পারমাণবিক বিদ্যুৎ

আধুনিক বিশ্বে বিদ্যুৎ ছাড়া আমরা এক মুহূর্ত চিন্তা করতে পারিনা। যত দিন যাচ্ছে, বিদ্যুতের ব্যবহার এবং চাহিদার পরিমান যেন বেড়েই চলেছে। আর এই  বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক আধুনিক প্রক্রিয়া হল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে তেজস্ক্রিয়তার ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কোন তেজস্ক্রিয় পদার্থকে (যেমন ইউরেনিয়াম-২৩৫) যদি নিউট্রন ( ইউরেনিয়ামের একটি আইসোটোপ) দ্বারা আঘাত করা হয় তখন তেজস্ক্রিয় পদার্থে চেইন রিয়্যাকশন (Nuclear Chain Reaction) শুরু হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলে ফিউসন (Fusion)। এই চেইন রিয়্যাকশনের ফলে প্রচুর তাপ উৎপাদন হয় যা পানি ফুটাতে ব্যবহার করা হয়। ফুটন্ত পানির বাস্পের মাধ্যমে টারবাইন ঘুড়ানো করা হয় এবং টারবাইনের ঘূর্ণন শক্তি থেকেই বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তর করা হয়।

কিছুটা বলে রাখি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘূর্ণন শক্তিকে বিদ্যুৎ শক্তিতে রুপান্তরের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়। যেমনঃ পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানির প্রবাহ থেকে টারবাইন ঘুরানো হয়, বায়ুবিদ্যুৎ বা উইন্ডমিলে বাতাসের মাধ্যমে বিদ্যুৎ টারবাইন ঘুরানো হয়।

পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সেরা দশটি দেশ

আগেই বলেছি ৩২টি দেশ পারমানবিক চুল্লি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করলেও সেরা দশটি দেশ যারা পারমানবিক চুল্লি ব্যবহার করে সবচেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন তাদের ক্যাপাসিটি সহ নিচে দেয়া হলঃ

১০। সুইডেন (Sweden)

সুইডেন তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৩৪% বিদ্যুৎ পারমানবিক চুল্লি থেকে উৎপাদন করে থাকে। সুইডেনের মোট ৭টি পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। আর চারটি পুরানো চুল্লি বন্ধ করে দিয়েছে।

সুইডেন আর নতুন কোন চুল্লি নির্মাণ করবেনা। কারণ সুডেনের Environment Code 2018 অনুযায়ি ইউরেনিয়াম খনি থেকে ইউরেনিয়াম উত্তলোন বন্ধ করা হয় পরিবেশগত কারণে। এখন সুডেনের সকল পারমানবিক চুল্লি চলছে ইউরেনিয়াম আমদানি করে।

সুইডেনের নেট ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ৭.৭ গিগাওয়াট।

০৯। ইউনাইটেড কিংডোম (UK)

ইউকে তার বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৫.৬% বিদ্যুৎ পারমানবিক চুল্লি থেকে উৎপাদন করে থাকে। মোট ১৫টি পারমানবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এই মুহূর্তে চালু রয়েছে। ২০৩৫ সালে এর অর্ধেক চুল্লির মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।

ইউকে এর নেট ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ৮.৯ গিগাওয়াট। ৩.৩ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটির দুইটি পারমানবিক চুল্লির কাজ চলমান রয়েছে যা চালু হলে মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৭% এখান থেকেই পাওয়া যাবে। এছাড়াও আরও নতুন নতুন পারমানবিক চুল্লি স্থাপনের ব্যাপারেও তাদের আগ্রহ রয়েছে।

০৮। ইউক্রেন (Ukraine)

ইউক্রেনেরও ১৫টি পারমানবিক চুল্লি চালু রয়েছে যার ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ১৩.১ গিগাওয়াট। এছাড়াও আরও দুইটি চুল্লি স্থাপনের কাজ চলছে যা চালু হলে ২ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটি বাড়বে।

দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার ৫৩.৯% বিদ্যুৎ ইউক্রেন উৎপাদন করে পারমানবিক চুল্লি থেকে।

ইউক্রেন তার ইউরেনিয়াম আমদানি করে রাশিয়া থেকে এবং প্রায় সব ধরনের সার্ভিস রাশিয়াই দিয়ে থাকে।

০৭। কানাডা (Canada)

চারটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে কানাডার যাতে চালু আছে ১৯টি চুল্লি। ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ১৩.৬ গিগাওয়াট। মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৪.৯% বিদ্যুৎ কানাডা উৎপাদন করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে।

০৬। সাউথ কোরিয়া

সাউথ কোরিয়ার রয়েছে ২৪টি পারমানবিক চুল্লি যার ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ২৩.২ গিগাওয়াট। বেশিরভাগ চুল্লিগুলোই দেশের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত।

সাউথ কোরিয়া তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ২৬ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমানবিক চুল্লি থেকে। আরও চারটি পারমানবিক চুল্লি স্থাপনের কাজ চলমান আছে যা সম্পন্ন হলে ৫.৩ গিগাওয়াট নেট ক্যাপাসিটি বাড়বে।

০৫। রাশিয়া

রাশিয়ার রয়েছে মোট ৩৮টি পারমানবিক চুল্লি যার নেট ক্যাপাসিটি ২৭.৮ গিগাওয়াট এবং আরও দুইটি চুল্লি স্থাপনের কাজ চলছে যা সম্পন্ন হলে আরও ২.৩ গিগাওয়াট নেট ক্যাপাসিটি বাড়বে।

রাশিয়া তার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ১৯.৭% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমানবিক চুল্লি থেকে। বিশ্বে রাশিয়াই প্রথম দেশ যারা প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ চুল্লি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে।

৪। জাপান

জাপানের রয়েছে মোট ৩৩টি পারমানবিক চুল্লি যার নেট ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি ৩২ গিগাওয়াট। এছাড়াও আরও দুইটি চুল্লির কাজ চলছে যা চালু হলে আরও ২.৬ গিগাওয়াট ক্যাপাসিটি বাড়বে।

২০১১ সালের ফুকুসিমা দুর্ঘটনার আগে দেশের মোট চাহিদার ৩০% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হত পারমানবিক চুল্লি থেকে এবং জাপান ছিল ইউএসএ এবং ফ্রান্সের পরে তৃতীয় অবস্থানে। দুর্ঘটনার পর সকল পারমানবিক কেন্দ্র থেকে নিউক্লিয়ার চুল্লি সরিয়ে ফেলা হয় এবং দুই বছর উৎপাদন বন্ধ থাকে।

৩। চীন

৪৭.৫ গিগাওয়াট নেট ইন্সটল্ড ক্যাপাসিটি নিয়ে চীন এই তালিকায় তৃতীয় অবস্থানে আছে। মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ৫% বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় পারমাণবিক চুল্লি থেকে ২০১৯ সালে যা এই বছর ১৮% এ উন্নিত হবে এই বছর।

চীনে এখন পর্যন্ত ৪৯টি রিয়াক্টর চালু আছে এবং ১৬টি চুল্লির কাজ চালু হবার অপেক্ষায় আছে। যা চালু হলে নেট ক্যাপাসিটি বাড়বে ১৫.৯ গিগাওয়াট।

কয়লা দিয়ে চালিত পাওয়ার প্লান্টগুলো পরিবেশ দূষনের জন্য দায়ি হওয়ায় চায়না ধীরে ধীরে তাপ বিদ্যুৎ থেকে সরে আসছে এবং পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাড়চ্ছে।

২। ফ্রান্স

ফ্রান্সের চালু রয়েছে ৫৮টি পারমাণবিক চুল্লি এবং নেট ক্যাপাসিটি ৬৩.১ গিগাওয়াট। এছাড়া আরও একটি চুল্লি স্থাপনের কাজ চলছে।

ফ্রান্স তার চাহিদার ৮০% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পারমানবিক চুল্লি থেকে। পুরানো দুইটি চুল্লির ইউনিট Fessenheim-১ এবং Fessenheim-২ বন্ধ ঘোষনা করা হয় ২০২০ সালে পরিবেশ দূষন জনিত কারণে।

এখন নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে ফ্রান্স বেশি জোড় দিচ্ছে। ২০৩৫ সাল নাগাত ফ্রান্স ৫০% বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে নবায়নযোগ্য শক্তি থেকে।

১। ইউনাইটেড স্টেট অব আমেরিকা

আমেরিকা পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রথম স্থান দখল করে আছে। ৯৬ টি পারমানবিক চুল্লি থেক মোট ৯৮.২ গিগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে আমেরিকা।

সারা বিশ্বের মোট পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের  ৩০% এর বেশি আসে আমেরিকার পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। নতুন দুইটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হবার পথে আর পুরান ২টি চুল্লি বন্ধ হয়ে যায় ২০২০ সালে যার ক্যাপাসিটি ছিল ১.৫ গিগাওয়াট।

বিদ্যুতের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাওয়ায়, অনেক নতুন দেশই তাপ বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে সরে এসেছে। পারমানবিক চুল্লির ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। বাংলাদেশেও রুপপুরে ২,১৬০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে যার প্রথম ইউনিটটি ২০২৩ সালে প্রোডাকশন শুরু করবে। রুপপুরের এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রাশিয়ার রোসাটোম স্টেট অ্যাটমিক এনার্জি কর্পোরেশন নামের একটি কোম্পানি নির্মাণ করছে।

Previous articleপানামা খাল – জাহাজকে পাহাড়ে তোলার ইতিহাস
Next articleকীভাবে বুঝবেন যে আপনার ওয়াইফাই হ্যাক হয়েছে কিনা?
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।