আইকিউ কি?

আমার আগের একটি ব্লগে আমি আপনাদের সাথে ইকিউ (EQ- Emotional Quotient)   এবং আইকিউ (IQ -Intelligence Quotient) নিয়ে আলোচনা করেছি। অনেকের কাছেই এই দুইটি টার্ম খুবই ভাল লেগেছে। তাদের মাঝে অনেকেই আমাকে রিকুয়েস্ট করেছেন ইকিউ (EQ) এবং আইকিউ(IQ) নিয়ে আরও ডিটেইল লিখতে। আপনাদের রিকুয়েষ্ট পাওয়ার পর আমারও মনে হয়েছে, একটু ডিটেইল লেখা যেতে পারে। আজকের লেখাটি আমি লিখব আইকিউ কি? কিভাবে আইকিউ হিসাব করা হয়? আইকিউ কিভাবে আবিস্কার হল এবং আমাদের জীবনে আইকিউ কতটা প্রভাব ফেলে?

আইকিউ (IQ -Intelligence Quotient) কি?

IQ = Intelligence Quotient নট Question অনেকেই এটা ভুল জানেন এবং বলেন। আজকে থেকে জেনে রাখুন আইকিউ মানে হল Intelligence Quotient. শব্দগতভাবে যদি আমরা এর অর্থ করি তাহলে দাঁড়ায়-

  • Intelligence মানে হল বুদ্ধিমত্তা আর Quotient মানে হল ভাগফল।
  • Intelligence Quotient তাহলে কি দাড়াল- বুদ্ধিমত্তার ভাগফল।

কিভাবে আইকিউ হিসাব করা হয়?

ব্যাপারটা ঠিক বুঝা গেলনা, তাইনা। Quotient শব্দটি আসলে গণ্ডগোলের মূল। কিন্তু না, আইকিউ মূলত একটা রেশিও (Ratio) বা অনুপাত, যা কিনা একজন মানুষের মেন্টাল এইজ (Mental Age) এবং ক্রোনোলজিকাল এইজের (Chronological Age) ভাগফল তাই এমন নামকরন। ক্রোনোলজিকাল এইজ মানে হল প্রকৃত বয়স।

আইকিউ এর বাংলা হল বুদ্ধাংক। কিছু নমুনা প্রশ্নপত্র দিয়ে মানুষের বুদ্ধিমত্তা পরিমাপের একটি পদ্ধতি হল আইকিউ বা বুদ্ধাংক। একজন মানুষ কতটুকু বুদ্ধিমান তা নির্ণয় করাই এর মূল উদ্দেশ্য।

আইকিউ= (মেন্টাল এইজ / ক্রোনোলজিকাল এইজ বা প্রকৃত বয়স) গুনন ১০০

এখানে,

  • মেন্টাল এইজ হল- যত বছরের বয়সের জন্য করা প্রশ্নপত্র আপনি সল্ভ করতে পারবেন সেটা।
  • ক্রোনোলজিকাল এইজ হল- জন্মের পর আপনার বয়স বা প্রকৃত বয়স ।
  • আর ১০০ হল আর কিছুই না একটা ধ্রুবক (Constant) যা ভগ্নাংশ এভয়েড করার জন্য দেয়া হয়েছে।

একজন মানুষ যদি তার জন্য করা তৈরি করা প্রশ্নের সকল প্রশ্নের জবাব নির্ধারিত সময়ের ভেতরে দিতে সক্ষম হয় তাহলে তার আইকিউ সূত্রানুযায়ি হবে ১০০। কিভাবে?

ধরি, দশ বছর বয়সের শিশু যদি তার জন্য করা প্রশ্নের সকল প্রশ্নের জবাব নির্ধারিত সময়ের ভেতরে দিতে সক্ষম হয় তাহলে, তার আইকিউ হবে, (১০/১০)*১০০= ১০০।

আবার, দশ বছর বয়সের শিশু যদি তের বছর বয়সের জন্য করা প্রশ্নের সকল প্রশ্নের জবাব নির্ধারিত সময়ের ভেতরে দিতে সক্ষম হয় তাহলে, তার আইকিউ হবে, (১৩/১০)*১০০= ১৩০।

এখন আপনার নিশ্চই এখন জানতে ইচ্ছা করছে আপনার আইকিউ কত? কিন্তু মনে রাখবেন, একটি সত্যিকারের আইকিউ টেষ্ট স্ট্রাকর্চাড, রিসার্চড, সাইকলোজিকাল ব্যাকিং দিয়ে ক্লিনিক্যালি এসেস করা। এবং এধরনের টেষ্ট কন্ডাক্ট করেন প্রফেশনাল ট্রেইনারেরা। অনলাইনে আইকিউ টেস্ট দিয়ে আপনি আপনার আইকিউ কত তা বের করতে পারবেন না।

অনেকেই হয়ত, তার বাচ্চার আইকিউ কত তাও বের করতে চাইতে পারেন। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আপনার বাচ্চা যদি পুরাপুরি সুস্থ্য এবং স্বাভাবিক থাকে কোন দরকার নাই আইকিউ টেষ্ট করার।

তাছাড়া আইকিউ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র মাঝে মাঝেই আপডেট করা হয়। আর আমাদের বাংলাদেশের মানুষের ত আইকিউ টেষ্ট করারই দরকারই নাই। কারন এরা লাষ্ট দশ বছরের প্রশ্ন পত্র ঠাটা মুখস্ত করায় ওস্তাদ।

আজকে যদি সরকার বলে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হতে হলে শিশুর আইকিউ ১২০ হতে হবে সব বাবা-মা তার সন্তানদের আইকিউ এর সব প্রশ্ন মুখস্ত করিয়ে নিবে। কি ভয়ঙ্কর ব্যাপার! একবার ভাবুন তো?

আইকিউ আবিস্কারের ইতিহাস

১৯৮২ সালে সর্ব প্রথম এক ব্রিটিশ পরিসংখ্যানবিদ ফ্রন্সিস গাল্টন মানুষের বুদ্ধিমত্তা নির্ণয়ের জন্য কিছু সাধারণ পরীক্ষা বের করেন। এরপর বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ফ্রান্সের এক স্কুলের ম্যানেজমেন্ট স্কুলের কোন কোন বাচ্চার স্পেশাল কেয়ার নেয়া প্রয়োজন তা নির্ণয়ের জন্য দুইজন মনোবিজ্ঞানির শরণাপন্ন হন।

১৯০৫ সালে ফ্রান্সে সেই দুইজন মনোবিজ্ঞানি Alfred Binet এবং Théodore Simon  একটি পরীক্ষা পদ্ধতি ডিজাইন করেন শিশুদের জন্য। যেখানে তিনি ঐসব শিশুদের আলাদা করতে চেয়েছিলেন যাদের প্রতি শিক্ষকদের আলাদাভাবে মনোযোগ দেয়া দরকার।

এরপর ১৯১৬ সালে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম. এন. টারম্যান প্রথম বুদ্ধিমত্তা পরিমাপকের গানিতিক পদ্ধতি আবিস্কার করেন। তিনিই প্রথম আইকিউ (IQ- Intelligence Quotient) শব্দটি ব্যবহার করেন।

আইকিউ টেষ্ট কেন ব্যবহার করা হয়?

আইকিউ টেষ্ট বেশ কয়েকটি কারণে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এর মধ্যে সবচেয়ে ইম্পরট্যান্ট যেটা সেটা হল শিশুদের ক্ষেত্রে যাদের স্কুলে পারফর্মেন্স খারাপ হচ্ছে কেন খারাপ হচ্ছে তা ডায়াগনোসিস করার জন্য।

আর বড়দের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি করা হয় চাকরির ইন্টারভিউতে আর ছাত্রদের ক্ষেত্রে কোন একাডেমিক ভর্তি পরীক্ষায় আইকিউ টেষ্ট নেয়া হয়।

আইকিউ টেস্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ?

এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর দেয়া আসলেই খুব কঠিন। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সূচনা থেকেই মানুষ তার ব্রেইন বা মস্তিস্ক নিয়ে জানতে চেয়েছে। আইকিউ টেষ্ট মানুষের এই জানতে চাওয়ার একটা বহিঃপ্রকাশ মাত্র।

লো আইকিউ মানে এই নয় যে আপনার কুয়ালিটি খারাপ, আপনি জীবনে সফল হতে পারবেন না। বরং দেখা যায় একেকজন একেক এরিয়াতে ভাল করতে পারে। কেও একটা ব্যাপার ভাল বুঝলে অন্য একটা ব্যাপার কম বুঝে, অন্য কেও হয়ত তার উল্টাটা।

তবে, কারও আইকিউ একদমই কম হলে মানে বিলো ৭০ হলে তার ক্ষেত্রে স্পেশাল কেয়ার লাগবে।

আইকিউ টেষ্ট কি একিউরেট?

এটা আরেকটা আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আইকিউ টেষ্ট কি একিউরেট? এটাকে কি স্ট্যান্ডার্ড প্রসেস (Standard Process) বলা যায়? একটা মানুষের ক্ষেত্রে আইকিউ টেস্টের দিনটি কোন কারণে খারাপ যেতে পারে। হয়ত সে আগের রাত্রে ভাল ঘুমাতে পারেনি, হয়ত তার ফ্যামিলিতে কোন সমস্যা চলছে কিংবা সকালে সে খেয়ে আসতে পারেনি।

বিলিভ মি, সকালে আপনি ভাল খেয়েছেন কিনা সেটার উপরেও নির্ভর করে আপনার মাথা সঠিকভাবে কাজ করবে কিনা। তাই আপনার বাচ্চাকে স্কুলে পাঠানোর আগে ভালমত খাইয়ে পাঠান।

আইকিউ স্কোর কি আপনার সফলতার নির্ণায়ক?

না, মোটেই না। আইকিউ টেষ্ট স্কোর মোটেই আপনার সফলতার নির্ণায়ক হতে পারেনা। বরং এটা একজন মানুষের পোটেনশিয়ালিটি বের করতে পারে। মানে আপনি কতটুকু পোটেনশিয়াল(Potential)  আইকিউ টেষ্ট তা বের করতে পারে।

কারন আপনার জীবনের সফলতার জন্য আই কিউ এর সাথে কম করে হলেও আরও চারটি প্রভাবক লাগে-

Ambition, Motivation, Opportunity, Ability to think to think clearly under pressure ইত্যাদি ইত্যাদি।

আইকিউ টেষ্টে এই চারটির কোনটিকেই কনসিডার করা হয়না। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আইকিউ কখনই আপনার জীবনের সফলতার চাবিকাঠি নয়।

কয়েকটা কেস আমরা একটু চিন্তা করে দেখি-

  • একজনের আইকিউ স্কোর খুব ভাল কিন্তু সে পরীক্ষার আগে খুব এংজাইটিতে ভোগে ফলে ভাল রেজাল্ট করতে পারেনা।
  • একজনের আইকিউ স্কোর খুব ভাল কিন্তু সে পরীক্ষার খাতায় যা জানে লিখে তা প্রকাশ করতে পারেনা।
  • আবার কারও আইকিউ স্কোর মোটামুটি, পড়াশোনা কোনভাবে পার করেছে কিন্তু চাকরিতে সে তার পছন্দের ক্যারিয়ার বেঁছে নিয়ে খুব ভাল করছে।

তাই আপনার আইকিউ স্কোর ভাল হলেই যে আপনি পরিক্ষায় ভাল করতে পারবেন তা কিন্তু না।

মানুষের আইকিউ কি বাড়ে?

মানুষের আইকিউ সীমাবদ্ধ নয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে এটি বাড়তে থাকে। এভাবে বাড়তে বাড়তে একসময় এটি একটি সংখ্যাতে রূপ নেয়। একসময় এটি ফিক্সড হয়ে যায়।

আমরা অনেক সময় চাই আমাদের বুদ্ধি বাড়াতে, তা কি সম্ভব? চর্চার মাধ্যমে অবশ্যই এটি সম্ভব হতে পারে। আইন্সটাইনের আইকিউ লেভেল অনেক হাই ছিল (১৬০)। এখন তাকে যদি কোন গ্রামের পরিবেশে থাকতে বাধ্য করা হত তাহলে তিনি অবশ্যই আইন্সটাইন হয়ে উঠতে পারতেন না।

তাই বলাই যায়- মানুষের আইকিউ লেভেল চর্চার মাধ্যমে বাড়তে পারে। সাধারনভাবে ধরে নেয়া হয় নিচের কাজগুলোর মাধ্যমে কারও আইকিউ লেভেল বৃদ্ধি পেতে পারে।

  • গল্পের বই পড়া। অন্ততঃ সপ্তাহে একটি গল্পের বই পড়া।
  • নানা ধরনের মেমরি গেইম খেলা। সুডুকো, পাজেল ইত্যাদি।
  • শরীর চর্চা করা, খেলাধুলা করা।
  • পুষ্টিকর খাবার খাওয়া।
  • ধাঁধার উত্তর খোঁজা, গাণিতিক সমাধান করা।
  • পরিমাণ মত ঘুমানো

উপরের অভ্যাসগুলো রপ্ত করতে থাকলে আশা করা যায় এগুলো আপনার আইকিউ লেভেল বাড়াতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

আমি আমার পরের লেখায় চেষ্টা করব ইকিউ (EQ- Emotional Quotient) নিয়ে আরেকটু বিস্তারিত লেখার, আজ আইকিউ (IQ -Intelligence Quotient) পর্যন্তই থাকুক। ততদিন পর্যন্ত আপনার সবাই ভাল থাকুন, সুস্থ্য থাকুন আল্লাহ হাফেয।

Previous articleEmotional Intelligence কি? কেন Emotional Intelligence গুরুত্বপূর্ণ?
Next articleডিজিটাল প্রপার্টি কিনে রাখুন। ভবিষ্যতের আয়ের রাস্তা খোলা রাখুন।
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।