প্রগতিশীল বিজ্ঞানে টেকনোলজি এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিজ্ঞানের নিত্যনতুন খোজে নিরন্তরভাবে ব্যবহার হয়ে চলছে প্রযুক্তি। বিজ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারমাণবিক, আণবিক বা বৃহৎ আণবিক স্তরে পর্দাথকে নিপুণভাবে ব্যবহার করে তার উপযােগিতার পরিবর্তন সাধনে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পদার্থগুলাে তৈরি করা হয়। আরাে ছােট, আরাে দ্রুত এবং আরাে তীক্ষ্ণ বেগে এগােতে গেলে পদার্থের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অংশের ব্যবহার আবশ্যক হয়ে পড়ে কিন্তু পদার্থের পারমাণবিক স্তরে পৌছে গেলেই সনাতন পদার্থবিদ্যার কোনাে নীতি কাজ করে না, কারণ, এই অবস্থায় পদার্থের আচরণ নাটকীয়ভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়। এই পরম পরিসরে পদার্থের এরূপ আচরণের কারণ খুঁজতে গিয়েই বিজ্ঞান এগিয়ে গেল তার নতুন দ্বারের দিকে। বিকাশ ঘটল ন্যানো টেকনোলজি ।
ন্যানো টেকনোলজি কি
ন্যানোপ্রযুক্তি বা ন্যানো ট্যাকনোলজি হলো পদার্থকে আণবিক পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা। একে সংক্ষেপে ন্যানো টেক বলা হয়। ন্যানোমিটার স্কেলের সাথে যে সমস্ত টেকনোলজি বা প্রযুক্তি সম্পর্কিত সেগুলোকেই ন্যানো টেকনোলজি বা ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়।
‘ন্যানো’ শব্দটি গ্রীক ‘ন্যানোস’ থেকে এসেছে যার অর্থ বামন বা যাদুকরী ক্ষমতার অধিকারী ক্ষুদ্রাকৃতির প্রাণী। কিন্তু এটি মাপের একক হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১ মিটারের ১০০ কোটি ভাগের এক ভাগকে বলা হয় ১ ন্যানোমিটার। রিচার্ড ফাইনম্যানকে ন্যানোপ্রযুক্তির জনক বলা হয়। এর ব্যবহার যেমন বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে তেমনি পরিবেশের উপর এর সম্ভাব্য বিরুপ প্রভাব নিয়েও সংশয় রয়েছে।
ন্যানো টেকনোলজি ইতিহাস
১৯৫৯ সালের ২৯ জানুয়ারি রিচার্ড ফাইনম্যান ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজিতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায় There’s Plenty of Room at the Bottom শীর্ষক এক বক্তৃতা দেন। এই বক্তৃতাটিই সর্বপ্রথম ন্যানো প্রযুক্তির ধারণা দেয়।
১৯৮৯ সনের নভেম্বরের ৯ তারিখ ন্যানো টেকনলজি এর জন্য একটা অন্যতম স্মরণীয় দিন হিসবে বিবেচিত হবে। এই দিনে ক্যালিফোর্নিয়ার IBM এর Almaden Research Center এ Don Eigler এবং Erhard Schweizer ৩৫ টি Xenon অণু দিয়ে IBM এর লগোটি তৈরি করেছিলেন। সেইদিনই প্রথম অণুকে ইচ্ছেমত সাজিয়ে পছন্দমত কিছু তৈরি করা সম্ভব হয় মানুষের পক্ষে। এইদিনই প্রথম মানুষ প্রকৃতির সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি অণুর কাঠামোকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল।
অণুর গঠনকে ইচ্ছেমত তৈরি করে অনেক কিছু করা সম্ভব। এক বিশাল সম্ভাবনার দ্বার মানুষের সামনে উন্মোচিত হল। শুধু মাত্র অণুর কাঠামোগত পার্থক্য হবার কারণেই কয়লা এত সস্তা আর হীরক এত দামী। দুটি জিনিসের মূল উপাদান হল কার্বণ। শুধু মাত্র অণুর গঠনের পার্থক্যের কারণে হীরক পৃথিবীর সবথেকে শক্ত দ্রব্য আর কয়লা কিংবা পেন্সিলের শীষ নরম।
১৯৯৯ সনে Cornell বিশ্ববিদ্যালয়ের Wilson Ho এবং তার ছাত্র Hyojune Lee অণুকে জোড়া লাগানোর প্রক্রিয়া প্রদর্শন করেন। এতদিন পর্যন্ত অণু-পরমাণুর সংযোগ শুধু মাত্র রাসয়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমেই সংগঠিত হত। কিন্তু ন্যানো টেকনলজির মাধ্যমে অণু-পরমাণুকে ভেঙে কিংবা জোড়া লাগিয়ে অনেক কিছুই করা সম্ভবনার দ্বার খুলে দিল।
ন্যানো প্রযুক্তির সুবিধা
- বেশি টেকসই বা স্থায়ী, আকারে তুলনামূলক ছোট ও ওজনে হালকা।
- ন্যানোপ্রযুক্তির প্রয়োগে তৈরি ঔষধ স্মার্ট ড্রাগস ব্যবহার করে দ্রুত আরোগ্য লাভ করা যায়।
- খাদ্যদ্রব্য প্যাকেজিংয়ের সিলভার তৈরির কাজে।
- ন্যানো ট্রানজিস্টর, ন্যানো ডায়োড, প্লাজমা ডিসপ্লে ইত্যাদি ব্যবহারের ফলে ইলেকট্রনিকস শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন হচ্ছে
- ন্যানোপ্রযুক্তি দ্বারা তৈরি ব্যাটারি, ফুয়েল সেল, সোলার সেল ইত্যাদির মাধ্যমে সৌরশক্তিকে অধিকতর কাজে লাগানো যায়।
ন্যানো প্রযুক্তির অসুবিধা
- ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যয়বহুল। তাই এই প্রযুক্তি ব্যবহারে তৈরি পণ্য ব্যয়বহুল।
- ন্যানো পার্টিকেল মানব দেহের জন্য ক্ষতিকর
- প্রচলিত প্রতিষ্ঠানে এই প্রযুক্তি ব্যবহারে বেকারত্ব বাড়তে পারে৷
- অনেক ন্যানো পণ্য ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।
- যুদ্ধাস্ত্র তৈরিতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হলে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হতে পারে।
- ন্যানোপ্রযুক্তির কারণে মানুষের প্রাইভেসি ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
- সর্বোপরি এ প্রযুক্তির ভুল ব্যবহার বিরাট ক্ষতি করতে পারে।
আরও পড়ুনঃ গ্লোবাল ওয়ার্মিং কি? এর কারন ও প্রতিকার।
ব্যবসায়ে ন্যানো প্রযুক্তি
ন্যানো টেকনোলজি দ্রুতগতিতে নতুন নতুন আবিষ্কারের সংযোজনের ফলে এর ব্যবসাও দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে এই সম্পর্কিত পণ্যের বাজার ১ ট্রিলিয়ন ডলার। এরাই সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছে।
ইউরোপের দেশগুলোতেও এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশি দেশ শ্রীলঙ্কা ২০০৮ সালে স্লিনটেক নামে ন্যানো টেকনোলজি বিষয়ক উচ্চতর গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
কৃষিক্ষেত্রে ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার
- কৃষি উন্নয়নে ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হলোঃ
- ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টি চাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ বৃদ্ধি।
- ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ।
- কৃষিতে ও কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর ইপস্থিতি শনাক্তকরণ ও শোধনসহ ন্যানো প্রযুক্তি সার , বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ।
পরিশেষে বলা যায়, এ প্রযুক্তির ব্যবহার চিকিৎসাবিজ্ঞান, বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনসহ অনেক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। শিল্পায়নে এই প্রযুক্তি নতুন মাত্রা যোগ করেছে। যার কারণে শিল্পোন্নত দেশগুলো এ খাতের গবেষণায় শতকরা প্রায় ২০ শতাংশ ব্যয় করছে। ক্ষতিকর দিকগুলোর দিকে যত্ন নিয়ে এই ন্যানো টেকনোলজি এর সঠিক ব্যবহার আগামী বিশ্বকে বদলে দেবার ক্ষমতা রাখে।