হুমায়ূন আহমেদ

জাদুকর শব্দটা শুনলেই বাঙালি সাহিত্যপ্রেমীদের মাথায় কোন নামটি ঘুরপাক খায়? উত্তরটা খুব সহজ –  হুমায়ূন আহমেদ । কিন্তু কেন তিনি এতোটা জনপ্রিয় কিশোর, তরুণ পাঠক-পাঠিকাদের কাছে? কেন তার লেখাকে তুলনা করা হয় জাদুর সঙ্গে?

বাংলা সাহিত্যের বিস্তার বেশ বড়সড় – একটা সময় ছিল যখন সাহিত্য নির্ভরশীল ছিল অধিকাংশে সামাজিক ঘটনার উপর। গ্রামীন জীবনযাত্রা, সমাজের রীতি-প্রথা সংস্কার কিংবা এধরণের গুরুগম্ভীর বিষয়ের উপরই গড়ে উঠতো অধিকাংশ উপন্যাস। যেগুলোকে এখন আমরা ক্লাসিক হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকি। সেগুলোর সাথে হুমায়ূন আহমেদ এর অনেক সহজসরল কিংবা ভিন্ন ধাঁচের লেখাগুলোকে তুলনা দিয়ে অনেকে বলে থাকেন তার লেখায় সাহিত্যমান ছিল হালকা। যদি তাই হয়ে থাকে, তবে তার লেখা কেন যুগের পর যুগ উন্মাদনা নিয়ে পড়ে এসেছে পাঠকসমাজ? মৃত্যুর আট বছর পরেও পাঠকদের কাছে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম উজ্জ্বল নক্ষত্রের একজন হয়ে বেঁচে রয়েছেন তিনি।

 হুমায়ূন আহমেদ

সাহিত্য জগতের গর্ব এই মানুষটি শিক্ষা জীবনেও ছিলেন কৃতিত্বের অধিকারী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ব্যাচেলরস এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন। ১৯৭০ সালের কথা, তিনি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, বয়স সবে বাইশ। মহসিন হলে থাকতেন। সেই সময়ে তিনি লিখেন তার প্রথম উপন্যাস “নন্দিত নরকে“। ১৯৭১ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে তার বই প্রকাশ করা সম্ভব হয় নি। আহমদ ছফার উদ্যোগে ১৯৭২ সালে অবশেষে প্রকাশিত হয় বইটি। বের হবার পরপর বইটি যে সাড়া ফেলে দিয়েছিল তা কিন্তু নয়! বরং বেশ কিছু সময় লেগে যায় তার উপন্যাস সকলের নজরে আসতে। কিন্তু একবার যখন খ্যাতি পায় নন্দিত নরকে, তারপর থেকে বহু জ্ঞানীগুণী লেখকের কাছে হুমায়ূন আহমেদ এর সেরা লেখার মধ্যে একটি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে এটি।

তার প্রথম উপন্যাস থেকেই মানবহৃদয়ের খুব কাছ ঘেঁষা লেখনী ফুটে উঠেছে বারে বারে। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত তার “শঙখনীল কারাগার” এর আরেকটি বড় উদাহরণ। তার চরিত্রে কিংবা গল্পে অবাস্তবতার ছোঁয়া ছিল খুব কম। চরিত্রগুলো পড়তে গেলে মনে হতো এমন মানুষ দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় প্রতিদিন আমরা দেখি, আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ছোট্ট ছোট্ট বিষয়গুলো কি আশ্চর্যভাবেই না কলমের ছোঁয়ায় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি! যেন আমাদের গল্প আমাদেরকেই আরো রঙিন ভাবে, আরো গুছিয়ে শোনাচ্ছেন।

মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত তার যে বইগুলো রয়েছে – “জোছনা ও জননীর গল্প”, “১৯৭১” কিংবা “আগুনের পরশমণি” সেগুলোতে তার লেখার ধাঁচটাও যেন অন্যদের চেয়ে ছিল কিছুটা আলাদা। তার মধ্যে যে গুণটি সবচেয়ে বড় ছিল তা হলো গল্প বলে পাঠককে ধরে রাখতে পারা। কৃত্রিম গল্পের মাধুর্য তো তার হাত থেকে বের হতো বিশেষ এক আকর্ষণ নিয়েই, সাথে সত্যি ঘটনাও যখন তিনি গল্পের আকারে বলতেন কিংবা কাগজে কলমে তুলে ধরতেন তখন তা হয়ে উঠতো লেখার চেয়েও বেশি কিছু – যেন জীবন্ত এক একটা অনুভুতি ঢেলে দিয়েছেন কালির ফোঁটায়।

তার সবচেয়ে বিখ্যাত দু’টি সিরিজের একটি মিসির আলী সিরিজ অন্যটি হিমু সিরিজ। সম্পূর্ণ দুই মেরুর দু’টি চরিত্র একজন লেখকের হাত থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। যুক্তিবাদী মিসির আলী, রহস্য সমাধান নিয়ে যার কাজকারবার – পুরোপুরি রহস্য গল্প লেখক বনে গিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এই উপন্যাসগুলো লিখতে গিয়ে। বুদ্ধির খেলা, চাতুর্য আর রোমাঞ্চের ছড়াছড়ি। অদ্ভুত আর অবাক করে দেয়া সব জট ছাড়ানোর খেলা। আবার হিমু যেন ছিল জট পাকানোতে ওস্তাদ। মিসির আলী যতটা চাইতেন রহস্যের খোলাসা করতে, হিমু যেন ততটাই চাইতো রহস্য রহস্যই থেকে যাক। উদাসীন এই চরিত্রে হুমায়ূন আহমেদেরই দার্শনিক চিন্তাভাবনা যেন ফিরে এসেছে বার বার। হিমুর কোনো গল্পে গভীর কাহিনীর খোঁজ যদি আপনি করতে যান, তবে পাবেন না হয়তো। কিন্তু তারপরেও যে আবেশ বই শুরু করার পর থেকে পাঠককে ঘিরে ধরে তা শেষ পর্যন্ত ছেড়ে যায় না একটুও।

তার আরো একটি চরিত্র ছিল শুভ্র, যে এসেছে কয়েকটি বইতে। হুমায়ূন আহমেদের লিখিত চরিত্রগুলো কিছুটা যেন জড়ানো একে অপরের সাথে, মিল খুঁজে পাবেন এখানে সেখানে। আবার কেউ কারো মতোই নয়। একজন সফল লেখকের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হলো তার সৃষ্ট চরিত্র। অনেক সময়ে দেখা যায় গল্পের আবেদনের চেয়েও বেশি চরিত্রের খেল দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় পাঠক। এই কাজটি তিনি খুব ভালো পারতেন। পাঠক মনে জাগিয়ে তুলতেন এই ইচ্ছা, “এই চরিত্রের মতো আমিও হতে চাই।” কতো তরুণ যে হলদে পাঞ্জাবি পরে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়িয়ে, রাত বিরাতে ফাঁকা প্রান্তরে হেঁটে নিজেকে কল্পনা করেছে হিমু বলে! কিংবা কতো তরুণী নীল শাড়ি পরে বৃষ্টিভেজা দিনে জলে সিক্ত হয়ে নিজেকে ভেবেছে রূপা! ভেসে গিয়েছে আবেগের বন্যায়! একজন লেখকের এতোটা প্রভাব থাকলে তাকে জাদুকর ছাড়া আর কিই বা বলা চলে?

হুমায়ূন আহমেদ নির্দিষ্ট ঘরানায় বাঁধা ছিলেন না, তার আছে অতিপ্রাকৃত কিছু উপন্যাসও। “পুফি”, “কালো যাদুকর” এবং তার কিছু সমগ্রসহ যে অতিপ্রাকৃত কিংবা ভূতের উপন্যাসগুলো রয়েছে তাতে আতঙ্কে গা হিম হয়ে আসে। তিনি এসব লেখায় কাজ করেছেন মূলত মানুষের মনস্তত্ত্ব নিয়ে – গভীরতম আতঙ্ক বা পশুবৃত্তি নিয়ে। মিসির আলী সিরিজটিতে মনস্তত্ত্ব বিষয়ে তার বিস্তর ধারণা ও পড়াশোনা টের পাওয়া যায়, তার সাথে রয়েছে এই হরর ঘরানার লেখাগুলো।

খুব ছোট্ট পরিসরের যে বইগুলো তার ছিল – যেমন এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছে তার “অচিনপুর”, “অন্যদিন” এবং “অন্ধকারের গান” এই তিনটি উপন্যাসের কথা। চিরায়ত জীবনের আখ্যান। খুব সহজ সাধারণ লেখা। কিন্তু তিনটি বই পড়ার পরই খাঁ খাঁ করা একটা শূন্যতা আর দুঃখবোধ রয়ে যাবে অন্তর জুড়ে। ট্রাজেডি খুব শক্তিশালী অংশ জীবনের এবং সাহিত্যের। যা কখনো পুরানো হয় না, কখনো ব্যর্থ হয় না মনে স্থায়ী দাগ কেটে যেতে। ষাট-সত্তর পাতার একটু খানিক পরিসরে এই অনুভূতিগুলো এতো দারুণভাবে লিখে ফেলতেন তিনি!

আরেকটি ঘরানায় তার উপস্থিতি ছিল বেশ প্রবল – বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী, তথা সায়েন্স ফিকশন। এই উপন্যাসগুলো তিনি লিখেছিলেন কিশোর বয়সী পাঠকদের টার্গেট করে। তার “তোমাদের জন্য ভালোবাসা”, ” ইরিনা”, “অঁহক”, “অনন্ত নক্ষত্র বীথি” সহ আরো যে কয়েকটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী রয়েছে প্রতিটি খুব পাঠকপ্রিয়। সায়েন্স ফিকশন হোক, কিংবা রহস্য, জীবনধর্মী, মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বা অতিপ্রাকৃত – সবজায়গাতেই তিনি কাজ করতেন মানব মনের বিভিন্ন দিক, অনুভূতি, আবেগ, দুঃখ-ভীতি ইত্যাদি নিয়ে। আর সেকারণে তিনি পৌঁছেছিলেন পাঠকের এতোটা কাছাকাছি।

তার লেখা বাকের ভাই চরিত্রটি প্রায় প্রত্যেক পাঠকের মনে থাকবার কথা। “কোথাও কেউ নেই” এর এই চরিত্রটি ছিল কেবলই একটি গল্পের চরিত্র, কিন্তু এই কাল্পনিক মূর্তি এতোটাই তীব্রভাবে গেঁথে গিয়েছিল মানুষের মনে – বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন নাটকটি প্রচারিত হচ্ছে তখন বাকের ভাইয়ের ফাঁসির আদেশ শোনার পর উত্তাল হয়ে গিয়েছিল জনগণ! প্রতিবাদ করতে রাস্তায় পর্যন্ত নেমে গিয়েছিল তারা! একটি চরিত্রের জন্য! যে কাল্পনিক হলেও মানুষের কাছে ছিল জীবন্ত কেউ! প্রতিবাদে নাটকের ঘটনা পরিবর্তন হয় নি ঠিকই, কিন্তু চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে গিয়েছিল হুমায়ূন আহমেদ মানুষটি কতো বড় একজন প্রভাব ছিলেন সকলের উপর!

শুধু বই নয়, তিনি পদচারণা করে গিয়েছেন সিনেমা এবং গানের জগতেও। তার লেখা গল্প থেকে অনেকগুলো সিনেমা তৈরি হয়েছে, তিনি নিজে পরিচালনা করেছেন তার মধ্যে বেশকিছু। এই ক্ষেত্রে সবচেয়ে খ্যাতিমান হয়ে রয়েছে তার “শঙখনীল কারাগার“, ” ঘেঁটুপুত্র কমলা”, “শ্রাবণ মেঘের দিনে”, “আমার আছে জল”, ” আগুনের পরশমণি”, “শ্যামল ছায়া” ইত্যাদি। প্রতিটি সিনেমা বাংলা সিনেমা জগতের অমূল্য রত্ন। তার জিতে নেয়া পুরস্কারের মধ্যে ছিল কেবল তিনটি সিনেমা থেকেই পাওয়া ছয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

তার শেষ উপন্যাস ছিল “দেয়াল”। নিউইয়র্কে থাকা অবস্থায় অসুস্থ থাকতেই তিনি লিখে গিয়েছিলেন এই বইটি। কিছু বিতর্ক ও ঝামেলা পেরিয়ে তার মৃত্যুর এক বছর পর প্রকাশিত হয় বইটি।

হুমায়ূন আহমেদ মারা গিয়েছেন আট বছর পূর্ণ হয়ে গিয়েছে। একুশে বইমেলায় তার আর নতুন কোনো লেখা আসে না বহুদিন হয়ে গিয়েছে। তার লেখার আবেদন কিন্তু পাঠকমনে কমে নি একটুও৷ জ্যোৎস্না রাতে, তীব্র বৃষ্টিতে কিংবা খোলা রাস্তায় খাঁ খাঁ রোদে সব জায়গাতেই যেন মিলেমিশে থাকে তার কোনো চরিত্রের কোনো স্মৃতি। তার কোনো গানের লাইন। পাঠকের কাছে বার বার ধ্বনিত হয়ে আসে তার উক্তিগুলো। তিনি রয়ে গিয়েছেন এক জ্বলন্ত নক্ষত্রের মতো, সাথে সাথে রয়েছে মনে গোপনে এসে ভীড় করা উত্তর না জানা এক প্রশ্ন – “এতোটা প্রভাবশালী একজন লেখক আবার কবে পাবো আমরা?”

Previous articleসফল যারা কেমন তারাঃ ব্যবসায় সফল হওয়ার উপায়
Next articleদাজ্জাল সম্পর্কে হাদীস জানুন – দাজ্জালের ফিতনা থেকে বেঁচে থাকুন