স্যাটেলাইট কাকে বলে এবং স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে ইত্যাদি নানা প্রশ্ন আপনার মাথায় নিশ্চয়ই ঘুরপাক খাচ্ছে। আধুনিক বিজ্ঞানের এক অন্যতম অবিশ্বাস্য আবিস্কার এই স্যাটেলাইট। খালি চোখে স্যাটেলাইট দেখা না গেলেও আমাদের আধুনিক জীবনের সাথে এই প্রযুক্তির সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আমরা অনেকেই স্যাটেলাইট শব্দটি শুনে থাকলেও এ নিয়ে তেমন বিশেষ কিছুই জানিনা। আপনাদের সবার জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারন করার উদ্দেশ্য নিয়েই আমাদের আজকের এই ব্লগ। আমাদের আজকের এই ব্লগ পড়ে আপনি জানতে পারবেন স্যাটেলাইট নিয়ে আপনার অজানা সব কথা। তাহলে আসুন দেরি না করে শুরু করে দেই।
স্যাটেলাইট কাকে বলে
স্যাটেলাইট শব্দটি এসেছে মূলত ল্যাটিন শব্দ থেকে। এর বাংলা অর্থ করলে দ্বারায় “অনুসরণ করা”। স্যাটেলাইটের বাংলা সমার্থক শব্দ উপগ্রহ। আমরা সবাই জানি, সৌরজগতের কেন্দ্র হচ্ছে সূর্য যা একটি নখত্র। সূর্যকে কেন্দ্র করে ৮টি গ্রহ তাদের নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে। আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী এই সৌরজগতের একটি গ্রহ। এছাড়া বাকি ৭টি গ্রহ হলঃ বুধ, শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন।
আবার চাঁদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে তার নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে। চাঁদ হল পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ মানে স্যাটেলাইট। এমনিভাবে মঙ্গল গ্রহের দুইটি উপগ্রহ আছে; ফোবোস ও ডেইমোস। চাঁদের মত তারাও মঙ্গল গ্রহের চারদিকে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে।
জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা ষোড়শ দশকে প্রথম বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ গুলি সম্পর্কে ধারণা দেয়ার সময় এই স্যাটেলাইট শব্দটি উচ্চারণ করেছিলেন। সেই থেকেই এই শব্দের উতপত্তি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, গ্রহের চারদিকে যে সকল মহাজাগতিক বস্তুগুলো তাদের কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান তাদেরকেই উপগ্রহ বলা হচ্ছে। এগুলো সবই প্রাকৃতিক। আর আমরা যদি কৃত্তিমভাবে কোন অবজেক্ট বা বস্তুকে পৃথিবীর চারদিকে ঠিক চাঁদের মতই অনন্তকালের জন্য একটি কক্ষপথ তৈরি করে ঘোরাতে পারি তাহলে তাকেও স্যাটেলাইট বলা যেতে পারে।
তাহলে বুঝতেই পারছেন, স্যাটেলাইট বা উপগ্রহ মূলত দুই ধরনের হতে পারে। প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট এবং কৃত্তিম স্যাটেলাইট। আর স্যাটেলাইট বলতে সাধারণত কৃত্তিম স্যাটেলাইটকেই বোঝানো হয়ে থাকে। আশা করি স্যাটেলাইট কি তা সহজেই বুঝতে পেরেছেন।
জেনে রাখা ভাল, মহাকাশের প্রতিটি বস্তুই একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে, এই আকর্ষণ শক্তিকে বলা হয় মহাকর্ষ বল। বলে রাখা ভালঃ পৃথিবীর উপর চাঁদ ও সূর্যের যে মহাকর্ষ বল কাজ করে তার প্রভাবেই পৃথিবীতে জোয়ার ভাটা হয়।
স্যাটেলাইট তৈরির ইতিহাস
স্যাটেলাইট তৈরির ইতিহাস খুব বেশিদিন আগের নয়। মানুষের মহাকাশ যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর। এই দিনে রাশিয়া তাদের প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক-১ উতক্ষেপন করে। সেই থাকে আজ পর্যন্ত ৪০টিরও বেশি দেশ স্যাটেলাইট উতক্ষেপন করেছে যার মোট সংখ্যা প্রায় ৯০০০।
একই বছর নভেম্বর মাসে রাশিয়া আরও একটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করে যার নাম স্পুটনিক ২ যার আরোহি ছিল লাইকা নামের একটি কুকুর। এটিই প্রানি বহনকারি প্রথম মহাকাশ যান।
মহাকাশ যাত্রার ইতিহাস জানতে হলে আপনাকে মনে রাখতে হবে তৎকালীন সময়ে আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ চলছিল। কার আগে কে মহাকাশে যেতে পারে তাই নিয়ে এক প্রতিযোগিতা ছিল। ১৯৫৮ সালের ৩১ জানুয়ারি এক্সপ্লোরার ১ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম কৃত্রিম উৎক্ষেপণ করা হয়।
২০১৮ সালের এক পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায় প্রায় ৫০০০ স্যাটেলাইট পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করছে যার মাঝে প্রায় ২০০০ স্যটেলাইট জীবিত। বাকিরা তাদের জীবন কাল অতিক্রম করে মৃত অবস্থায় ঘুরছে। মৃত স্যাটেলাইটগুলো এখন মহাকাশের আবর্জনা ছাড়া আর কিছুই নয়।
কোন দেশের কতগুলো স্যাটেলাইট রয়েছে
সবচেয়ে বেশি স্যাটেলাইট রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের, যার সংখ্যা ৪৩৭১টি , চীনের রয়েছে ৫২৭টি স্যাটেলাইট এবং রাশিয়ার রয়েছে ১৭৬টি স্যাটেলাইট। এরপরে রয়েছে ভারতের ১০৪টি, জাপানের ২০৫টি এবং যুক্তরাজ্যের ৪৩৮টি। এছারাও আর অনেক দেশের স্যাটেলাইট রয়েছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ৭৫ এবং এই সংখ্যা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে।
তবে, বর্তমান সময়ে লাইভ স্যাটেলাইটের সংখ্যা এটা নয়। এখানে উতক্ষেপনের সংখ্যা দেয়া হয়েছে। এই সংখ্যা ক্রমাগত পরিবর্তনশীল।
বাংলাদেশেরও একটি স্যাটেলাইট রয়েছে যার নাম ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। কিছুদিন আগে ২০১৮ সালের ১২ই মে উৎক্ষেপণ করা হয় আমাদের বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে সফলভাবে এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। স্যাটেলাইটটির নামকরণ করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে।
স্যাটেলাইটের প্রকারভেদ
আগেই বলেছি স্যাটেলাইট মূলত দুই প্রকার।
- প্রাকৃতিক স্যাটেলাইট
- কৃত্তিম স্যাটেলাইট
আবার স্যাটেলাইটের (কৃত্তিম) কার্যকারিতা এবং উদ্দেশ্য অনুসারে একে ভাগ করা যায় বেশ কয়েক ভাগে। যেমন-
- কমিউনিকেশন স্যাটেলাইট
- রিমোট সেন্সিং স্যাটেলাইট
- গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম
- ড্রোন স্যাটেলাইট
- গ্রাউন্ড স্যাটেলাইট
- পোলার স্যাটেলাইট
- ন্যানো, স্মল ও স্মার্ট স্যাটেলাইট
- জিওসেন্ট্রিক অরবিট টাইপ বা জিওসিনক্রোনাস স্যাটেলাইট
আবার পৃথিবী থেকে এর দূরত্বের উপর নির্ভর করে একে চারভাগে ভাগ করা হয়।
- GEO (Geostationary Earth Orbit) স্যাটেলাইট
- LEO (Low Earth Orbit) স্যাটেলাইট
- MEO (Medium Earth Orbit) স্যাটেলাইট
- HEO (Highly Elliptical Orbit) স্যাটেলাইট
এই চার প্রকারের নিয়ে কিছুটা না বললেই নয়। তাই এদের কিছুটা বর্ণনা দিয়ে দিচ্ছি।
Geostationary Earth Orbit স্যাটেলাইট
পৃথিবী থেকে বা কেন্দ্র থেকে এই ধরনের স্যাটেলাইটের দূরত্ব ৩৬০০০ কিলোমিটার। এই ধরনের স্যাটেলাইটের গতি পৃথিবীর গতির সমান হয় তাই কার্যত এটি পৃথিবীর সাপেক্ষে স্থির। টিভি চ্যানেল, রেডিও চ্যনেল, আবহাওয়া ইত্যাদির স্যাটেলাইটগুলো মূলত এই শ্রেনির হয়ে থাকে। একই স্থানে স্থির থাকে বলে রিসিভারের এন্টেনা পরিবর্তন করতে হয়না। মাত্র তিনটি স্যাটেলাইটের মাধ্যমেই আপনি পুরা পৃথিবীকে কাভার করতে পারবেন।
এই ধরনের স্যাটেলাইট খুবই ব্যয় বহুল হয়ে থাকে। বিল্ডিং এর ভিতরে এর সিগন্যাল পেতে সমস্যা হয়। রিসিভার এন্টেনা তাই নির্দিষ্ট দিকে মুখ করে বাড়ির ছাদে বসাতে হয়।
LEO (Low Earth Orbit) স্যাটেলাইট
পৃথিবী থেকে এই ধরনের স্যটেলাইট মাত্র ৫০০-১৫০০ কিলোমিটার দূরে কক্ষপথে অবস্থান করে। এই ধরনের স্যটেলাইট GEO (Geostationary Earth Orbit) স্যাটেলাইট মত একই অবস্থানে অবস্থান করে না। দ্রুতই পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে। এ ধরনের স্যটেলাইট দিয়ে পুরো পৃথিবীকে কাভার করতে হলে অনেকগুলো স্যাটেলাইটের দরকার। তাছাড়া এদের জীবনকাল কম, মাত্র ৫-৮ বছর। ভয়েস কমুনিকেশন এর জন্য এই ধরনের স্যাটেলাইট উত্তম।
MEO (Medium Earth Orbit) স্যাটেলাইট
এই ধরনের স্যাটেলাইট পৃথিবী থেকে ৬০০০ থেকে ২০০০০ কিলোমিটারের মাঝে অবস্থান করে। তার মানে হচ্ছে এটি GEO (Geostationary Earth Orbit) স্যাটেলাইট এবং LEO (Low Earth Orbit) স্যাটেলাইট এর মাঝামাঝি কোথাও অবস্থান করে। এর কার্যকারিতা অনেকটা LEO (Low Earth Orbit) স্যাটেলাইট এর মতই কিন্তু কাভারেজ বেশি। পুরো পৃথিবীকে কাভারেজ দিতে হলে প্রায় ডজন খানেক MEO (Medium Earth Orbit) স্যাটেলাইট লাগবে।
HEO (Highly Elliptical Orbit) স্যাটেলাইট
এই ধরনের স্যাটেলাইটগুলো উপবৃত্তাকার পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে থাকে। পৃথিবী থেকে এর দূরত্ব ৩৬০০০ কিলোমিটারের চেয়েও বেশি হয়ে থাক। একপাশে কাভারেজ কম হলেও আরেকপাশে কাভারেজ অনেক বেশি থাকে। কমিউনিকেশন, রেডিও, রিমোট সেন্সিং এর কাজে এই ধরনের স্যাটেলাইট ব্যবহার করা হয়ে থাকে। মাত্র দুইটি স্যাটেলাইট দিয়েই পুরো পৃথিবীকে কাভারেজ দেয়া যায়।
স্যাটেলাইটের গঠন
বুঝতেই পারছেন, স্যাটেলাইট আসলে যোগাযোগ ব্যবস্থার এক আধুনিক অস্ত্র। আর স্যাটেলাইটের অবস্থান পৃথিবী থেকে অনেক দূরে। তাই স্যটেলাইট গঠনের অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হল পাওয়ার সাপ্লাই। এই চ্যালেঞ্জের সমাধান হল সৌর বিদ্যুৎ। স্যাটেলাইটের দুইপাশে পাখার মত শক্তিশালী সোলার প্যানেল বসান থাকে। এছাড়াও স্যটেলাইটের প্রধান যে অংশগুলো থাকে তা হলঃ
- অ্যান্টেনা যা ডাটা আদান ও প্রদান করার কাজ করে।
- রেডিও ট্রান্সমিটার যা আপলিঙ্কিং কমান্ড ও তথ্য ডাউনলোড করার জন্য ব্যবহৃত হয়।
- কম্পিউটার চিপ যা ডাটা প্রসেস করে থাকে।
- পাওয়ার সিস্টেম যা শক্তি যোগায়।
- ব্যাটারি যা সৌরশক্তিকে সঞ্চয় করে রাখে।
- পাওয়ার বাস যা পাওয়ারের কাজে লাগে।
- সেন্সর যা সেন্সিং এর কাজ করে।
- ক্যামেরা, ডিটেক্টর যা ডাটা সংগ্রহ করে, ইত্যাদি
স্যাটেলাইটের বডি এবং এর যন্ত্রাংশ টাইটেনিয়াম মেটাল দিয়ে তৈরি হবার কথা থাকলেও অধিকাংশ স্যাটেলাইট এর বডি ও যন্ত্রাংশ এলুমিনিয়াম ও এলুমিনিয়ামের এলয় দিয়ে তৈরি করা হয়। কারণ টাইটেনিয়াম অনেক শক্ত, টাইটেনিয়াম মাইনিং করা এবং যন্ত্রাংশ ফেব্রিকেট করা বেশ কঠিন। পক্ষান্তরে এলুমিনিয়াম অনেক হালকা, দীর্ঘস্থায়ী এবং দামে সস্তা।
বর্তমানে অনেক স্যাটেলাইটে সোলার সিস্টেমের বদলে নিউক্লিয়ার পাওয়ার সিস্টেম ব্যবহার করা হয়।
স্যাটেলাইট কিভাবে কাজ করে
এতক্ষনে আমরা নিশ্চই বুঝে গেছি স্যাটেলাইটের মূল কাজ কি, তাই না? স্যাটেলাইটের মূল কাজ আসলে তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্য আদান প্রদান করা। স্যাটেলাইট তার ইনপুট ডিভাইসের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- স্যাটেলাইটের ক্যামেরা দিয়ে স্যাটেলাইট ছবি তুলে তা ধারণ করে এবং তোলা ছবি বেতার তরংগের মাধ্যমে এন্টেনা দিয়ে ট্রান্সমিট করে থাকে। পৃথিবী থেকে রিসিভার দিয়ে ঐ তরঙ্গকে রিসিভ করা হয় এবং প্রসেসিং করে তা আমাদের বোধগম্য করে দেখান হয়, মানে ছবি হিসেবে প্রকাশ করে থাকে।
আবার কখনও কখনও এমনও হয়ে থাকে পৃথিবী থেকে পাঠানো কোন তরঙ্গ এন্টেনার মাধ্যমে রিসিভ করে এবং আবার সেটাকে ট্রান্সমিট করে পৃথিবীর দিকে ট্রান্সমিট করা হয়। পৃথিবীতে রিসিভার দিয়ে সেই তরঙ্গকে আবার রিসিভ করা হয়ে থাকে।
স্যাটেলাইট টেলিভিষনে আমরা এভাবেই ডিস এন্টেনা ও সেট টপ বক্সের মাধ্যমে আমরা টিভির অনুষ্ঠান দেখে থাকি।
স্যাটেলাইটের কাজ কি
আশা করি আপনি স্যাটেলাইটের কাজ নিয়ে ইতিমধ্যে একটি ধারণা পেয়ে গেছেন। তারপরেও স্যাটেলাইটের কাজ নিয়ে আরও কিছু তথ্য আপনাদের দিয়ে রাখি। স্যাটেলাইটের প্রথম এবং প্রধান কাজ হচ্ছে বিরামহীনভাবে পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করা এবং মহাকাশের খুটিনাটি সকল তথ্য সংগ্রহ করে তা পৃথিবীতে ফেরত পাঠান।
স্যাটেলাইট কিভাবে পাঠানো হয়
মহাকর্ষ বল নিয়ে আমি আপনাদের আগেই বলেছি। এবারে জানুন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি নিয়ে। নিশ্চয়ই খেয়াল করে দেখেছেন- উপর দিকে কোন বস্তুকে ছুড়ে মারলে তা আবার পৃথিবীতে ফিরে আসে। পৃথিবীর যে শক্তির কারনে এমন ঘটনা ঘটে থাকে তাকেই বলা হয় পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি।
পৃথিবী থেকে স্যাটেলাইট পাঠাতে হলে তাই পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করে তাকে আপনাকে পাঠাতে হবে। এবং এমন উচ্চতায় আপনাকে পাঠাতে হবে যেখানে পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি কাজ করে না। আর সাধারণ বিমানে করে এই কাজ করা সম্ভব না।
স্যাটেলাইট পৃথিবীকে কেন্দ্র করে নিজ কক্ষে ঘুরতে থাকে। কেন্দ্র বিমুখি বল একে বাইরের দিকে গতি প্রদান করে থাকে কিন্তু পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি একে বাইরের দিকে যেতে দেয়না। ফলে এটি একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থায় গতিশীল থাকে এবং পৃথিবীর চারদিকে প্রদক্ষিন করতে থাকে।
পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভেদ করতে হলে আপনাকে যে বেগে উপরের দিকে ছুড়তে হবে তা বিমানের পক্ষে অর্জন করাও অসম্ভব। এই বেগকে বলে মুক্তি বেগ, যা ১১ কিলোমিটার/সেকেন্ড।
রকেটের মাধ্যমে স্যাটেলাইটকে এই গতিতে পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়। জেনে রাখুন সম্পূর্ণ রকেট স্যাটেলাইটের সাথে যায়না। নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রমের পর এর একটি অংশ খুলে পরে এবং তা পৃথিবীতে ফেরত আনা হয়, যা আবার পরে ব্যবহার করা যায়। বাকি অংশ স্যটেলাইটের সাথে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।
পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা স্যাটেলাইটগুলো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতা, গতি ও পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে থাকে। তবে দুটি কমন কক্ষপথ হলো- জিওস্টেশনারী এবং পোলার।
জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইটগুলো বিষুব রেখার উপর দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে পরিভ্রমণ করে থাকে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সমান তাল রেখে এ স্যাটেলাইটগুলো একই দিকে অগ্রসর হয় বলে পৃথিবী থেকে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় জিওস্টেশনারী স্যাটেলাইট একই স্থানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
আবার পোলার স্যাটেলাইটগুলো উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে এক মেরু থেকে আরেক মেরুতে ভ্রমণ করে, পৃথিবী নিচের দিকে ঘোরে বলে এইসব স্যাটেলাইট দিয়ে একই সময়ে পুরো পৃথিবীর চিত্রধারণ সম্ভব হয়। মজার ব্যাপার, তাইনা?
কেন দুইটি স্যাটেলাইটের সংঘর্ষ হয়না
সাধারণত দুইটি স্যাটেলাইটের মধ্যে কখনই সংঘর্ষ হয়না, আশা করি এর কারণ আপনি অলরেডি বুঝে গেছেন। এর কারণ হলঃ পৃথিবী থেকে উৎক্ষেপণ করা স্যাটেলাইটগুলো ভিন্ন ভিন্ন উচ্চতা, গতি ও পথে পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে থাকে। তাই দুইটি স্যাটেলাইটের সংঘর্ষ হবার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। তাছাড়া নাসা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা স্যাটেলাইটের গতিপথের উপর নজর রাখে সবসময়।
তার পরেও এমন ঘটনা যে কখনই ঘটেনি তা কিন্তু নয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে মহাশূণ্যে দুটি আমেরিকান ও রাশিয়ান স্যাটেলাইটের মধ্যে সংঘর্ষ হয় যা মানুষের তৈরি স্যাটেলাইটের মধ্যে প্রথম সংঘর্ষের ঘটনা।
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ নিয়ে কিছু তথ্য
২০১৮ সালের ১২ই মে উৎক্ষেপণ করা হয় আমাদের বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’। সুদূর যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার কেপ ক্যানাভেরাল থেকে সফলভাবে এই স্যাটেলাইটটি উৎক্ষেপণ করা হয়। স্যাটেলাইটটির নামকরণ করা হয় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। এর মাধ্যমে ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণকারী দেশের তালিকায় যোগ হয় বাংলাদেশের নাম।
‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ পাঠানোর মূল উদ্দেশ্য হল সম্প্রচার এবং দেশের দুর্গম অঞ্চলগুলোতে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা করা। প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় যদি ফাইবার অপটিক কিংবা ট্রান্সমিশন লাইন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েও যায় ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর মাধ্যমে বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করা সম্ভব হবে।
‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর আওতায় রয়েছে বাংলাদেশ, বঙ্গোপসাগরে তার জলসীমাসহ ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া অঞ্চল। শুধু দেশি সংস্থাই নয়, য়ামাদের দেশের পাশাপাশি বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশের বিভিন্ন টিভি চ্যানেল বর্তমানে ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ থেকে ট্রান্সপন্ডার ভাড়া নিয়ে ব্যবহার করছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশগুলো হচ্ছে তুরস্ক, হুন্ডুরাস, ক্যামেরুন, ফিলিপাইন, ও দক্ষিণ আফ্রিকা।
বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট ‘বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১’ এর আয়ু ধরা হয়েছে ১৫ বছর। এই সময়কাল পরে এটি আর সার্ভিস দিবে না। বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কম্পানি এটি নিয়ন্ত্রন করে।
আধুনিক জীবনে স্যাটেলাইটের ব্যবহার
এখনকার সময় আধুনিক বিজ্ঞানের যুগ, যোগাযোগের যুগ, তথ্য আদান প্রদানের যুগ। আর স্যটেলাইটের মূল কাজই হল যোগাযোগ করা, তথ্য আদান প্রদান করা। তাই বোঝাই যাচ্ছে আমাদের আধুনিক জীবনে এর ব্যবহার কি অপরিসীম ভূমিকা রাখছে। অন্যতম কিছু ব্যবহার এখানে উল্লেখ করা হলঃ
আবহাওয়ার পূর্বাভাস
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের ছবি তুলে তা থেকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কখন কোথায় ঝড়-বৃষ্টি বা সাইক্লোন হবে তা আগে থেকেই জেনে নিয়ে পদক্ষেপ নেয়া যায়।
রেডিও টিভি সম্প্রচার
স্যাটেলাইটের কারনে রেডিও-টিভির সম্প্রচার সহজ হয়েছে। সাটেলাইট টিভি কোন প্রকার সম্প্রচার কেন্দ্র ছাড়াই সারা বিশ্বে সম্প্রচার করতে পারে।
যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
টেলিকমিউনিকেশন ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এই স্যাটেলাইট ফোনের কারনে। দুর্গম এলাকা থেকেও আপনি চাইলে যোগাযোগ করতে পারবেন। কোন মোবাইল টাওয়ারের দরকারই নাই।
ম্যাপ এবং গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম
জিপিএস ব্যবহার করে, আপনি আজ মুহূর্তেই আপনার অবস্থান জানতে পারছেন। লাইভ ম্যাপ ব্যবহার করতে পারছেন। রাস্তার ট্রাফিক ভলিউম দেখতে পারছেন – এর সবই হচ্ছে এই স্যাটেলাইটের কল্যাণে।
মনিটরিং ব্যবস্থা
স্যাটেলাইট ব্যবহার করে আপনি যেকোন জায়গার ছবি তুলে নিতে পারছেন। চাইলে লাইভ কোন জায়গাও আপনি ঘরে বসেই দেখতে পারবেন। গুগল আর্থ এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ বলা যায়। এমন অনেক জায়গাই আছে পৃথিবীতে যেখানে মানুষের পক্ষে যাওয়াই সম্ভব না, কিন্তু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সেখানকার তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব।
প্রতিরক্ষা কাজে স্যাটেলাইট
প্রতিরক্ষা কাজে স্যাটেলাইট এক যুগান্তকারী অবদান রাখছে। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় এর ভূমিকা অপরিহার্য। তাদের যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও স্যটেলাইট ব্যবহার করা হয়। দেশের ইঞ্চি ইঞ্চি জায়গা তারা পর্যবেক্ষণ করতে পারে স্যাটেলাইট ব্যবহার করে।
মহাকাশের তথ্য সংগ্রহ
মহাকাশের তথ্য সংগ্রহ করে তা পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছে পাঠিয়ে দেয়ার মত সূক্ষ আজ স্যাটেলাইট করে থাকে। পৃথিবীর দিকে কোন গ্রহানু কিংবা এস্ট্রয়েড যদি আসতে থাকে তাহলে তার গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করার কাজ স্যাটেলাইট সূচারুভাবে করতে সক্ষম।
অবশেষে
স্যাটেলাইট কাকে বলে , স্যাটেলাইটের কাজ কি সহ আপনার মনে থাকা অজস্র প্রশ্নের উত্তর আশা করি আপনারা আমাদের এই ব্লগ পড়ে আশা করি জানতে পেরেছেন। ধন্যবাদ সবাইকে।