উসমান (রাঃ)

 

প্রথম পর্বে আমরা জেনে ছিলাম উসমান (রাঃ)  ব্যক্তিগত গুণাবলি। জন্ম থেকে তার শাসনামলে তার নেয়া পদক্ষেপ সমূহ।  আজ আমরা আলোচনা করবো তার সময়কার বিজয় সমূহ থেকে তাঁর আমলে শুরু হওয়া ফিতনা আর সেই ফিতনার জের ধরে তার শাহাদাতবরণের কাহিনি।

উমর (রাঃ) নিহত হওয়ার পর ইসলামের শত্রুদের অন্তরে সাহস সঞ্চার হয়। বিশেষ করে পারস্য ও বাইজেন্টাইনরা মুসলমানদের নিকট হারানো ভূমি পুনরুদ্ধাদের আশায় জেগে উঠে। তারা বেশ কয়েক জায়গাতে বিদ্রোহ উচকে দেয়।  তিনি খুব সাফল্যের সাথে এদের মোকাবেলা করেন।

হযরত উসমান (রাঃ)- পর্দার আড়ালের নায়ক পর্ব ০১

পূর্বদেশীয় রাজ্য সমূহে উসমান (রাঃ) এর বিজয়

২৪ হিজরিতে আজারবাইজানের অধিবাসীরা উমর (রাঃ) এর সময়কার সন্ধি চুক্তি ভঙ্গ করে গভর্নর উকবা ইবনে ফারাকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তখন উসমান (রাঃ) ওয়ালিদ (রাঃ) কে আদেশ দেন। পরবর্তীতে সফলতার সাথে এই বিদ্রোহ দমন করা হয়। তাছাড়া সাঈদ ইবনে আল-আস (রাঃ) এর তাবারিস্তান, আব্দুল্লাহ ইবনে আমির (রাঃ) কর্তৃক  আবারশাহর,তুস, বাইয়ূদ, নিসা ইত্যাদি অঞ্চলে অভিযান চালিয়ে বিজয় লাভ করেন।

মুসলমানদের প্রথম সমদ্র পথে অভিযানের অনুমতি প্রদান

মুয়াবিয়া ইবনে আবু সুফিয়ান (রাঃ) যখন সিরিয়ার গভর্নর ছিলেন তখন উমর (রাঃ) এর কাছে সমুদ্র পথে অভিযান পরিচালনার অনুমতি চান। কিন্তু উমর (রাঃ) তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন৷ পরে উসমান (রাঃ) খলিফা নির্বাচিত হলে মুয়াবিয়া (রাঃ) আবার অনুমতি চেয়ে পত্র লিখেন। তখন উসমান (রাঃ) তাকে কিছু শর্ত দিয়ে অনুমতি প্রদান করেছিলেন। তার মধ্যে একটি শর্ত ছিলো অভিযানে মুয়াবিয়া (রাঃ) তার স্ত্রীকে সঙ্গে রাখবেন।

কুরআনের  একটি মাত্র মাসহাফ সংকলন

কুরআন রাসূল (সাঃ) এর সময় থেকেই সংকলন হয়ে এসেছে৷ এর জন্য তার ওহী লেখক সাহাবিও ছিলো।  তবে তা একত্রিত অবস্থায় ছিলো না। ইয়ামামাহার লড়াইয়ে যখন অনেক হাফেজ নিহত হলো তখন উমর (রাঃ) এর পরামর্শে আবু বকর (রাঃ) ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কুরআনের কপি একত্র করার নির্দেশ দেন যায়িদ ইবনে সাবিত (রাঃ) কে। যে ৪ জন ওহী লেখক প্রসিদ্ধ ছিলেন তাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। কুরআনের কপি হয়ে গেলে তা আবু বকর (রাঃ),তারপর উমর (রাঃ) এবং তার মারা যাওয়ার পর সেই কপিটি হাফসা বিনতে উমর (রাঃ) আনহার নিকট সংরক্ষিত থাকে। হুযাইফাহ ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) আরমেনিয়া ও আযারবাইজান অভিযানে ইরাকী যোদ্ধাদের  মধ্যে কুরআন পাঠে মতবিরোধ দেখতে পান। তিনি যুদ্ধ থেকে ফিরে উসমান (রাঃ) কে বিষয়টি জানান এবং আশঙ্কা প্রকাশ করেন যে কিতাব সম্পর্কে ইহুদী ও নাসারাদের মতো মতপার্থক্যের তৈরি হতে পারে। তাই এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য উসমান (রাঃ)-কে পরামর্শ দেন। তারপর উসমান (রাঃ) হাফসা (রাঃ) আনহার নিকট সংরক্ষিত কুরআনের কপি চেয়ে চিঠি পাঠান। কুরআনের একটি মাত্র মাসহাফ সংকলন শেষ করে তিনি রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রান্তে এর কপি প্রেরণ করেন। তারপর তিনি এই কপির সঙ্গে অমিল আছে এমন সব কপি জ্বালিয়ে দেয়ার নির্দেশ জারি করেন। উনি এই সবগুলো কাজ করার আগে সাহাবিদের সাথে আলোচনা করেই করেছেন। এই বিষয়ে ফিতনার সময় যে সকল অভিযোগ উঠে তা মিথ্যা এবং ভিত্তিহীন। এ সম্পর্কে আলী (রাঃ) বলেনঃ

‘ হে লোকসকল, উসমান রাযিয়াল্লাহু আনহুর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করো না এবং তার ব্যাপারে শুধু ভালোই বলবে। কারণ, আমি আল্লাহর কসম করে বলছি, তিনি কুরআনের ব্যাপারে যা কিছু করেছেন, তা আমাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই করেছেন৷  আল্লাহর কসম, আমি যদি খলীফা হতাম, তাহলে আমি একই কাজ করতাম।’ (ফাতহুল বারি, ৯/১৮)

গভর্নর নিয়োগ ও তাদের প্রতি খেয়াল

একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত উমর (রাঃ) এর নিয়োগ করে যাওয়া গভর্নরদের তাদের পদে বহাল রাখা হলেও সময়ের প্রয়োজন ও জনগণের চাহিদা অনুযায়ী উসমান (রাঃ) বিভিন্ন এলাকার গভর্নর পরিবর্তন ও নিয়োগ করেছিলেন। এই সকল ক্ষেত্রে তিনি সততা, ন্যায়পরায়ণতা, আল্লাহ ভীরুতা এই বিষয়গুলো খেয়াল রাখতেন। শুধু নিয়োগ দিয়েই ক্ষান্ত হতেন না তাদের প্রতি যত্ন নিতেন, তাদের চাদিহার প্রতি খেয়াল রাখতেন, তাদের অধিকার বুঝিয়ে দিতেন।তাছাড়া গভর্নরদের কাজের প্রতিও নজর রাখতেন, খবর নিতেন। হজের সময় তিনি হাজীদের কাছে গভর্নদের কাছে প্রশ্ন করে জেনে নিতেন তাদের গভর্নররা তাদের প্রতি কেমন ব্যবহার করেন। উসমান (রাঃ) বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন এলাকায় পরিদর্শক  প্রেরণ করে তথ্য জানতেন। মাঝে মাঝে তিনি নিজেই সফরে বের হতেন। মানুষকে দ্বীন শিক্ষা দেয়া, নামাজ কায়েম করা, যাকাত আদায়, অমুসলিমদের সাথে ব্যবহারসহ অনৈসলামিক কোনো কাজ যেন না হয় সেই সব ব্যাপারে গভর্নরদের সচেতন করে দিতেন।

গঠিত ফিতনার কারণ সমূহ

উসমান (রাঃ) এর সময়কার ফিতনার কারণ হিসেবে বেশ কিছু বিষয় তুলে ধরা হয়। তার মধ্যে প্রথমত, সহজ ও উন্নত জীবন-যাপনের প্রভাব। মানুষ তখন ইসলামের প্রভাবে আল্লাহর রহমতে অনেক সুখে শান্তিতে বসবাস করছিলো। আগের অনেক জাতির মত এদেরও সুখ শান্তি সহ্য হচ্ছিলো না৷ শয়তানের ধোঁকাতে এরা এদের সুখের সময়ে ফিতনা সৃষ্টি করে বসে৷ দ্বিতীয়ত, সমাজে মানুষের মিশ্রণ গঠতে থাকে। একদিকে সাহাবায়ে কেরামের সংখ্যা কমছিলো অপর দিকে বেদুইন, বিজিত এলাকার লোকদের আগমন, ইহুদি ও খ্রিস্টানদের মিলে সেখানে বিভিন্ন মতবাদের মানুষের মিলন মেলায় রূপ নেয়। তাছাড়া সংস্কৃতির পালাবদল, নতুন প্রজন্মের আগমন, সাহাবিদের মদিনা থেকে বহির্গমন বৃদ্ধি, সামাজিকভাবে গুজবের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পাওয়া ফিতনা সৃষ্টিতে অনেক বড় ভূমিকা পালন করে। কুচক্রী মহলের চক্রান্ত চলতে থাকে গোপনে ও প্রকাশ্যেই। তারা ধর্মানুরাগ এর ভুল ব্যাখ্যার পাশাপাশি উসমান (রাঃ) এর সম্পর্কে মানুষকে ভুল তথ্য দিয়ে ক্ষেপিয়ে তুলতে থাকে।

গঠিত ফিতনা বিরুদ্ধে পদক্ষেপ ও পরামর্শ

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ভবিষৎবাণী  অনুযায়ী উসমান (রাঃ) যুদ্ধ করতে না চাইলেও ফিতনা নিবারণের জন্য চেষ্টা করেছিলেন। যেমনঃ বিভিন্ন সাহাবির পরামর্শে তদন্ত কমিটি প্রেরণ,  জনগণের উদ্দেশ্যে চিঠি প্রেরণ, গভর্নরদের সাথে পরামর্শ করা ইত্যাদি। তিনি ফিতনাকারিদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলেও তাদের কিছু প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলেন। তাদের যেসকল গভর্নরের প্রতি অভিযোগ ছিলো তাদের পদচ্যুত করা হয়েছিলো৷ ফিতনা মোকাবেলায় হযরত উসমান (রাঃ) মাথা ঠান্ডা রেখে সবকিছু যাচাই বাছাই করার চেষ্টা করেছেন। ন্যায় বিচারের প্রতি দৃঢ় অবস্থানে ছিলেন। ধৈর্য ও বিনয়ের সাথে চুপচাপ জ্ঞানীদের সাথে পরামর্শ করেছিলেন।

ফিতনার বিরুদ্ধে সাহাবিদের অবস্থান

জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ থেকে ইবনে আসাকীর বর্ণনা করেন, আলী (রাঃ) নিচের বার্তাটি উসমান (রাঃ) এর নিকট প্রেরণ করেনঃ ‘আমার নিকট ৫০০ যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। আপনি আমাকে অনুমতি দিলে এই লোকগুলো থেকে আপনাকে রক্ষা করতে পারি। আপনি এমন কিছু করেননি যে আপনাকে হত্যা করতে হবে।’ উসমান (রাঃ) জবাবে বললেম, ‘আল্লাহ আপনাকে পুরস্কৃত করুন; কিন্তু আমি আমার জন্য মুসলমানদের মধ্যে রক্তপাত ঘটাতে চাই না।’

হাসান ইবনে আলী (রাঃ) তরবারী কোষমুক্ত করতে চাইলে উসমান (রাঃ) তরবারী কোষবদ্ধ করে তার বাবার নিকট ফিরে যেতে আদেশ করেন৷ তাছাড়া আব্দুল্লাহ ইবনে উমর ইবনে আল-খাত্তার (রাঃ) তরবারী কোষমুক্ত করে তার ঘরে অবস্থান নিলে তাকে বিদ্রোহীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার আগেই প্রস্থান করতে বলেছিলেন।  (ফিতনাত মাকতাল উসমান)

শাহাদাতবরণ

সাহাবিরা যখন উসমান (রাঃ) কে বুঝাতে ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন তখন সাবায়ী বিদ্রোহীরা তার গৃহে আক্রমণ চালায়৷ হাসান (রাঃ), যুবায়ের (রাঃ) সহ আরো যে কয়জন আশেপাশে ছিলো তারা প্রতিরোধ করার জন্য লড়াই করেছিলো। কিন্তু উসমান (রাঃ) বারবার উচ্চস্বরে বলছিলো, ‘তোমরা আল্লাহকে ভয় করো! তোমাদের আমাকে রক্ষা করার প্রয়োজন নেই। তিনি যেহেতু খলিফা ছিলেন তাই তার আদেশ পালন করা অপরিহার্য ছিলো৷ তিনি তখন কুরআন তিলাওয়াত করছিলেন। এমন সময় তার গৃহে ঢুকে তাকে হত্যা করা হয়। হত্যার পর তার ঘর লুট করা হয় এমনকি বায়তুল মালও লুট করে।  তার মৃত্যুর পর বিদ্রোহীদের অনেকেই বুঝতে পারে তাদেরকে ভুল বুঝিয়ে এই বিদ্রোহ করা হয়েছিলো।

এই ছিলো সংক্ষেপে হযরত উসমান (রাঃ) এর জীবনী। জটিল পরিবেশের মধ্যে তার খলিফা জীবন তিনি ভালোমতই পরিচালনা করেছেন। কিন্তু অইযে নবী (সাঃ) এর ভবিষ্যৎবাণি ও আল্লাহর ইচ্ছায় যা হওয়ার তাই হলো। বিস্তারিত পড়ার যাদের সময় নেই তারা আমার দুই পর্বে লেখা  উসমান (রাঃ) এর জীবনী পড়ে দেখতে পারেন। আল্লাহ তার জীবনী থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার তৌফিক দান করুক। আমীন ।

Previous articleকি ওয়ার্ড কি ও কত প্রকার – এসইও কি এবং এসইও নিয়ে বেসিক ধারনা পর্ব ০৪
Next articleবই থেকে সিনেমা হওয়া অসাধারণ ৭টি বই
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।