কম্পিউটার ভাইরাস

মডেমটা কানেক্ট করার সাথে সাথেই কি যেনো একটা শুরু হলো কম্পিউটারে। অটো ডায়াল হচ্ছে ফোন নাম্বার গুলোতে। আমার এখন ভয় লাগছে। কি করবো আমি? ডায়াল তো বন্ধই হচ্ছে না। জানিনা কতগুলো নাম্বারে ডায়াল হয়েছে। হঠাৎ ডায়াল করা বন্ধ হয়ে গেলো। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছি মডেম টার দিকে।

অরুণা টেলিফোন মডেম কানেক্ট করে কম্পিউটারে কাজ করছিলো। হঠাৎ কল এলো। কল কানেক্ট করার সাথে সাথেই কি যেনো একটা শুরু হলো। ফোনবুক এর সব নাম্বারে ডায়াল হচ্ছে একটার পর একটা। কি হচ্ছে এইসব? সাকিবের ও একই অবস্থা। রিফাত, মিমি, মিমির খালাতো বোন, তার বাবা…… ছড়িয়ে গেছে ভাইরাস টা। সবার কম্পিউটারে। ডায়াল হচ্ছে তো হচ্ছেই।

বুঝতে পারছি, পুরো ঘটনাটা পড়তে গিয়ে আপনার গায়েও কাটা দিয়ে উঠেছে। নিশ্বাস বন্ধ করে পড়েছেন, যেমনটা আমারও হয়েছিলো পড়ার সময়। না, এই ঘটনা আমার সাথে ঘটেনি। ঘটেছিল ১৯৭০ সালের the scarred man নামক একটি সায়েন্স ফিকশন স্টোরিতে।

আমরা কথা বলেছি কম্পিউটার ভাইরাস (computer virus) নিয়ে। ঘটনাটি ফিকশনে দেখানো হলেও, বাস্তবে এর চেয়েও ভয়াবহ অবস্থা হয়েছে অনেক বার।

আজকে আমরা জানবো সেসব ভয়াবহ ভাইরাস আক্রমন নিয়ে। জানবো কম্পিউটার ভাইরাস কি, কে আবিষ্কার করেন, প্রথম কম্পিউটার ভাইরাস এর নাম, কত রকমের ভাইরাস হতে পারে, কি করে বুঝবো কম্পিউটারে ভাইরাস আক্রমণ করেছে এবং এর থেকে বাঁচার উপায় কি।

কম্পিউটার ভাইরাস কি

আমরা কম বেশি সবাই জানি, যেকোনো সফটওয়্যার বা অ্যাপ্লিকেশন কিছু প্রোগ্রামিং কোড দিয়ে তৈরি হয়। কম্পিউটার ভাইরাসও তেমনই সফটওয়্যার। অর্থ্যাৎ এটি হলো এমন কিছু কোড, যা কম্পিউটারের সব তথ্য চুরি করে নেয়, কখনো কখনো কম্পিউটার এর কাজ একেবারেই বন্ধ করে দেয়।

কিন্তু, কম্পিউটার ভাইরাসের নাম ভাইরাস কেনো? আমাদের শরীরে ভাইরাস জনিত অনেক রোগ হয়। যেমন করোনা ভাইরাস এর কথাই ধরি। এই ভাইরাস কি করে? আমাদের অসুস্থ করে দেয়, অনেক সময় মৃত্যু ও ঘটায়। আবার একজনের দেহ থেকে অন্য জন কে আক্রান্ত করে।

উদাহরণ হিসেবে বর্তমান সময়ের আলোচিত মহামারী করোনা ভাইরাস বা COVID-19 কথা বলা যেতে পারে।

একইভাবে কম্পিউটার ভাইরাস এক কম্পিউটার থেকে অন্য কম্পিউটারে ট্রান্সফার হতে পারে। কম্পিউটারকে স্লো করে দেয় এমনকি কম্পিউটারের কাজ বন্ধ পর্যন্ত করে দিতে পারে।

কম্পিউটার ভাইরাস মূলত তৈরি করা হয় অসাধু উদ্দেশ্যে। যে বা যারা এই ভাইরাস তৈরি করে, তারা আপনার সব তথ্য চুরি করে বিক্রয় করে। কখনো কখনো শুধুমাত্র এক্সপেরিমেন্ট এর জন্যও ভাইরাস ছড়িয়ে দেয়া হয়।

কম্পিউটার ভাইরাস কে আবিষ্কার করেন প্রথম

ইতিহাসের প্রথম কম্পিউটার ভাইরাসের নাম Creeper virus. ১৯৭১ সালে Bob Thomas এই ভাইরাস তৈরি করেন। ভাইরাসটি মূলত এক্সপেরিমেন্টের জন্য তৈরি করা হয়। দেখা হয় যে এমন কোনো প্রোগ্রাম তৈরি করা সম্ভব কিনা যা নিজেই replica বা নিজের মত একাধিক প্রোগ্রাম তৈরি করতে পারবে। এবং, দেখা যায়, Creeper তা করতে সক্ষম।

Creeper virus যখন নতুন কোনো ড্রাইভকে আক্রমণ করতে সক্ষম হতো, সে চেষ্টা করতো পূর্বের ড্রাইভ থেকে নিজের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে। Creeper তেমন কোনো ক্ষতি করেনি কম্পিউটারের। শুধু একটি মেসেজ দেখাতো : I’M THE CREEPER. CATCH ME IF YOU CAN!”

কম্পিউটার ভাইরাস এর প্রকারভেদ

অনেক ধরণের কম্পিউটার ভাইরাস হতে পারে। আমরা এখন সেগুলোই জানবো।

Boot sector virus

Boot sector virus কম্পিউটার এর হার্ড ডিস্ককে আক্রমণ করে। বুট সেক্টরে সাধারণত ওই সকল ফাইল থাকে যা কম্পিউটার এর অপারেটিং সিস্টেম ওপেন করতে সাহায্য করে। বুট ভাইরাস হয় সিস্টেম এর ভিতর ঢুকে সিস্টেমকে আক্রমণ করে অথবা নিজের একাধিক অনুরূপ তৈরি করে অন্যান্য প্রোগ্রামের ভিতর ঢুকিয়ে দেয়। মাইক্রোসফট এর প্রথম ভাইরাস ছিল brain, যা একটি বুট ভাইরাস।

কম্পিউটার ভাইরাস
প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাইরাস তৈরি হচ্ছে।

Direct action virus

কিছু কিছু কম্পিউটার ভাইরাস আছে, যা সরাসরি কম্পিউটার কে আক্রমণ করে। তবে কাজগুলো করে নিজেকে লুকিয়ে রেখে। এগুলো হলো direct action virus. এই ভাইরাস গুলো সাধারণত .exe এবং .com এই এক্সটেনশনের ফাইলের ভিতর ঢুকে যায়। এদের কে non-residnet ভাইরাস ও বলা হয়।

Resident virus

Resident virus মেমরিতে অবস্থান করে এবং অন্য ফাইল গুলোকে ধীরে ধীরে আক্রমণ করে। একসময় ফাইল গুলো আর কাজ করেনা। এই ভাইরাস কম্পিউটার থেকে রিমুভ করা খুবই কষ্টসাধ্য।

Multipartite virus

Multipartite virus এর নাম থেকেই বোঝা যায়, এই ভাইরাস অনেক ধরণের কাজ করতে পারে। এরা একই সাথে কম্পিউটারের boot সিস্টেম ও মেমরিতে থাকা অন্য ফাইল গুলোকে আক্রমণ করে। Multipartite virus attack হলে আপনার সাইবার থ্রেট এর রিস্ক রয়েছে।

Overwrite virus

কম্পিউটার ভাইরাসের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ হল এই ধরণের ভাইরাস। এই ভাইরাস আপনার কম্পিউটারের পুরো প্রোগ্রামকে মুছে দিয়ে malicious কোড দিয়ে প্রতিস্থাপন করে দিবে। এক সময় পুরো কম্পিউটারকে ক্ষতিকর কোড দ্বারা পূর্ণ করে দিবে।

Polymorphic virus

এই ধরণের ভাইরাস মূলত spam এবং বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে কম্পিউটারে প্রবেশ করে। এরা কম্পিউটারের কোনো প্রোগ্রামের আসল কোড নিয়ে নেয় এবং মূল প্রোগ্রামকে পরিবর্তন করে দেয়। Polymorphic ভাইরাস  শনাক্ত করা বেশ কঠিন।

File infector virus

নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এই ভাইরাস কোনো ফাইলকে আক্রমণ করে। প্রথমে এরা কোনো একটি ফাইলের ভেতর প্রবেশ করে। পরে অন্য ফাইল গুলোতেও আক্রমণ করে। সাধারণত বিভিন্ন গেইম এবং ওয়ার্ড ফাইল থেকে এদের বিস্তার শুরু হয়।

Spacefiller virus

এই ভাইরাস কোনো ফাইলে প্রবেশ করে, তার ভেতর থাকা খালি জায়গা গুলোকে পূর্ণ করে ফেলে। এদের আরেক নাম cavity ভাইরাস। এরা এমন ভাবে স্পেস ফুল করে দেয় যাতে করে ফাইলের আকার বড় হয় যনা ঠিকই, তবে ফাইলে কোনো খালি জায়গা থাকেনা। এদেরকেও শনাক্ত করা খুব কঠিন।

Macro virus

Macro virus এর আক্রমণ শুরু হয় মূলত মেইল থেকে। কোনো ওয়ার্ড ফাইল ওপেন করা হলে সেখান থেকে কম্পিউটারে ছড়ায় এরা।

এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরণের কম্পিউটার ভাইরাস দিন দিন আবিষ্কার হচ্ছে।

কিভাবে বুঝবেন আপনার কম্পিউটার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে?

আমাদের কোনো রোগ হলে যেমন তার কিছু লক্ষণ থাকে, কম্পিউটার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলেও কিছু লক্ষণ প্রকাশ পায়।

  • সবার প্রথমেই যেই বিষয়টি চোখে পড়বে তা হলো কম্পিউটার কোনো কারণ ছাড়াই হঠাৎ hang করবে।
  • কম্পিউটার প্রচণ্ড slow হয়ে যাবে।
  • হটাৎ করে উইন্ডো freeze হয়ে থাকবে।
  • কম্পিউটার অন বা অফ করার সময় বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিবে
  • প্রচুর pop-up অ্যাড চলে আসবে, উইন্ডো বারবার pop-up করতে পারে।
  • কম্পিউটার অটো অন বা অফ হয়ে যেতে পারে।
  • কম্পিউটার এর ভিতরে থাকা ফাইল গুলো পরিবর্তন হয়ে যাবে, ফাইল extension ও পরিবর্তন হতে পারে।
  • পাসওয়ার্ড দেয়া সাইট বা প্রোগ্রামে পাসওয়ার্ড কাজ নাও করতে পারে।
  • Unknown মেইল এড্রেস এ প্রচুর মেইল send হতে পারে।
  • Homepage বারবার পরিবর্তন হতে পারে।
  • কিছুক্ষণ পর পর প্রোগ্রাম crash করতে পারে।
  • Unknown বা unusual ফাইল অথবা প্রোগ্রাম হঠাৎ করে ওপেন হয়ে যেতে পারে।

কম্পিউটারে ভাইরাস আক্রমন করলে এই ধরণের অনেক লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যা একেবারেই unusual.

কম্পিউটার ভাইরাস থেকে বাঁচার উপায়

ভাইরাস কিন্তু একই নেটওয়ার্ক এর সব ডিভাইসকে আক্রমণ করতে পারে। তাই ভাইরাস যেনো আক্রমণ না হয় সেই দিকে খেয়াল রাখা খুবই জরুরী। কিছু সতর্কতা আমাদের সবারই পালন করা উচিত।

বিশেষ করে অপরিচিত ওয়েবসাইট বিশেষ করে পর্ণ ওয়েবসাইট থেকে কোনো ফাইল ইন্সটল করা যাবেনা। অবশ্যই trusted source ব্যবহার করতে হবে। অপরিচিত কোনো মেইল থেকে কোনো ফাইল ওপেন করা যাবেনা। এমনকি পরিচিত মেইল থেকেও না জেনে বা না যাচাই করে কোনো লিঙ্কে ক্লিক করা ঠিক না।

আরো একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। তা হলো অপারেটিং সিস্টেম এর আপডেট এলেই তা আপডেট করে নিতে হবে।

কোন ওয়েবসাইট  ভিসিট করার ক্ষেত্রে দেখে নিন সাইটটি সিকিউরড কিনা, সাইটটি সিকিউরড কিনা সহজেই বুঝার জন্য সাইটটির এড্রেসবারে একটু খেয়াল করুন। সেখানে http এর পর s আছে কিনা। আমাদের এই ব্লগের এড্রেসবার দেখুন https://ready2reading.com/

অ্যান্টিভাইরাস

কম্পিউটার ভাইরাস বা যেকোনো ভাইরাস নিয়ে কথা বলতে গেলে স্বাভাবিক ভাবেই অ্যান্টিভাইরাস এর বিষয় চলে আসে। antivirus কাজ করে ভাইরাসের বিরুদ্ধে।

Antivirus এর কাজ হলো কম্পিউটারে থাকা কোনো ভাইরাসকে শনাক্ত করা, এবং তাকে ধ্বংস করে ফেলা। আর যদি ভাইরাসকে ধ্বংস করতে না পারে তাহলে ইনফেক্টেড ফাইলগুলোকে কুয়ারেন্টাইনে রাখা যাতে আপনার কম্পিউটারের অন্যান্য ফাইলে সংক্রমণ ঘটাতে না পারে।

ঠিক যেমনটা আমরা করোনা আক্রান্ত রুগীর ক্ষেত্রে করে থাকি। বর্তমান সময়ের খুবই কার্যকর একটি এন্টিভাইরাস সফটওয়্যার হল ESET Internet Security. আমি নিজে এটি ব্যবহার করি। আপনারাও ব্যবহার করে দেখতে পারেন।

যেমন, কিছুক্ষন আগেই আমরা Creeper ভাইরাসের কথা জানলাম। এই ভাইরাসকে ডিলিট করা হয়েছিলো “The Reaper” নামক অ্যান্টিভাইরাস দিয়ে।

মনে প্রশ্ন জাগতে পারে অ্যান্টিভাইরাস কিভাবে কম্পিউটার ভাইরাসকে মেরে ফেলে বা ডিলিট করে। আসুন, সেটিও জেনে নেই।

অ্যান্টিভাইরাস কিভাবে কাজ করে

যেকোনো অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার ইন্সটল করার পরে আমরা কি দেখি? Scanning ফাইল এর বিষয়টা তাইতো?

স্ক্যান করে ভাইরাসকে খুঁজে বের করে ফেলে অ্যান্টিভাইরাস। কিন্তু সেটার পিছনেও কিন্তু অনেক কিছু ঘটে।

অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার স্ক্যান করে কম্পিউটারের প্রতিটা ফাইল। ইনফ্যাক্ট, পুরো কম্পিউটারকেই স্ক্যান করে।

অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যারও কিন্তু অন্য সব সফটওয়্যারের মতই কোড করে তৈরি হয়। সফটওয়্যারের ভিতরে ভাইরাস থাকতে পারে এমন সব ফাইলের extension এবং প্রোগ্রাম সেট করে দেয়া হয়। এই ফাইল গুলোকে অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার blacklist হিসেবে ধরে।

স্ক্যান করার সময় অ্যান্টিভাইরাস প্রতিটা ফাইল এর extension চেক করে। যেই extension টি blacklist এর সাথে মিলে যায়, তাকে ভাইরাস চিহ্নিত করে ডিলিট করে দেয়া হয়। এভাবেই মূলত অ্যান্টিভাইরাস কাজ করে।

বিধ্বংসী দশ কম্পিউটার ভাইরাস

আসুন জেনে নেয়া যাক ইতিহাসে ভয়ঙ্করতম দশটি ভাইরাসের নাম। এরা এতই বিধ্বংসী ছিল যে কম্পিউটার ভাইরাসের ইতিহাসে নিজেদের নাম লিখিয়ে নিয়েছে। এদের হাত থেকে বাঁচার জন্য মানুষকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করতে হয়েছে।

  • ILOVEYOU ভাইরাস
  • Code Red ভাইরাস
  • Melissa ভাইরাস
  • Sasser ভাইরাস
  • Zeus ভাইরাস
  • Conficker ভাইরাস
  • Stuxnet ভাইরাস
  • Mydoom ভাইরাস
  • CryptoLocker ভাইরাস
  • Flashback ভাইরাস

শেষ কথা

যদিও অ্যান্টিভাইরাস আমাদের ডিভাইসকে ভাইরাস আক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে, তবুও ভুলে গেলে চলবেনা যে, প্রতিনিয়ত নতুন নতুন ভাইরাস আবিষ্কার হচ্ছে। আর এই ভাইরাস গুলো তাদের কাজ করার আগে পর্যন্ত অ্যান্টিভাইরাস সফটওয়্যার তৈরি করা সম্ভব নয়।

এছাড়া আপনি জানেনও না কি ধরণের ভাইরাস দ্বারা আপনার কম্পিউটার আক্রান্ত হতে পারে। আপনার কারণে কিন্তু আপনার আশেপাশের মানুষের কম্পিউটারেও এই ভাইরাস আক্রমণ করতে পারে!

তাই এর থেকে বাঁচার উপায় একটাই, সতর্ক থাকা। নিজে সতর্ক থাকুন এবং অন্য দেরও সতর্ক হতে উৎসাহিত করুন। কারণ কম্পিউটার ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হওয়া কারোই কাম্য নয়।

Previous articleইউটিউব থেকে মেমোরিতে ডাউনলোড করার উপায়!!
Next articleহযরত বেলাল (রাঃ) – ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব