আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
আমেরিকার গৃহযুদ্ধ

১৪৯২ সালে কলোম্বাসের ইউরোপ থেকে ভারতবর্ষের নৌপথ আবিস্কারের ঘটনা ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেয়। মূলত কলোম্বাসের এই প্রচেষ্টা আমেরিকার সাথে ইউরোপের যোগাযোগ করিয়ে দিয়ে আমেরিকাকে ইউরোপের এক বিরাট উপনিবেশে পরিণত করে এবং পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির লোক আমেরিকায় আসতে থাকে। তাদের মধ্যে ইংরেজ, ফরাসি ও স্প্যানিশরা অন্যতম। প্রাথমিকভাবে তারা বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে গেলেও পরবর্তীতে কলোনি স্থাপনই তাদের মূল উদ্দেশ্য হয়ে যায়। ইংরেজ, ফরাসি ও স্প্যানিশদের মধ্যে প্রতিযোগিতায় ইংরেজরা জয়ী হয় এবং কলোনি স্থাপন করে। ইংরেজরা তাদের স্বার্থে কৃষি এবং শিল্প কাজের জন্য প্রচুর কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকা থেক জাহাজে করে আমেরিকা নিয়ে আসে এবং কৃতদাস হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। মূলত আমেরিকার গৃহযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে এটি একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে।

পটভূমি-আমেরিকার গৃহযুদ্ধ

১৭৭৬ সালে আমেরিকা (যুক্তরাষ্ট্র) ইংরেজদের হাত থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ইংরেজদের আধিপত্য কমে যায় কিন্তু দাসপ্রথা ঠিকই রয়ে যায়। উনবিংশ শতাব্দীতে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তরভাগে শিল্পের ব্যাপক উন্নতি হতে থাকে এবং একই সাথে শিক্ষা-সভ্যতার দারুন উন্নতি সাধিত হয়। সাধারণ মানুষের মাঝে দাসপ্রথার বিরুদ্ধে এক জনমত গঠিত হয়। একই সময়ে দক্ষিনভাগের অর্থনীতি সম্পূর্ণ কৃষি নির্ভর হওয়ায় এবং কৃষিকাজে দাসদের বহুল ব্যবহারের কারনে তারা কৃতদাসদের উপর নির্ভরশীল রয়ে যায় ফলশ্রুতিতে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ সবাই দাসপ্রথার পক্ষে অবস্থান নেয়। মূলত কৃষি জমির মালিক এবং ব্যবসায়ি শ্রেনি তাদের ব্যবসা এবং কৃষি উৎপাদন টিকিয়ে রাখার স্বার্থে দাসপ্রথার পক্ষে জনমত গড়ে তোলে। উত্তরের রাস্ট্রগুলোর দ্রুত উন্নয়ন আরে দক্ষিনের পিছিয়ে পরার কারনে স্পষ্টই একটা বিরোধ ও বৈষম্য তৈরি হয় উত্তর-দক্ষিনের মাঝে।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধ
দাসপ্রথার পক্ষে বিপক্ষের রাস্ট্রসমুহ

আসলে উত্তরে কলকারখানার প্রসারের কারনে ধীরে ধীরে দাসদের প্রয়োজনীয়তা লোপ পাচ্ছিল আরে দক্ষিন যেহেতু কৃষিনির্ভর তাই কৃষিকাজে দাসদের ব্যবহার আগের মতই ছিল। তাই উত্তর যখন চাচ্ছিল দাসপ্রথার বিলোপ, দক্ষিন সেটাকে তাদের অর্থনীতির বিরুদ্ধে হীন ষড়যন্ত্র মনে করে।  আর ১৯৬০ সাল ছিল আমেরিকার নির্বাচনের বছর।

রিপাবলিকান মনোনীত সদস্য আব্রাহাম লিংকন নির্বাচনের আগেই ঘোষনা দেন অমানবিক দাসপ্রথা বিলুপ্তির এবং নির্বাচনে তিনি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা পত্রের ঘোষনা অনুযায়ী সকল ধর্ম-বর্ণের লোক রাস্ট্রের চোখে সমান এবং কাওকে ধর্ম-বর্ণ দিয়ে বিচার না করে নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করার কথা বলা হয়েছে। আব্রাহাম লিংকন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা পত্রের ঘোষনা বাস্তবায়নে জোর দেন। ফলাফল হিসেবে, দক্ষিনের ৭টি রাষ্ট্র (সাউথ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুজিয়ানা এবং টেক্সাস) আমেরিকা ইউনিয়নের বিপক্ষে চলে যায়। তারা কেন্দ্রিয় সরকারের মতামতকে উপেক্ষা করে এবং ধীরে ধীরে যুক্তরাষ্ট্র একটি গৃহযুদ্ধের দিকে ধাবিত হয়।

আমেরিকার গৃহযুদ্ধ শুরু

নির্বাচিত হয়ে আব্রাহাম লিংকন সরাসরি দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘোষনা না করে কিছুটা নমনীয় হন। তিনি ঘোষনা দেন যেসব রাস্ট্রে দাসপ্রথা বিদ্যমান রয়েছে তা বিলুপ্ত করার চেষ্টা তিনি করবেন না, বরং নতুন কোন রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে সংযুক্ত হতে চাইলে তাদের অবশ্যই দাসপ্রথার অবসান ঘটিয়ে তারপর অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এতে তিনি আশা করেন ধীরে ধীরে আমেরিকা থেকে দাসপ্রথার বিলুপ্তি ঘটবে। সরাসরি আব্রাহাম লিংকন দক্ষিনের দাসপ্রথার বিরুদ্ধে না গেলেও তার এই পদক্ষেপ কিছুটা আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের বিরোধী বলে মনে করেন দক্ষিনের ৭টি রাষ্ট্র। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ঘোষণা করা হয়েছিল, ‘সকল জাতি, ধর্ম ও বর্ণের মানুষ সমান’, আবার অন্যদিকে সংবিধানে লেখা হয়েছিল, যুক্তরাষ্ট্রের অন্তর্গত সব রাস্ট্রই তাদের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণে অবস্থিত ৭টি রাস্ট্রের ধারনা ছিল, কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে। যেকারনে এই সাতটি রাজ্য কেন্দ্রীয় সরকারের এই নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। পরবর্তী সময়ে দক্ষিণের আরও ৪টি রাষ্ট্র ( ভার্জিনিয়া, আলাস্কা, উত্তর ক্যারোলিনা এবং টেক্সাস) তাদের সাথে যোগ দেয়।

১৮৬১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি দক্ষিনের মোট ১১ রাষ্ট্র একত্রিত হয়ে ঠিক করল তারা যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে যাবে এবং যুক্তপ্রদেশ বা কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকা গঠন করবে। জেফারসন ডেভিস হবেন সেই যুক্তপ্রদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট। কেন্দ্রীয় সরকার এই কনফেডারেট স্টেটস অফ আমেরিকার কঠোর বিরোধিতা করল স্বাভাবিকভাবেই। দাসপ্রথার বিলুপ্তির বিবাদ রুপ নেয় আমেরিকার গৃহযুদ্ধে।দক্ষিণের রাস্ট্রগুলোর সম্মিলিতভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে কিনা, তা-ই প্রধান হয়ে সামনে উপস্থিত হলো।

১৮৬১ সালের ১২ই এপ্রিল। কনফেডারেট বাহিনী ফোরট সামারাটে অবস্থাকারী ফেডারেল সৈন্যবাহিনির উপর আক্রমণ করে বসে এবং ফেডারেল সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়। ফেডারেল বাহিনীর প্রাথমিক ব্যর্থতা কাটানোর জন্য উত্তরের আরও ২৩ টি রাষ্ট্র এগিয়ে আসে। বলাই বাহুল্য উত্তরের ছিল অধিক জনসংখ্যা, উন্নত প্রযুক্তি আর পক্ষান্তরে দক্ষিনের ছিল আধুনিক সেনাবাহিনী। একই বছরের ২১শে জুলাই, আবারও যুদ্ধে আব্রাহাম লিংকনের সৈন্যরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধ ঐতিহাসিক বুল রান যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৬২ সালের মে মাসের মধ্যে ফেডারেল সৈন্যরা নিউইয়র্ক দখলে সমর্থ হয়। সেপ্টেম্বারে আবারও ভয়াবহ যুদ্ধ সংগঠিত হয় এবং ব্যাপক প্রানহানি ঘটে আর দুই পক্ষ মিলে এক লাখের বেশি সৈন্য নিহত হয়।

গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ও প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন খুন

১৯৬৩ সালের ১লা জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন দাস মুক্তি দিবস অফিসিয়ালি ঘোষনা করেন এবং বিশ্বজনমত নিজের পক্ষে নিয়ে আসেন। রাতারাতি প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার কৃষ্ণাঙ্গ দাস ফেডারেল বাহিনীতে যোগ দেয় এবং যুদ্ধে প্রায় ৩৮হাজার কৃষ্ণাঙ্গ প্রান বিসর্জন দেয়। যুদ্ধ চলতেই থাকে এবং ক্রমান্বয়ে কনফেডারেট বাহিনী পিছু হটতে থাকে। অবশেষে ১৯৬৫ সালের ১১ এপ্রিল কনফেডারেট বাহিনী আত্মসমর্পণ করে ফেডারেল বাহিনীর কাছে এবং এর মধ্য দিয়ে গৃহযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে।

এর মাত্র ৩ দিন পরেই ১৪ এপ্রিল ১৯৬৫ আমেরিকার ১৮তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন স্ত্রীর সাথে নাটক দেখা অবস্থায় একজন অভিনেতার পিস্তলের গুলিতে নিহত হন। খুন করে খুনি পালিয়ে যেতে সমর্থ হন। প্রেসিডেন্টের খুন এবং তার খুনিকে পাকড়াও করার ইতিহাস আরও চমকপ্রদ। আরেক ব্লগে আমি সেটা লিখব ইনশাল্লাহ। আপাতত জেনে রাখুন খুনি অভিনেতার নাম ছিল জন উইল্কিস বুথ।

Previous articleআমেরিকা আবিস্কার করেন সর্বপ্রথম কে? কলোম্বাস, আমেরিগো নাকি ভাইকিং?
Next articleWheel Loader সহ যে কোন কন্সট্রাকশন হেভী ইকুপমেন্ট কিনুন।
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।

2 COMMENTS