ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা

বাংলাদেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রীদের মতই আমিও এইচএসসি পরীক্ষার পর ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছি। এই ভর্তিযুদ্ধে আমিও সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেছি। আমার ছাত্র জীবনের এক কঠিন দুঃসময় আমি পার করেছি ২০০০ সালের সেই সময়ে, যা মনে হলে আমি এখনও অনেক্ষন সময় নিয়ে ভাবি। ইন্টারে পড়ছে কিংবা ইন্টার পাশ করে ভর্তি যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন কাওকে পেলে আমি আজও তাদেরকে আমার জীবনের ঘটনাগুলো শেয়ার করি। খুব করে চাই আমার করা ভুলগুলো থেকে তারা যেন শিক্ষা নিতে পারে, একই ভুল যেন তারা না করে ফেলে। এতদিনে, সিলেবাসের অনেক পরিবর্তন হয়ত হয়েছে, কিন্তু ঘটনাগুলো কিন্তু সেই একই। আমার মনে হয়েছে, হয়ত প্রপার গাইড লাইন পেলে আমার জীবন কিছুটা হলেও অন্য রকম হতে পারত। যারা আজ আমার এই লেখাটি পড়ছ/পড়ছেন তাদের যেন কিছুটা উপকারে আসে তাই আমার এই অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, আর কিছুই নয়।

আগেই বলে রাখি, আমার লেখাটি কিছুটা নিজস্ব ডায়েরীর মত হবে, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা শেয়ার করা, কিছুটা আত্ম উপলব্ধি আর কিছুটা নিজের জীবনের ঘটনা থেকে শিক্ষা নেয়ার মত ব্যাপার। কেও বিরক্ত হলে এখনই পড়া ছেড়ে পালাতে পারেন, আপনার ইচ্ছা। ভুল বানান এবং নিম্নমানের লেখা মেনে নেবার মানসিকতা নিয়ে পড়া শুরু করতে পারেন।

মূল ঘটনায় যেতে হলে আমাকে আসলে ১৯৯৮ সাল থেকেই শুরু করতে হবে, মানে এসএসসি পরীক্ষা থেকে। তা না হলে একজন ছাত্রের পুরো সাইকোলজি বুঝা যাবেনা। তাই সেখান থেকেই শুরু করছি। শেষ করব ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা শেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পরের আরও কিছু ঘটনা দিয়ে। আশা করি আপনাদের ভালই লাগবে।

এসএসসি পরীক্ষা পর্ব

১৯৯৬ সালে আমি ক্লাস নাইনে উঠি। পড়তাম খিলগাঁও সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রভাতি শাখায়। যতদূর মনে পড়ছে আমি ক্লাসের ক শাখার ছাত্র ছিলাম, রোল নম্বর ছিল তিন। আমাদের সময়ে নতুন সিলেবাস তৈরি হয়, আমরাই প্রথম ব্যাচ ছিলাম। নতুন বই আসতে আসতে মার্চ মাস পার হয়ে গিয়েছিল। তাই প্রথম তিন/চার মাস তেমন ক্লাস হয়নি।

আগে থেকেই গল্পের বইয়ের প্রতি আমার অদম্য নেশা থাকায় আর এইটের ফাইনাল  পরীক্ষার পর মানে ডিসেম্বর’৯৫ থেকে মার্চ’৯৬ পর্যন্ত ক্লাসের বইপত্র না থাকায় এই সময় আমার কাটে গল্পের বই পড়ে। বলে রাখা ভাল সেভেন-এইটে পড়ার সময়ে দুই টাকা দিয়ে লাইব্রেরি থেকে বই ভাড়া করে পড়তাম। এখনকার সময়ে এমন কোন লাইব্রেরী আছে কিনা জানা নেই। রামপুরা বাজারের আনোয়ার ভাইয়ের বই বিচিত্রা লাইব্রেরীতে এই সুবিধা ছিল।

আনোয়ার ভাই, আমাকে অনেক নতুন বই বিনা পয়সায় দিয়েছেন, ৩০/৩৫ টাকা দামের বই। আমি এক-দেড় মাস ধরে রিক্সা ভাড়া থেকে বাঁচিয়ে তার টাকা শোধ দিয়েছি। ৫/৭ টাকা করে করে তাকে দিয়েছি কখনও কিছুই বলেন নাই। বরং নতুন বই আসলে তিনি নিজে থেকেই আমাকে বই দিতেন। এই লেখার মাধ্যমে তার কাছে আমি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। তিনি না থাকলে আসলে আমার পক্ষে অনেক বই-ই পড়া সম্ভব হত না।

আরেকজনের কথা আসলে না বললেই নয়। আমার চাচা আবু আলম। তার নিজেরও অনেক বই সংগ্রহে ছিল। যতদূর মনে পড়ছে প্রায় সবই সেবা প্রকাশনীর। হঠাত করেই মাসুদ রানা নাগালে পেয়ে গেলাম। টানা পড়তে শুরু করে দিলাম। তার কাছে যা পেলাম আর বাকিটা আনোয়ার ভাইয়ের কাছ থেকে নিয়ে ঐসময় পর্যন্ত যতগুলো সংখ্যা বের হয়েছিল (সম্ভবত ২০০ সংখ্যা পর্যন্ত) সব শেষ করে ফেললাম। তিন গোয়েন্দা সিরিজের কিছু বই পড়েছি। কিন্তু এই বই আমাকে তেমন টানেনি কখনই। সেবার ওয়েস্টার্ন, রহস্য উপন্যাস, রোমাঞ্চপন্যাস, অনুবাদ বই, কুয়াসা সিরিস আর মাসুদ রানা আমার পছন্দের তালিকায় ছিল।

যাই হোক এরই মাঝে আমার ক্লাস নাইনের বই বাজারে চলে আসল। ক্লাস শুরু হল কিন্তু গল্পের বই পড়া আর থামেনি। ১৯৯৮ সালে মনে হয় এপ্রিলে আমার এসএসসি পরীক্ষা হয়ে গেল। মোটামুটি ভালই পরীক্ষা দিয়ে দিলাম। এবার রেজাল্টের অপেক্ষা।

ছয় সাবজেক্টে লেটার মার্কস সহ ৮৭২ নম্বর নিয়ে ঢাকা বিভাগ থেকে আমি এসএসসি পাশ করলাম। রেজাল্ট আশানুরূপ হয়েছে, সবাই খুশি। ভাল ছাত্রে তকমা লেগে গেল। এখান থেকেই আসলে ঘটনা শুরু।

এইচএসসি তে ভর্তি পর্ব

এসএসসি তে সামান্য ভাল রেজাল্ট করার পর আসলে আমি অনেকের নজরে আসলাম। এলাকায় কিংবা আশে পাশে আরও যারা ছিল যারা আমার সাথে একই বছর পরীক্ষা দিয়েছিল তাদের অনেকেই ব্যবপারটি হয়ত সহজভাবে নিতে পারেনাই। ১৯৯৮ সালে রেজাল্ট যেদিন পাব্লিস হয় ঐ বছর সেই সময়ে ব্যাপক বন্যা হয় ঢাকা সহ সারা দেশে। আমাকে সাকো পার হয়ে বাসায় যেতে হত।

শুধুমাত্র আমার রেজাল্ট শোনার জন্য অন্য এক ছাত্রের মা তার বাসায় জানালার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন। রেজাল্ট জানতে চাইলেন, কয়টা লেটার পেয়েছি তাও। বলতে ভয় পাচ্ছিলাম, কারণ তার ছেলে অনেক ভাল ছাত্র ছিল আমার চেয়ে, আরও ভাল স্কুলে পড়ে আর আমিতো এক সাধারণ ছাত্র। সে হয়ত বোর্ড স্ট্যান্ড করে ফেলতে পারে, আমার ধারণা তাই ছিল। আমার রেজাল্ট শোনার পর তার মুখটা হয়ত মলিন হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষনের জন্য- অথবা আমার দেখার ভুলও হতে পারে। উনার ছেলে ৪টা লেটার সহ ৮৪০ বা এর কাছাকাছি কিছু পেয়েছিল। আমার এখন আর মনে নাই। আমার কিছুটা বিশ্বাস হতে শুরু করল- আমি হয়ত ভাল ছাত্রের কাতারে পরি।

এত কিছু বলার আসলে কারণ একটাই। আমি ভাল ছাত্র তকমা পেয়ে গেছি। সবার এমনই এক ধারণা হয়ে গেছে। প্রত্যাসার চাপ বেড়ে গেল আমার উপর। এবার কলেজে ভর্তির পালা।

সত্যি বলতে আমি ঢাকা শহরের তেমন কোন কলেজের নাম জানতাম না। পরীক্ষার পর বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে কিছু নাম শুনেছি মাত্র। এর মাঝে ঢাকা কলেজ, নটরডেম কলেজ, বিজ্ঞান কলেজ এবং শাহীন কলেজ ভাল বলছে সবাই। এসবেই ভর্তি হতে হবে। বন্ধুদের সাথে ঘুরে ঘুরে এই চার কলেজের ভর্তির ফর্ম কিনে ফেললাম। ফিলাপ করে জমাও দিয়ে দিয়েছি।

ভর্তির ফর্ম জমা দেয়ার পর প্রথম নটরডেম কলেজ প্রাথমিক বাছাই পর্ব শেষে রোল নাম্বার প্রকাশ করল যারা কিনা ভর্তি পরিক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারবে। আমার রোল নাম্বার সেখানে ছিল। পরীক্ষার দিনে পরীক্ষা দিতে উপস্থিত হলাম, তেমন কোন প্রস্তুতি ছাড়াই। এমনকি অনেকেই কোচিং করেছে, আমি তাও করিনি।

নটরডেম কলেজ। যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল। ৩০ মিনিট পর পর এক এক সেট প্রশ্ন দিচ্ছিল। মনে হয় চার কি পাঁচ সেট প্রশ্ন। আমার যখন বাংলা পরীক্ষা, আমার পাশের জনের ইংলিশ তার পাশের জন আবার গণিত প্রশ্নপত্রে গণিত পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি এক কথা অভিভূত হয়ে গেলাম। পাশের জনের সাথে কথা বলার তেমন সুযোগ নাই। বলেও বা কি লাভ? সে অন্য সাবজেক্টের পরীক্ষা নিয়ে ব্যস্ত। চলছে পরীক্ষা। অল্প সময়ে অনেক প্রশ্ন। সব প্রশ্নের উত্তর করাই টাফ ছিল, সময় খুব কম।

আমি যেই রুমে পরীক্ষা দিচ্ছি সেখানে দুই পরীক্ষার্থী কি যেন একটু কথা বলেছে। কথা বলার সময়ে তাদের কিছুই বলা হয়নাই। শেষে ক্লাসের পরীক্ষক জানালেন তাদের খাতা মূল্যায়ন করা হবেনা। কারণ তারা হলের নিয়ম ভংগ করে নিজেরা কথা বলেছে। এ কি কথা? তাদের খাতা বাতিল? নটরডেম কলেজ নিয়ে আমার প্রথম অভিজ্ঞতা। এই কলেজে পড়ার খুব আগ্রহ হলেও যা পরীক্ষা দিলাম এতে চান্স পাবার সভাবনা নাই বললেই চলে। পরীক্ষা শেষে বাসায় চলে আসলাম। ঢাকা কলেজ আর বিজ্ঞান কলেজের ভর্তি পরীক্ষা আশা করা ছাড়া আর গতি কি?

দুই তিন দিনের পরেই মনে হয় রেজাল্ট দিয়েছিল। টিকবনা মাথায় রেখেই কলেজে চলে গেলাম। গিয়ে দেখি কলেজের দেয়ালে রেজাল্ট টানিয়ে দিয়েছে। মনে মনে ভাবছি টিকার যেহেতু চান্স নাই তেমন তাই শেষের দিক থেকেই দেখা শুরু করি। টিকলে হয়ত শেষ দিকে রোল থাকতেও পারে। আবার অয়েটিং লিষ্টেও থাকতে পারে। কিছুক্ষন দেখার পরেই বুঝলাম আমার রোল নাই।

হঠাত খেয়াল করে দেখি রোল নাম্বারগুলো ক্রমানুসারে দেয়া। আবার আশা জাগল বুকে। একটু পরেই নিজের রোল নাম্বার খুঁজে পেলাম। কী যে আনন্দ হচ্ছিল বলে বুঝাতে পারবনা। আমার স্কুলের কয়েকজন বন্ধু মিলে কোন এক বিরানীর দোকান থেকে বিরানী খেলাম। পাশের বাসায়, মানে আমার চাচার বাসায় ফোন করে জানালাম আমি চান্স পেয়েছি। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। বলে বোঝাতে পারবনা। এর পর ভাইভা পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি ভর্তি হয়ে গেলাম। আমি এখন নটরডেম কলেজের ছাত্র, ভাবই আলাদা। ভাল ছাত্রের তকমা আরও জোড়দার হল। আমার কনফিডেন্স লেভেল সেই রকম তুঙ্গে।

নটরডেম কলেজে পড়ার অভিজ্ঞতা আরেকদিন অন্য কোন লেখায় বলা যাবে। তবে প্রথম ওরিয়েন্টেশন ক্লাসের ঘটনা আসলে না বললেই নয়।

সকাল আটটা ত্রিশে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। আমার বাসার কাছে রামপুরা বাজার থেকে বিআরটিসি বাস মতিঝিলে যেত ৬ টাকা বাস ভাড়া। ঐ বাসে করেই কলেজে যাব। এরকমই প্লান।

সরকারি স্কুলে পড়াকালীন দেখেছি, এসব নবীন বরন কিংবা বিদায় অনুষ্ঠান খুব বেশি টাইম মত শুরু হয় নাই। আমার মনেও এরকম প্লান, সাড়ে আটটা বলছে বলেই কি সাড়ে আটটাতেই শুরু হবে? কিছুটা দেরি ত হবেই। তারপরেও আমি সময় হিসাব করেই গেলাম। সাড়ে আটটার মধ্যেই যেন পৌঁছানো যায়।

আটটা সাতাইশে আমি কলেজের মেইন গেইটে পৌঁছে গেলাম। হাতের স্টিলের ক্যাসিও ঘড়ির টাইম এখনও আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। একটু সামনে আগাতেই দেখি কলেজের অ্যালার্ম বেল বাজছে। সবাইকে বাস্কেটবল গ্রাউন্ডে যেতে বলছে। এক্ষনি শুরু হবে ওরিয়েন্টেশন ক্লাস। আমি দৌড়ে পৌঁছে গেলাম সেখানে।

নটরডেম কলেজ থেকে পাওয়া এটাই আমার প্রথম শিক্ষা। সবকিছু সময় মত করা চাই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত কখনও কোন কাজে দেরিতে পৌছাইনি। সবসময় চেয়েছি সময়ের আগে পৌঁছাতে।

আমি তখন ভাল ছাত্র সুখ্যাতি পেয়ে গেছি

আমি গ্রুপ টুয়ের ছাত্র ছিলাম, আমার রোল ১০০২০৮৭, এখনও পরিস্কার মনে আছে।

কলেজের ব্র্যান্ড ভ্যালুর কল্যাণে আমি তখন ভাল ছাত্র। সবাই বলে। আমার নিজের খুব বেশি বিশ্বাস হয়না। কলেজের প্রথম ক্লাসটি ছিল ফিজিক্স প্রথম পত্র। ক্লাস নিচ্ছেন শ্রদ্ধেয় স্যার ফাদার পিসাতো। ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা আর ইংরেজি দিয়ে তিনি বেশ ভালই পড়াতেন বলে আমার ধারণা। কিন্তু আমি তেমন কিছুই বুঝতাম না। প্রথম দিকের ক্লাসে ভেক্টর চ্যাপ্টার পড়াতে লাগলেন।

সাপ্তাহিক কুইজ পরীক্ষায় পরীক্ষা দিতে গিয়ে দেখি উনি সম্ভবত দুই চ্যাপ্টার পড়িয়ে ফেলেছেন আমি ভাবছিলাম প্রথম চ্যাপ্টার এর উপর পরীক্ষা। ২০ এর মধ্যে ৫/৭ পাইছিলাম হয়ত। মনে নাই কিছুই এখন আর। কিছু বুঝার আগেই ৩/৪ মাস চলে গেল।

হ্যা, বলে রাখি ইন্টারে আমি বায়োলোজি বাদ দিয়ে কম্পিউটার শিক্ষা নিলাম। বায়োলজি আমার কখনই ভাল লাগত না তাই। বিদ্ঘুটে বৈজ্ঞানিক শ্রেনীবিন্যাস এর নামগুলো আমার একদমই মনে থাকেনা। ভর্তির ৪/৫ মাসের মধ্যেই বাসায় কম্পিউটার কিনে দিল। দিনের একটা বড় সময় কম্পিউটারের পেছনে চলে যাচ্ছে। কম্পিউটারের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। সময় নষ্ট হচ্ছে প্রচুর।

আমি বুঝতে শুরু করলাম। আমার হচ্ছেনা, আমি সবার থেকে পিছিয়ে যাচ্ছি। কি করব? কার কাছে পড়ব। সব পোলাপান ব্যাচে বিভিন্ন স্যারের কাছে পড়ছে। অনেকদূর এগিয়ে গেছে, আমি পিছিয়ে যাচ্ছি। কিভাবে যেন, কিংবা কার রেফারেন্সে যেন আমি বুয়েট ৯৭ ব্যাচ মেকানিকাল এর এক স্টুডেন্ট এর খোঁজ পেলাম। মনে নাই তেমন। তিনি মাসিক ২৫০০ টাকা বেতনে আমাকে বাসায় এসে সপ্তাহে তিন দিন পড়াতে রাজি হলেন। আমিও যেন জানে পানি ফিরে পেলাম। জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি, ম্যাথ, ফিজিক্স খুব ভাল বুঝাতে পারতেন ভাই। কলেজের প্রথম পরিক্ষায় অনেকের চেয়ে ভাল করে ফেললাম।

দুই মাস মত আমি তার কাছে পড়ে বেশ ভাল বুঝতে শুরু করলাম। হঠাত দেখি সবাই ব্যাচে সব বিখ্যাত স্যারের কাছে পড়ে। আমিও ভাবলাম আমারও তাই করা উচিত। সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে। পিছিয়ে পড়া চলবেনা। বুয়েটের ভাই বাদ দিয়ে বিখ্যাত স্যারদের কাছে ম্যাথ, ক্যামিস্ট্রি পড়তে গেলাম। খুব একটা লাভ হচ্ছেনা। ব্যাচে স্যারেরা যা পড়াচ্ছে তা ত আমি ক্লাসেই শিখতে পারছি। কেও কিছু বুঝায় না, খালি গতবাধা সমাধান করায়। আমি বাদে বাকিরা কিভাবে কিভাবে জানি সব বুঝে যায়। আমিই শুধু কিছু বুঝতে পারিনা। মনে হচ্ছিল সবাই সব আগে থেকেই পারে। স্যারের কাছে এমনি এমনি আসছে। কেও কেও স্যারের কাছে প্রশ্ন করে। কি যে সেই প্রশ্ন আমি শালা তাও বুঝিনা। কী যে বিপদ?

কোথায় যেন একটা গরমিল হয়ে যাচ্ছে। ব্যাচে পড়া ছেড়ে দিলাম। বাসায় একা একাই পড়া শুরু করলাম। তিতুমির কলেজের সিরাজ স্যারের বাসা রামপুরা বাজারের কাছে। শুধু তার কাছে ফিজিক্স পড়তে থাকলাম। স্যার অসাধারণ পড়ায়। বুঝানোর ক্ষমতা অসাধারণ। ফিজিক্স খুব ভাল বুঝতে লাগলাম।

ফিজিক্স বাদে বাকি সব সাবজেক্টের অবস্থা আমার খুব একটা ভাল না। এদিকে সবাই জানে, আমি নটরডেমের ছাত্র। সবার এক্সপেক্টেশন খুবই হাই। আমি বুঝতে পারছি আমার ভেতরের অবস্থা খুব বেশি ভালনা। ভয়াবহ রকমের খারাপ।

জ্যামিতি, ত্রিকোণমিতি ভালই পারি। কেমিস্ট্রি আমার কাছে এক ভয়ানক সাব্জেক্ট মনে হয়। কিচ্ছু মনে থাকেনা। কীসের জারন-বিজারন, কিসের উরটজ বিক্রিয়া……… ভয়াবহ খারাপ অবস্থা। এক স্যারের কাছে ১ মাস পড়ে দেখলাম, সপ্তাহে তিনদিন পড়ায়। স্যার খালি রিডিং পড়ায়………একবার বই দেখে রিডিং পড়ে, আরেকবার সামনের দিকে তাকিয়ে, মানে সামনের ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে না দেখে রিডিং পড়ে। এইভাবে কিছু হয়? এই রিডিং ত আমি নিজেই পড়তে পারি। বাসায় বইসা। বাদ দিলাম। মনে আছে, মাসের টাকাটাও দেইনাই। যা পড়াইছে সে, তার জন্য সে টাকা প্রাপ্য বলে মনে হয়নাই আমার কাছে। তবে বাসা থেকে টাকা ৫০০ ঠিকই নিয়েছিলাম।

এরই মাঝে টেস্ট পরীক্ষা চলে এল। আমি এক সাবজেক্টে ফেল করলাম। ম্যাথে ফেল। কলেজ থেকে নোটিস দিল যারা এক সাবজেক্টে ফেল করবে তারা ১মাস কলেজে কোচিং ক্লাস করে আবার পরীক্ষা দিয়ে তারপর পাশ করলে এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে পারবে। নইলে ইয়ার লস। ফুটো।

একমাস ক্লাস করার পরে পরীক্ষা দিয়ে পেলাম ৩২। স্যার দয়া করে ১ নম্বর যোগ করে দিয়ে আমাকে পাশ করিয়ে দিলেন। এইচএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহনের যোগ্যতা অর্জন করলাম। মনে হল এযাত্রা বেঁচে গেলাম।

হাতে আছে আর মাত্র ৪ কি ৫ মাস। আমার পরিস্কার মনে নেই। নিজের পড়ালেখার দূরাবস্তা নিজেই বুঝতে পারছি। ফিজিক্স আমি খুব ভাল পারি। ফিজিক্সে আমার কোন সমস্যা নেই। ধীরে ধীরে ফিজিক্স আমার প্রিয় সাবজেক্ট হয়ে উঠেছে এতদিনে। আর সব গোল্লায় যাবার মতই অবস্থা। আমি হতাসাগ্রস্থ হতে শুরু করলাম।

বাসায় ব্যাপারটা শেয়ার করলাম। আমি স্কুলে পড়াকালীন যেই স্যারের কাছে বাসায় প্রাইভেট পড়তাম তিনি একদিন একজন মধ্যবয়স্ক লোককে আমাদের বাসায় নিয়ে আসলেন। তিনি নাকি খুবই ভাল ছাত্র পড়ান। মনে নাই কয়দিন, সপ্তাহে ৪/৫ দিন দিনে ২ ঘণ্টা আমাকে পড়তে শুরু করলেন।

আমি উনার কাছে ম্যাথ করা শুরু করলাম।

ইনি আবার অংকের জাহাজ। ইন্টারের সব অংক তার উত্তরসহ মুখস্ত। আমাদের সিলেবাসের নতুন বই, তাই তার বই দেখা লাগে, আগের সিলেবাসের বই নাকি তার  খুলাই লাগত না। ম্যাথ বুঝানের চেয়ে তার সমাধান করার দিকে আকর্ষণ বেশি।

তিনি নিজে কলম ধরেন না। কিছু বুঝান না। কিন্তু যেহেতু আমাকে দিয়েই তিনি সমাধান করান। তাই না বুঝে ত আমি এক লাইনও লিখতে পারিনা। ফলাফল, আমি বুঝতে শুরু করলাম। আমার গণিত সমস্যার সমাধান হতে শুরু করল। উনার নাম এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা। কিন্তু উনি আমাকে ভালই গণিত শিখিয়ে গেলেন।

এদিকে বাসায় আমি প্রচুর পরিশ্রম করছি। দিন-রাত খেয়ে না খেয়ে পড়াশোনা করে যাচ্ছি। যেই ক্যমেস্ট্রি আমি কিছুই বুঝতাম না। আমি ভালই বুঝতে শুরু করলাম। না বুঝলে স্যারের হেল্প নিতে লাগলাম। আমার সব সিলেবাস ধীরে ধীরে শেষ হতে লাগল।

কী যে অমানুষিক পরিশ্রম আমি করেছি তা শুধু আমি নিজেই জানি। কেমিস্ট্রি প্রথম পত্র পরিক্ষায় আমি আউট অফ ৭৫, ৭১ এন্সার করেছিলাম। পেয়েছি ৬৫। খুব ভাল পেয়েছিলাম। প্রাক্টিক্যালে ২৪ পেয়েছিলাম। মানে ক্যামেস্ট্রি প্রথম পত্রে ৮৯ পেয়েছিলাম। এখনকার ছাত্রছাত্রীরা ৮৯ নম্বরের মাহাত্ম বুঝতে পারবেনা।

এইচএসসিতে ক্যামেস্ট্রি দ্বিতীয় পত্রে খুব একটা ভাল করতে পারিনাই। মুখস্তের অনেক ব্যাপার স্যাপার ছিল। পরীক্ষার খাতায় লিখতে গিয়ে দেখি কিছুই মনে নাই। ৪৪+২৪= ৬৮ নাম্বার পাই মাত্র।

যাইহোক, দেখতে দেখতে বোর্ড ফাইনাল পরীক্ষার টাইম চলে আসল। তেজগাঁও বিজ্ঞান কলেজে আমার পরীক্ষার সীট পরল। আমি স্টার মার্কস, ১ লেটার সহ ৭৮৬ নম্বর পেয়ে ইন্টার পাশ করলাম। আমার নটরডেম কলেজ লাইফ শেষ হল। সামনে ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা।

পর্ব – ০২

ইউনিভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষা

ক্লাস নাইন থেকে এত ইতিহাস এত ডিটেইলভাবে লেখার মূল উদ্দেশ্য ছিল একজন ছাত্রের সাইকোলজি বুঝানোর চেষ্টা করা। সামনের ঘটনা বিশ্লেষণে এগুলো সাহায্য করবে। তা নাহলে শুধু ইন্টারমেডিয়েট পাশ করার পরের ঘটনাগুলো লিখলেই চলত। কেন লেখাটি এত লম্বা করেছি আশা করি বুঝতে পেরেছেন। এবার আসল ঘটনায় আসি।

ইন্টার পরীক্ষা শেষ হবার সাথে সাথেই স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনা একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল। সারাদিন কম্পিউটারে গেম কিংবা মুভি দেখেই পার করতে শুরু করলাম। ভর্তি পরীক্ষার কথা একদমই মাথায় নাই। তখনকার দিনে এখনকার মত মোবাইল ফ্যাসিলিটি না থাকায় বন্ধু-বান্ধব কারও সাথে যোগাযোগই নাই। দিন পনের যাবার পরেই আস্তে আস্তে ভর্তির ব্যাপার আমার নিজেরই চলে মাথায় এল।

খোঁজ খবর নিয়ে জানলাম কেও ইঞ্জিনিয়ারিং, কেও মেডিকেল আবার কেওবা ইউনিভার্সিটি ভর্তির জন্য কোচিং এ ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। আমি যেহেতু পন্ডিতি করে বায়োলজি নেই নাই তাই মেডিকেল আমার লিষ্ট থেকে এম্নিতেই বাদ। বাকি রইল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইউনিভার্সিটি।

যারা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ইচ্ছুক তারা সানরাইজ অথবা ওমেগা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হচ্ছে আর যারা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হতে ইচ্ছুক তারা ইউসিসি কোচিং এ ভর্তি হচ্ছে।

আমার এক নাম্বার টার্গেট ছিল বুয়েট, আর বুয়েটে যদি না হয় ঢাকা ইউনিভার্সিটি ত আছেই- আমার ঢাকা ইউনিভার্সিটি ভর্তি কেও ঠেকাতে পারবেনা, কারণ আমি একজন নটরডেমিয়ান। নটরডেমের পোলাপানের আবার কোচিং লাগে এখানে ভর্তি হতে। আমার মানসিকতা এমনই ছিল।

আমার এরকম মন-মানসিকতাকে ঐ সময় আমি কনফিডেন্স কিংবা অভার কনফিডেন্স বলে মনে করতাম। কিন্তু এখন আমি বুঝি- এটা আসলে ছিল অহংকার। আর অহংকার যে পতনের মূল তা কে না জানে?

এর মাঝে এলাকায় বুয়েটের (মেকানিক্যাল) এক বড় ভাইয়ের দেখা পেয়ে গেলাম, যার ভাষ্যমতে বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষা বাংলাদেশের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষাগুলোর মধ্যে একটা। আর ভর্তি পরীক্ষা রেজাল্টের কতদিন পরে হবে তা কেও বলতে পারেনা। প্রথম কথাটি মাথায় না ঢুকলেও পরের কথাটি আমার মাথায় ঢুকে গেল। যেই পরীক্ষা কবে হবে তার ঠিক নাই তার প্রিপারেশন এখনই নিয়ে কী লাভ?

সে যাই হোক, কলেজের বন্ধুরা ততদিনে সবাই কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেছে। আমি আর তাদের সাথে ভর্তি হলাম না, গড়িমসি কারে আরও কয়েকদিন কাটিয়ে দিলাম। বেশ ভালই যাচ্ছিল দিনকাল। একদিন আমিও আমার এক স্কুল বন্ধুকে সাথে নিয়ে ওমেগা কোচিং সেন্টারে গেলাম, ওমেগাতে ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং এ ভর্তি হয়ে গেলাম। প্রথম কয়েকটা ক্লাস করেও ফেললাম বন্ধুকে সাথে নিয়ে।

হঠাৎ করে আমার বন্ধু কোচিং এ যাওয়া বন্ধ করে দিল, এর পর আমিও ধীরে ধীরে কোচিং এ যাওয়া ছেড়ে দিলাম। একসময় এমন হল কোচিং এর সময়ে বাসা থেকে বের হতাম আর কোচিং না করেই কিছু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে চলে আসতাম।

এর মাঝে শুনলাম, কোচিং এ নাকি গাইড বই দিয়ে দিচ্ছে। বন্ধুকে নিয়ে গেলাম কোচিং সেন্টারে গাইড বই আনতে। কোচিং এর ভাইয়ারা আমাদের গাইড বই দিতে চাইলেন না, যেহেতু আমরা ক্লাস করছিনা। তাও বলে কয়ে গাইড বই নিয়ে আসলাম। আর ক্লাস মিস হবেনা কথা দিলাম। এর পরে মনে হয় আর কোচিং এ যাই নাই। পরে শুনেছি আমার সেই বন্ধু নাকি তার গাইড বই নীলক্ষেতে বেঁচে দিয়েছে। ৩০০ বা ৫০০ টাকা দিয়ে। আমি বেচলাম না, কারণ আমাকে বুয়েটে ভর্তি হতে হবে।

আর হ্যা, নীলখেত থেকে ইউসিসি ভর্তি গাইড কিনলাম, ভার্সিটির ভর্তি প্রিপারেশনের জন্য। গাইড বইটি টেবিলের এক কোনায় পরে থাকল বেশ অনেক দিন।

এদিকে ২২শে আগষ্ট সম্ভবত রেজাল্ট পাবলিশ হয়ে গেল। সাথে সাথে এও জানা গেল এই বছর সরকার সকল ইউনিভার্সিটিকে নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে খুব দ্রুত ভর্তি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে। একে একে সব ভার্সিটি তাদের ভর্তির নোটিস দিয়ে দিল।

সবার আগে দিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর বুয়েট এটুকু মনে আছে। স্কুল লাইফে আমাকে যেই স্যার বাসায় পড়াতেন তিনি একদিন বাসায় আসলেন। তার সাথে জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাসে যাওয়ার প্লান হল। তিনি আমাকে ফর্ম কেনার ব্যাপারে হেল্প করবেন।

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন

আমি আর মিজান স্যার বাসে করে সাভার গেলাম। ইউনিভার্সিটির গেটে বাস থেকে নামলাম। নামার পর তিনি একটা রিকশা নিলেন, রিকশাওয়ালাকে কোথায় যেন যেতে বললেন। আমি ভাবছি, ভার্সিটি চলে আসছি আবার কেন রিকশা নিচ্ছি? একটু হাটলেই ত হয়। একটু বেশি বেশি লাগল তার এই আচরন। বিশ্ববিদ্যালয় জিনিসটা যে এত বড় কিছু আমি প্রথম উপলব্ধি করলাম, আমি যে আসলে কুয়ার ব্যাঙ প্রথম সেই দিন আমি উপলব্ধি করেছি। ম্যাথমেটিক্স, কেমেস্ট্রি, ফিজিক্স আর বিবিএ সাবজেক্টের ফর্ম কিনলাম। যদিও এসব কোনটাতেই আমার পড়ার ইচ্ছা না। এখানে কেও পড়ে? আমি ত পড়ব বুয়েট কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। স্যারের ইচ্ছায় এখানে আসা। এমন একটা ভাব আমার মনে মনে।

ধীরে ধীরে অন্যান্য ভার্সিটির ফর্ম ছাড়তে শুরু করল। আমি ফর্ম কিনলাম ঢাকা ভার্সিটি আর বুয়েটের। আমি নিজে বন্ধুদের সাথে গিয়ে। আরেক স্কুল বন্ধু একদিন জানাল সে সিলেট শাহজালাল ইউনিভার্সিটির ফর্ম কিনেছে। তার জোড়াজুড়িতে আমিও কিনে ফেললাম। যদিও আমার মোটেই ইচ্ছা ছিলনা। এই উছিলায় সিলেট যাওয়া হবে মনে করে কিনে নিলাম।

পড়শোনার কিন্তু তেমন কোন খবর নাই। বুয়েটের পরীক্ষা কাছাকাছি চলে আসছে, সম্ভবত আর মাস খানেক আছে। জাহাঙ্গীরনগরের পরীক্ষা সবার আগে কিন্তু রেজাল্ট হবে সবার শেষে, মনে হয় ডিসেম্বরের শেষ দিকে। আমি আমার বন্ধুর সাথে যোগাযোগ করলাম, ঠিক হল ও আর আমি একসাথে যাব। কিভাবে যেন আরও কিছু পোলাপান জুটে গেল। প্লান হল আগেরদিন গিয়ে এক বড় ভাইয়ের হলে থাকব তারপরের দিন ম্যাথমেটিক্স, কেমেস্ট্রি, ফিজিক্স পরীক্ষা দিয়ে চলে আসব।

রাতে আল বেরুনি হলে থাকলাম সবাই মিলে। বেশ মজা হচ্ছিল। যেই ভাইয়ের রুমে ছিলাম ঐ ভাই রাতে খোঁজ নিতে আসলেন। বলেছিলেন, ভালমত পরীক্ষা দাও, টিকলে তারপর দেখা যাবে। আমি মনে মনে হাসি, কি বলে? টিকবনা মানে? জাহাঙ্গীরনগরে না টিকার ত কোন কারনই নাই। মুখে কিছুই বললাম না। ভাই আমাদের ডাইনিং এ নিয়ে ফ্রিতে রাতের খাবার খাওয়ালেন।

পরেরদিন সকালে পরীক্ষা দিলাম ফিজিক্স আর ক্যামেস্ট্রি। কেন যেন ম্যাথমেটিক্স পরীক্ষা না দিয়েই বাসায় চলে আসলাম। পরের দিন আমি একাই গিয়ে বিবিএ পরীক্ষা দিয়ে আসলাম। সব পরীক্ষা ভালই দিলাম, একবারে খারাপ না।

এরপর আবার টেস্ট পরীক্ষার পরে যে স্যারের কাছে পড়েছিলাম সেই অংকের জাহাজ স্যারের সাথে যোগাযোগ করলাম। তিনি দিন পনের বা মাস খানেক বাসায় এসে পড়ালেন। আমাকে মাঝে মাঝেই বলতেন, মামুন তোমার কনফিডেন্স বেশি, এত কনফিডেন্স ভালনা।

বুয়েটের ফর্ম ফিলাপ করার সময় আব্বা বললেন, দেখ সিভিলে চান্স পাস কিনা? সিভিল ইঙ্গিনিয়ারিং খুব ভাল সাবজেক্ট।

আমি হাসলাম, বললাম, আব্বা, আজকাল কেও আর সিভিলে পড়েনা। সবাই কম্পিউটার সাইন্স পড়ে নইলে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং।

আব্বা বছিলেন, বুয়েটের বারান্দায় ঘুরলেও লাভ আছে। তার সেই কথার মর্ম সেদিন আমি বুঝতে পারিনাই।

এরমাঝেই একদিন আব্বা অফিস থেকে আসার পথে কার পরামর্শে যেন রাজশাহি বিআইটি (বর্তমানে রুয়েট) এর ভর্তির ফর্ম কিনে নিয়ে আসলেন। আমার ত মেজাজ খারাপ। আমি আগেই বলেছি আমি ঢাকার বাইরে যাবনা পড়তে। কেন এই ফর্ম কিনে আনল?

ফর্ম ফিলাপ করতে চাচ্ছিলাম না। আব্বা বারবার জোর করেছিলেন। তার এক কথা তুই ভর্তি না হইলে না হবি ফর্ম ফিলাম করতে সমস্যা কোথায়?

আমি গো ধরে রইলাম, যেখানে ভর্তি হবনা সেখানকার ফর্ম ফিলাপ কেন করব? অনেক বুঝানোর পরে ফর্ম ফিলাপ করলাম। ফার্স্ট চয়েস দিলাম রাজশাহি বিআইটি। যেহেতু ওখানে আমাদের কিছু আত্মীয় আছে।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার সর্টলিস্ট প্রকাশ করল, আমার সিরিয়াল ২০০০ মত আসছিল মেবী। আমি ভাবলাম বাহ ভালই ত। আমার স্যার বললেন, তাহলে তোমাকে ফাইট দিতে হবে ২০০০ জনের সাথে। যারা পেছনে আছে তাদের চিন্তা বাদ দাও। এই দুই হাজারজনকে কিভাবে টপকাবা সেই চিন্তা কর। আমিও সেভাবেই ভাবছিলাম। সবমিলে হাজার পাঁচেক মত সর্ট লিস্ট করেছিল বুয়েট। ইনশা আল্লাহ চান্স পাব। ব্যাপারনা। বুয়েটের ৪০% ছাত্রই নাকি নটরডেমের ছাত্র- সবাই বলে।

দেখতে দেখতে বুয়েটের পরীক্ষা চলে আসল। সকালে বিসমিল্লাহ বলে রওয়ানা দিলাম। মারাত্মক ঝড়ের কবলে ঢাকা শহর। তারপরেও সময়ের আগেই পৌঁছে গেলাম। সিট খুঁজে বের করে রুমে চলে গেলাম। বুয়েটে সেদিন বিদ্যুৎ নাই। জানালা খোলা, হালকা আলো আসছে।

আমার পাশের সীটের একটা মেয়ে বসেছে। ফুল বোরখা পড়া। নাম এখনও মনে আছে। মোনালিসা। মেয়েটাই আগে কথা শুরু করেছিল। আমি নটরডেমের ছাত্র শুনে হয়ত একটু উৎসাহী হয়ে বেশ ভালই কথা বলল। আমারও গল্প করতে ভালই লাগছিল। মেয়েটা মনে হয় চিটাগাং থেকে এসছিল। পরীক্ষা শুরু হতে বেশ দেরি হচ্ছিল। কারেন্ট নাই বলে।

বলতে ভুলে গেছি, আমি আবার ইঞ্জিনিয়ারিং আর আর্কিটেকচার দুইটার জন্যই ফর্ম কিনেছিলাম। আমার আকার হাত আবার সেই ছিল, হাহাহাহা।

যাইহোক একসময় পরীক্ষা শুরু হল। ইঞ্জিনিয়ারিং পার্ট পরীক্ষা দিলাম, ভাল হইছে বলা যাচ্ছে না। বুঝতেছিনা কি দিছি, কয়টা উত্তর কারেক্ট হচ্ছে। আর্কিটেকচার পার্ট যাচ্ছেতাই। একটা মেয়ে গাছের নিচে পাতা ঝাড়ু দিচ্ছে এরকম একটা ছবি আকতে দিছিল যতদূর মনে পড়ছে। তাই কি আমার পক্ষে আকা সম্ভব? দাগাদাগি করে আসলাম। আর্কিতে কে পড়ে? এমনিই দিছি, শান্তনা দিচ্ছিলাম নিজেকে।

পরীক্ষা শেষে বাসায় আসলাম, আম্মা জিজ্ঞেস করেছিলেন কেমন হইছে। বললাম ভাল হয় নাই। আম্মা বললেন তুই ত সবসমই পরীক্ষা দিয়ে বলিস ভাল হয়নাই। রেজাল্ট ত ভালই হয়। চান্স পেয়ে যাবি ইনশা আল্লাহ।

কয়েকদিন পরে, আব্বা বাসায় এসে হেবী চিল্লাচিল্লি করছেন। আমি নাকি বুয়েটে চান্স পাই নাই। আজকে রেজাল্ট দিছে। আব্বা অফিস থেকে আসার পথে দেখে আসছেন। সব সানরাইজ কোচিং এর পোলাপান চান্স পাইছে, আর আমি নাকি কোন ফালতু কোচিং এ ভর্তি হইছি।

কোচিং এর আর কি দোষ? আমি তো কোচিঙে ক্লাসই করিনাই। আমিও উল্টা রাগ দেখাইয়া বাসা থেকে বের হয়ে গেলাম। বাসায় ফিরলাম রাত দশটার পরে। পরের দিন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ক ইউনিটের পরীক্ষা। বরাবরের মত আমার কোন প্রিপারেশন নাই।

আমার আব্বারও যে ছেলেকে বুয়েটে পড়ানোর স্বপ্ন ছিল, তা আমি আগে বুঝতে পারিনাই। সেদিন আব্বার রাগ করার ধরন দেখে বুঝতে পেরেছিলাম। ততক্ষনে আমি সব আশা শেষ করে দিয়েছি। বুয়েটের রেজাল্ট  দেখতে আমি বুয়েট ক্যাম্পাসে যাই নাই, আজও না। নিজের চোখে নিজের পরাজয় দেখতে চাইনি বলেই হয়ত।

বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষার রেজাল্ট আমার আর দেখা হোলনা। মানে আমি আর বুয়েটে গেলাম না। সকাল বেলা গেলাম ঢাকা ইউনিভার্সিটির পরীক্ষা দিতে। এটা আমার জীবনের আরেকটি কালো দিন বলা যায়।

ইউসিসির গাইড বই কিনছিলাম, এক দিনও খুলে দেখা হয় নাই। পরীক্ষার হলে উত্তর পত্র দিল প্রথমে। নাম ধাম, রোল লিখার পরে প্রশ্নের জন্য অপেক্ষা করতেছিলাম। একসময় প্রশ্নপত্র দিল। আমি কী যেন হিসেব করলাম, প্রতি সেকশন এত মিনিট করে টাইম নিব, এভাবে শেষ করে ফেলব টাইম মত।

পরীক্ষা দিয়ে যাচ্ছি, বৃত্ত ভরাট করছি। একটা সেকশন (ম্যাথ সবার শেষে দিব ভেবে রাখছি) বাকি আছে এখনও সেই সময় ক্লাসের স্যার বললেন আরমাত্র দশ  মিনিট আছে। আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! কি বলে স্যার? আমার ২৫টা ম্যাথ পুরা বাকি? কী করি এখন? আমি কি ঘড়ি ভুল দেখলাম?

প্রথম কয়েকটা ম্যাথ পড়ে, রাফ করে দিলাম। লাস্ট ২/৩ মিনিট সব “খ” বৃত্ত ভরাট করে দিলাম। জানি নেগেটিভ মারকিং আছে, জেনেও দিলাম। আমার আর কী করার আছে? হল থেকে বের হয়ে মনে হচ্ছিল না আর বাসায় যাই। এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করে শেষে বাসায় ফিরলাম।

বাসায় গিয়ে বলে দিলাম আম্মার কাছে। বুয়েট, ঢাকা ভার্সিটি আমার দুইটাই শেষ। হায়রে কপাল আমার। আমি এখন কোথায় যাই। মানসিক অবস্থা এমন হল যে, জাহাঙ্গীরনগরেও চান্স পেতে পারি সেটা আর নিজের কাছে বিশ্বাস হচ্ছিলনা।

ঢাকা ভার্সিটিতে ৫৩০০ মত সিরিয়াল এল রেজাল্টে। ভর্তির আর কোন সুযোগ নাই।

সিলেট শাহজালালে যে বন্ধুর পাল্লায় পরে ফর্ম ফিলাপ করেছিলাম তার সাথে যোগাযোগ করলাম। সে যাবে আমাকে কনফার্ম করল। একসাথে টিকেট কাটলাম ট্রেনের। আগেরদিন সন্ধ্যায় পাশের বাসায় ফোন করে জানাল তার পেট খারাপ, যাবেনা। আমি যেন একাই চলে যাই। সে তার ট্রেনের টিকেট ফেরত দিয়ে আসছে। আমিও আর গেলাম না। টিকেট ফেরতও দিলাম না। কি লাভ আর পরীক্ষা দিয়ে?

এর বদলে আমি যা করলাম, সব বই পলিথিন মুড়িয়ে প্যাকেট করা শুরু করলাম। এই বছর আর কোথাও পরীক্ষা দিবনা। সামনের বছর জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে আবার পড়াশুনা শুরু করব। আমাকে বুয়েটে চান্স পাইতেই হবে। প্রতিজ্ঞা করে ফেললাম। আগামী এক দেড় মাস আমি রেস্ট নিব। যা ভাবা সেই কাজ।

বাসার সবারই মন খুব খারাপ। বিশেষ করে আব্বা আর আম্মার। বাসায় কেও হাসে না, খুব কম কথা বলে। মনে হচ্ছে কেও বুঝি মারা গেছে আমাদের ফ্যামিলিতে। চুপচাপ সবাই।

এরই মাঝে একদিন আব্বা অফিস থেকে আসার সময় খবর নিয়ে আসলেন, ঢাকা কলেজের ফর্ম ছাড়ছে। আমাকে বললেন ঢাকা কলেজের ফর্ম কিনে আনতে। এতদিনে আমার অহংকারের পতন শুরু হয়ে গেছে।  আমার গলায় আর সেই জোড় নাই। তাও মিন মিন করে বললাম- এই বছর আর পড়াশোনা করবনা। সামনেরবার আবার পরীক্ষা দিব।

আব্বার সাথে আর পারলাম না। তিনি বললেন, তুই ভর্তি হয়ে থাক ঢাকা কলেজে। সমস্যা কি? আমি রাজি হলাম। পরের দিন গেলাম ফর্ম তুলতে।

মাস খানেক পরে, রাজশাহি বিআইটির ভর্তি পরীক্ষার সময় চলে আসল। আব্বা আর আমি পরীক্ষার একদিন আগে বাসে চলে গেলাম রাজশাহি। বিআইটির গেটের সামনে দিয়ে যাবার সময় আব্বা দেখালেন, এই যে দেখ বিআইটি। আমি দেখলাম, ঠিক বুয়েটের গেইটে যেমন পিতল দিয়ে বুয়েটের নাম লেখা ঠিক সেভাবেই পিতল দিয়ে লেখা “বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব টেকনোলোজি”। মনে হচ্ছিল এখানে পড়তে পারলেও ভাল, এটাও ত ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়।

আমার চোখে প্রায় পানি চলে আসার মত অবস্থা। মন বলছিল কেন গত একমাস বই খুলি নাই। সত্যিকার অর্থেই আমার সাথে বইয়ের কোন যোগাযোগ নাই। আমার সব বই প্যাকেট করা। বুয়েট ভর্তি পরীক্ষায় তাও যাওবা প্রিপারেশন ছিল এখন তাও নাই। সুতরাং আমি যে এখানেও চান্স পাবনা তা এক কথায় নিশ্চিত। এসেছি যখন পরীক্ষা দেই। লাভ ত নাইই আমি জানি।

উঠেছি আমার এক চাচার বাসায়। অসামান্য আতিথিয়তা করেছিলেন। না বললেই নয়। বলেছিলেন যদি চান্স পাও। আমি তো আছি। যে কোন সমস্যায় আমার কাছে চলে আসবা। উনি আজ আর পৃথিবীতে বেঁচে নেই। চাচী ও নাই। আমাকে খুব আদর করেছিলেন, মনে আছে খুউব।

আব্বা সহ পরীক্ষা দিতে গেলাম সকালে। প্রশ্ন পত্র পেয়ে প্রথমে ফিজিক্স এন্সার করতে গেলাম, ২০০ এর মাঝে ১৫০ এন্সার করেছি। এবং আমি সিউর ১৫০ই পাব। কিছু কিছু সূত্র মনে পড়ছেনা, তাই এন্সার করতে পারলাম না। ম্যাথ কিছু এন্সার করলাম। ভাগ্য ভালই বলতে হবে কেমিস্ট্রিতে এসছিল কিছু অব্জেক্টিভ মনে হয়। ভালই টিক দিলাম। ইংলিসে ১০০ এন্সার করলাম। সব মিলে ৭০০ মার্কস। আমি হয়ত ৩৩০-৩৫০ মত পেতে পারি। এর বেশিও পেতে পারি, তবে ৩৫০ পাব কনফার্ম। পরীক্ষা শেষ করে সিড়ি দিয়ে নামছিলাম। এক ছেলে বলতেছে- এত সহজ প্রশ্ন সবাই ৪০০/৫০০ মার্কস পাবে। আমি চুপ করে থাকলাম।

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়ে গেটে এসে আব্বার সাথে দেখা, আব্বা জিজ্ঞেস করল- কেমন হইছে? বললাম- হইছে মোটামুটি। বিআইটি তে পড়ে কোন ছেলের সাথে আব্বার পরিচয় হইছে, সে নাকি বলছে মিনিমাম ৪০০ পাইলে, চান্স পাওয়া যেতে পারে। নইলে কোন সুযোগ নাই। শুনে আমার মনের ভেতর হতাসা ভর করল, ৪০০ পাওয়ার কোন সুযোগ আমার নাই। হয়ত ৩৫০ পাব বড়জোড়, তার বেশি না। মুখে কিছুই বললাম না।

বিকাল বেলা আব্বা আমাকে নিয়ে পদ্মার পাড়ের শাহ মখদুম মাজারে নিয়ে গেলেন। আড় চোখে দেখলাম আমার আব্বা শাহ মখদুমের কবর জিয়ারত করে কোন এক বাক্সে ৫০ টাকা দান করলেন। আব্বা কি দোয়া করেছিলেন শুনতে না পেলেও আমি পরিস্কার বুজতে পারলাম। একমাত্র ছেলেকে এই পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দাও, আল্লাহ, জীবনে আর কিছুই চাইনা।

আমার আব্বার চেহারা দেখে আমার নিজের এত খারাপ লাগছিল যা বলার ভাষা আমার নাই।

আমরা আবার ঢাকায় ফিরলাম। ঢাকা ভার্সিটির পরীক্ষায় ফেল্টু মারার পরের একটি ঘটনা আসলে না বললেই নয়। আগেই বলেছি আমার বাসার অবস্থা খুব চুপচাপ, যেন কেও মারা গেছে পরিবারে। ব্যাপারটি খেয়াল করেছিল আমাদের বাসায় ভাড়া থাকা একজন রাজ মিস্ত্রী। তার নাম এখানে আর বলছিনা।

তিনি নাকি আগে ঢাকা ভার্সিটির এক স্যারের মেয়েকে স্কুলে  আনা-নেয়া করতেন। রিকশা চালাতেন তখন। তার সাথে কথা হল। তিনি আমাকে নিয়ে সেই স্যারের কাছে নিয়ে যেতে চান। যদি কিছু সাহায্য হয় তাই। আমি মোটেও যেতে রাজী না। আম্মার চাপাচাপিতে রাজী হলাম।

স্যারের বাসায় গেলাম, স্যার আমার সাথে কিছুক্ষন গল্প করলেন, নটরডেমের ছাত্রের এই অবস্থা হবে কেন? ইত্যাদি বললেন, কিছু খাওয়ালেন।  কোন কোটায় এপ্লাই করেছি কিনা জানতে চাইলেন। ঘণ্টা খানেক সময় দিলেন আমাকে। তারপর আমরা বিদায় নিলাম। আমাকে নিয়ে আমাদের বাসার সেই ভাড়াটিয়া ভাইয়ের টেনশন ছিল মারাত্মক। তার সেই ভালবাসার জন্য আজও আমি কৃতজ্ঞ।

এরপর, আমার বাসায় এলেন মিজান স্যার। সব শুনলেন। বলা বাহুল্য তিনি নিজেও জাহাঙ্গীরনগরের ছাত্র ছিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ফিজিক্স পরীক্ষা কেমন হইছিল। ভাল বলতে আর সাহস পাচ্ছিলাম না। বললাম- হইছিল মোটামূটি। বললেন- চলো কাল আমার সাথে। ফিজিক্সের এক প্রফেসরের সাথে আমার খুব খাতির। দেখা করে আসি। আমার না বলার মুখ ততদিনে আর নাই। গেলাম উনার সাথে আবার জাহাঙ্গীরনগর।

স্যার থাকেন ক্যাম্পাসের ভিতরেই। উনার বাসায় গেলাম। স্যারের সাথে অনেক কথা হল। সত্যি বলতে কি উনাকে আমার খুব করে পছন্দ হয়ে গেল। জ্ঞানীলোকের সানিধ্য আসলে কেমন, উনার সাথে দেখা না করলে আমি বুঝতে পারতাম না।

উনাকে ভাল লেগে যাওয়ায় আমি উনাকে আমার সব কিছু খুলে বললাম। বুয়েটে চান্স পাইনি এতে উনি তেমন কিছুই বললেন  না। ঢাকা ভার্সিটিতে পরীক্ষার ঘটনা শুনে উনি বললেন, মামুন তুমি সত্যি করে বল পরীক্ষার আগের রাতে তুনি কি করেছ? বাসায় ছিলা?

তার প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম। মনে পরে গেল আগের রাতে আমি বাসায় ফিরেছি রাত দশটার পরে। বই খুলা ত দূরের কথা। আমার আর বলার কিছু রইলনা।

বার হবার সময় আমি জুতা পরতে গিয়ে মাথায় গুতা খেলাম, সোফার হাতলের সাথে। দূর থেকে তিনি বলে উঠলেন- মামুন, যদি কিছু তাড়াতাড়ি করতে চাও তাহলে সেটা আস্তে আস্তে কর। আমি অবাক হয়ে তার দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকলাম। আফসোস উনার নামটি আমার মনে নেই। তার সাথে একবার দেখা করতে পারলে ভাল লাগত।

ঢাকায় ফিরে ঢাকা কলেজের ফর্ম জমা দিতে গেলাম ঢাকা কলেজে। লাইন ধরে দাঁড়িয়ে আছি। পেছনের ছেলেটা জিজ্ঞেস করল আমি কোন কলেজের ছাত্র। বললাম- নটরডেম কলেজ। যে কলেজের নাম গত দুই বছর গর্বের সাথে উচ্চারন করেছি সেই নামটি উচ্চারন করতে আমার কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছিল, সাথে লজ্জাও।

ছেলেটি যা বলল তার সারমর্ম হল, “তোমরা এইখানে ভর্তি পরীক্ষা দিলে আমরা কোথায় যাব?” তাকে কে বুঝাবে- আমার নিজেরই কোথাও যাবার জায়গা নাই।

পর্ব-০৩

বিআইটি রাজশাহি

যারা আগের দুই পর্ব পড়েছেন তারা হয়ত আমার সম্পর্কে নেগেটিভ ধারনা পোষন করতে শুরু করেছেন। ভেবেছেন আমি নিজেকে বুয়েটে চান্স পাবার যোগ্য মনে করি কিন্তু চান্স পাইনি তাই হয়ত এতকিছু বলছি। আসলে ব্যাপারটি তেমন কিছু নয়। পুরো গল্প লেখার পরে আমি সব বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণ করতে চাই। দেখা যাক কতটুকু করতে পারি। আর এই বিশ্লষন নতুনদের জীবনে কাজে লাগবে আশা করি। আসুন তারপরের ঘটনা শুরু করা যাক।

ডিসেম্বর মাসে আমার মন খারাপের চুড়ান্ত। কোন কাজ নাই, বাসাতেই থাকি, কম্পিউটারে গান শুনি, গেম খেলি আর সিনেমা দেখি। খবর পাই অমুকে তমুক জায়গায় চান্স পেয়েছে, আমার নিজের ভর্তির তেমন কোন খবর নাই।

এরই মাঝে একদিন আমি জানতে পারলাম আইইউটি কথা। সম্ভবত ২ লাখ ৩০ হাজার টাকা লাগবে, ভর্তি হতে। আমার যা মার্কস আছে কোন না কোন সাবজেক্ট পেয়ে যাব। ওখানে কোন ভর্তি পরীক্ষা হয়না। অনেক সুবিধা নাকি, পরে আর টাকা লাগেনা ওখানে। থাকা-খাওয়া ফ্রি, মাসে নাকি পকেট মানিও ইউনিভার্সিটি থেকে দেয়। এত টাকা একবারে লাগবে শুনে বাসায় আর জানালাম না।

ডিসেম্বরের ২০ তারিখের পরে একদিন সকালে বাসায় বসে আছি, হঠাত পাশের বাসা (সম্পর্কে আমার দাদা) থেকে ডাক দিল, ফোন আসছে। দৌড়ায়া গেলাম, শুনলাম আব্বা ফোন দিয়েছে। ফোন ধরেই যা শুনলাম তাতে আমার এতদিনের কষ্ট সব একবারে রিলিজ হয়ে গেল। আমি নাকি রাজশাহি বিআইটিতে মেকানিক্যালে চান্স পেয়েছি। যাক আমার একটা গতি হল। কীযে অমানুষিক এক অশান্তিতে ছিলাম তা আর বলার নয়। সব অশান্তি একবারে দূর হয়ে গেল, নিমিষেই। মজার ব্যাপার হল ঐদিনই আমার ঢাকা কলেজের ভর্তি পরীক্ষার ডেট ছিল। ফোনেই আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলাম, পরীক্ষা দিতে যাব কিনা? আব্বা বলছিল আর দরকার নাই পরীক্ষা দেবার। আমিও আর সেখানে গেলাম না পরীক্ষা দিতে।

আমার বাসার পরিবেশ আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে উঠল। সবার মুখে হাসি, কারও আর কোন কষ্ট নেই। এক নরক যন্ত্রনা থেকে মুক্তি পেলাম যেন। কয়দিন পরই জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটির রেজাল্ট পাব্লিশ হল। ফিজিক্সে ওয়েটিং লিস্টে আর বিবিএ তে মেধাতালিকায় ৭ম হয়েছি। আমি আবার কনফিডেন্স ফিরে পেতে শুরু করলাম। এ নটরডেমিয়াম ক্যান নেভার ফেইল ইন হিজ লাইফ। মাথায় শুধু এই একটাই কথা ঘুর পাক খাচ্ছে। একজন নটরডেমিয়ান তার জীবনে ব্যর্থ হতে পারেনা।

যথাসময়ে আব্বা সহ রাজশাহী গেলাম বিআইটিতে ভর্তি হয়ে গেলাম। সম্ভবত ততদিনে ফেব্রুয়ারি মাস চলে। ক্লাস শুরু হতে দেরি আছে। কিন্তু কবে ক্লাস শুরু হবে কেও বলতে পারেনা। আমার আবার অপেক্ষার পালা শুরু। এই ক’মাসে কিছু বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পরেছি। যেগুলো আসলে না বললেই নয়!

সেসময় অনেকেই বিআইটি কি, কি পড়ায়, কোথায়, অনেকেই জানতনা। নানা রকম প্রশ্ন করত। এদের মাঝে কেও ছিল আত্মীয়স্বজন, তবে বাইরের মানুষই বেশি।

একদিন রামপুরা বাজারের দিকে দাঁড়িয়ে আছি, স্কুলের এক বন্ধু রিকশা করে যাচ্ছিল। আমাকে দেখে দাঁড়াইল; জিজ্ঞেস করল কই ভর্তি হইছি, বললাম। এক কথায় বলে দিল বিআইটিগুলোর অবস্থা এমনিতেই খারাপ তার মধ্যে রাজশাহি বিআইটি নাকি আরও বেশি খারাপ অবস্থায়। কেও মুখের উপর এমন কথা বলতে পারে, আমার জানা ছিলনা। সে কোথায় ভর্তি হইছিল তা এখন আর মনে করতে পারছিনা।

একদিন স্কুলে গেলাম কয়েক ফ্রেন্ড মিলে। এক স্যারের সাথে দেখা। কে কোথায় ভর্তি হইছি জিজ্ঞেস করল। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে কম্পিউটার সাইন্সে ভর্তি হওয়া এক বন্ধুকে বেশ বাহবা দিল। ঐটাই নাকি খুব ভাল হইছে। রাজশাহি বিআইটি কোন মূল্যই নাই, এমন একটা অবস্থা।

আবার অনেকেই জিজ্ঞেস করে জেনে নিত ওখানে ডিপ্লোমা পড়ায় নাকি বিএসসি। বুঝলাম না, কই ভর্তি হইলাম রে ভাই। কেও চিনেনা।

এদিকে মাসের পর মাস চলে যাচ্ছে ক্লাসও শুরু হচ্ছেনা। কি আরেক যন্ত্রনা শুরু হয়ে গেল। কেও কেও হয়ত মনে করছে, আমি কি আদৌ চান্স পেয়েছি? যাই হোক ক্লাস শুরু না হলেও আমার সময় ভালই কাটছে। মাথায় কোন প্যারা নাই।

এদিকে সেপ্টেম্বর’০১ মাসে ক্লাস শুরুর নোটিস দিল। এবার আম্মা এবং আমার ছোট বোনকে সাথে করে রওয়ানা হলাম রাজশাহীর দিকে। ঢাকা ছেড়ে যাবার সময় আমার খুব কান্না পাচ্ছিল। মজার ব্যাপার হল,  ফ্যামিলির কথা ভেবে খারাপ লাগছিল না একদমই, আমার খারাপ লাগছিল এতদিনের পরিচিত বন্ধু-বান্ধব আর পরিচিত জায়গা ছেড়ে যাবার কারণে। যখন বাস ছেড়ে দিল তখন চোখে পানি চলে আসল। কিন্তু আমি জানতাম না, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় আমার জন্য অপেক্ষা করছে সামনে।

উঠলাম আমার সেই চাচার বাসায়। অরিয়েন্টেশন ক্লাসে অংশ গ্রহন করলাম। পাশের ছেলেটার সাথে পরিচিত হলাম, নাম মাসুদ। সে নাকি ফাস্ট চয়েজ সিভিল দিয়েছিল, তাই তার মেধাতালিকার সিরিয়াল অনেক আগে থাকা সত্ত্বেও ইলেক্ট্রিক্যাল বা কম্পিউটার সাইন্স না পেয়ে সিভিল পেয়েছে। আমি ত মেকানিকাল থেকে মাইগ্রেট হয়ে সিভিলে আসছি। আরও কারও কারও সাথে ওখানে পরিচয় হয়েছিল স্পেছিফিক মনে নাই।

অরিয়েন্টেশন ক্লাস শেষে অডিটোরিয়ামের সামনে দাঁড়িয়ে আছি একাই। দেখি দুইটা লম্বা লম্বা ছেলে কথা বলতেছে। মনে হচ্ছে তারা আগের পরিচিত। আমার সাথেও কথা হল। বাটুল আর রোকন। এরা দুইজনই আমার চার বছরের রুমমেট ছিল।

পরের দিনই মনে হয় ক্লাস শুরু হয়ে গেল।  অন্য সবার সাথে আস্তে আস্তে পরিচয় হতে লাগল। আসিফ, জনি, রাব্বানী, হুজুর জনি, শিশির, মিজু সহ আরও অনেকের সাথে খুব ভাল বন্ধুত্ব হয়ে গেল। দিন তিনেক পর আসিফ আর জনির সাথে ৯৫ ব্যাচের কারেজ ভাইয়ের রুমে উঠে পড়লাম, সেলিম হলে। ৭/৮ দিন সেখানে থাকলাম। এরপর মুন্নাফের মোড়ে রোকন, হুজুর জনি আর আমি মিলে এক মেসে উঠে পড়লাম। দেড়মাস পরে হলে উঠে পরলাম আমি, বাটুল, রোকন আর আসিফ হুজুর একরুমে। আমাদের হল লাইফ শুরু হয়ে গেল।

ক্লাস শুরুর পর আমি আসলে অভিভূত হয়ে যাচ্ছিলাম দিন দিন, এখানে পড়শোনার কুয়ালিটি, সিলেবাস, সিস্টেম সবকিছুই আমার কাছে অনেক আধুনিক মনে হতে লাগল। আধুনিক ক্রেডিট সিস্টেমে পড়াশোনা করানো হয়, ল্যাব ফ্যাসিলিটিস থেকে শুরু করে অন্যান্য সব কিছুই নটরডেম কলেজের মত। নটরডেমে যেমন সপ্তাহে সপ্তাহে ক্লাস টেস্ট হত এখানেও ঠিক সেরকম। নটরডেম কলেজে দুই বছরের সিস্টেমেটিক ধাঁচে থাকার কারণে আমার খুব সুবিধা হচ্ছিল এই নতুন পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে।

কিন্তু যেখানে আমি আটকে গেলাম সেটা হল, এখানে অবারিত স্বাধীনতা। এতটা স্বাধীনতা আমি কখনই পাইনি।এখানে পড়তে বসতে বলার কেও নাই, সারাদিন যা খুশি করা, আড্ডা দেয়ার সুযোগ, কার্ড খেলা ইত্যাদি ইত্যাদি। স্বাধীনতার সুফল না নিয়ে আমি কুফলগুলো বেশ উপভোগ করতে শুরু করলাম এবং নির্ধারিত সময়ের চেয়ে ২ মাস আগেই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ বিএসসি ডিগ্রী অর্জন করলাম।

যদিও রেজাল্ট আমার আশানুরূপ হয়নি, তবে এই চার বছর আমি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় পার করেছি। অনেকগুলো ভাল মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে, যাদের কাছ থেকে আমি অনেক কিছুই শিখেছি। চার বছর হলে একসাথে থাকার কারণে, তাদের সাথে এক আত্মিক বন্ধনে আমি আবদ্ধ হয়েছি। যে বন্ধন কোনদিন ছুটবেনা বলে আমার বিশ্বাস।

২০০৫ সালের জুনের ৩০ তারিখ আমার হল লাইফের একমাত্র স্থাবর সম্পদ খাটের নিচের ট্রাংক আর লাগেজ নিয়ে ঢাকার বাসে রওয়ানা হয়ে গেলাম। পেছনে রয়ে গেল এক সাগর সুখের স্মৃতি যা কোনদিনও ভুলে যাবার নয়।

এখন ১৯৯৯ থেকে ২০০৫ এই সাত বছর সময়কালকে আমি চল্লিশ বছর বয়সি মাথা দিয়ে বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে দেখতে পারি। কোন ব্যাপারগুলো সঠিক করেছি কিংবা কোন বিষয়গুলো ভুল করেছি এসব ভেবে যদিও কোন লাভ নেই, তার পরেও একটু হিসেব কষে দেখা যাক।

(চলবে)

Previous articleবিমান কিভাবে আকাশে উড়ে ? বিমান কি আসলেই কেরোসিনে চলে?
Next articleবিকাশ মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করবেন কিভাবে?
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।