হযরত উমর (রাঃ)
হযরত উমর (রাঃ)

 

ইসলামে হযরত মুহাম্মদ সাএর পর সবচেয়ে সম্মানিত ব্যক্তি হযরত আবু বকর রা. দুই বছর শাসন শেষে জীবনের শেষ সময়ে খলিফা নির্বাচিত করলেন  হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব  (রাঃ) –কে। প্রথম দিকে বেশ কয়েকজন এতে আপত্তি জানিয়েছিল হযরত উমর (রাঃ) এর রাগান্বিত স্বভাবের জন্য। কিন্তু দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে সকলের ধারণা ভুল প্রমাণিত করে ইসলামের সবচেয়ে ক্ষমতাবান প্রিয় শাসকে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

কুরাইশ বংশে জন্ম নেয়া উমর ইসলামের প্রথম দিকে ছিলেন প্রচুর ইসলাম মুহাম্মদ (সাঃ) বিদ্বেষী। তার ইসলাম গ্রহণের কাহিনি মুসলিম বলতে সবারই জানা। আমি এখানে মূলত তার শাসনকালে তিনি কেমন ছিলেন, শাসক হিসেবে তিনি তার অধীনস্তদের সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন, কেমন ছিলো একজন শাসক হিসেবে তার জীবন সেই দিকটি তুলে ধরা চেষ্টা করবো।

মহান বিজেতা হয়েও অনন্য সাধারন জীবন-যাপন

আমাদের একজন শাসক ছিলেন যিনি নিজে হেঁটেছেন খালি পায়ে। তিনি ছিলেন মহান বিজেতা যে শাসন করেছেন অর্ধ পৃথিবী। ইসলামের দ্বিতীয় খলিফায়ে রাশেদ হযরত উমর (রাঃ) ছিলেন সবার চোখের মণি। যার ইসলাম গ্রহণে স্বয়ং মুহাম্মদ সা. দোয়া করেছিলেন। তিরমিজি হাদিস নং ৩৬৮১ তে আছেঃ
হে আল্লাহ! আবু জাহল ইবনে হিশাম বা উমর ইবনুল খাত্তাবের মধ্যে যাকে আপনার পছন্দ, তাকে ইসলাম গ্রহণের তাওফিক দিয়ে ইসলামের শক্তি দান করুন। হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব ছিলেন আল্লাহর প্রিয়। তিনি তাকে ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় দান করেন।

হযরত উমর (রাঃ)খুবই সাধারণ জীবন যাপন করতেন। তাঁর একাধিক জামা না থাকার কারণে একবার জুম্মার সময়ে তিনি কিছুটা সময় পরে উপস্থিত হয়েছিলেন। হাফেজ জাহাবি রাহ. কাতাদাহ রাহ. হতে উদ্ধৃত করে বলেন, উমর রা. খলিফা নিযুক্ত হওয়ার  পর তালিযুক্ত আলখেল্লা পড়ে বাজারে চক্কর দিতেন। তালিগুলোর মধ্যে কিছু ছিলো চামড়ার। তাঁর কাধে থাকতো চাবুক। অপরাধী পেলেই শাস্তি দিতেন। (তারিখুল খুলাফা২৬৮)

কুরাআনের অনেক মতের সঙ্গেই ছিলো হযরত উমর (রাঃ) এর মিল। যেমনঃ হযরত উমর (রাঃ) মুহাম্মদ (সাঃ) কে বলেছিলেনহে আল্লাহর রাসুল! যদি আপনি মাকামে ইবরাহিমকে নামাজের স্থান হিসেবে গ্রহণ করতেন। পরবর্তীতে আল্লাহ অবতীর্ণ করেছিলেনঃ
তোমরা ইবরাহিমের দাঁড়ানোর জায়গাকে নামাজের জায়গা হিসেবে গ্রহণ করো।‘ (সূরা বাকারাঃ১২৫)

আল্লাহভীতি ও নম্রতা

খেলাফতের দায়িত্ব গ্রহণ করে অভিষেক ভাষণে আল্লাহর কাছে দোয়া চেয়ে বলেছিলেনঃ
হে আল্লাহ আমি রূঢ় কঠোর, তুমি আমাকে কোমল করে দাও। আমি দুর্বল, তুমি আমাকে শক্তিশালী করে দাও। আমি কৃপণ, আমাকে তুমি দানশীল বানিয়ে দাও।‘ (ইবনুল জাওজি প্রণীতমানাকিবু আমিরিল মুমিনিন ১৭০, ১৭১

তিনি ক্ষমতায় থাকা কালে কোনো অপরাধীকে হুমকি দিয়ে সত্য স্বীকার করতে বাধ্য করতেন না তিনি বলতেনঃ
কাউকে তার অন্যায়ের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য কষ্ট দেয়া, ধমক দেয়া বা বন্দি করা মানে তাকে প্রাণের নিরাপত্তা না দেওয়া।‘ (নিজামুল হাকাম ফি আহদিল খুলাফাইর রাশিদিনঃ১৬৫)

খোদাভীতি আত্মশুদ্ধিতে তিনি ছিলেন অগ্রগামী। তিনি সব সময় সব দিকে খেয়াল রাখতেন আর কোনো অন্যায়, ভুল বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার জন্য তিনি সব সময় নিজেকে দোষারোপ করতেন। একবার তিনি বললেনঃ

আমার ভয় হয় যদি ফুরাত নদীর তীরে কোনো ছাগলের বাচ্চাও মরে যায়, বিষয়ে আল্লাহ আমাকে জিজ্ঞেস করবেন।‘  (মানাকিবু উমর ১৬০১৬১)
তিনি মাঝে মাঝে আগুন ধরিয়ে তাতে হাত রেখে নিজেকে সম্বোধন করে প্রশ্ন করতেন, ‘হে খাত্তাবের ছেলে! তোমার কি এর ওপর ধৈর্য ধারণের ক্ষমতা আছে?’ (প্রাগুক্ত ১৬২)

দুনিয়া বিমুখ এবং আখিরাত প্রত্যাশী

একদিন হযরত উমর (রাঃ) একটি ডাস্টবিনের সামনে দিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তিনি সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেন। তার সাথীদের বিষয়টি পছন্দ হলো না। উমর রা. বললেন, এটা তোমাদের সেই দুনিয়া, যার জন্য সর্বস্ব ত্যাগ কর। যাকে পেতে সব বিলীন করে দিচ্ছো। (ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল প্রণীতআজজুহদ ১১৮)

এই ঘটানার দ্বারা আমরা বুঝতে পারি কেমন দুনিয়া বিমুখ ছিলো আমাদের শাসক। যার কাছে এত সম্পদ, নারী, দেশ থাকার পরেও তিনি শুধু চিন্তা করেছেন আখিরাত নিয়ে।

একজন আইনের শাসক

মুসলমানদের উত্তম কীর্তির স্বীকৃতি দিতেন হজরত উমর ফারুক (রাঃ) মানুষ চেনার খুব সূক্ষ্ম এক মানদন্ড ছিল তাঁর কাছে। তিনি বলতেন,
তোমাদেরকে কারো প্রসিদ্ধি যেন ধোঁকায় না ফেলে। উত্তম ওই ব্যক্তি যে আমানত রক্ষা করে এবং মানুষের দোষচর্চা থেক দূরে থাকে।‘ (ফিকহুল ইতিলাফ ১৬৪)

আইন ভঙ্গকারীদের জন্য উমর ছিলেন কঠোর ব্যক্তি। এইক্ষেত্রে তিনি কখনো সম্পর্ক, সম্পদ কিংবা ব্যক্তির ক্ষমতা তোয়াক্কা করতেন না। মদ পানের দোষে তিনি নিজ সন্তানকে শাস্তি দিয়েছিলেন এই ঘটনা আমাদের সবারই কম বেশি জানা আছে। শুধু নিজ সন্তান নয়, তিনি শাস্তি হিসেবে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন অনেক গভর্নরের। একজন গভর্নরকে শাস্তি দেয়া যা কিনা এই যুগে এক বিরল ঘটনা হিসেবেই ধরা হয়।

হযরত উমর (রাঃ)ইসলামের ওইসব ব্যক্তিত্বের একজন যারা ইনসাফ ন্যায়নীতির সঠিক নমুনা পেশ করে গেছেন।কিন্তু তা সত্ত্বেও তিনি উক্ত কথাটি বললেন।এটি আল্লাহভীতির নিদর্শন।তাঁর ওপর সর্বদা তাকওয়ার চাদর বেষ্টন করে রাখত।তাই তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার বড় পুণ্যের কথা ভুলে গিয়ে যেকোনোভাবে ত্রুটি থেকে বেঁচে থাকতে চান।

শিক্ষানুরাগী হযরত উমর (রাঃ)

ইসলামের খেদমতে হযরত উমর (রাঃ)অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছিলেন। মক্কি পাঠশালা, মদিনা পাঠশালা, বসরার পাঠশালা, কুফার পাঠশালা, সিরিয়ার পাঠশালা সহ যেখানেই তিনি জয় লাভ করেছেন সেখানেই প্রতিষ্ঠা করেছেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতে অনুধাবন করা সহজ যে উমর শিক্ষার প্রতি কত গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।

একজন দক্ষ প্রশাসক

হযরত উমর (রাঃ) প্রশাসনিক কাজে ছিলেন বেশ দক্ষ। এক কথায় তিনি ইসলামি অর্থ ব্যবস্থা, যাকাত ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এনেছিলেন। অর্থ বিভাগ, বিচার বিভাগের মাধ্যমে তিনি তাঁর সময়কালে সব কিছু একটা সুন্দর আইনের আওতায় এনেছিলেন। ফলে তাঁর সময়ে অপরাধ বোধ যেমন কমে গিয়েছিল তেমনি নী গরীবের ব্যবধানও হ্রাস পেয়েছিলো অনেক।

একের পর এক যুদ্ধে জয় লাভ করে যখন ইসলামি সালাতান বৃদ্ধি করে যাচ্ছিলেন তখন অন্যদিকে তাঁর জীবনের শেষ সময় চলে আসে। মৃত্যু শয্যাতেও উমর (রাঃ)  ছিলেন সৎ, আল্লাহ ভীত, আইনের শাসনের অনড়। তিনি চাইলেই তাঁর পুত্রকে পরবর্তী খলিফা নির্বাচন করে যেতে পারতেন। এমন কথা উঠলে উমর বলেছিল, নিশ্চই তোমরা আল্লাহকে খুশি করার জন্য কথা বলোনি।
পরবর্তী খলিফা নির্ধারণে তিনি যে উপদেষ্টা পরিষদ করে দিয়েছিলেন তাতে সবাই একমত ছিলো। এতে করে বড় ধরনের ফেতনা থেকে বেঁচে যায় মুসলিম উম্মাহ।

দুর্যোগ মোকাবেলায় দক্ষতা

হজরত আনাস রা. বর্ণিত আছে, তিনি বললেন, দুর্ভিক্ষের বছর তেল খেয়ে হজরত ওমর রা.- এর পেট নেমে গিয়েছিল (ডায়রিয়া হয়ে গিয়েছিল) তিনি নিজের উপর ঘি খাওয়া হারাম করে নিয়েছিলেন। তিনি আঙ্গুল দ্বারা নিজের পেটে টোকা মেরে বলতেন, হে পেট! মানুষের অবস্থা পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কাছে এর চেয়ে ভাল কিছু নেই। তিনি বলতেন, হে উমর! যতদিন পর্যন্ত ঘি উকিয়ার মাধ্যমে বিক্রি না হবে ততদিন পর্যন্ত তুমি তেলেই গড়াগড়ি খাবে।

তিনি দুর্ভিক্ষের সময় সবার খোঁজ নিতেন। জায়গায় জায়গায় পান শালা খুলে গরীবদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতেন।

তিনি সব সময় কাজ করাকে উৎসাহ দিতেন। বসে থেকে কারো বোঝা না হয়ে ব্যবসা করতে বলতেন। অলসতাকে তিনি একদমই প্রশ্রয় দিতেন না।  তিনি বলতেন,
হে দুস্থের দল! মাথা তোলো। ব্যবসা করো। পথ উম্মুক্ত। মানুষের ওপর বোঝা হইও না।‘ ( নিজামুল হুকুমাতিল ইসলামিয়াঃ /২০)

ভাষাহীন পশুদের প্রতি ভালবাসা

ভাষাহীন পশুদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখতেন হযরত উমর (রাঃ) পশুদের ওপর কোনো মনিব  অত্যাচার করে কি না, পশুরা অনাহারে থাক কি না এসব খবর নিতেন। তিনি ভাবতেন, এসব ভাষাহীনেরাও আল্লাহর সৃষ্টি। প্রত্যেক প্রাণীর প্রতি দয়ার প্রকাশ পুরস্কার পাওয়ার মত কাজ। পশুদের ওপর বাড়াবাড়ি করা, ক্ষমতার বেশি কাজ দেয়া, যে উদ্দেশ্য তাদের সৃষ্টি হয়নি সেই সকল কাজ দেয়াকে তিনি ইসলামি শরিয়ত বিরোধী মনে করতেন। (শহীদুল মিহরাবঃ২২৬)

অবশেষে

এমন ছিলেন আমাদের শাসক হযরত উমর (রাঃ) বেহেশতের সুসংবাদ পেয়েও এক মুহূর্তের জন্য যার মধ্যে অহংকার আসেনি, উল্টো সব সময় ছিলেন ভীত। ন্যায়ের ক্ষেত্রে উমরের ভূমিকা ছিলো পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। আজ আমাদের শুধু একটিই আফসোস। আমাদের যদি একজন উমর রা. থাকতো।

আমাদের ব্লগের আরও ইসলামিক ব্লগ পড়তে এই লিংক এ ক্লিক করুন।

ধন্যবাদ।

Previous articleবিখ্যাত লেখকদের মজার কিছু গল্প!
Next articleনিষিদ্ধ বইঃ যেগুলো না পড়লেই নয় (পর্ব-০২)
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।

5 COMMENTS