নিষিদ্ধ বই-০২

 

সুপ্রাচীন সময় থেকে যেমন বই প্রকাশ হয়ে আসছে, তেমনি একদল লোক বারংবার কিছু বইকে রাখতে চেয়েছেন সাধারণ পাঠকসমাজের নাগালের বাইরে।  আর তারই প্রেক্ষিতে উৎপত্তি বইকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার।   প্রতি বছর ALA (American Library Association) যেসব বইয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ হয়েছে তার তালিকা করে এবং তার  নিষেধাজ্ঞা হটানোর জন্য অনুযোগ করে থাকে।  যদিও ALA এর মতে তাদের পক্ষে সব বইয়ের হয়ে এডভোক্যাসি করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না ।  কোনো স্কুল বা লাইব্রেরি থেকে কোনো বই সরানোর পেছনেও থাকে বিভিন্ন কারণ।

রাজনৈতিক, ধর্মীয় কারণ বা বলুন গতানুগতিক সমাজ ব্যবস্থাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখানো বা নেহাতই অশ্লীলতা, নানাবিদ কারণে বইকে হতে হয় নিষিদ্ধ। যদিও এই প্রথাটি ব্যাপকভাবে নিন্দিত কিন্তু তার প্রসার কিন্ত কম না মোটেও।  Judy Blume, যার লেখা প্রচুর নিষেধাজ্ঞার শিকার হয় একসময় বলেছিলেন, “Something will be offensive to someone in every book, so you’ve got to fight it.” অর্থাৎ  “প্রতিটা বই কাউকে না কাউকে অখুশি করবে,  তো লড়ে যেতে হবে! ” তো যদি আপনিও মুক্তচিন্তা চর্চায় বিশ্বাসী হোন বা মানবজীবনে ঘটে যাওয়া অন্ধকার ও কুৎসিত সত্যকে সামনা করার মনোবল যদি আপনার থাকে তবে এই বইগুলো আপনার জন্যেই।

সব নিষিদ্ধ বই মন্দ হয় না। সব নিষিদ্ধ বই ভালোও হয় না।  আবার সব নিষিদ্ধ বইয়ের লেখক সাহসীও হন না।  কিন্তু কিছু কিছু লেখক আছেন যারা প্রচুর সাহসী  হোন, যাদের লেখায় ওজন থাকে,  যারা স্রোতের বিপরীতে ছুটে চলে, যারা সমাজকে তার কুৎসিত চেহারা দেখিয়ে দেয়, তাদের উপর্যুক্ত  সম্মান দেয়াটা প্রতিটা পাঠকের দায়িত্ব।  আর সেই দায়ভার থেকেই নিষিদ্ধ বই নিয়ে লেখার আমার পথচলা শুরু হয় “নিষিদ্ধ বই : যা না পড়লেই নয় ” পর্ব – ১ দিয়ে।  পড়ে নিতে পারেন আর্টিকেলটি।  তারই ধারাবাহিকতায় আজ হাজির হয়েছি নিয়ে আরো এক ঝাপি নিষিদ্ধ বই, যেগুলো না পড়লেই নয়!

যারা নিষিদ্ধ বইঃ যেগুলো না পড়লেই নয় (পর্ব-০১) পড়েননি তারা পড়ে আসুন।

★ Harry Potter series, By J.K. Rowling (1997)

Harry Potter series, By J.K. Rowling (1997)

হ্যারি পটারের নাম শোনেনি এমন মানুষ পাওয়া বিরল।  স্মরণকালের সর্বাধিক জনপ্রিয় কিশোর ফ্যাস্টাসি সিরিজ হ্যারি পটার।  আবালবৃদ্ধবনিতা সবারই কাছে সমানতালে জনপ্রিয়তা পেয়েছে সিরিজটি।  কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই সিরিজকেও পড়তে হয়েছিল নিষেধাজ্ঞায়।  কিছু লোক বিশেষ করে খ্রিষ্টান ক্যাথলিকরা এর শক্তহাতর বিরোধিতা করেছে।   সিরিজে দেখানো জাদুবিদ্যাকে তারা Satanism তথা শয়তান পুজোকে প্রমোট করার অপবাদ দিয়েছে।  তাদের মতে দেখানো রিচুয়ালগুলো অসামাজিক এবং ধর্মানুভুতিতে আঘাত করে ।  পাশাপাশি তাদের মত এই সিরিজ শিশু কিশোরদের কোমল মনে খারাপ প্রভাব ফেলবে ।

এবার প্রশ্নটা হলো কেন পড়বেন সিরিজটা? এক, এই সিরিজ পুরোপুরিভাবে কাল্পনিক এবং সিরিজে দেখানো স্থাপনা ও রিচুয়াল সবই কাল্পনিক তাই তাকে বাস্তবের সাথে মিলানোর চেষ্টা করাটা কতটুকু সমীচীন?  দুই,  এই সিরিজ শিশু মনের ওপর খারাপ প্রভাব না বরং শিশুদের চিন্তাধারা, ইমাজিনেশনের ক্ষেত্রটা প্রসার করবে বলে আমার শক্ত বিশ্বাস৷  তিন,  অন্যসব কিশোর উপন্যাসের মতো এই সিরিজ গতবাধা রোমান্টিক উপাখ্যান না,  এ বইতে মানবিক বন্ধন খুব দৃঢ়ভাবে দেখানো হয়েছে, যা সব বয়সী পাঠককেই আকৃষ্ট করতে পারে।  চার, সিরিজের চরিত্রের অভাব নেই।  এবং আপনি আপনার পছন্দের চরিত্রের সাথে এমনভাবে জুড়ে যাবেন যেন মনে হবে আপনি তাদের একজন।  চরিত্রগুলো জীবিত। এমন দুর্দান্ত চরিত্রায়ন আপনাকে চমৎকৃত করতে বাধ্য।  তারপরেও যদি বলেন কেন পড়বো? তবে মশাই আমার খটমটে জবাব, “জোর করছে কে আপনাকে পড়তে?”

★ The Color Purple, by Alice Walker (1982)

The Color Purple, by Alice Walker (1982)

এলিস ওয়াকার একজন আমেরিকান কবি, সাহিত্যিক,  ছোটগল্পকার,  সমাজ সংস্কারক এবং সক্রিয় নারীবাদী।  তিনি তার কড়া ভাষা এবং বাস্তবধর্মী লেখার জন্য বিখ্যাত।  ১৯৮২ সালে তিনি তার প্রথম উপন্যাস “The Color Purple” লিখেন, যার জন্য তিনি ১৯৮৩ সালে পুলিৎজার এওয়ার্ড এবং জাতীয় সাহিত্য সম্মাননা পান।  এবং এটা ইতিহাসের একমাত্র বই যা একসাথে এই দুটি পুরস্কার জিতে নেয়।

যদিও বইটা পুলিৎজার পুরস্কার জিতে নেয়,কিন্তু তবুও একে পড়তে হয়েছে নিষেধাজ্ঞায়।  বইটাতে ১৯৩০ এর দশকের কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাদের জীবন নিয়ে দেখানো হয়েছে। লেখিকা তার কড়া ভাষা ও বাস্তবধর্মী  বর্ণনা দিয়ে গতানুগতিক ক্লাসিকের সঙ্গা পাল্টে দেন। বর্ণবাদ,  নারীর অসহায়ত্ব,  ধর্ষণ, যৌনতা, নির্যাতন, মাদক সবকিছুকে একদম সবার সামনে খুলে ধরেন লেখিকা।   ১৯৮৪ সালে এক হাইস্কুল বইটাকে অশ্লীল,  অসামাজিক হবার অভিযোগ জানায়।  তাছাড়াও বইটার বিরুদ্ধে জাতিগত সমন্বয়ের অন্তরায়, ধর্মীয় অবক্ষয়, আফ্রিকান ইতিহাসের অবমাননা সহ আরো বেশ কিছু অভিযোগ আরোপিত হয়।

এবার আসল কথা কেন পড়বেন The Color purple?  তবে তার আগে বলে রাখা ভালো বইটা সবার জন্য না, সমকামিতা ও  এক্সট্রিম ভায়োলেন্স সহ্য করতে না পারলে বই থেকে যতটা দুরে থাকবেন ততোই আপনার জন্য মঙ্গল। এবার মোদ্দাকথায় ফেরা যাক।  প্রসিদ্ধ একটা ভুল ধারণা নারীরা সেক্সুয়াল বিষয়াদি নিয়ে ভাবে না। এই ভ্রান্ত ধারণা প্রতিটা বইতে আদিকাল থেকে দেখানো হয়ে আসছে।  অতএব এর বিপরীতে যাওয়া লেখা পড়াটা অবশ্যকর্তব্য।  লেখিকার ভাষা এক কড়া যা নিয়ে যত বলি ততই কম।  লেখিকা কোনো রাখডাক ছাড়াই বইটাতে বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তোলতে চেয়েছেন এবং সক্ষমও হয়েছেন।  তবে হ্যাঁ ব্যাকরণজনিত সঙ্কটে বারংবার পড়তে হবে আপনাকে।  একজন অশিক্ষিত কিশোরীর ভাষায় লেখা হয়েছে বইটা, আর বিষয়টাকে বিশ্বাসযোগ্য করতে বইটা লোকাল একসেন্টে লেখা হয়েছে।  অতএব বইটা বাস্তবধর্মী হলেও কিছু ক্ষেত্রে পাঠক ফ্রেন্ডলি নয়।

★ The Great Gatsby, By F. Scott Fitzgerald (1925)

The Great Gatsby, By F. Scott Fitzgerald (1925)

Francis Scott Key Fitzgerald ছিলেন আমেরিকান উপন্যাসিক,  প্রাবন্ধিক, চিত্রনাট্যকার এবং ছোট গল্পাকার।  যদিও তিনি প্রসিদ্ধ তার চাকচিক্যময় জ্যাজ ঘরানার জীবনযাত্রাকে উপন্যাসে ফুটিয়ে তোলার জন্য। তার লেখা ব্যাপক সমালোচক প্রিয়তা পায় তার মৃত্যুর পর।  তাকে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা লেখক হিসেবে গণনা করা হয়।

জ্যাজ আমলের ক্লাসিকবইগুলো সচরাচর নিষ্পাপ ধরনের হয়ে থাকে। খুব বেশি ঋজুতা,  পঙ্কিলতা পাওয়া যায় না এই সময়কার বইগুলোতে।  সেসময়কার লেখক হিসেবে Fitzgerald এর লেখাগুলোও পঙ্কিলতাবর্জিত।  কিন্তু কিছু মানুষ তাতেও খুঁত খোঁজে বের করেছেন।  কিছু কিছু স্কুল কর্তৃপক্ষ বইটাকে স্কুল কারিকুলামের পরিপন্থী  বলে মনে করেন।  কিন্তু প্রশ্নটা হলো কেন? জ্বি আর এই কেন-র জবাব নেহাতই হাস্যকর।  তাদের মতে বইটায় অনুপুর্যুক্ত শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে।  চলুন জানা যাক শব্দগুলো কি কি! প্রথম শব্দটা হলো Damn! আক্ষরিক ভাবে এটাকে বাংলায় “ধুর” এক্সপ্রেশনের সাথে তুলনা করা যেতে পারে।  দ্বিতীয় শব্দটা হলো “Son of a bitch” তথা “কুত্তার বাচ্চা” ।  ব্যাপারটা লঘু অপরাধের গুরু সাজা ধরনে হয়ে গেল। তো আসা যাক মোদ্দায় কেন পড়বেন মশাই  বইটা?    প্রথমত এই তুচ্ছ কারণে বইটা না পড়া লেখকের মেধার অপমান বটেই।  দ্বিতীয়ত আধুনিক রোমান্স বই হিসেবে The Great Gatsby র সমতুল্য বই খুব কমই রয়েছে। ভাষা, বর্ণনা,  গল্প চরিত্রায়ন সবমিলিয়ে জ্যাজ আমলের একটা নিখুঁত চিত্র আঁকতে সক্ষম বইটা।  পাশাপাশি লেখকের দুর্দান্ত বর্ণনা তো আছেই। প্রতিটা বাক্যই মনে গেঁথে যাবার মতো।  আমার ব্যক্তিগতভাবে বেশ প্রিয় লাইন হলো, “I was within and without, simultaneously enchanted and repelled by the inexhaustible variety of life.”   আর বইটাতে মানুষের বাহ্যিক এবং ভেতরের রুপ কতটা ভিন্ন তা বেশ সুচারুভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।  আদতে এই সহজ গল্পটা একবার পড়ে দেখুন,  বারবার পড়তে মন চাইবে তার নিশ্চয়তা আমি দিচ্ছি।

এই ছিলো আজকের আয়োজন।  ভালো লাগা মন্দ লাগা, অভিযোগ অনুযোগ সব জানাতে পারেন নিচের  কমেন্ট বক্সে।  জলদিই দেখা হবে আবারো কোনো ইন্টারেস্টিং কন্টেন্ট নিয়ে।  ততদিন নাগাদ ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন। ধন্যবাদ।

Previous articleহযরত উমর (রাঃ)-ইসলামের ইতিহাসের এক সর্বশ্রেষ্ঠ শাসক
Next articleলকডাউনে দেখতে পারেন এই পাঁচটি সাউথ কোরিয়ান রোমান্টিক মুভি
আমার জন্য জীবন মানে বই আর সোশাল মিডিয়া। বইতে বাঁচি, সোশাল মিডিয়তে শ্বাস নিই। দুইয়ের কোনোটিতেই একটু ভাটা পড়লেই মেঘ জমে আমার আকাশে। বৃষ্টিভেজা দিনে বা খর রৌদ্র দুপুরে ছাদের রেলিং এ হাতে বই নিয়ে বা জানালার ধারে একমনে প্রিয় তারকাদের প্রোফাইল ঘাটা, দুটিতেই সমান পারদর্শী। মাঝে মাঝে Indie pop গানের জগতে বা কখনো kpop নিয়ে মাতি। কখনো korean rom-com মুভি দেখে হাসতে হাসতে প্রেমে পড়ি, কখনো Titanic দেখে বিশাদরসে হাবুডুবু খাই। জীবন এভাবে চলছে। মন্দ কি?