জলাতঙ্ক রোগের চিকিৎসা

জলাতংক রোগের নাম আমরা সবাই শুনেছি। এটি একটি ভাইরাস জনিত রোগ যা প্রানি থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়। যেসব রোগ প্রানি থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায় সেসব রোগকে জোনোটিক রোগ (Zoonotic Diseases) বলে। জলাতংক রোগের ইংরেজি হল Rabies, রেবিজ ভাইরাস নামক একধরনের নিউরোট্রপিক ভাইরাস থেকে এই রোগের সৃষ্টি। এই রোগ একসময় পৃথিবীর আতংক হলেও এখনকার দিনে জলাতংক রোগের চিকিৎসা তেমন কঠিন কিছু নয়।

মনে রাখবেন, জলাতংক রোগের মৃত্যু হার প্রায় শতভাগ। কারও জলাতংক রোগের উপসর্গ দেখা দিলে তাকে বাঁচানো প্রায় অসম্ভব। সারা পৃথিবীতে প্রতিবছর মারা যায় প্রায় ২৪ থেকে ৬০ হাজার মানুষ আর বাংলাদেশে এই সংখ্যা দুই হাজারের বেশি। তাই জলাতংক নিয়ে সম্পূর্ণ জ্ঞান থাকা আমাদের সবার জরুরী।

আপনারা জেনে অবাক হবেন, বিশ্বে ভারতের পরেই আমাদের দেশে জলাতংক রুগীর মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। যদিও বিশেষজ্ঞদের ধারনা আমাদের দেশে সঠিক তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যাবস্থা না থাকায় প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে আরও বেশি হয়াও বিচিত্র কিছু নয়।

জলাতংক রোগ কিভাবে হয়

প্রথমেই বলেছি জলাতংক একধরনের জোনোটিক রোগ মানে এই রোগ পশু থেকে মানুষের মাঝে ছড়ায়। সাধারণত গৃহপালিত কিংবা বন্য প্রানি এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে এসব পশুর লালা কোন কারণে মানুষের ক্ষতস্থানে লাগলে মানুষ জলাতংক রোগে আক্রান্ত হয়। অর্থাৎ বেবিজ ভাইরাস বহনকারী কোন পশু যদি মানুষকে কামড় দেয় বা আঁচড়ে দেয় তাহলে ঐ ব্যাক্তির জলাতংক রোগ হতে পারে।

জলাতংক রোগটি সাধারণত কুকুর, শেয়াল, বানর, বেঁজি, বিড়াল, বাদুর ইত্যাদি প্রাণীর মাঝে দেখা যায়। আক্রান্ত প্রাণীর লালা থেকে কিংবা রক্ত থেকে অন্য পশু আক্রান্ত হয়ে রোগটি ছড়িয়ে পরে। তবে আমাদের দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ জলাতংক রোগ হয় কুকুরের কামড়ে।

মনে রাখবেন, আপনার শরীরে যদি কোন ক্ষতস্থান থাকে আর রেবিজ ভাইরারে আক্রান্ত প্রাণির মুখের লালা যদি ক্ষত স্থানে লেগে যায় আপনার জলাতংক রোগ হবার সম্ভাবনা শতভাগ। এছাড়া লালা যদি আপনার চোখ, নাক বা মুখের সংস্পর্শে আসে সেক্ষেত্রেও  দেরি না করে ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা নিন দ্রুত।

জলাতংক রোগের লক্ষণ

সাধারণত ক্ষতস্থানে চুলকানো, ব্যাথা করা, মুখ থেকে লালা ঝড়া, শরীরে তাপমাত্রা বৃদ্ধি বা জ্বর, উত্তেজনা, অস্থিরতা, পানির পিপাসা থাকা, পানি দেখে ভয় পাওয়া, ঢোক গিলতে সমস্যা হওয়া, উল্টা-পাল্টা বকা, মানসিক বিভ্রম, অনিয়ন্ত্রিত নড়াচড়া, ইত্যাদি উপসর্গ জলাতংক রোগের লক্ষণ।

এই ভাইরাস যেহেতু মস্তিস্কে প্রদাহ সৃষ্টি করে তাই মস্তিস্ক হতে ক্ষতস্থানের উপর নির্ভর করে উপসর্গ কতদিনের মধ্যে দেখা যাবে। তবে সাধারণত এক থেকে তিন মাসের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়। আবার কখনও এক সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে অথবা এক বছরের পরেও লক্ষণ প্রকাশ পেতে পারে। আসলে এটি নির্ভর করে ভাইরাসের জীবাণু কতদিনে ক্ষতস্থান থেকে মস্তিস্কে প্রবেশ করতে পারে। সংক্রমণের পর থেকে উপসর্গ প্রকাশ পাওয়ার সময় পর্যন্ত সময়কালকে রোগের সুপ্তাবস্থা বলে।

আমাদের সবারই ধারনা কুকুর কামড়ালেই বুঝি জলাতংক রোগ হয়। ধারনাটা সত্যি নয়। জলাতঙ্ক মূলত পশুদের রোগ। তাই প্রথমত কুকুর বা অন্যান্য প্রাণীকে এই রোগে আক্রান্ত হতে হবে। তারপর যদি সেই আক্রান্ত পশু মানুষকে কামড়ায় বা আঁচড়ে দেয় তাহলেই শুধুমাত্র আপনার জলাতংক রোগ হতে পারে।

কুকুরের যদি জলাতংক রোগ না থেকে থাকে তাহলে আপনার জলাতঙ্ক রোগ হবার সম্ভাবনা নাই। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হবার জন্য অনেক পরীক্ষা নিরিক্ষার ব্যাপার রয়েছে, তাই কুকুর কামড়ালেই জলাতংকের টিকা নেয়া আবশ্যক। কোন কোন ক্ষেত্রে সাধারণ আঁচড় থেকেও এ রোগ হতে পারে।

জলাতংক রোগের উপসর্গের স্তরকে তিনভাগে ভাগ করা যেতে পারে।

  • প্রথম স্তরঃ এক থেকে তিন দিন সময়কাল যখন রুগীর ব্যবহারে পরিবর্তন দেখা যায়।
  • দ্বিতীয় স্তরঃ তিন থেকে পাঁচ দিন এসময় রুগী যাকে পায় তাকে কামড় দিতে চেষ্টা করে।
  • তৃতীয় স্তরঃ সাত থেকে পরবর্তী স্তরে রুগী পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে পরে, তার লালা নির্গত হয়।

জলাতংক রোগ কিভাবে বিস্তার ঘটায়

আগেই বলেছি জলাতংক রোগ ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত রোগ। এই ভাইরাস কোন ভাবে মাংসপেশিতে বা স্নায়ুতে প্রবেশ করতে পারলেই তা বংশবৃদ্ধি শুরু করে দেয়। প্রথমে ভাইরাস কোষে প্রবেশ করে এবং আশেপাশের অংশে সংক্রমিত হয়। তারা সেখানে নীরবে বংশবৃদ্ধি করতে থাকে আমাদের ইমিউনিটি সিস্টেমের আড়ালে।

মাংস পেষিতে যখন পর্যাপ্ত পরিমানে বংশ বিস্তার করে ফেলে তখন তা মাংস ও স্নায়ুর সংযোগস্থলে প্রবেশ করে। একবার ভাইরাস স্নায়ু কোষে প্রবেশ করলে তা দ্রুতই মস্তিস্কে পৌছে যায়।

মস্তিস্কে প্রবেশ করার পর এর শেষ ধাপ হল লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ। একবার লালাগ্রন্থিতে প্রবেশ করলে অন্য প্রাণীর দেহে সংক্রমণের জন্য প্রস্তুত হয়। তাই জলাতংকে আক্রান্ত রুগী খুব সহজেই অন্য সুস্থ্য মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে। বিশেষ করে আক্রান্ত ব্যক্তি যদি সুস্থ্য ব্যক্তিকে কামড় দেয়। তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম হলেও অসম্ভব নয়।

তবে, ভাইরাস যেহেতু শুক্রানু ও যোনি নিঃসৃত রসে বর্তমান তাই শারীরিক মিলনের মাধ্যমেও এই রোগের বিস্তার হতে পারে।

কারা জলাতংক সংক্রমণের শিকার

সকল উষ্ণ রক্তের প্রাণীই জলাতংক রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এবং সকল আক্রান্ত প্রাণী নিজে আক্রান্ত হয়ে বাহক হিসেবে বহন করে মানুষের মাঝে চালান করে দিতে পারে। এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত সকল প্রাণী যেমন- কুকুর, শেয়াল, বানর, বেঁজি, বিড়াল, বাদুর ইত্যাদি মানুষের জন্য প্রধান ঝুঁকির কারণ।

সাধারনত এই রোগে আক্রান্ত পশু বিনা উস্কানিতেই মানুষকে কামড় দিতে পারে। কামড় দিলেই আপনার উচিত দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ ও চিকিৎসা নেয়া।

জলাতংক রুগী পানি দেখে ভয় পায় কেন

এই ভাইরাস মস্তিস্কের নিউক্লিয়াস এমবিগুয়াসে আক্রমণ করে। আর মস্তিস্কের এই অংশটি আমাদের প্রশ্বাসে নিয়োজিত অংশকে অতিরিক্ত উত্তেজনা থেকে দমন করে রাখে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সমন্বয় ঘটায়। রেবিজ ভাইরাস সংক্রমণ এই কাজে ব্যাঘাত ঘটায়।

এজন্যই জলাতংক রুগী যখন পানি খেতে চায়, তার গলা ও শ্বাসনালী উত্তেজনায় সংকুচিত হয় এবং ব্যাথার অনুভুতি তৈরি করে এবং কিছু পানি তার শ্বাসনালীতে দিয়ে ফুসফুসে প্রবেশ করে এবং এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। তখন রুগী পানি দেখলেই ভয় পায়। একে বৈজ্ঞানিক ভাষায় হাইড্রোফোবিয়া বলে।

জলাতংক রোগ নির্ণয়

জলাতংক রোগ নির্ণয় অনেক সময়ই অনেক কঠিন ও দুঃসাধ্য। কারণ অন্যান্য রোগের সাথে এর উপসর্গের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে। তাছাড়া যে কুকুর/পশু কামড় দিয়েছে তাকে চিনে রাখা এবং তাকে পরিক্ষা-নিরিক্ষা করে ভাইরাস নির্ণয় করাও প্রায় দুঃসাধ্য এক কাজ।

মনে রাখবেন জলাতংক রুগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা ১০০ ভাগ। ভাইরাস মাংশপেশী থেকে মস্তিস্কে পৌছে গেলে রুগীর আর বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। তাই রোগ নির্ণয়ে সময় নষ্ট না করে দ্রুত জলাতংক রোগের ভ্যাকসিন নেয়া একান্ত কর্তব্য।

জলাতংক রোগের ভ্যাকসিন আবিস্কার

১৮৮৫ সালে যোশেফ মাইস্টার নামের একটি ছেলেকে পাগলা কুকুর কামড় দেয়, যোশেফ মাইস্টার এর মা এতে মারাত্মক ভীত হয়ে পরেন এবং লুই পাস্তুরের কাছে নিয়ে যান। এই ঘটনার কিছু সময় আগেই মাত্র টিকার ধারনা আবিস্কার হয়েছে।

লুই পাস্তুর ভাবলেন ছেলেটিকে টিকা দেবেন কিনা। যদি টিকা নাও দেন তাহলেও ছেলেটি জলাতংক হয়ে মারা যাবে। তাই তিনি টিকা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন এবং টিকা দিলেন। এতেই কাজ হল, ছেলেটি আর জলাতংক রোগে আক্রান্ত হল না, আমরাও উপহার পেলাম জলাতংক রোগের ভ্যাকসিন।

জলাতংক রোগের চিকিৎসা আবিস্কারের আগে পৃথিবীতে অনেক লোক এই রোগে মারা যেত। অন্যান্য রোগের ভ্যাকসিনের প্রস্তুতপ্রণালীর মত এটিও এই ভাইরাসের জীবাণু থেকেই তৈরি করা হয়। সংক্রমিত খরগোশের স্নায়ুতন্ত্র থেকে এই ভাইরাস বের করে রোদে শুকাতে হয় ৬-১০ দিন। এতে ভাইরাসটি দুর্বল হয়ে পরে। এ প্রক্রিয়ায় তৈরি ভ্যাকসিন দামেও সস্তা এবং সম্পূর্ণ কার্যকর। লুই পাস্তুর এই পদ্ধতিতে ভ্যাকসিনের আবিস্কারক।

এছাড়াও গবেষনাগারেও জলাতংক রোগের ভ্যাকসিন তৈরি করা যায় যাতে অনেক খরচ। তাই আজও লুই পাস্তুরের আবিস্কার করা ভ্যাকসিন চলে আসছে।

ভ্যাকসিন কি? ভ্যাকসিন আবিস্কারের ইতিহাস জেনে নিন নিচের ভিডিও থেকে।

জলাতংক রোগের চিকিৎসা

কুকুর বা অন্য কোন প্রানী কামড় দিলেই প্রথম কাজ হল সাবান ও প্রচুর পরিমাণ পানি দিয়ে ক্ষতস্থান ধুয়ে ফেলা এবং যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী জলাতংক রোগের চিকিৎসা নেয়া।

যেসব রোগের জলাতংক রোগের ভ্যাকসিন দেয়া হয়নি তাদের যদি কেও জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয় এবং স্নায়ুতন্ত্রের উপসর্গ দেখা দেয় তাহলে তার মৃত্যু নিশ্চিত। ৬ দিনের মধ্যেও যদি ভ্যাকসিন দেয়া যায় তার পরও প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু যদি ভ্যাকসিন দেয়া না হয় একবার উপসর্গ প্রকাশ পেয়ে গেলে আর রুগীকে বাঁচানো সম্ভব নয়।

আগেকার দিনে জলাতংক রোগ থেকে বাঁচার জন্য বর্বর কায়দায় কুকুর নিধন করা হত। কিন্তু বর্তমান কালে রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়ানো পশু বিশেষ করে কুকুরের জন্য বাংলাদেশ সরকারে পক্ষ থেকে টিকা দেবার ব্যবস্থা আছে।

আপনি চাইলে আপনার পোষা প্রাণীকে টিকা দিয়ে জলাতংক রোগ থেকে নিজে এবং আপনার পরিবারকে রক্ষা করতে পারেন খুব সহজে। এছাড়া আপনি নিজেও আক্রান্ত হবার আগেই টিকা নিয়ে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারেন।

জলাতংক নিয়ে আমার এই ব্লগ যদি আপনার ভাল লেগে থাকে তাহলে নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার ভাল লাগার অনুভূতি জানিয়ে যেতে ভুলবেন না। ধন্যবাদ সবাইকে।

তথ্যসূত্রঃ উইকিপেডিয়া, বিভিন্ন পত্র পত্রিকা এবং অনলাইন গুগল সার্চ

Frequently Asked Question (FAQ)

১. জলাতংক রোগীর মৃত্যুর হার কত?

উত্তরঃ জলাতংক রোগীর মৃত্যুর হার প্রায় শতভাগ। আপনার জলাতংক হলে যদি চিকিৎসা না করান তাহলে আপনার বাঁচার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

Previous articleভ্যাকসিন কিভাবে কাজ করে ,ভ্যাকসিন কিভাবে তৈরি করা হয় এবং মানুষের কেন এত অনীহা।
Next articleবাংলা ব্লগিং সাইট – বাংলা ব্লগিং সাইটের সেরা ২০
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।