বিশাল আকৃতির বিমান আমাদের মাথার উপর দিয়ে উড়ে যেতে দেখলেই আমাদের যে প্রশ্নটি মাথায় আসে তা হল- এত ওজন নিয়ে এত বড় বিমান কিভাবে আকাশে উড়ে? মানুষের আকাশে উড়ার ইতিহাসও খুব বেশি দিনের নয়। একশ বছরের কিছু বেশি সময় ধরে মানুষ আকাশে উড়তে শিখেছে। তবে, এর আগে মানুষ যুগের পর যুগ ধরে চেষ্টা করে গেছে আকাশে উড়ার কৌশল রপ্ত করতে। এখনকার সময়ে মানুষ শুধু আকাশেই উড়ছে না, যাত্রা করেছে মহাকাশেও।
বিমান কিভাবে আকাশে উড়ে
একটি বিমান যখন স্থির অবস্থায় থাকে তখন এর উপর দুইটি বল কাজ করে। একটি হচ্ছে বিমানটির ওজন, যা পৃথিবীর অভিকর্ষজ বলের কারনে নিচের দিকে ক্রিয়াশীল এবং অপরটি হল বাতাসের বাধা যা পেছেনদিকে ক্রিয়াশীল।
বিমানকে উড়তে হলে এই দুইটি বলকে কাটিয়ে তার বিপরীত দিকে আরও বেশি বল কার্যকর করতে হবে। তার মানে হল, বিমানকে উড়ার জন্য প্রয়োজন অভিকর্ষজ বলের বিরুদ্ধে একটি উর্ধ্বমুখী বল বা Lift এবং বাতাসের বাধা কাটিয়ে উঠার জন্য একটি ধাক্কা বা Thrust।
এই দুইটি কাজ সফলভাবে করতে পারলেই বিমান খুব সহজেই আকাশে উড়তে সক্ষম হবে। রানওয়ে দিয়ে উড়ে যাওয়া বিমানগুলো এই দুইটি কাজ খুব সুচারুভাবে করে থাকে।
স্যার আইজ্যাক নিউটন বলে গেছেন “প্রত্যেক ক্রিয়ারই একটা সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে” আর এই সূত্রই বিমানের আকাশে উড়ার মূল শক্তি। আসুন দেখি কিভাবে পদার্থ বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে বিমান আকাশে উড়ছে।
আগেই বলেছি, উড়তে হলে বিমানকে দুইটি বাধা অতিক্রম করতে হবেঃ
- পেছন থেকে ধাক্কা প্রয়োজন যা বিমানকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
- উর্ধ্বমুখী বল প্রয়োজন যা বিমানকে উপরে উঠতে সাহায্য করে।
বিমানের যে অংশ প্রথম কাজটি করে থাকে তা হল প্রোপেলর অথবা জেট ইঞ্জিন। আগেকার দিনের বিমানগুলোতে প্রোপেলর এই কাজটি করলেও এখনকার সব আধুনিক বিমানে রয়েছে জেট ইঞ্জিন। আর দ্বিতীয় কাজটি করার জন্য থাকে বিমানের পাখা, যা কিনা বিমানের দুই পাশে পাখির ডানার মত বিস্তৃত থাকে। আসুন দেখে নেই বিমান কিভাবে প্রোপেলর অথবা জেট ইঞ্জিন এবং পাখার সহায়তায় আকাশে উড়ে বেড়ায়।
প্রথমেই দেখি প্রোপেলর অথবা জেট ইঞ্জিনের ফাংশানঃ
বিমানের প্রোপেলর সামনের বাতাস কেটে বাতাসকে পেছনে ঠেলে বিমানকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে। প্রোপেলর বিমানের সামনে অথবা দুই পাখায় লাগান হয়ে থাকে।
জেট ইঞ্জিনও একই কাজ করে কিন্তু তা আরও আধুনিক আরও গতিশীল। জেট ইঞ্জিন তার সামনের চেম্বার দিয়ে বাতাসকে ভেতরে প্রবেশ করায় এবং বাতাসকে প্রচন্ড চাপ দিয়ে তাকে ইঞ্জিনের পেছন দিক দিয়ে বের করে দেয়, ফলে বিমান নিউটনের সূত্রানুযায়ি সামনের দিকে গতি পায়।
বিমান উড়ার পথে প্রথম বাধাটি এভাবেই অতিক্রম করে। এবার আসুন দেখি কিভাবে দ্বিতীয় বাধাটি অতিক্রম করে তার পাখা ব্যবহার করে।
পদার্থ বিজ্ঞানের আরেকটি সূত্র আমরা সবাই জানি, যেকোন তরলের প্রবাহের বেগ তার পথের প্রস্থচ্ছেদের ক্ষেত্রফলের ব্যস্তানুপাতিক। আর প্রবাহের বেগ বৃদ্ধি পেলে এবং চাপ হ্রাস পায়। বাতাসও তরলের এই সূত্র মেনে চলে।
বিমানের পাখা একটু ভালভাবে খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন, পাখাটির উপরের তলটি বৃত্তাকার আকৃতির কিন্তু নিচের তলটি সমান। মানে হল, উপরের তলের ক্ষেত্রফল নিচের তলের চেয়ে বেশি।
বিমান যখনই সামনের দিকে চলতে শুরু করে, বিমানের ডানা বা পাখা সামনের বাতাসকে কেটে দুইভাগে বিভক্ত করে ফেলে। বাতাসের একটি অংশ পাখার উপর দিয়ে এবং অন্য অংশটি পাখার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়।
পাখার উপরের অংশ দিয়ে যে বাতাস প্রবাহিত হয় তা পাখার বক্রতার কারনে বেশি ক্ষেত্রফল দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় বাধা বেশি পায় তাই চাপ কমে যায়। আর পাখার নিচের অংশ সমান হওয়ায়, পৃষ্ঠতলের ক্ষেত্রফল কম থাকে, তাই সেখান দিয়ে যে বাতাস প্রবাহিত হয়, সেখানে বাধা কম হয় এবং চাপ বেশি থাকে।
এখন খেয়াল করুন, বিমানের পাখার নিচের অংশে চাপ বেশি এবং উপরের অংশে চাপ কম ফলে বিমান তার ওজনের বিপরীতে প্রয়োজনীয় উর্ধ্বমুখী বল পায় এবং আকশে উড়তে পারে।
প্রাথমিক অবস্থায় বিমানের অনেক বেশি উর্ধ্বমুখী বলের দরকার হয় বলেই বিমান প্রোপেলর অথবা জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করে রানওয়েতে দ্রুত বেগে সামনের দিকে ছুটতে থাকে। উর্ধ্বমুখী বল যখনই তার ওজনের চেয়ে বেশি হয় তখনই বিমান আকাশে উড়তে সক্ষম হয়।
বিমান কিভাবে বামে-ডানে বাঁক নেয়
এতো গেল সামনের দিকে এগিয়ে চলা, বিমান কিভাবে বামে কিংবা ডানে বাঁক নেয়? ইঞ্জিন চালিত নৌকা যেভাবে একটি বৈঠার মাধ্যমে নৌকাকে বামে-ডানে বাঁক নেয়ায় ঠিক তেমনি বিমানের পেছনের দিকের লেজ ব্যবহার করে বিমানও বামে কিংবা ডানে বাঁক নিতে পারে।
বিমান কিভাবে ল্যান্ডিং করে
বিমানকে যখন ল্যান্ডিং করানোর প্রয়োজন হয়, বিমানের পাখা দুইটি নিচের দিকে বাঁকা করা হয়। ফলে, পাখার নিচের অংশে বাতাসের চাপ ধীরে ধীরে কমতে শুরু করে এবং উপরের অংশে বাতাসের চাপ বাড়তে শুরু করে এবং ফলাফল হিসেবে বিমানটি তার উচ্চতা হারিয়ে নিচে নামতে শুরু করে।
বিমানে করে কি মহাকাশে যাওয়া সম্ভব
বিমান উড়তে হলে লাগে বাতাস। বাতাস কেটেই প্রোপেলারের মাধ্যমে বিমান সামনে এগিয়ে যায়, আবার জেট ইঞ্জিনেরও কাঁচামাল হচ্ছে বাতাস। আর আমরা সবাই জানি মহাকাশে বাতাস নেই। তাই এক কথায় বলে দেয়া যায় বিমানে করে মহাকাশ ভ্রমণ করা সম্ভন নয়।
বিমানে জ্বালানি হিসেবে কি ব্যবহার করা হয়?
এভিয়েশন ফুয়েল, জেট ফুয়েল, এভিয়েশন গ্যাসলাইন, বাইও ফুয়েল এসব ধরনের বিভিন্ন জ্বালানি বিমানে ব্যবহার করা হয়ে থাকে, নির্ভর করে কি ইঞ্জিন রয়েছে ঐ বিমানে। আসলে নাম যাই হোক না কেন এটি আসলে কেরোসিন তেল। কি, শুনে অবাক হচ্ছেন? অবাক হবার কিছু নেই।
বিমানে কেন কেরোসিন তেল ব্যবহার করা হয়?
বিমানে জ্বালানি হিসেবে কেরোসিন ব্যবহার করার পেছনে বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
- বিমান যখন আকাশে উঠে যায় সেখানকার বাইরের তাপমাত্রা থাকে অনেক কম। কেরোসিনের তরল হতে বরফ (ফ্রিজিং পয়েন্ট) হতে লাগে -৪০ ডিগ্রি থেকে -৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা। কেরোসিনের বদলে যদি গ্যাসোলিন ব্যবহার করা হত তাহলে বিমান উপরে উঠা মাত্র তা বরফ হয়ে যেত। কেরোসিনে এই সমস্যা নেই।
- কেরোসিনের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট (Flash Point) গ্যাসোলিনের চেয়ে অনেক বেশি। ফ্ল্যাশ পয়েন্ট (Flash Point) হল সেই তাপমাত্রা যে তাপমাত্রায় দাহ্য কোনো পদার্থ জ্বলে উঠে এবং বাষ্পে রূপান্তরিত হয়। বিমানের আকাশে উড়া এবং দ্রুত গতি অর্জনের ক্ষেত্রে ফ্ল্যাশ পয়েন্ট অনেক দরকার।
- কেরোসিনে অকটেনের পরিমাণ বেশি, তাই গ্যাসোলিনের চেয়ে দ্রুত গতি অর্জনে করতে পারে।
- কেরোসিন গ্যাসোলিনের চেয়ে অনেক বেশি পাতলা ও মসৃণ হয়ে থাকে।
- কেরোসিন দামেও সস্তা গ্যাসোলিনের চেয়ে।
বিমানের ফুয়েল ট্যাংক কোথায় থাকে?
এই প্রশ্ন অনেকেই করে থাকেন কারণ এর উত্তরটি বেশ মজার। বিমানের ফুয়েল ট্যাংক থাকে এর ডানার বা পাখার ভেতর। একটি বোয়িং-৭৪৭ বিমান দুই লাখ ৩৮ হাজার ৬০৪ লিটার তেল নিয়ে যাত্রা করে থাকে। ভাবতে পারেন?
ফুয়েল ট্যাংক কেন পাখায় থাকে? এর মূল কারণ একে প্যাসেঞ্জার ইউনিট থেকে দূরে রাখা। কোন কারনে ফুয়েল ট্যাংকে আগুন লেগে গেলে প্যাসেঞ্জাররা নিরাপদ থাকে। তাছাড়া বিপদে পরলে পাইলট খুব দ্রুত ফুয়েল ট্যাংক খালি করে ফেলতে পারে। এতে আগুন ছড়িয়ে যাবার সম্ভাবনা কমে যায়।
বিমানের ইঞ্জিন কোথায় থাকে?
বিমানের ইঞ্জিন কোথায় থাকে এটাও খুব কমন প্রশ্ন। বিমানের ইঞ্জিন থাকে পাখার নিচে। একটি মজার ব্যাপার হল বিমানের ইঞ্জিন নিজে নিজে স্টার্ট হতে পারেনা। বিদ্যুৎ দিয়ে স্টার্ট করতে হয়। আমরা এয়ারপোর্টে দেখেছি একটি ছোট জীপ বিমানের পাশে থাকে যার সাথে তার যুক্ত থাকে।
আমরা অনেকেই ভাবি যে হয়ত ফুয়েল ভরা হচ্ছে বিমানে কিন্তু আসলে তা নয়, এটা এয়ারপোর্টের গ্রাউন্ড পাওয়ার সিস্টেম। বিমান যখন এয়ারপোর্টে থাকে তখন তার দুইটি ইঞ্জিনই বন্ধ থাকে। ইঞ্জিন স্টার্ট বার জন্য বিমানে পাওয়ার দেয়া হচ্ছে।
বিমানে ভাড়া এত বেশি কেন
আমাদের অনেকের মনে প্রশ্ন বিমানের ভাড়া এত বেশি কেন? দ্রুত এবং অল্প সময়ে নিয়ে যাচ্ছে বলেই কি বিমানের এত ভাড়া? মোটেই তা নয়। বিমানের ভাড়া বেশি হবার কিছু কারণ এখানে দেয়া হলঃ
- বিমান কিনতে এয়ারলাইন কম্পানিকে অনেক টাকা গুনতে হয়।
- বিমানের রেগুলার মেইন্টেন্যান্স খরচ অনেক বেশি।
- বিমানে প্রতি চার সেকেন্ডে এক লিটার তেল খরচ হয়, বোয়িং-৭৪৭ এ।
- এয়ারপোর্ট এ ল্যান্ডিং এর জন্য এয়ারপোর্ট অথোরিটিকে ট্যাক্স প্রদান করতে হয়।
- পাইলট ও কেবিন ক্রুদের বেতন ভাতাও অনেক বেশি।
- প্রতিটি প্যাসেঞ্জারের লাইফ ইন্সুরেন্স করা থাকে।
বিমানে চলাচল কতটুকু নিরাপদ
আমাদের অনেকেরই বিমানে চলাচল নিয়ে ভীতি কাজ করে করে, ভয় পাই বিমানে উঠতে। আপনাকে নিশ্চিত করে বলতে চাই, কোন ভয় নেই। অন্যান্য যেকোন পরিবহনের চেয়ে বিমান ভ্রমণ অনেকটাই বেশি নিরাপদ। আপনার বোঝার সুবিধার্থে কিছু পরিসংখ্যান তুলে ধরছি।
২০২১ সালে ৭৭ লক্ষ ফ্লাইট পরিচালিত হয়েছে যার মধ্যে মাত্র একটি মেজর বিমান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এখান থেকেই বুঝা যায় বিমান ভ্রমন কতটা নিরাপদ। দুর্ঘটনার রিস্ক ফ্যাক্টর হল ০.২৩। এদিয়ে বুঝায় একজন মানুষ যদি প্রতিদিন বিমানে ভ্রমণ করে ১০,০৭৮ বছর ভ্রমণ করলে একটি বিমান দুর্ঘটনার শিকার হতে পারেন।
তাছাড়া প্রতিটি বিমান ফ্লাই করার আগে বেশ ভাল ভাবে পরীক্ষা নিরিক্ষা করা হয়ে থাকে, যাতে দুর্ঘটনা না হয়। সামান্য ত্রুটি থাকলেও বিমানের ফ্লাইট বাতিল করা হয়।
এজন্যই বলা হয় Flying is safer than driving.
বিমানের ব্লাক বক্স থাকে, যা সকল ইনফরমেশন ধারণ করে। কখনও বিমান দুর্ঘটনার শিকার হলে এটি উদ্ধার করে এখান থেকে তথ্য পাওয়া যায়। ব্লাক বক্স নিয়ে বিস্তারিত জানতে উপরের লিংকে ক্লিক করে পড়ে ফেলুন।
আশা করি আমাদের আজকের ব্লগ পড়ে আপনি বুঝতে পেরেছেন বিমান কিভাবে আকাশে উড়ে ? ধন্যবাদ।