জোয়ার ভাটা কেন হয় ? আমরা যারা সমুদ্র সৈকতে বেড়াতে গিয়েছি তারা হয়ত জোয়ার এবং ভাটা শব্দ দুইটির সাথে সুপরিচিত। আবার অনেকেই বইপত্রে পড়ে জেনেছি জোয়ার-ভাটা সম্পর্কে। তারপরেও অনেককেই প্রশ্ন করলে জোয়ার ভাটা কি এবং কেন হয় তার উত্তর ভালভাবে দিতে পারেননা, আবার অনেকেই কিছুটা সদুত্তর দিতে পারলেও জোয়ার ভাটা নিয়ে তার কন্সেপ্ট ক্লিয়ার না। তাই জোয়ার ভাটা নিয়ে সকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে সাজানো আমাদের আজকের এই ব্লগ। আসুন দেরি না করে শুরু করে দেই।
জোয়ার ভাটা কাকে বলে?
নদীমাতৃক দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। আমাদের দেশে ছোট বড় সবমিলিয়ে ৪০৫টি নদী সারা দেশ জুড়ে জালের মত ছড়িয়ে আছে। আমরা যারা নদীর খুব কাছাকাছি থাকি তারা হয়ত খেয়াল করেছি কখনও কখনও এক এলাকার নদীর পানি কিছুটা বেড়ে যায় বা ফুলে ওঠে, একই সময়ে অন্য এলাকার নদীর পানি কমে গেছে বা নেমে গেছে। পানির এই ফুলে ওঠাকে জোয়ার এবং নেমে যাওয়াকে বলে ভাটা।
সাদা চোখে আসলে জোয়ার ভাটার সংগা এটাই। কিন্তু যার অনুসন্ধিৎসু মন রয়েছে তাকে তো আর এই বলে বুঝ দেয়া যায়না। অনুসন্ধিৎসু মন সবসময় কারণ খোঁজে, জানতে চায় এর পেছনের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা। তাদের জন্যই মূলত জোয়ার ভাটা নিয়ে আমাদের আজকের এই লেখা।
কিন্তু জোয়ার ভাটা কেন হয় এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা পরিপূর্ণভাবে বুঝতে হলে কিছু বেসিক জ্ঞান থাকতে হবে, তা না হলে ব্যাপারটি বোঝা একটু কঠিন হবে। তাই বেসিক বিষয়গুলো আগে বলে নিচ্ছি।
সৌরজগৎ নিয়ে জেনে নেই সবার আগে
আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী সৌরজগতের একজন বাসিন্দা। সৌরজগতের কেন্দ্রে রয়েছে সূর্য। বর্তমানে আমাদের এই সৌরজগতের আবিষ্কৃত গ্রহের সংখ্যা রয়েছে আটটি। আর সেগুলো হলঃ বুধ, শুক্র, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস ও নেপচুন। আগের দিনে প্লুটোকে গ্রহের মধ্যে ধরা হলেও পরে ২০০৬ সালে ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়নের বিজ্ঞানীরা ‘বামন গ্রহ’ তকমা দিয়ে একে গ্রহের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেন। তাই আমরা সৌরজগতের মোট গ্রহের সংখ্যা আটটিই বলব।
সৌরজগতের একটি নিয়ম হচ্ছে প্রতিটি গ্রহ নিজে লাটিমের মত নিজের অক্ষকে মানে মেরুরেখাকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং একই সাথে সূর্যের চারদিকে ঘুরছে। গ্রহদের এই ঘূর্ণনের একটি নির্দিষ্ট গতি রয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে এই ঘূর্ণন সম্পন্ন করছে।
পৃথিবীর আবর্তন
শুধু তাই নয়, এই গ্রহগুলোর আবার উপগ্রহ রয়েছে। তারাও একই ভাবে নিজ অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘুরছে এবং তার গ্রহকে কেন্দ্র করে নিজস্ব কক্ষপথে ঘুরছে। যেমন, আমাদের গ্রহ পৃথিবীর একমাত্র উপগহ হচ্ছে চাঁদ। উপগ্রহদের এই ঘূর্ণনের একটি নির্দিষ্ট গতি রয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময়ে এই ঘূর্ণন সম্পন্ন করছে। এই গতিকে আমরা বলি আহ্নিক গতি।
জেনে রাখি, পৃথিবীর নিজের অক্ষকে কেন্দ্র করে ঘোরার কারনেই দিন-রাতের সৃষ্টি হয়, ২৪ ঘন্টায় পৃথিবী এই ঘূর্ণন সম্পন্ন করে এবং পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একবার ঘুরে আসতে সময় লাগে ৩৬৫ দিন বা এক বছর। সূর্যের চারদিকে ঘুরার এই গতিকে বলে বার্ষিক গতি।
তাহলে আমরা শিখলাম। আহ্নিক গতি এবং বার্ষিক গতি।
আরও একটি মজার তথ্য জেনে নেই, পৃথিবী সহ মহাবিশ্বের অন্যান্য সকল বস্তু যেমন গ্রহ, উপগ্রহ, নক্ষত্র প্রতিটি বস্তু একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে থাকে। যার আকার যত বড় তার আকর্ষণ বলও তত বেশি। আকার ছোট হলে আকর্ষণ বল কম হয়ে থাকে। এছাড়া দূরত্ব কম বেশি হবার কারনেও আকর্ষণ বল কম বেশি হয়ে থাকে। একে বলে মহাকর্ষ বল। পরিস্কার ভাবে বুঝার জন্য আপনি চাইলে চুম্বকের সাথে তুলনা করে নিতে পারেন।
কেন্দ্রবিমুখী বল
কোন বস্তু যদি কোন নির্দিষ্ট বিন্দুকে কেন্দ্র করে ঘুরতে বৃত্তাকারে থাকে তাহলে একটি কেন্দ্রবিমুখী বলের উতপত্তি হয় যা স্পর্শক বরাবর কাজ করে। আপনি যদি কোন বস্তুকে একটি সুতা দিয়ে বেধে ঘুরাতে থাকেন আর হঠাত করে ছেড়ে দেন দেখবেন বস্তুটি ভিতরের দিকে না এসে বাইরের দিকে ছুটে যায়। পৃথিবীও যখন সূর্যের চারদিকে ঘুরতে থাকে তার মধ্যে কেন্দ্রবিমুখী একটি বলের সৃষ্টি হয়।
এবার আমরা যদি জোয়ার ভাটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেই আপনার জন্য বুঝতে সহজ হবে। আসুন শুরু করা যাক জোয়ার ভাটা কেন হয় মানে জোয়ার ভাটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা।
জোয়ার ভাটা কেন হয়?
আগেই বলেছি মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তু একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে যাকে মহাকর্ষ বল বলে। সূর্য এবং চন্দ্র পৃথিবীকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে কিন্তু সূর্য চন্দ্র থেকে দূরে অবস্থিত হওয়ার কারনে সূর্যের আকর্ষণ বল চন্দ্রের তুলনায় কম। আর পৃথিবীর আবর্তনের কারনে পৃথিবীর একটি কেন্দ্রবিমুখী বল রয়েছে। জোয়ার ভাটার মূল কারণ এই দুটিই।
- পৃথিবীর উপর সূর্য এবং চন্দ্র এর আকর্ষণ বল
- পৃথিবীর আবর্তনের কারনে কেন্দ্রবিমুখী বল
আসুন এবার দুটি কারণ ব্যাখ্যা করা যাক, জোয়ার ভাটা কেন হয়। সংক্ষেপে।
পৃথিবীর উপর সূর্য এবং চন্দ্র এর আকর্ষণ বল
সূর্যের ভর চন্দ্রের তুলনায় দুই কোটি ষাট লক্ষ গুন বেশি হলেও পৃথিবী থেকে চন্দ্রের দুরত্বের তুলনায় পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ৩৯০ গুন দূরে অবস্থিত। আগেই বলছি আকারের কারনে আকর্ষণ বল বেশি হলেও দূরত্বের কারনে তার কার্যকারিতা কমে যায়। তাই পৃথিবীতে সূর্যের তুলনায় চন্দ্রের আকর্ষণ বল দুইগুন বেশি হওয়াতে পৃথিবীতে চন্দ্রের আকর্ষণই কাজ করে।
পৃথিবী তার নিজ অক্ষে ঘুরছে, চন্দ্র নিজেও তার নিজ অক্ষের উপর ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর চারদিকে ঘুরছে। এভাবে ঘুরতে ঘুরতে পৃথিবীর যেপাশে চাঁদ রয়েছে সেইপাশে চাঁদের আকর্ষণে পানি ফুলে উঠে এবং জোয়ার আর তার বিপরীত পাশে ভাটা পরিলক্ষিত হয়।
পৃথিবীর আবর্তনের কারনে কেন্দ্রবিমুখী বল
পৃথিবীর আবর্তনের কারনে বা আহ্নিক গতির কারনে যে কেন্দ্রবিমুখী বল সৃষ্টি হয় তার কারনে সমুদ্রের পানি বাইরের দিকে ছিটকে বেড়িয়ে যেতে চায়। চাঁদের আকর্ষণের কারণে সমুদ্রের যেইখানে জোয়ার হয় তার ঠিক বিপরীত দিকে চাঁদের আকর্ষণ এর তুলনায় কেন্দ্রবিমুখ বলের প্রভাব বেশি হয় ফলে সমুদ্রের ওই স্থানেও জোয়ার হয়। আর সমুদ্রের পরস্পর বিপরীত যে দুটি স্থানে জোয়ার হয় তার সমকোণে অবস্থিত দুটি স্থানে জল নেমে গিয়ে তখন ভাটা হয়।
জোয়ার ভাটা নিয়ে কিছু তথ্য
জোয়ার ভাটা নিয়ে আরও কিছু তথ্য জানা জরুরী। আপনাদের সুবিধার্থে তথ্যগুলো আপনাদের সামনে তুলে ধরছি।
জোয়ার ভাটার সময়ের ব্যাবধান
২৪ ঘন্টায় একই জায়গায় ২ বার জোয়ার এবং ২ বার ভাটা হয়। কেন এমন হয়? পৃথিবীর আহ্নিক গতিই এর মূল কারণ। পৃথিবী তার মেরুরেখাকে কেন্দ্র করে ২৩ ঘন্টা ৫৬ মিনিট ৪ সেকেন্ড সময়ে একবার আবর্তন করে। পৃথিবীর এই আহ্নিক গতির ফলে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দ্রাঘিমা একবার করে চাঁদের সরাসরি সামনে আসে। তাই ২৪ ঘন্টায় একই জায়গায় ২ বার জোয়ার এবং ২ বার ভাটা হয়।
মুখ্য জোয়ার
পৃথিবীর যেই জায়গাটি চাঁদের সাথে মুখামুখি অবস্থানে থাকে সেই জায়গাতে চাঁদের আকর্ষণ সবচেয়ে বেশি থাকে। তাই এখানে পানি সবচেয়ে বেশি ফুলে ওঠে। এই জায়গার জোয়ারকে তাই মুখ্য জোয়ার বলা হয়।
গৌণ জোয়ার
পৃথিবীর যেই জায়গাটি চাঁদের সাথে মুখামুখি অবস্থানে থাকে ঠিক তার বিপরীত পাশে চাঁদের আকর্ষণ সবচেয়ে কম থাকে কিন্তু কেন্দ্র বিমুখী বলের প্রভাব বর্তমান থাকে। একারনে এখানে যে জোয়ারের সৃষ্টি হয় তাকে গৌণ জোয়ার বলে।
ভরা কাটাল
আমাবস্যা ও পূর্ণিমা তিথিতে চাঁদ, পৃথিবী এবং সূর্য একই সরল রেখায় থাকে। এতে চাঁদ এবং সূর্যের মিলিত আকর্ষণ বলের কারনে পৃথিবীতে এক তীব্র জোয়ারের সৃষ্টি হয়। একে ভরা কাটাল বলে।
মরা কাটাল
কৃষ্ণপক্ষ ও শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথিতে চাঁদ ও সূর্য পৃথিবীর সঙ্গে পরস্পর সমকোণে অবস্থান করে। তাই বুঝতেই পারছেন, চাঁদ ও সূর্যের আকর্ষণ বিপরীতমুখী থাকে। সুতরাং, চাঁদের আকর্ষণে চাঁদের দিকে জলরাশি ফুলে ওঠে আবার সূর্যের আকর্ষণে তার দিকের জলরাশিও ফুলে ওঠে। দুইটি বিপরীতমুখী হবার কারনে একে অপরকে কাটিয়ে জোয়ারের তীব্রতা কমে যায়। একে মরা কাটাল বলে।
জোয়ার ভাটার ফলাফল
জোয়ার ভাটার ফলাফল সাধারণ নদীতে খুব বেশি পরিলক্ষিত না হলেও সমুদ্রে এবং সমুদ্র উপকূলের নদীগুলোতে এর প্রভাব বেশ পরিলক্ষিত হয়। এখানে জোয়ারের সময় পানি আসে আবার ভাটার সময় পানি চলে যায়।
আমরা যারা কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছি তারা একটি ব্যাপার অবশ্যই খেয়াল করেছি। জোয়ারের সময় এখানে সমুদ্রে নামতে বাধা না দিলেও ভাটার সময় লাল ফ্লাগ উড়িয়ে পর্যটকদের পানিতে নামতে বাধা দেয়া হয়। কারণ ভাটার সময় পানিতে টান থাকে যা দুর্ঘটনার কারণ হতে পারে।
এছাড়া সমুদ্র উপকূলের নদীগুলোতেও সকাল বিকাল পানির উপস্থিতি ও অনুপস্থিতি দেখা যায়। এসব ঘটনা জোয়ার ভাটার কারনেই হয়ে থাকে।
জোয়ার ভাটার সুফল
পৃথিবীর অনেক দেশ জোয়ার ভাটাকে কাজে লাগিয়ে অনেক কাজ করে নিচ্ছে যার মধ্যে অন্যতম হলঃ
- জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন।
- জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে লবনের উৎপাদন।
- জোয়ার ভাটাকে ব্যবহার করে অভ্যন্তরীণ নদী বন্দরের জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রন করা।
- নদীর পানি সংরক্ষণ করে তা পরবর্তীতে সেচকাযে ব্যবহার করা।
- নদীর পলির পরিমাণ ঠিক রাখা এবং নদীর পানি পরিস্কার রাখা।
জোয়ার ভাটার কুফল
- কৃষি জমিতে জোয়ারের পানি এসে তা চাষের অনুপযুক্ত হয়ে যায়।
- জোয়ারের কারনে নদী ভাংগনের ফলে জনবসতি হুমকির মুখে পরে যায়।
- অনেক সময় নদীর মিষ্টি পানি নোনা হয়ে তা সেচ কাজের উপযুক্ত থাকেনা।
পৃথিবীতে একই সাথে দুই জায়গায় জোয়ার হয় না কেন?
উপরের সবকিছু আপনি যদি সঠিকভাবে বুঝে থাকেন তাহলে অবশ্যই এই প্রশ্নের উত্তর আপনি জেনে গেছেন। যদি এখনও না বুঝে থাকেন একটু ভাবুন। আশা করি এই প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন।
ধন্যবাদ সব্বাইকে। আমাদের চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করতে ভুলবেন না।