বাংলা প্যালিনড্রোম
বাংলা প্যালিনড্রোম

প্যালিনড্রোম? এটা আবার কী জিনিস? কী খটমটে নামরে বাবা! চলুন তাহলে প্রথমেই প্যালিনড্রোম এর সংজ্ঞা জেনে নেয়া যাক। উইপিডিয়ার সংজ্ঞানুযায়ী, প্যালিনড্রোম (ইংরেজি: Palindrome) হল এমন কিছু বিশেষ শব্দ আর সংখ্যা যার আরম্ভ বা শেষ দুদিক থেকেই পড়লে শব্দের উচ্চারণ আর অর্থের কোনো বদল হয় না (শব্দ বা বাক্যের ক্ষেত্রে); বা সংখ্যার মান একই থাকে (সংখ্যার ক্ষেত্রে)। আজ আলোচনা করব বাংলা প্যালিনড্রোম নিয়ে।

প্যালিনড্রোম কি

মূল গ্রীক শব্দ প্যালিনড্রোমাস (অর্থ: Running back again) থেকে ইংরেজি প্যালিনড্রোম শব্দটি এসেছে। ইংরেজি প্যালিনড্রোম (Palindrome) শব্দের উৎপত্তি দুটো গ্রিক শব্দ ‘প্যালিন’ (Palin) এবং ‘ড্রোমোস’ (Dromos) থেকে।

যার অর্থ যথাক্রমে ‘পিছন’ ও ‘দিক’। যদিও গ্রিকদের কাছে এই রকম শব্দ ‘কারকিনিকে এপিগ্রাফে’ অর্থাৎ ‘কাঁকড়া শব্দ’ নামে পরিচিত ছিল। প্যালিনড্রোম আলোচনার পাশাপাশি আজ আমি বাংলা প্যালিনড্রোম নিয়ে আলোচনা করব।

সংজ্ঞা তো জানা গেলো, এবার কিছু উদাহরণ দেখলে ব্যাপারটা আরো পরিষ্কার হবে। প্যালিনড্রোম সংখ্যা রয়েছে অসংখ্য, যেমন: ১২১, ১৩৩১, ১৪১৪১ এভাবে চাইলে অসংখ্য প্যালিনড্রোম সংখ্যা লেখা যাবে। এই সংখ্যাগুলো উল্টোদিক থেকে লিখলেও একই মান প্রকাশ করে।

তেমনি এবার আমরা দেখতে পারি শব্দের ক্ষেত্রে, যেমন: Madam, Radar, Mom, Dad, নতুন, কনক ইত্যাদি। এই শব্দগুলো ভালো মতো লক্ষ করলে দেখবেন প্রতিটি শব্দ বিপরীত দিক থেকে পড়লেও একই অর্থ প্রকাশ করে। এবার নিশ্চয়ই প্যালিনড্রোম সম্পর্কে সবার কিছুটা হলেও ধারণা হয়েছে।

তো শব্দ যেহেতু আমরা কয়েকটা শিখে ফেললাম এবার কয়েকটা বাক্য দেখা যাক। যেহেতু ইংরেজি সাহিত্যে প্যালিনড্রোম নিয়ে খুব বেশি কাজ হয়েছে তাই আগে কয়েকটা ইংরেজি বাক্যই দেখা যাক।

  • Madam, I’m Adam.
  • Was it a cat I saw?
  • Murder for a jar of red rum.
  • Never odd or even.
  • Do Geese See god?

বাংলা প্যালিনড্রোম বাক্যের উদাহরণ

  • কীর্তন মঞ্চ ‘পরে পঞ্চম নর্তকী।
  • তুমি কোথায় থাকো মিতু?
  • রোকন পানি পান করো।
  • নব ভুলে চলে ভুবন।
  • থাক বসন্তে সব কথা।

উদাহরণগুলো দেখে সবারই নিশ্চয়ই একটা নামের কথা মনে এসেছে। হ্যা, ছোটবেলায় আমাদের পরিচিত ‘রমাকান্ত কামার’ নামটিও প্যালিনড্রোম। এরকম আরো অনেক প্যালিনড্রোমিক নাম রয়েছে, যেমন: সুবল লাল বসু, মাহি ফাহিমা, রাইসা ইরা ইত্যাদি।

অনেকক্ষণ ধরে আমরা শুধু ‘প্যালিনড্রোম’ শব্দটিই বলে যাচ্ছি, প্রশ্ন করতে পারেন এর কি কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই? হ্যা, এর একাধিক বাংলা প্রতিশব্দ রয়েছে। প্রতিসম, উভমুখীসম, বহুমুখীসম এরকম বেশ কয়েকটি বাংলা প্রতিশব্দ থাকলেও শব্দগুলোর ব্যবহার খুব কম হওয়ায় আমরা বহুল পরিচিত প্যালিনড্রোম শব্দটিই ব্যবহার করে থাকি।

বাংলা কিংবা ইংরেজি, যেকোনো ভাষাতেই প্রধানত দুই ধরণের প্যালিনড্রোম রয়েছে। বর্ণ প্যালিনড্রোম ও শব্দ প্যালিনড্রোম। উপরের সবগুলো উদাহরণই বর্ণ প্যালিনড্রোমের। শব্দ প্যালিনড্রোমের একটি উদাহরণ হচ্ছে, “লাল-নীল চিরকুট জুড়ে চিরকুট নীল-লাল!”

সাহিত্যে প্যালিনড্রোম

প্যালিনড্রোম কী তা এতক্ষণে সবাই একদম স্পষ্ট বুঝে গিয়েছেন। তাহলে চলুন এবার প্যালিনড্রোম সাহিত্য নিয়ে কথা বলি।

সর্বপ্রথম প্যালিনড্রোম লিখেন গ্রীক কবি সোতাদেস (খ্রিষ্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী)। তিনি লিখেছিলেন- Sator Arepo Tenet Opera Rotas

S  A  T  O  R

A  R  E  P  O

T  E  N  E  T

O  P  E  R  A

R  O  T  A  S

প্যালিনড্রোম বাক্য
( ছবিতে সোতাদেসের লেখা প্যালিনড্রোম বাক্য)

মজার ব্যাপার হচ্ছে তিনি প্যালিনড্রোমটি এমন ভাবে লিখেছিলেন যে শুধু উল্টোদিক থেকেই নয়, মোট চারদিক থেকে পড়লে একই রকম হয়। আনুভূমিক ও উলম্ব বরাবর উপর-নীচ কিংবা পাশাপাশি দিক (ছবি লক্ষ করুন) থেকে পড়লেও প্যালিনড্রোম হবে।

এই বাক্যটির আক্ষরিক অর্থ, বীজ বপনকারী আরেপো শক্ত করে চাকা ধরে আছে। এছাড়াও তৎকালীন হিব্রু ও ল্যাটিন ভাষায় প্যালিনড্রোম চর্চার একাধিক উদাহরণ রয়েছে। তেমনই একটি ল্যাটিন প্যালিনড্রোম হচ্ছে, ” ΝΙΨΟΝ ΑΝΟΜΗΜΑΤΑ ΜΗ ΜΟΝΑΝ ΟΨΙΝ” যার অর্থ “শুধু মুখ নয়, তোমার পাপগুলোও ধুয়ে ফেলো।”

ইংরেজি সাহিত্যে প্যালিনড্রোম

ইংরেজি সাহিত্যে প্যালিনড্রোম এর চর্চা অত আগে শুরু না হলেও, বিচ্ছিন্নভাবে এর চর্চা হচ্ছে বহু আগে থেকেই। বিচ্ছিন্নভাবে অনেকেই বিভিন্ন প্যালিনড্রোমিক শব্দ, বাক্য ও অনুকবিতা লিখেছেন। তবে ১৬১৪ সালে John Taylor এর লেখা “Lewd did I live, & evil I did dwel” বাক্যটিকে প্রথম ইংরেজি প্যালিনড্রোমের স্বীকৃতি দেয়া হয়।

মজার ব্যাপার হচ্ছে ইংরেজিতে দুটো উপন্যাস আছে যা পুরোটাই প্যালিন্ড্রোমিক! কি আতকে উঠলেন? হ্যাঁ আতকে ওঠার মতই কথা বটে।

প্রথমটি হচ্ছে “Satire: Veritas”, যা ১৯৮০ সালে David Stephens লিখেন। বইটিতে মোট ৫৮,৭৯৫ বর্ণ রয়েছে। আরেকটি হচ্ছে ৩১,৯৫৪ শব্দের “Dr Awkward and Olson in Oslo”, যা Lawrence Levin লিখেছেন ১৯৮৬ সালে।

এছাড়াও বই আকারে না হলেও বিচ্ছিন্নভাবে অনেক প্যালিনড্রোম কবিতা রয়েছে। যা গুগল সার্চ করলে যে কেউই খুঁজে পাবেন। এরকম একটি কবিতা হচ্ছে Demetri Martin এর লেখা Dammit I’m mad. ২২৪ শব্দের প্যালিনড্রোমিক কবিতাটির প্রথম দু’লাইন এরকম-

Dammit I’m mad.

Evil is a deed as I live

বাংলা সাহিত্যে প্যালিনড্রোম

বাংলা সাহিত্যে প্যালিনড্রোম চর্চা একদমই নতুন। ‘রমাকান্ত কামার’, ‘সুবল লাল বসু’ ছাড়া তেমন কোনো প্যালিনড্রোম শব্দ আমাদের কারোই জানা ছিলো না। বাংলায় প্রথম প্যালিনড্রোম রচনা করেন শরৎচন্দ্র পন্ডিত (যিনি দাদাঠাকুর নামে বহুল পরিচিত)।

তাঁর সম্পাদিত ‘বিদূষক’ পত্রিকায় তিনি অসংখ্য প্যালিনড্রোমিক বাক্য লিখেছেন। যেমন: চেনা সে ছেলে বলেছে সে নাচে, তাল বনে নেব লতা, মার কথা থাক রমা, রমা তো মামা তোমার, চার সের চা, বেনে তেল সলতে নেবে, ক্ষীর রস সর রক্ষী, কেবল ভুল বকে, দাস কোথা থাকো সদা?, নিমাই খসে সেখ ইমানি, থাক রবি কবির কথা, বিরহে রাধা নয়ন ধারা হেরবি ইত্যাদি হল দাদাঠাকুর সৃষ্ট অমর কিছু প্যালিনড্রোম।

তবে ইন্টারনেটে দাদাঠাকুরের অমর কীর্তি বলে চার লাইনের যে কবিতাটি দেয়া হয় তার পুরোটা কিন্তু তাঁর লেখা নয়! চলুন প্রথমে বিখ্যাত সেই চারটি লাইন দেখে নেই-

“রাধা নাচে অচেনা ধারা

রাজন্যগণ তরঙ্গরত, নগণ্য জরা

কীলক-সঙ্গ নয়নঙ্গ সকল কী?

কীর্তন মঞ্চ পরে পঞ্চম নর্তকী”

শরৎচন্দ্র পন্ডিত (দাদাঠাকুর)
শরৎচন্দ্র পন্ডিত (দাদাঠাকুর)

চার লাইনের এই কবিতাটির শেষ লাইনটি শুধুমাত্র দাদাঠাকুর লিখেছেন। বাকি তিন লাইন লিখেছেন বাংলাদেশের প্রথম প্যালিনড্রোম লেখক সৌমিত্র চক্রবর্তী। ক্যাডেট কলেজে থাকাকালীন সময়ে একটি দেয়ালিকার জন্য এই কবিতাটি লিখেছিলেন তিনি। এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে সরাসরি তার সাথে সাক্ষাত হয়েছিলো একটি সেমিনারে, তখন পুরো গল্পটিই জানিয়েছিলেন তিনি।

তবে বাংলা সাহিত্যে প্রথম প্যালিনড্রোমিক কবিতার বই প্রকাশ করেন ফরিদ উদ্দিন। ‘কথা থাক’ নামের এই বইটি ২০১৯ সালের অমর একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হয়। এছাড়াও ২০২০ বইমেলায় প্যালিনড্রোম ছড়া, কবিতা ও অন্যান্য লেখায় দুটো বই প্রকাশিত হয়।

নব প্লাবন‘ ও ‘নব যৌবন‘ নামের এই বই দুটিও সম্পাদনা করেন ফরিদ উদ্দিন। বর্তমানে তাঁর অনুপ্রেরণায় অনেকেই প্যালিনড্রোম চর্চা করছেন। ফেসবুকে ‘প্যালিনড্রোম প্রচার পর্ষদ’ নামে একটি গ্রুপ খুলে তরুণ লেখকদের অনুপ্রাণিত করছেন বাংলায় প্যালিনড্রোম চর্চায়।

বিখ্যাত গণিতবিদ চমক হাসানও তাঁর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে বেশ কয়েকটি প্যালিনড্রোম কবিতা এবং বাংলা ভাষায় প্রথম প্যালিনড্রোম গান রচনা করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বাংলা সাহিত্যে প্যালিনড্রোম চর্চা এখন এতটাই এগিয়েছে যে সনেট, মাত্রাবৃত্ত, অক্ষরবৃত্ত, অমিত্রাক্ষর, হাইকু, লতিফা সহ প্রায় সব ধরণের কবিতাই এখন প্যালিনড্রোম ফরম্যাটে লেখা হয়েছে!

একাধিক অনুগল্প ও প্রায় পাঁচ শতাধিক বাক্য লেখা হয়েছে প্যালিনড্রোমে। সর্বসাধারণ এর প্যালিনড্রোম চর্চার সুবিধার্থে ‘প্যালিনড্রোম লেখার কৌশল’ লিখেছেন চমক হাসান। যা পিডিএফ ফরম্যাটে সকলের জন্যই উন্মুক্ত। এছাড়াও ইংরেজিতে লেখা প্যালিনড্রোম কবিতাগুলোর অনুবাদ নিয়েও কাজ চলছে।

পরিশেষে

ছোটবেলায় ‘রমাকান্ত কামার’ শোনার পর এরকম আরো শব্দ বা বাক্য তৈরি করতে চেষ্টা করেননি এমন লোক খুব কমই আছেন। অনেক চেষ্টার পর শেষমেশ জিনিসটাকে অসম্ভব মনে হত। কিন্তু, এখন আমরা জানতে পারলাম প্যালিনড্রোম লেখা কোনো অসম্ভব কাজ নয়। জেনে অবাক হবেন হয়তো, ২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ব্রুকলিনে ‘World Palindrome Championship’ এর আয়োজন করা হয়েছিলো!

ইংরেজি সাহিত্যে ঢাউস সাইজের দুটো উপন্যাসই লেখা হয়েছে প্যালিনড্রোম ফরম্যাটে। বাংলা সাহিত্যেও সেদিন খুব বেশি দূরে নেই যেদিন পুরো একটি উপন্যাস লেখা হবে প্যালিনড্রোম ফরম্যাটে। আর সেই কাজটি সম্পন্ন করবেন আপনি, আমি বা আমাদের মাঝেই কেউ একজন।

লেখাটা শেষ করছি আমার নিজের লেখা একটি প্যালিনড্রোম অনুকাব্য দিয়ে,

এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হয়ে আপনি যদি রেডিটুরিডিং ব্লগকে ডোনেট করতে চান তাহলে বিকাশ-০১৬১৪১৭১৭৬৫ অথবা নগদ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ অথবা ইউক্যাশ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ এ আপনার ডোনেশন পাঠাতে পারেন।

অথবা,

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেও আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন। ইউটিউব চ্যানেল লিংক এখানে। আশা করি অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সহযোগীতা করবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হয়ে আরও লেখা পাবলিশ করব।

চেনা কীর্তন, নর্তকী নাচে

জেবার সুপ্ত সুর বাজে।

 তথ্যসূত্র:

Previous articleBanglalink Internet Offer – সব ইন্টারনেট অফার এক পাতায় ২০২০
Next articleAirtel Facebook Pack- এয়ারটেল নিয়ে এলো ৩জিবি এফবি মেসেঞ্জার প্যাক

1 COMMENT

  1. অনবদ্য প্রকাশ!
    প্যালিন্ড্রোম সম্পর্কে এতো সুপ্ত তথ্য দেওয়া এবং প্যালিন্ড্রোমকে এতো সহজভাবে উপস্থাপনের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। সকল বাংলা প্যালিন্ড্রোমিষ্টদের জয় হোক।