ষ্টুডিও জিবলী

এনিমেশন তো সকলের কাছে খুব পরিচিত শব্দ – এনিমেটেড টিভি সিরিজ বলুন, কিংবা সিনেমা। সেই সূত্রে “এনিমে” নামটার সাথেও জানাশোনা আছে এমন মানুষ কম নয়! এনিমে হলো এনিমেশনেরই একটি শাখা, যেটি শুধুমাত্র জাপানের এনিমেটেড টিভি সিরিজ কিংবা সিনেমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এই শাখাটিতে জাপানিজরা যে কতোটা সিদ্ধহস্ত তা আমরা যারা ছোটবেলায় বুঝে কিংবা না বুঝে টিভিতে “সামুরাই এক্স” সিরিজটি দেখতাম তারা সবাই জানি। বড় হবার পর বোঝার পরিধি, জানার পরিধি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিচয় হয়েছে জাপানের সেরা এনিমেটেড কাজগুলোর সঙ্গে। বিনোদন জগতের এই শাখাটিতে সবচেয়ে দৃপ্ত পদচারণা তাদেরই। তবে আজ “এনিমে” বা টিভি সিরিজগুলো নিয়ে নয়, কথা হবে এনিমে মুভি – কিংবা নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে ষ্টুডিও জিবলী (Studio Ghibli) নিয়ে।

ষ্টুডিও জিবলী (Studio Ghibli) সৃষ্টির ইতিহাস

জাপানিজ এনিমে মুভির জগতে এক ঐতিহাসিক নাম ষ্টুডিও জিবলী (Studio Ghibli), ১৯৮৫ সাল থেকে যাত্রা শুরু করে তারা আজ পর্যন্ত বহু অসাধারণ সৃষ্টি দর্শকদের সামনে উপহার দিয়ে পৌঁছে গেছে কিংবদন্তীর পর্যায়ে। ষ্টুডিও জিবলির নাম উচ্চারণ করলে পাশাপাশি বলতে হয় হায়াও মিয়াজাকির কথা। প্রতিষ্ঠার সময়ে হায়াও মিয়াজাকির সাথে আরো কয়েকজন থাকলেও তার নামটা শোনা যায় বেশি, কেননা এই ষ্টুডিও থেকে বানানো সিনেমাগুলোর অধিকাংশ হায়াও মিয়াজাকিরই তৈরি।

ইদানীংকালে ষ্টুডিও জিবলী তৈরিকৃত সিনেমার মধ্যে প্রায়শ ভুলবশত যেই সিনেমাটির কথা শোনা যায় সেটি হলো “Nausicaa Of The Valley Of The Wind“। আদতে এটি ষ্টুডিও জিবলীর সিনেমা নয়, কিন্তু ষ্টুডিও প্রতিষ্ঠার পেছনে এর রয়েছে বড়সড় ভূমিকা। জিবলী শুরু হবার অনেক আগে থেকেই হায়াও মিয়াজাকি এবং তার সহকর্মীরা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন, বিভিন্ন সময়ে তারা একত্রেও কাজ করেছেন। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়া “Nausicaa Of The Valley Of The Wind” তাদের সাহস ও অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল ষ্টুডিও জিবলী দাঁড় করানোতে।

এই সিনেমার প্রোডাকশন টিমে ছিলেন প্রতিষ্ঠাতাদের একজন – তোশিও সুজুকি। হায়াও মিয়াজাকি এবং তার আহ্বানে যোগদান করেন ইসাও তাকাহাতা, অতঃপর তিনজনের প্রচেষ্টায় সূচনা হয় ষ্টুডিও জিবলীর। “জিবলী” নামটির পেছনে রহস্য কি? জিবলী শব্দটি এসেছে মূলত ইতালিয়ান ভাষা থেকে, সার অর্থ দাঁড়ায় মরুভূমির উষ্ণ বাতাস। ফিল্ম ষ্টুডিওটি শুরু করবার এবং নামকরণের সময়ে হায়াও মিয়াজাকি স্বপ্ন দেখেছিলেন এনিমেশন জগতে নতুন হাওয়া বয়ে আনবে তার ষ্টুডিও । সেটি সফল হয়েছে খুব ভালোভাবেই, কেবল বাতাস নয় – যেন ঝড়ের মতো শক্তিশালীভাবে নিজের উপস্থিতি বারবার প্রমাণ করে গিয়েছে জিবলীর সিনেমাগুলো।

ষ্টুডিও জিবলীর অনন্য বৈশিষ্ট

অন্যান্য এনিমেশন কিংবা ষ্টুডিওর সাথে জিবলীর কাজের পার্থক্য কোথায়? কেন বিশেষভাবে কথা হচ্ছে এটি নিয়ে? প্রথমত, এনিমেশনের ধরণ – বা আর্ট স্টাইল যেটাই বলুন৷ দুই একটি জিবলী সিনেমা দেখার পরই আপনি ধরে ফেলতে পারবেন আসলে আবেদনটা কোথায়। তাদের এনিমেশনগুলো দেখতে অত্যন্ত চমকপ্রদ – প্রতিটি দৃশ্য চোখে যেন শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। যতক্ষণ স্ক্রিনে চোখ থাকবে, চারপাশে একটি আলাদা আবেশ অনুভব করবেন। আর খুবই কালারফুল হওয়ায় দেখতে আরো ভালো লাগে। অধিকাংশ সিনেমার কাহিনী হয় জীবনধর্মী, ছোট শহরের নির্ঝঞ্ঝাট জীবনের একটি অংশ যেন তুলে এনে নিখুঁতভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলা হয়। তাছাড়া তাদের সিনেমার গল্পগুলোও হয় সকলের চেয়ে আলাদা রকম।

তাদের ব্যতিক্রমী আর্টের ধরণের জন্য পৃথিবী জুড়ে বহু শিল্পী নিজের অনুপ্রেরণা হিসেবে ধরে নেন ষ্টুডিও জিবলী। মনোরম দৃশ্যগুলো রঙ তুলির আঁচড়ে ক্যানভাসে ফুটিয়ে তোলা বহু শিল্পীর প্রিয় সময়যাপন।

ষ্টুডিও জিবলীর যত সিনেমা

ষ্টুডিও জিবলীর প্রথম সিনেমা ছিল “Laputa : Castle In The Sky“, যেটি মুক্তি পায় ১৯৮৬ সালে। “Nausicaa Of The Valley Of The Wind” এ যেসব লোকজন কাজ করেছিলেন, তাদের সাথে মিলেই এটি তৈরি করেন মিয়াজাকি৷ তার এই সিনেমার পেছনে উৎসাহ হিসেবে কাজ করেছে গ্রীক আর্কিটেকচার, এবং তার ওয়েলশ ভ্রমণের সময় খনি শ্রমিকদের কাজ স্বচক্ষে দেখার অভিজ্ঞতা। মুক্তি পাবার পর পর সিনেমাটি জাপানের সব জায়গায় বহুল প্রশংসা অর্জন করে।

১৯৮৮ সালে একসাথে দু’টো সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল জিবলী থেকে। সে সময় তারা কিছুটা অর্থনৈতিক টানাপোড়েনে ভুগছিলেন। দু’টি সিনেমার একটি ছিল “My Neighbor Totoro“, যেটি বানানো হয়েছিল আধুনিক বিশ্ব বা প্রযুক্তি প্রকৃতির উপর কি খারাপ প্রভাব ফেলছে তার উপর নির্ভর করে। জটিল বিষয় খুব সহজভাবে এবং আগ্রহ উদ্রেক করার মত উপস্থাপন করায় মিয়াজাকির জুড়ি নেই। অন্য সিনেমাটি ছিল “Grave Of The Fireflies“, এই সিনেমা কেবল জাপানিজ এনিমেশন নয় – আন্তর্জাতিকভাবে সবচেয়ে বেশি সমাদৃত কাজের একটি। এটি তৈরি হয়েছিল ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত আকিওকি নোসাকার আত্মজীবনীমূলক ছোট গল্পের আলোকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগের সময়ে দুই ভাইবোনের বেঁচে থাকার তীব্র সংগ্রামের কাহিনী এটি।

হৃদয়স্পর্শী এবং দর্শক ধরে রাখার মত গল্প হবার কারণে লেখকের কাছে অসংখ্য প্রস্তাব গিয়েছিল ছোট গল্পটি থেকে লাইভ একশন ফিল্ম বানানোর। কিন্তু তিনি সেগুলোতে রাজি হচ্ছিলেন না – তার বক্তব্য ছিল সেই বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিবেশ পরিস্থিতি কখনো কৃত্রিমভাবে তৈরি করে উপস্থাপন করা সম্ভব না। যখন তার কাছে জিবলীর পক্ষ থেকে এনিমেটেড সিনেমার প্রস্তাব পাঠানো হয় – তিনি কিছুটা অবাক ও দ্বিধান্বিত হন, কিন্তু সম্মতিও জানান। তার অনুমতি পাবার পর কাজ শুরু হয় সিনেমার। পরবর্তীতে আকিওকি নোসাকা স্বীকার করতে বাধ্য হন এনিমে মুভিটিতে কতোটা জীবন্তভাবে ফুটে উঠেছে তার লিখিত কাহিনী। লাইভ একশনের দ্বারা যেটি সম্ভবপর হতো না।

এরপরের বছরে মুক্তি পায় আরেকটি দারুন সৃষ্টি “Kiki’s Delivery Service“। প্রথমে অন্য কারো দ্বারা পরিচালিত হবার কথা থাকলেও শেষমেশ এই সিনেমা এসেছিল হায়াও মিয়াজাকির হাত ধরেই। ১৯৮৫ সালে প্রকাশিত ইকো কাদোনোর উপন্যাস থেকে নেয়া হয়েছিল এর গল্প, তবে সিনেমাতে বহুল পরিবর্তন আনা হয় মূল গল্পটি থেকে। জিবলীর পরবর্তী কাজ “Only Yesterday“। গ্রামীণ সহজসরল জীবনযাপন আর শৈশবের সুমধুর স্মৃতি নিয়ে বানানো সিনেমাটি মন ভালো করে দিতে পারে দর্শকের। ১৯৮২ সালে প্রকাশিত একটি মাঙ্গা থেকে এই সিনেমা তৈরি হয়।

Only Yesterday” রিলিজ পাবার পরের চার বছরে টানা চারটি সিনেমা আসে ষ্টুডিও জিবলী – তার মধ্যে “Porco Rosso” এবং “Whisper Of The Heart” এই দু’টির পরিচালক ছিলেন হায়াও মিয়াজাকি। “Porco Rosso” একটি রম্যরসপূর্ণ এডভেঞ্চার সিনেমা, অন্যদিকে “Whisper Of The Heart” রোমান্স ঘরানার। বাকি দু’টি হলো – “Ocean Waves” এবং “Pom Poko“। ১৯৯৭ সালেই আসে মিয়াজাকির নতুন সিনেমা “Princess Mononoke“। এপিক ফ্যান্টাসি ঘরানার প্রিন্সেস মনোনকি জিবলীর সবচেয়ে প্রিয় নামগুলোর মধ্যে একটি, আর জিবলীর সেরা সিনেমার মধ্যে উপরদিকে স্থান করে নেয় আজও।

১৯৯৯ সালে মুক্তি পায় ইসাও তাকাহাতার “My Neighbors The Yamadas” আর পরের বছর মিয়াজাকির “Spirited Away”। খেয়াল করলে দেখা যায়, ষ্টুডিও জিবলীর অন্যান্য পরিচালকদের তুলনায় মিয়াজাকির কাজগুলো বেশি পরিচিত আর সমাদৃত। কেননা তার সিনেমায় রয়েছে আলাদা ধরণের বৈচিত্র‍্য, গভীর অর্থপূর্ণতা।

Whisper Of The Heart” সিনেমাটির স্পিন-অফ “The Cat Returns” মুক্তি পায় ২০০২ সালে। এরপর ২০১৩ সাল পর্যন্ত যে মুভিগুলো হয়েছে তার প্রায় সবগুলোতে পরিচালক হিসেবে ছিলেন মিয়াজাকি। এগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা খ্যাতি পেয়েছিল “Ponyo” ও “Arietty“। তাছাড়া “Howl’s Moving Castle” ও পেয়েছিল ব্যাপক প্রশংসা। তুলনামূলকভাবে বিষয়বস্তুর কারণে “Tales From Earthsea” অতোটা গ্রহণযোগ্যতা পায় নি। শেষের দিকে তৈরিকৃত “From Up On Poppy Hill“, “The Wind Rises” দু’টিই অসম্ভব চমৎকার সিনেমা।

২০১৩ সালের একটি ব্লাস্ট বলা চলে ইসাও তাকাহাতার “The Tale Of The Princess Kaguya“-কে। এর পরবর্তী বছরে হওয়া “When Marnie Was There“-ও জিবলী ভক্তদের পছন্দের তালিকায় উজ্জ্বল নাম।

বর্তমানে ষ্টুডিও জিবলী

২০১৪ সালের আগস্ট মাসে তোশিও সুজুকির পক্ষ থেকে জানানো হয় হায়াও মিয়াজাকির অবসরগ্রহণের কারণে জিবলীর কাজকর্ম অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য স্থগিত রাখার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ষ্টুডিওর ভবিষ্যত নিয়ে বেশকিছু সময়ের জন্য শঙ্কা দেখা দিয়েছিল। তবে ২০১৭ সালে নতুন আশার সংবাদ জানানো হয় – হায়াও মিয়াজাকি অবসর থেকে ফিরে এসে ষ্টুডিও জিবলীর সাথে নতুন ফিচার ফিল্মের কাজ করবেন। শেষ খবর অনুযায়ী “Earwig And The Witch” নামে  নতুন সিনেমার কাজ চলছে – যার পরিচালক হায়াও মিয়াজাকির ছেলে গোরো মিয়াজাকি এবং মিয়াজাকি নিজে। এছাড়া ১৯৩৭ সালের এক উপন্যাসের উপর নির্ভর করে মিয়াজাকির আরেকটি সিনেমা আসবে যার নাম “How Do You Live?

ষ্টুডিও জিবলী এর ইতিহাস ও সিনেমা নিয়ে আলাপ আজ এতোটুকুই। পরবর্তীতে বিস্তারিত রিভিউ নিয়ে আসবো আবার কোনো একদিন।

Previous articleকালোজিরার ঔষুধি গুণাগুণ – এক বিস্ময়কর শক্তি
Next articleপ্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণ ও ফলাফল নিয়ে বিশ্লেষণধর্মী লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here