হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)

 

দুনিয়া বা পৃথিবী, একে অপরের সমার্থক শব্দ৷ কী অর্থ এই দুনিয়ার?? কেন আমরা এসেছি আবার কোথায়ই বা চলে যাবো? ছোট বাচ্চা হয়ে জন্ম নেয়া তারপর একদিন হঠাৎ করে চলে যাওয়া। খুবই অল্প সময় কোনো মানুষ এখানে থাকতে পারে৷ কিন্তু এই অল্প সময়ের মধ্যেই কিছু মানুষ অনেক বড় স্বপ্ন দেখে, কেউ অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলে।  কেউ কেউ বাঁচতে চায় অনেক বছর। মৃত্যুকে জয় করার স্বপ্নও দেখে অনেকে। একেক জন দুনিয়াকে একেক ভাবে দেখে। কেউ এই অল্প দিনে দুনিয়ার মোহ ও সুখ-ভোগের আশায় পড়ে যায়৷ আবার কেউ এই ক্ষণজন্মাকে সাধারণ ভাবেই কাটিয়ে দেয়। দুনিয়ার সাথে মানুষের সম্পর্ক কী? মানুষ কেন এখানে আসে, আবার কেনই বা এখান থেকে চলে যায়? কতটুকু অংশ, গ্রহণীয় কতটুকু বর্জনীয়? এই প্রশ্নের জবার দেয়ার জন্য আল্লাহ যুগে যুগে অসংখ্য নবী রাসূলকে পাঠিয়েছেন। শেষ জামানার পথ প্রদর্শক হিসেবে এসেছিলেন প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ)। অন্যান্য মানুষদের মত দুনিয়া নিয়ে তারও ছিলো আলাদা চিন্তা ভাবনা। তিনিও দুনিয়াকে নিয়ে ভেবেছেন নানা ভাবে। একজন মুসলিম হিসেবে আমাদের জানা উচিত দুনিয়া নিয়ে কী কী ভেবেছেন তিনি। কীভাবে জীবন যাপন করেছেন এই দুনিয়াতে। আজ আমরা দুনিয়া দেখবো রাসূল মুহাম্মদ (সাঃ) এর চোখে।

দুনিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক

দুনিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক ঠিক কেমন? যে দুনিয়ার সাথে আমাদের এত স্বপ্ন, এত আশা-আকাঙ্ক্ষা সেই দুনিয়া নিয়ে নবি (সাঃ) ভাবনা ছিলো একজন মুসাফিরের মত। মাদুরে শুয়ে যখন নবি (সাঃ) এর পার্শ্বদেশে মাদুরের ছাপ লেগে গিয়েছিলো, তখন উমার (রাঃ) তাকে নরম বিছানা গ্রহণ করতে বলেছিলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন,

‘ এ দুনিয়ার সাথে আমার কী সম্পর্ক?  এ দুনিয়ার সাথে আমার দৃষ্টান্ত হলো নিছক এমন এক অশ্বারোহীর ন্যায় যে প্রচন্ড গরমে একদিন ভ্রমণে বের হয়ে দিনের কিছুক্ষণ একটি গাছের নিচে ছায়া গ্রহণ করলো, তারপর বিশ্রাম নিয়ে সেখান থেকে চলে গেলো।’ (আহমাদ, আল মুসনাদ, ১/৩০১)

আরেকটি হাদিসে এসেছে নবি (সাঃ) বলেন,’ আব্দুল্লাহ! দুনিয়াতে এমনভাবে থেকো যেন তুমি একজন অপরিচিত ব্যক্তি কিংবা মুসাফির, আর নিজেকে কবরের বাসিন্দাদের অন্যতম হিসেবে গণ্য করো।’ (তিরমিযি,২৩৩৩)

আল্লাহর কাছে দুনিয়া

যে দুনিয়া নিয়ে আমাদের গর্ব, সে দুনিয়ার দাম আমাদের রবের কাছে কতটুকু? একদিন নবি (সাঃ) রাস্তা দিয়ে হেটে যাওয়ার সময় একটি ভাগারে মৃত ভেড়া দেখতে পেলেন। তিনি সেখানে দাড়িয়ে গেলেন আর সাহাবীদের উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘ফেলে দেওয়ার সময় মালিকের নিকট এ ভেড়াটি যতো তুচ্ছ মনে হয়েছে আল্লাহ তাআলা’র নিকট দুনিয়া তার চেয়েও অধিক তুচ্ছ।’ (মুসলিম, ২/২৯৫৭)

বিলাসিতার ব্যাপারে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর অবস্থান

বিলাসিতা এখন আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। আমরা যে শ্রেণীর মানুষই হই একটু বিলাসিতা যেন না করলেই নয়। কিন্তু রাসুল (সাঃ) বিলাসিতা থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি বলেন,

‘বিলাসিতা থেকে দূরে থাকো, কারণ আল্লাহ’র বান্দারা বিলাসী হয় না।’ (হাইসানি, ১০/২৫০)

একবার যব, চিনি, খেজুর ও কাঠবাদামের মিশ্রণে তৈরি এক বিশেষ তরল খাবার রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর সামনে আনা হলে তিনি বললেন,

‘এটি আমার কাছ থেকে সরাও; এটি বিলাসী মানুষের পানীয়।’ (ইবনুল মুবারক, আয-যুহদ, ২/৫৫)

খাওয়া দাওয়া নিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি

আজকাল আমাদের জেনারেশনে খাওয়া দাওয়া নিয়ে অনেক ন্যাকামি। এটা খাবো না ওটা খাবো। আর ফাস্ট ফুডের চাহিদা তো আজকাল বলার অপেক্ষাই রাখে না। তাছাড়া পরিবার গুলোতে এক মাস, তিন মাসের খাবার মজুদ করা এখন দৈনন্দিন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। অথচ আমাদের নবি (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন ছিলো খাবার নিয়ে চলুন জেনে নেইঃ তিনি সব সময় প্রয়োজনটুকু মেটে এমন পরিমাণ খাবার প্রার্থনা করতেন৷ তিনি বলতেন,

‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদের পরিবারবর্গের যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু খাবারের ব্যবস্থা করে দাও!’ (মুসলিম, ১০৫৫)

একবার নবি (সাঃ) কে তিনটি পাখি উপহার দেয়া হয়েছিল। তাঁর সেবিকা একটি পাখি খাওয়ালেন। পরদিন আবার পাখি হাজির করলে রসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেনঃ

‘আমি কি তোমাকে আগামীকালের জন্য কোনো কিছু তুলে রাখতে নিষেধ করিনি? আল্লাহ তা’আলাই তো প্রত্যেক আগামীকাল জীবিকার ব্যবস্থা করে দিবেন।’ (আহমাদ, আল-মুসনাদ, ৩/১৯৮)

দুনিয়ার কষ্ট যন্ত্রণা সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর বাণী

দুনিয়াতে কম বেশি সবাইকে দুঃখ, কষ্টের মধ্যে  দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু আমরা এতে ধৈর্য হারা হয়ে যাই। পৃথিবীতে আগত প্রায় সব নবি-রাসূলের জীবনেই ছিলো কষ্ট, যন্ত্রণা। এই কষ্টের বিপরীতে পরকালে যে পাওনা রয়েছে তা আমরা ভুলে যাই৷ দুনিয়ার এই কষ্ট যন্ত্রণা সম্পর্কে নবি (সাঃ) বলেনঃ

‘দুনিয়া মুমিনের জন্য জেলখানা আর কাফিরের জন্য জান্নাতস্বরুপ।’ (মুসলিম, ১/২৯৫৬)

একবার হজ্বের সময় কাবা ঘরে গিয়ে বললেন,'(আল্লাহ) আমি হাজির! পরকালের আরাম আয়েশই প্রকৃত আরাম আয়েশ।’ (ইবনু আবী শাইবা, ৭/৮২)

অথচ আমরা অন্যের সুখে শান্তিতে থাকা দেখে হিংসা করি, তাদের মত সুখ, শান্তি কামনা করি। কত পার্থক্য আমাদের ও নবি (সাঃ) দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে।

অতিরিক্ত কথা না বলা

আমরা সারাদিনই অযথা কথা নিয়ে পড়ে থাকি৷ প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একবার সারাদিনের কথা বার্তা, তর্ক বিতর্ক গুলো একটু বিবেচনা করলেই দেখাবেন প্রায় ৯৫% ছিলো অহেতুক৷ নবি (সাঃ) এই অতিরিক্ত কথা থেকে আমাদের বিরত থাকতে বলেছেন। তিনি বলেনঃ

‘মানুষের প্রত্যেকটি কথা তার ক্ষতি সাধন করবে, কোনো উপকারে আসবেবনা; তবে এ কয়েকটি বাদে – ভালো কাজের আদেশ, মন্দ কাজে নিষেধ ও আল্লাহ’র যিকর।’

আল্লাহ আমাদের অহেতুক কথাবার্তা থেকে মুক্তি দান করুক। আমীন।

সবার ডাকে সাড়া দেওয়া

আমরা আমাদের চেয়ে নিচু শ্রেণির মানুষদের অন্য চোখে দেখি। তাদের ডাকে তাদের পাশে যেতে চাই না। তাদের থেকে নিজেদের আলাদা করে রাখি। কিন্তু নবি (সাঃ) এর স্বভাব ছিলো ভিন্ন। বর্ণিত আছেঃ

‘তিনি কৃতদাসের ডাকে সাড়া দিতেন, অসুস্থকে দেখতে যেতেন এবং গাধায় চড়তেন।’ (তিরমিযি, ১০১৭)

আখিরাতে ধনী-হতদরিদ্র

আমাদের মধ্যে একটি হতাশা সব সময় কাজ করে যে, ঐ লোকটি এত এত সম্পদ, এটা ওটা আছে কিন্তু আমার নেই। আমরা এই তুলনা থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখি না। আমরা এটা ভাবি না যে, শেষ বিচারে আমাকে সব কিছুর জন্য হিসেব দিতে হবে। যার সম্পদ বেশি তার হিসেব স্বাভাবিক ভাবেই বেশি হবে। এ সম্পর্কে নবি (সাঃ) বলেনঃ

‘ আমি জান্নাতের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সেখানকার বেশিরভাগ অধিবাসী হলো দুনিয়ার নিঃস্ব ব্যক্তি; জাহান্নামের দিকে তাকিয়ে দেখি, সেখানকার বেশিরভাগ বাসিন্দা নারী; দুনিয়ার ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আটকে গেছে;  কাফিরদের জাহান্নামে নিয়ে যাওয়ার জন্য আদেশ দেওয়া হচ্ছে।’ (বুখারি,১০৫২)

হযরত উমর (রাঃ) কে নিয়ে আমার আরেকটি লেখা পড়ে দেখুনঃ

হযরত উমর (রাঃ)-ইসলামের ইতিহাসের এক সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক

দুর্ভিক্ষের তুলনায় প্রাচুর্য ভয়ঙ্কর

আমরা মনে করে থাকি দুর্ভিক্ষ আমাদের জন্য অনেক বড় আজাব৷ কত মানুষ না খেয়ে মারা যায়। যারা বেঁচে থাকে তাদের অনেক অর্থ ব্যয় করতে হয়। কিন্তু রাসূল (সাঃ) বলতেন ভিন্ন কথা৷ একবার এক ব্যক্তি নবি (সাঃ) এর কাছে এসে বললো, ‘হে আল্লাহ’র রাসূল, দুর্ভিক্ষ তো আমাদেরকে খেয়ে ফেললো।’ তখন নবি (সাঃ) বললেন,

‘প্রাচুর্য তো তোমাদের জন্য আরো বেশি ভয়ঙ্কর। দুনিয়া তোমাদেরকে নিমজ্জিত করে ফেলবে। হায়! আমার উম্মাহ’র লোকেরা যদি স্বর্ণ পরিধান না করতো!’ (ইবনু আবী শাইবা, ৭/৮৫)

অধিক জীবনোপকরণ সম্পর্কে হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর  মন্তব্য

আমরা আমাদের জীবনোপকরণ বৃদ্ধি করতে সবসময় ব্যস্ত থাকি। নশ্বর এই পৃথিবীর সবকিছুই যেখানে অপ্রয়োজনীয় সেখানে অহেতুক, অধিক জীবনোপকরণ  কখনই গ্রহণযোগ্য নয়৷ তবুও আমরা আরেক জনের সাথে তুলনা দিয়ে দিনের পর দিন ঘর ভর্তি জিনিস কিনতে ব্যস্ত থাকি। আর এই ব্যস্ততায় আমরা দুনিয়ামুখি হয়ে পড়ি।   এ সম্পর্কে নবি (সাঃ) বলেনঃ

‘তোমরা অধিক জীবনোপকরণ গ্রহণ কোরো না, অন্যথায় দুনিয়ার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়বে।’ (তিরমিযি, ২৩২৮)

দুনিয়া সম্পর্কিত রাসূল (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো আমাদের চেয়ে ভিন্ন। আমরা দেখতে পাই তিনি জীবনের প্রতিটি বিষয়ের উপর কীভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং প্রয়োজনী, অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন। আমাদের পুরো জীবনের প্রায় সব বিষয়েই তিনি জ্ঞান রাখতেন৷ এই পর্বে আমরা তার আংশিক তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আপনাদের পড়ার সুবিধার্থে আরো একটি পর্ব লেখার চেষ্টা করবো ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ আমাদের নবি (সাঃ) এর দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুক। আমিন।

 

Previous articleঢাকার আশেপাশে বেড়ানোর জায়গা – কম সময়ে ঘুরে আসুন (পর্ব- ২)
Next articleব্লগ থেকে আয় কতটুকু কঠিন এবং আয়ের রাস্তাসমূহ পর্ব ০২ (গুগল এ্যাডসেন্স)
Rasel Khan
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here