সাজেক ভ্যালি

নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি বাংলাদেশ। সাজেক ভ্যালি বাংলাদেশের অন্যতম সুন্দর জায়গা । এখানে প্রকৃতি তার রূপ বদলায় ক্ষনে ক্ষনে। সারা বছর মেঘের খেলা চলে এখানে। তাই সাজেককে মেঘের রাজ্য বলা হয়।সাজেক ভ্যালি গেলে মুহূর্তেই মধ্যেই আপনি নিজেকে আবিষ্কার করবেন মেঘের চাদরে ঢাকা।

এখানে থেকে আপনি সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা রাত কখনোই বিরক্ত কিংবা ক্লান্ত হবেন না। তাই পাহাড়, মেঘ, ঝর্নার এক সম্মিলিত সৌন্দর্য উপভোগ করতে একবার হলেও আপনাকে যেতে হবে সাজেক ভ্যালি ।

আপনি যদি ভ্রমণ পিপাসু হয়ে থাকেন তাহলে দেরি না করে, ঘুরে আসুন মেঘের রাজ্য সাজেক। তবে যাওয়ার আগে ধারণা নেওয়া দরকার নিশ্চয়ই! তাই আজকের সাজেক ভ্যালি ভ্রমণের সম্পূর্ণ গাইডলাইন আপনার জন্যই।

আর যদি ঢাকার আশেপাশের যেকোন জায়গা ঘুরে আসতে চান, আমাদের তিন পর্বের লেখা পড়ে দেখতে পারেন। লিংক নিচে দেয়া হলঃ

১। ঢাকার আশেপাশে বেড়ানোর জায়গা- কম সময়ে ঘুরে আসুন। পর্ব -০১

২। ঢাকার আশেপাশে বেড়ানোর জায়গা- কম সময়ে ঘুরে আসুন। পর্ব -০২

৩। ঢাকার আশেপাশে বেড়ানোর জায়গা- কম সময়ে ঘুরে আসুন। পর্ব -০৩

সাজেক ভ্যালি কোথায়?

সাজেক বাংলাদেশের বৃহতম ইউনিয়ন যার আয়তন ৭০২বর্গমাইল। সাজেক ভ্যালি রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে অবস্থিত।এর উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮০০ ফুট। সাজেকে অবস্থিত বিজিবি ক্যাম্প বাংলাদেশের সর্বোচ্চ উচু বিজিবি ক্যাম্প।

সাজেকে মূলত লুসাই ,পাংখোয়া এবং ত্রিপুরা আদিবাসী বসবাস করে । সাজেকের কলা ও কমলা বেশ বিখ্যাত । রাঙামাটির অনেকটা অংশই দেখে যায় সাজেক ভ্যালি থেকে । তাই সাজেক ভ্যালিকে বলা হয় রাঙামাটির ছাদ ।

সাজেক ভ্যালি
সাজেকের নৈসর্গিক দৃশ্য

সাজেক ভ্যালি ভ্রমণের সম্পূর্ণ গাইড লাইন

যেকোনো একটি ট্যুর সুন্দরভাবে শেষ করতে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইডলাইন দরকার । সাজেক ভ্রমনের সম্পুর্ন   গাইডলাইন নিয়ে এলাম। চলুন তাহলে জেনে নেই কখন, কিভাবে সাজেক যাওয়া যায়?

কখন সাজেক ভ্যালি যাবেন

ভ্রমন পিপাসুরা যেকোনো সময়ই সাজেক ভ্যালি যেতে পারেন।সাজেক বর্ষায় একরকম,শীতে একরকম। তবে যেহেতু পাহাড়ি রাস্তা ট্রেকিং রয়েছে সে ক্ষেত্রে বর্ষার সিজন বাদ দেওয়াই ভালো।গরম এড়িয়ে চলাটাও বুদ্ধিমানের কাজ। তাই আপনার সৌন্দর্য উপভোগের জন্য শীতের আগে আগে যাওয়াই ভালো হবে।জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এখানের আকাশে মেঘের পরিমাণ বেশি দেখা যায়।

ঢাকা থেকে কিভাবে যাবেন সাজেক ভ্যালি

সাজেক রাঙ্গামাটি জেলায় হলেও খাগড়াছড়ি থেকে যাওয়া সুবিধা। তবে দীঘিনালা থেকে যেতে সবাই পছন্দ করে। খাগড়াছড়ি জেলা সদর থেকে সাজেকের দূরত্ব প্রায় ৭০ কিলোমিটার । আর দীঘিনালা থেকে প্রায় ৪৯ কিলোমিটার ।

সাজেকে যেতে হলে আপনাকে প্রথমে আসতে হবে খাগড়াছড়ি জেলায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খাগড়াছড়ি আসা যায়।

তবে ঢাকা থেকে শ্যমলী,হানিফ,সৌদিয়া,সেন্ট মার্টিন পরিবহন,এস আলম ইত্যাদি কোম্পানির এসি/নন এসি বাস খাগড়াছড়ি যেয়ে থাকে।নন এসি বাস ভাড়া ৫২০ টাকা।এসি বাসেও যেতে পারেন।

খাগড়াছড়ি শহর বা দিঘীনালা পৌছানোর পর সেখান থেকে আপনাকে লোকাল গাড়ি জিপ বা চান্দের গাড়ি ভাড়া করতে হবে।এ ই গাড়ি আপনাকে সাজেক ভ্যালি নিয়ে যাবে।এক গাড়িতে ১০/১২ জন যাওয়া যায়।

সাজেক ভ্যালি
সাজেকের মেঘমালা

দিঘীনালা থেকে সাজেক ভ্যালি যাতায়াত ভাড়া কত?

  • এক দিনে গিয়ে চলে আসলে ৫ ০০০-৫,৫০০টাকা।
  • এক রাত থেকে পরের দিন আসতে যান তাহলে ভাড়া পরবে ৭০০০-৮০০০ টাকা।
  • দুইরাত থাকলে ভাড়া ১০০০০-১৩০০০ টাকা পরবে।

* ভাড়া কিছুটা হেরফের হতে পারে।

যদি  সংখ্যায় মানুষ কম হয় তাহলে সি এন জি নিয়ে যেতে পারেন। ভাড়া পরবে ৪০০০-৫০০০ টাকা।

আরো কম খরচে যদি যেতে চান খাগড়াছড়ি থেকে দিঘীনালা গিয়ে সেখান থেকে মোটরসাইকেল ভাড়া করে সাজেক যেতে পারেন। ভাড়া পরবে ১০০০/১২০০ টাকা।

আপনি চাইলে প্রাইভেট কার/মোটরসাইকেল নিয়েও যেতে পারেন।

সাজেক ভ্যালি গিয়ে কি কি করবেন?

সাজেক গিয়ে কি করবেন এটা সসম্পুর্নই আপনার ইচ্ছে। আমি আপনাকে সামান্য ধারনা দিয়ে দিচ্ছি এখানে মাত্র।যদি আপনি সকালের এসকোর্টে যেতে পারেন রুইলুই পাড়া হয়ে ১২টা ১২:৩০ টার মধ্যেই পৌছে যাবেন সাজেক ভ্যালিতে, বেড়িয়ে পরবেন চারপাশের সৌন্দর্য দেখতে।

পড়ন্ত বিকেলে সূর্যাস্ত দেখতে চলে যেতে পারেন হ্যালিপ্যাডে। রাতে সেখানে আড্ডা দেওয়া আপনার ভ্রমনে যোগ করবে ভিন্ন মাত্রা।

সাজেকের প্রধান আকর্ষন মেঘ। মেঘ দেখতে হলে আপনাকে একটু সকালে ঘুম থেকে উঠতে হবে। চাইলে আপনি আপনার কটেজের বারান্দায় বসেই উপভোগ করতে পারেন মেঘের খেলা। হ্যলিপ্যাডে গিয়েও উপভোগ করতে পারেন সকালের অপরূপ দৃশ্য।

সাজেকের সর্বশেষ পাড়া কংলাক পাড়া।সেটি কংলাক পাহাড়ে অবস্থিত।এখানে প্রধানত লুসাই জনোগোষ্ঠী বসবাস করে থাকে।সাজেকে যাবেন আর কংলাক পাহাড়রে যাবেন না তাতো হয় না।কংলাক থেকে দেখা যায় কর্নফুলী নদীর উৎপত্তিস্থল লুসাই পাহাড়।

সাজেক ভ্যালি এর আরেকটি ভ্রমনের জায়গা কমলাক ঝর্না বা পিদাম তৈসা বা সিকাম তৈসা ঝর্না।রুইলুই পাড়া থেকে দুই আড়াই ঘন্টা ট্রেকিং করে দেখে আসতে পারেন এই ঝর্না।

সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে গাড়িবহর দ্বারা পর্যটকদের গাড়িগুলোকে নিরাপত্তার সাথে সাজেক পৌছে দেয়া হয়, একে আর্মি এসকর্ট বলা হয় ।

সেনাবাহিনীর এসকোর্ট কখন শুরু হয়

দিঘীনালা থেকে সেনাবাহিনীর এস্কোর্ট শুরু হয়। প্রতিদিন ২ টি এসকোর্ট পরিচালনা করা হয়।

  • প্রথমটি সকাল ১০ টায়।
  • দ্বিতীয়টি বিকাল ৩ টায় সাজেকে গিয়ে থাকে।

সাজেক ভ্যালি ঘুরতে গেলে কোথায় থাকবেন

সাজেক ভ্যালি থাকার জন্য বেশ কিছু রিসোর্ট এবং আদিবাসীদের কটেজ রয়েছে। তবে এখন অনেক রিসোর্ট থাকার কারনে থাকা নিয়ে তেমন সমস্যা হয় না।

সাজেক ভ্যালি এর কিছু রিসোর্ট ও কটেজ

সাজেক রিসোর্ট

এটি সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি রিসোর্ট। ভাড়া ১০,০০০ থেকে ১৫,০০০ হতে পারে। তবে সেনাবাহিনীতে কর্মরত বা প্রথম শ্রেনীর  সরকারী কর্মচারীদের জন্য ডিসকাউন্ট রয়েছে। যোগাযোগঃ ০১৮৪৭০৭০৩৯৫

মেঘপুঞ্জি রিসোর্ট

সুন্দর ডেকোরেশন এবং আকর্ষনীয় ল্যান্ডস্কেপিক ভিউ এর জন্য এটি বেশ জনপ্রিয় একটি রিসোর্ট। এটিতে মোট ৪ টি কটেজ রয়েছে।

  • তারাশা – ৪৫০০ টাকা
  • পূর্বাশা – ৪০০০ টাকা
  • রোদেলা – ৪০০০ টাকা
  • মেঘলা – ৪০০০ টাকা
মেঘ মাচাং রিসোর্ট

এটি নিরিবিলি পরিবেশ আর এটির বারান্দার জন্য বেশ জনপ্রিয়।

  • বন্ধের দিন ছাড়া ব্যাম্বু কটেজে অন্যান্য দিন ৩৫০০ টাকা,
  • উডেন কটেজ ৪০০০ টাকা।বন্ধের দিন গুলোতে ৪০০০ এবং ৪৫০০ টাকা। বুকিং 01822168877 নাম্বারে।
অবকাশ হোটেল

৩ তালা একটি রিসোর্ট। এটি শুরুর দিকের এক মটি রিসোর্ট।কাঠের তৈরি বেশ সুন্দর একটি রিসোর্ট। ৩ তলার খোলা বিশাল বারান্দা থেকে ভালো ভিউ পাওয়া যায়।

  • নিচতলা – ২৫০০ টাকা,
  • দোতলা – ৩০০০ টাকা,
  • তিনতলা – ৩০০০ টাকা

এছাড়াও রয়েছে চান্দের বাড়ি রিসোর্ট, রুম্মন রিসোর্ট, জুম ঘড় ইকো রিসোর্ট,লুসাই রিসোর্ট,  মেঘাদ্রি ইকো রিসোর্ট ইত্যাদি। প্রায় রিসোর্ট এর ইনফরমেশন তাদের ফেজবুক পেইজে পেয়ে যাবেন।

সাজেক ভ্যালি গেলে কি খাবেন এবং খাওয়ার খরচ কেমন

এখানে সবকটি রিসোর্টেই খাবারের ব্যবস্থা আছে।আপনি চাইলে পছন্দ মতো খাবার বানিয়ে দিবে।ভাত, আলু ভর্তা ডাল মুরগি খেলে প্রতি জনে খরচ হবে ১৫০-২৫০ টাকা।চাইলে রাতে বার বি কিউ করতে পারেন। প্রতি পিস মুরগি ২০০-২৫০ টাকা।

সাজেক ভ্যালি যাবেন আর সেখানের লোকাল খাবার টেস্ট করবেন না তা হয় নাকি?

সাজেক ভ্যালি তে বিখ্যাত খাবার ব্যাম্বু বিরিয়ানি এবং ব্যাম্বু চিকেন ট্রাই করতে পারেন।দাম পরবে ৫০০-৮০০ টাকা। সাজেকের মাস্ট ট্রাই ব্যাম্বু টি/চা।

সাজেক এ বেশ কিছু বিখ্যাত রেস্টুরেন্ট

  • মনটানা
  • মারুতি
  • ফুডানকি
  • চিম্বাল ইত্যাদি
সাজেক ভ্যালি
সাজেকের সূর্যাস্তের মনোরম দৃশ্য

সাজেক এর দর্শনীয় স্থান

সাজেক ট্যুর প্লানে আপনি ঘুরে আসতে পারেন খাগড়াছড়ি শহরের আশেপাশের কয়েকটি জায়গায়।যেমনঃ

রিসাং ঝর্না

খাগরাছড়ি শহর থেকে এর দূরত্ব  প্রায় ১০ কিমি।উচ্চতা ১০০ ফুট।১০০ ফুট উপর থেকে পানি গড়িয়ে পারায় প্রাকৃতিক ওয়াটার স্লাইডিং তৈরি হয়েছে।

আলুটিলা গুহা

এটির ভেতরে কোনো প্রকার সূর্যের আলো পৌছায় না তাই মশাল বা টর্চ নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়। গুহাটি কিছুটা টানেলের মতো এক পাশ নিয়ে ঢুকে অন্য পাশ দিয়ে বের হতে ১০-১৫ মিনিট সময় লাগে।

এছাড়া ঘুড়ে আসতে পারেন,

  • সিস্টেম রেস্তোরা
  • পর্যটন মোটেল
  • হাজাছড়া ঝর্ণা
  • ঝুলন্ত ব্রিজ
  • দিঘীনালা বনবিহার
  • তৈদুছড়া ঝর্ণা
  • সিজুক ঝর্ণা
  • তারেং ইত্যাদি।

সাজেক ভ্যালি ঘুরতে যাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু জরুরী পরামর্শ

  • চান্দের গাড়ির ছাদে উঠবেন না।
  • বাঘাইহাট ক্যাম্পে ছবি তুলবেন না।
  • পাহাড়িদের ছবি তুলতে হলে অবশ্যই তাদের অনুমতি নিবেন।
  • ট্রাকিং এর অভিজ্ঞতা না থাকলে কমলান ঝর্নায় যাবেন না
  • রিসাং ঝর্নায় স্লাইডিং এর সময় সাবধানে থাকবেন।
  • সাথে প্রয়োজনীয় পানি,স্যালাইন,ওষুধ নিয়ে নিবেন।
  • অবশ্যই সাথে রবি,এয়ারটেল সিম রাখবেন।

আপনার মত ভ্রমণ পিপাসুদের জন্যই ছিল সাজেক ভ্যালি ভ্রমণের সম্পূর্ণ গাইডলাইন। তাই আর দেরি কিসের? এখনই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করুন, আর ঘুরে আসুন মেঘের রাজ্য সাজেক ভ্যালি থেকে।

Previous articleসুয়েজ খাল কোথায় অবস্থিত ?
Next articleওয়াইফাই কি এবং কিভাবে কাজ করে?