইতিহাস

ঘটনাটি ঘটে প্রাক-ইসলামি যুগের ষষ্ঠ শতকের শেষ ভাগে,  পূর্ব আফ্রিকার দেশ আবিসিনিয়ায়।  হামামা দাঁড়িয়ে ছিলেন  তার বাড়ির উঠোনে। অদূরেই খেলা করছিল তার ফুটফুটে দুটি সন্তান।  বিলাল এবং গুফায়রা। হঠাৎ করেই দিগন্ত জুড়ে দেখা দিল ভয়ানক  ধুলোর ঝড়। ঘোড়ার ক্ষুর ছুটিয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো একদল ভয়ালদর্শন অশ্বারোহী। বিপদ টের পেয়ে হামামা চেষ্টা করেন তার দুই ছেলেমেয়েকে লুকিয়ে রাখতে।

তবে শেষ রক্ষা আর হলো না। ডাকাতদল তার দুই সন্তানকে অপহরণ করে নিয়ে গেল হাজার মাইল দূরের মরুময় এক নগরীতে।  আর তাদেরকে দাস হিসেবে বিক্রি করে দিল আরবের মক্কা নগরীর বিশিষ্ট মূর্তি ব্যবসায়ী উমাইয়া বিন খালাফের কাছে। এখানেই শুরু হয় হযরত বেলাল রাঃ এর দাসত্বের করুন জীবন।

হযরত বেলাল (রাঃ) এর ইসলাম গ্রহণ

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) যখন তার নবুয়তের কথা ঘোষণা করা শুরু করেন এবং এক ইলাহ অর্থাৎ আল্লাহ এর বাণী প্রচার করা শুরু করেন, বেলাল (রাঃ) তখন থেকে অবতীর্ণ সকল আয়াত মনোযোগ সহকারে শুনতেন। এবং অত্যন্ত মেধাবী এই সাহাবী সাথে সাথে আয়াত গুলো মুখস্ত করে ফেলতেন।

মুহাম্মদ (সাঃ) এর ধর্ম প্রচার বিলালকে ইসলামের দিকে এতটাই আকৃষ্ট করে যে তিনি কোনো কিছু চিন্তা না করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। সর্ব প্রথম  ইসলাম গ্রহণকারী কয়েকজনের মধ্যে একজন হয়ে ওঠেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ টাকা ছাড়াই সদকা হাসিলের শ্রেষ্ঠ ৫ উপায়।

ইসলাম গ্রহণের পর নির্মম অত্যাচার ভোগ

ইসলাম গ্রহনের জন্য বিলালকে সহ্য করতে হয়েছে অমানবিক কষ্ট ও যন্ত্রণা। তার মনিব উমাইয়া ইবনে খালাফ যখন জানতে পারে সে  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে সেই থেকে তার ওপর নির্যাতনের মাত্রা বাড়তে থাকে।

তাকে নানা ভাবে তাকে ইসলাম ত্যাগ করার জন্য জোড় করা শুরু হয় । নির্যাতনের প্রথম দিকে হযরত বিলাল (রাঃ) কে বেঁধে চাবুক ও লাঠি দিয়ে পেটানো হতো। পালাক্রমে চলতেই থাকত নির্মম লাঠিপেটা ও চাবুকাঘাত।

কোনো ভাবেই যখন তাকে দিয়ে ইসলাম ত্যাগ করানো যাচ্ছিলো না তখন  তাকে মরুভূমির উত্তপ্ত বালির উপর শুইয়ে রাখা হয়। তার বুকের উপর পাথর চাপা দিয়ে রাখা হয় যাতে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়।  এরপরেও এই মহান সাহাবী  ইসলাম ত্যাগে অস্বীকার জানালেন।

ফলে নির্যাতন আরো ভয়াবহ রুপ নেয়। তার বুকে চড়ানো  পাথরের উপর একজন মানুষ উঠিয়ে দেওয়া হয়, এবং সেই মানুষটি অনবরত লাফাতে থাকে।এতো কিছুর পরেও তিনি,  আহাদ,আহাদ (এক আল্লাহ,এক আল্লাহ) বলে এক নাগাড়ে  চিৎকার করতে থাকেন। এতটা নির্মম ও অমানবিক নির্যাতনের পরও এই মানুষটি দ্বীনের পথ কে ত্যাগ করেন নি।

দাসত্ব থেকে মুক্তি

ইসলামের পথে অটুট থাকার অপরাধে হযরত বেলাল (রাঃ) কে সহ্য করতে হয়েছিল অমানবিক জুলুম।  আর এই  এ খবর জানার পর

মহানবী (সাঃ) হজরত আবু বকর (রাঃ) কে যে কোনো মূল্যে তাকে মুক্ত করার আদেশ দেন। নবী করিম সা. এর পরামর্শ মোতাবেক হযরত আবু বকর (রা.) একজন শক্ত-সামর্থ্য ক্রীতদাসের বিনিময়ে মতান্তরে অর্থের বিনিময়ে হজরত বিলাল (রা.) কে ক্রয় করে নেন এবং নিজ হাতে তাকে দাসত্ব থেকে  মুক্ত করে দেন।

সেই থেকেই হযরত বেলাল (রাঃ) আমৃত্যু ইসলামের পক্ষে কাজ করে গেছেন। তার জীবদ্দশায় তিনি ছিলেন মহানবী (সাঃ)-এর একান্ত সঙ্গী।

হযরত বেলাল (রাঃ) এর হিজরত

৬২২ খ্রিস্টাব্দে,  হযরত বেলাল (রাঃ) অন্যান্য মুসলিমদের সাথে মদিনায় হিজরত করেন। এরপর প্রায়  এক দশক , তিনি মুহাম্মদ (সাঃ) এর সকল সামরিক সকল অভিযানে তার সঙ্গ দিয়েছেন। হযরত বেলাল (রাঃ) মুহাম্মাদ (সাঃ) এর বর্শা বহন করতেন। যা তিনি ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দ থেকে নামাজের দিকনির্দেশনায়  ব্যবহার করতেন।

ইসলামে হযরত বেলাল (রাঃ) এর অবদান

উহুদ, বদর এবং খন্দকের যুদ্ধ সহ রাসূল সাঃ এর সকল সামরিক অভিযানে  বেলাল (রাঃ)  অংশগ্রহণ করেন। এক সাথে তারা ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দে  কোন রক্তপাত ছাড়াই মক্কা জয় করেন।

রাসূল সাঃ এর মৃত্যুর পর আবু বকর রাঃ এর খিলাফতের সময়কাল থেকে বেলাল (রাঃ)  সিরিয়ায় সাঈদ ইবনে আমির আল-জুমাহি এর নেতৃত্বাধীন মুসলিম সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন।  ইসলামের খেদমতে নিজেকে পুরোপুরি  সঁপে দেন। তাই ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব- হযরত বেলাল (রাঃ)।

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন কে

ইসলামের প্রথম মুয়াজ্জিন ছিলেন হযরত বেলাল (রাঃ)।

সুন্নিগন এবং শিয়াগণ উভয়ের মত অনুযায়ী,  হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ১ম হিজরী সনে আযান দেয়ার রীতি চালু করেন।  বেলাল (রাঃ) এর সুগভীর, সুমধুর ও সুরেলা কণ্ঠের জন্য রাসূল (সাঃ)  প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে তাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এজন্য সুন্নি এবং শিয়াগণ উভয় জাতি বেলাল (রাঃ) কে প্রথম মুয়াজ্জিন হিসেবে স্বীকার করেন।

মুসলিম সেনাবাহিনী মক্কা দখল করার পর, বেলাল (রাঃ) প্রিয় নবীর নির্দেশে কাবা ঘরের উপরে উঠে  আযান দেন। সেই আযানই ছিলো মক্কা শহরের মুসলিমদের দেয়া প্রথম আযান।

আযানঃ আরবী আযানের বাংলা অর্থসহ

  • আল্লাহু আকবার –৪ বার আল্লাহই মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ
  • আশহাদু আল্লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্ –২ বার আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে এক আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই।
  • আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রসুল্লাল্লাহ্– ২বার আমি সাক্ষ্য দিচিছ যে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ আঃ) আল্লাহর প্রেরিত রসুল।
  • হাইয়্যা আলাছ ছালাহ্ -২ বার তোমরা নামাযের দিকে ছুটে এসো।
  • হাইয়্যা আলাল ফালাহ্– ২ বার তোমরা সাফল্যের দিকে ছুটে এসো।
  • [ফজরের আজানের] সময় আসসালাতু খাইরুম মিনান নাউম-২ বার ঘুম থেকে সালাত উত্তম।
  • আল্লাহু আকবার-২ বার আল্লাহই মহান ও সর্বশ্রেষ্ঠ।
  • লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ্-২ বার এক আল্লাহ্ব ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই।

প্রিয় নবীর প্রতি ভালবাসা

বেলাল (রাঃ) নবী করীম (সাঃ) এর মৃত্যুর পর আর কখনোই আযান দেননি। যখন খলিফা উমর (রাঃ) জেরুজালেম পরিদর্শন করেন, সাহাবাগণ তখন উমর (রাঃ) কে অনুরোধ করেন,  বেলাল (রাঃ) যেন শেষবারের মত একবার আযান দেন। যখন বেলাল (রাঃ) আযান দিচ্ছিলেন, তখন সকল সাহাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে প্রিয় নবীর কথা মনে করে।

বেহেশতের সুসংবাদ প্রাপ্ত  হযরত বেলাল (রাঃ)

জীবিত থাকা অবস্থায় বেহেশতে যাওয়ার সুসংবাদ আমাদের প্রিয় নবীই পেয়েছিলেন। তিনিই সর্বপ্রথম বেহেশতের দরজায় টোকা দেবেন।  অর্থাৎ সর্ব প্রথম তিনিই বেহেশতে প্রবেশ করবেন। তার সাথে আরো একজন নিজ জীবদ্দশায় জান্নাতে যাওয়ার সংবাদ পেয়েছিলেন

সে হলো বেলাল (রাঃ) কতই না ভাগ্যবান সে  ব্যক্তি,  যে নবীজির সাথে বেহেশতে প্রবেশ করবে!

হযরত বেলাল (রাঃ) এর মৃত্যু কাহিনী

৬৩০-৪০ খ্রীস্টাব্দে সিরিয়ার দামেস্কে হযরত বেলাল (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। তবে তার মৃত্যু নিয়ে বেশ কিছু মতভেদ রয়েছে। জর্ডানের আম্মামেও তার একটি সমাধী রয়েছে। কেউ কেউ মনে করে তিনি ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দ মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউ বলে থাকেন  তিনি ৬৪২ খ্রিস্টাব্দে মারা যান। মৃত্যুকালে  তার বয়স প্রায় ৬৩ বছর ছিলো।

শেষ কথা, যা না বললেই নয়

বেলাল (রাঃ) এর মৃত্যুর পূর্ব লক্ষণ দেখতে পেয়ে তার স্ত্রী দুঃখে ভারাক্রান্ত হয়ে বললেন,

“কি দুঃখময় পরিস্থিতি!”

কিন্তু হযরত বেলাল (রাঃ) তার স্ত্রীর মন্তব্যের বিরোধিতা করে বললেন,

“পক্ষান্তরে, এটা কতই না সুখময় সময়! কাল ই তো আমি রাসূল (সাঃ) এবং তার সাথীদের সাথে মিলিত হব!”

তার বলা এই শেষ কথাগুলো, আল্লাহর আনুগত্য ও নবীর প্রতি ভালোবাসার এক অনন্য নিদর্শন।

দ্বীনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করা, শারিরীক মানসিক নির্যাতন সহ্য করা এমন মানুষের সংখ্যা কম নয় এবং নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও সামনে এগিয়ে যাওয়া মানুষও কম নয়। তবে এদের মধ্যে বেলাল রাঃ কেন  অন্যতম হয়ে উঠলেন? কারণ

ইসলামে হযরত বেলাল (রাঃ) ছিলেন  মুসলমান ও রিসালাতের জন্য একজন  নিবেদিত প্রাণ সাহাবী। ইসলাম গ্রহণের জন্য তাকে যে নির্যাতন কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে এতোটা কষ্ট আর কাউকে সহ্য করতে হয়নি।প্রাথমিক যুগে এতো নির্যাতন সহ্য করেও এক আল্লাহ প্রতি অনুগত থাকা ইসলামে এক বিরল দৃষ্টান্ত তিনি।

তাই ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব- হযরত বেলাল (রাঃ) এর জীবনী  আমাদের জন্য একটি শিক্ষা হয়ে থাকুক এবং আমাদের ঈমানি ভীত আরো মজবুত হোক এই কামনা করি।

এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হয়ে আপনি যদি রেডিটুরিডিং ব্লগকে ডোনেট করতে চান তাহলে বিকাশ-০১৬১৪১৭১৭৬৫ অথবা নগদ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ অথবা ইউক্যাশ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ এ আপনার ডোনেশন পাঠাতে পারেন।

অথবা,

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেও আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন। ইউটিউব চ্যানেল লিংক এখানে। আশা করি অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সহযোগীতা করবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হয়ে আরও লেখা পাবলিশ করব।

Previous articleকম্পিউটার ভাইরাস কি ? বাঁচবেন যেভাবে।
Next articleউহুদের যুদ্ধ বিস্তারিত – উহুদের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল