বারকোড কি কেউ যদি আপনাকে এই প্রশ্নটি করে তবে আপনি হয়তো ফিরে যাবে বইয়ের পাতায় দেখা কিংবা পণ্যের প্যাকেটে দেখে সেই সমান্তরাল সাদা-কালো লাইনগুলোতে। কিন্তু আসলে এই বারকোড কি, কি তার সংজ্ঞা। আমরা কেন আজ এই বারকোড ব্যবহার করছি, বারকোড কিভাবে কাজ করে। এই প্রশ্নগুলো হয়তো আপনার মনে ঘুরাফিরা করছেই। আর এই সব প্রশ্নের উত্তর থাকছে আজকের আলোচনায়।
আমরা আজ আলোকপাত করব, বারকোড কি, কিভাবে তৈরি করে, অনলাইন বারকোড স্ক্যানার উপরে। জানতে হলে আমাদের সাথেই থাকুন।
বারকোড কি?
এটি মূলত সাংকেতিক কালো-সাদা সমান্তরাল রেখা। তবে কখনো কখনো একে মোর্স কোডও বলা হয়ে থাকে। কিন্তু মোর্স কো্ড পুরোপুরিভাবে এর সাথে সামঞ্জস্য রাখে না। বলা যায় বারকোড এর অনুপ্রেরণার পিছনে রয়েছে এই মোর্স কোড। মোর্স কোডের আবিষ্কারক ছিলেন একজন স্বনামধন্য বিজ্ঞানী যাকে হয়তো অনেকেই চিনে থাকবেন। এবং এই মোর্সের মধ্যেই তার নাম নিহিত। হ্যাঁ, আপনার অনুমানটি ঠিক, বিজ্ঞানী স্যামুয়েল মোর্স (১৭৯১-১৮৭২) এই আবিষ্কারটি বিশ্বকে উপহার দেন। আর মোর্স কোডকে ব্যবহার করে বারকোড উপহার দেন দুজন বিজ্ঞানী। তারা হলেন- নরম্যান জোসেফ (১৯২১-২০১২) ও বার্নাড সিলভার (১৯২৪-১৯৬৩)।
আইটির ভাষায় এই কোড কি তার উত্তর খুঁজতে গেলে আপনি পাবেন তথ্য সংগ্রহের ভিজুয়াল পদ্ধতি। যা সম্পাদন করা হয়ে থাকে স্ক্যানার মেশিন এর সাহায্য নিয়ে। একটু খেয়াল করে দেখলে বুঝবেন যে, এটি কিছু কালো সমান্তরাল লাইন এবং এর মধ্যকার ফাঁকা স্থান নিয়ে গঠিত।
আর এই লাইনের দৈর্ঘ্য প্রস্থ এবং ফাঁকা স্থানের তারতম্য বিভিন্ন তথ্যের প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। যার কারণে বারকোড মেশিন এর সাহায্যে আমরা বুঝতে পারি কোনটি দ্বারা কোন পণ্যকে বুঝানো হচ্ছে। বারকোডকে আয়তক্ষেত্র এবং বর্গক্ষেত্র আকারেও দেখা যায়। যার কারণে একে দ্বিমাত্রিক কোডও বলা হয়ে থাকে।
শুরুর দিকে এই কোড ব্যবহৃত হতো মূলত ট্রেন শনাক্ত করার জন্য। এর জন্য প্রতিটি ট্রেনের আগে এবং পিছনে কিছু দাগ দেয়া হতো। পরবর্তীতে এটি আরও বেশী জনপ্রিয় হয়ে উঠে যখন তা শপিং মলের চেক আউট পয়েন্টে ব্যবহার করা শুরু হয়।
আবিস্কারের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-
এই কোড আবিস্কারের মূল ইতিহাসের পিছনেও কিছুটা কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে। এ পর্যায়ে আমরা একটু সেই কাহিনীর প্রতি দৃষ্টিপাত করব।
সময়টা ছিল ৫০ এর দশকের দু বছর আগে অর্থাৎ ১৯৪৮ সাল। স্থানটা যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিল্ভেনিয়া। ডেক্সেল প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্নাতক ছাত্র নাম তার বার্নাড সিলভার। হঠাৎই মাথায় কি এসে যায় সে এক কাণ্ড ঘটিয়ে বসে। সেখানকার স্থানীয় খাদ্যশৃঙ্খলের প্রেসিডেন্টকে সে চ্যালেঞ্জ করে বসে। বলে, সে স্বয়ংক্রিয় পণ্য শনাক্তের উপর রিসার্চে করে ভালো কিছু আবিষ্কার করবে।
এই বলে সে গবেষণার জন্যও অনুমতি নেয়। অতঃপর তার বন্ধু নরম্যান জোসেফকে উক্ত বিষয়টি জানায় এবং তার মতামত জানতে চায়। জোসেফ সেই প্রোজেক্টে সম্মতি জ্ঞাপন করেন এবং তারা তাদের কাজ শুরু করে দেয়।
শুরুর দিকে তারা এ কাজে ব্যবহার করে অতিবেগুণী রঙের কালি। যা তখনকার সময়ে বেশ চড়া দামের ছিল। আর কাজের দিক দিয়ে দেখতে গেলেও এটি ক্রমশ হালকা হয়ে যাচ্ছিল।
এরপরেই তারা মোর্স কোডের সহায়তা নেয় তাদের কাজের জন্য। ইতোপূর্বে আমরা জেনেছি যে এর মূল প্রেরণা এসেছিল এই মোর্স কোড থেকেই। আর এই মোর্স কোডের সহায়তা নিয়েই বালির মধ্যে তারা তাদের প্রথম বারকোড তৈরি করেন।
আর এভাবেই আধুনিক বারকোডের যাত্রাটা শুরু হয় এই দুজন প্রথিতযশা বিজ্ঞানীর হাত ধরে। যাদের আবিষ্কার আজ পণ্য তালিকা রাখতে এক বিশেষ সহায়তা প্রদান করে চলেছে।
বারকোড সম্পর্কিত তথ্য-
বারকোডের নিচে কিছু সংখ্যা নির্দেশ করা হয়। হয়তো আপনি তা দেখে থাকবেন। সাধারণত এই ডিজিট বা অংকগুলো হয়ে থাকে EAN-13। এই সংখ্যাগুলো দ্বারা কিছু বিষয় নির্দেশ করা হয়ে থাকে। যেমন ধরুন, প্রথম অঙ্কগুলোকে যদি আপনি বাম থেকে ডানে পড়েন তবে ৬টি অঙ্ক দ্বারা যে পণ্য উৎপাদনকারীর দেশ বা পরিচয় বুঝানো হচ্ছে তা সমন্ধে জানতে পারবেন। এই ৬টি অঙ্ক দ্বারা মূলতপক্ষে তাই নির্দেশ করা হয়। এর পরের যে ৫টি অঙ্ক রয়েছে তা দ্বারা মূলত পণ্যের নম্বর বুঝানো হয়।
এবং এরপরের একেবারে সর্বশেষে যে অঙ্কটি আমরা দেখতে পাই তা দ্বারা মূলত কিছু বুঝানো হয় না। তবে এই অঙ্কটিকে চেক ডিজিট বলা হয়ে থাকে। কেননা এই ডিজিট বা অঙ্কটিই বারকোড রিডারকে সেই বারকোডটিকে ভালোভাবে বা সঠিকভাবে স্ক্যান করতে সহায়তা করে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রোডাক্টের ক্ষেত্রে বারকোডও আন্তর্জাতিক ভাবেই বানানো হয়ে থাকে। আর তাই বারকোডও আন্তর্জাতিকভাবে পড়ার ব্যবস্থা করা জরুরি। তাই GS1 নামক একটি অর্গানাইজেশন আন্তর্জাতিক বারকোড তৈরি করেছে। এই সংস্থাটি ইউনিক বারকোড প্রতিটি পণ্যের জন্য নির্ধারণ করে দেয়। যার ফলে মিলে যাওয়ার আশংকা থাকে না।
বারকোড সমন্ধিত প্রাথমিক কথা মূলত এটুকুই। আপনি এরপর থেকে আশা করছি চোখে দেখেই ধরে নিতে পারবেন বারকোড দ্বারা কোন দেশের পণ্য এবং কি পণ্য বুঝানো হচ্ছে।
আমার লেখা আরেকটি ব্লগ পড়ুনঃ ওয়াইফাই কি এবং কিভাবে কাজ করে।
কিভাবে কাজ করে?
আলোচনার এ পর্যায়ে এসে আপনার হয়তো এই কোড কিভাবে কাজ করে সে সমন্ধে জানতে ইচ্ছা করছে। আর তাই আপনাকে বেশি অপেক্ষা এবং আলোচনা দীর্ঘও করতে চাচ্ছি না। তাই এ পর্যায়ে আমরা জানব যে বারকোড কিভাবে কাজ করে। নিচের আলোচনার প্রতি লক্ষ রাখুন-
আমরা আগেই জেনেছি যে বারকোড একটি সাংকেতিক ভাষা। তাই সহজ ভাষায় বলা যায় যে, বারকোড মূলত সাংকেতিক চিহ্নের সমন্বয়ে কাজ করে থাকে। আর এই সাংকেতিক ভাষা থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য বের করে আনতে পারে একটি স্ক্যানার। একে বারকোড রিডার বা বারকোড মেশিন বলা হয়ে থাকে। স্ক্যানার অনেক তাড়াতাড়ি এই বারকোড কি বুঝাচ্ছে তা পড়তে পারে এবং প্রয়োজনীয় তথ্য ডাটাবেজে সংরক্ষণ করে।
আধুনিক ব্যবসা জগতকে এই কোড এক তুমুল সাফল্য এনে দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা বিখ্যাত ই-কমার্স প্লাটফর্ম ওয়ালমার্টের কথাই ভাবতে পারি। তারা তাদের পণ্যের স্টক রয়েছে কি না। বা সব পণ্য সঠিকভাবে আছে কি না তা মূলত নির্ণয় করে এই বারকোডের মাধ্যমেই।
এই বারকোড ব্যবহার করেই ব্যবসা ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ে একদম তুমুল সাফল্য পাওয়া গিয়েছে। তারই মধ্যে কিছু কাজ হচ্ছে। বারকোড সিস্টেমের আওতায় যদি কোনো পণ্য কেউ কিনে এবং তা স্টক থেকে চলে যায় তবে সেই সিস্টেম থেকেও অপসারিত হয়। ফলে স্টকে কত পণ্য রয়েছে তার একটা সঠিক ধারণা পাওয়া যায়।
আরও পড়ুনঃ ফ্রি ওয়াইফাই কতটুকু নিরাপদ।
বারকোড কিভাবে তৈরি করে?
বর্তমানে বারকোড তৈরি অত্যন্ত সহজ। কেননা এখন বাজারে এই কোড প্রস্তুতকারক কম্পানি রয়েছে।
আর এই সব সিস্টেম ব্যবহার করেই আপনি এটি জেনারেট করতে পারবেন। আমার জানামতে একটা ভালো বারকোড সিস্টেমের মধ্যে রয়েছে- the WaspNest Barcode System। এছাড়াও আপনি ফ্রি বারকোড জেনারেটর ব্যবহার করেও আপনার কাজ সমাধা করতে পারবেন খুব সহজেই। অনলাইনে এমন অনেক সাইট পাবেন যেখান থেকে খুব সহজে জেনারেট করা যায়। একটু গুগল করেই দেখুন না।
বারকোড মেশিন বা জেনারেটর কিভাবে কাজ করে?
বারকোড জেনারেট করার ক্ষেত্রে একটি বারকোড জেনারেটর মূলত স্ট্রিং আকারে এই তথ্য নিয়ে থাকে। পরবর্তীতে বারকোড জেনারেটর সেই স্ট্রিংকে বাইনারিতে প্রকাশ করে এবং এলগোরিদম সাজায়। উপরোক্ত আলোচনাটিতে আমরা জেনেছি দ্বিমাত্রিক বারকোড এর কথা। এছাড়াও রয়েছে একমাত্রিক বারকোডও। একমাত্রিক বারকোডের ক্ষেত্রে ২০টি ক্যারেক্টার দেখা যায়।
এবং এক্ষেত্রে কোনো ইরর কারেকশন থাকে না। ফলে যদি বারকোডে ভুল হয়ে থাকে তা স্ক্যানারে স্ক্যান হবে না। তবে দ্বিমাত্রিকে দেখা যায় ২০০০ এর মতো ক্যারেক্টার। আর এক্ষেত্রে ইরর কারেকশন থাকে। সেজন্যই কিছু অংশ ভুল বা নষ্ট হলেও বারকোড রিডার বা স্ক্যানার তা স্ক্যান করে নিতে পারে খুব সহজেই।
বারকোড রিডার কি?
যে মেশিনের সাহায্যে এই কোড রিড করা যায় বা পড়া যায় তাই বারকোড রিডার। বিভিন্ন শপিং মলে আপনি ক্যাশ কাউন্টারে এই রিডার দেখে থাকবেন। অথবা আপনি চাইলে মোবাইল দিয়েও বারকোড পড়তে পারবেন। আপনি এন্ড্রয়েড মোবাইল ব্যবহারকারী হলে গুগল প্লে স্টোর থেকে সহজেই বারকোড রিডার এয়াপ্স ডাউনলোড করে নিতে পারবেন।
বারকোড রিডার এর কাজ কি?
তাহলে এতক্ষনে নিশ্চই আপনারা বুঝে গেছেন বারকোড রিডার হল এক প্রকারের স্ক্যানার যার কাজ হল কোন পণ্য বা বস্তুর গায়ে উল্লেখ করা ভাষাকে কিংবা কোডকে পড়ে কম্পিউটার বা মেশিনের বোধগম্য ল্যাঙ্গুয়েজে রুপান্তর করা তথ্যে রুপান্তর করা।
এই রুপান্তরিত ল্যাঙ্গুয়েজ নিয়ে বা তথ্য নিয়ে সে তার ডাটাবেজে সংরক্ষন করতে পারে বা সেই ডাটাবেজ এনালাইসিস করতে পারে। মানে হল, তার স্টক ইনভেন্টরি আপডেট করে নিতে পারে নিজে থেকেই।
বর্তমানে হ্যান্ডহেল্ড, পেনটাইপ সহ বিভিন্ন ধরনের বারকোড রিডার রয়েছে।
ধন্যবাদ সবাইকে। আমার এই ব্লগ যদি আপনার কোন কাজে লেগে থাকে বা আপনার কাজে লেগে থাকে নিচের কমেন্ট বক্সে কমেন্ট করতে ভুলবেন না। এছাড়া আমাদের ফেসবুক পেজে লাইক দিন এবং ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন। আমাদের সাস্থেই থাকুন।