রক ব্যান্ড কুইন

 

রক ব্যান্ড শ্রোতাদের মধ্যে কুইন-এর নাম শোনেন নি এমন মানুষ মনে হয় একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না। রক জগতের আইকন বলতেই প্রথমে মনে আসে লন্ডন-ভিত্তিক রক ব্যান্ড “কুইন” এর কথা।  ১৯৭০ সালে যাত্রা শুরু করা কুইন আজও বিশ্বজুড়ে মাতিয়ে রেখেছে শ্রোতাদের। বলা হয়, সঙ্গীতজগতে সবচেয়ে পুরানো এবং সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে থাকা ফ্যানবেসটি হলো কুইনের। আজ কথা বলছি সেই কুইন নিয়ে আমি উম্মে শারিকা

রক ব্যান্ড কুইন- ইতিহাস

“কুইন” যখন “কুইন” ছিল না, অর্থাৎ বর্তমান নামটি নেবার আগে ব্যান্ডের গিটারিস্ট ব্রায়ান মে এবং ড্রামার ও ব্যাকিং ভোকাল রজার টেইলর দুইজনে একটি ডুও ব্যান্ড পরিচালনা করতেন – যার নাম ছিল “স্মাইল”।  ১৯৬৮ সালে লন্ডনের ইম্পিরিয়াল কলেজে অধ্যয়নরত ছিলেন ব্রায়ান মে, সে সময়ে তার এবং তার বন্ধু টিম স্ট্যাফেলের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল স্মাইল। ড্রামার হিসেবে তাতে এসে যোগ দেন ডেন্টালের ছাত্র রজার টেইলর। কিছুদিন বাদে স্ট্যাফেলের পরিচয় হয় ফ্রেডি বুলসারার সাথে। ফ্রেডি ছিলেন পারসিয়ান বংশোদ্ভূত, জাঞ্জিবার থেকে আগত ছাত্র যিনি লন্ডনে গ্রাফিক আর্ট এন্ড ডিজাইন বিষয়ে পড়ালেখা করছিলেন। ফ্রেডি “স্মাইল” এর গান শোনার পর তাদের ভক্ত হয়ে পড়েন।

১৯৭০ সালে স্ট্যাফেল “স্মাইল” ছেড়ে দিয়ে আরেকটি ব্যান্ড “হাম্পি বং”-এ যোগ দেন। তখন ফ্রেডি যোগ দেন “স্মাইল” এর নতুন সদস্য হিসেবে, সাথে প্রস্তাবনা রাখেন “কুইন” নামটির। নাম পরিবর্তনের পর ১৯৭০ সালের ১৮ জুলাই কুইন তাদের প্রথম শো করে। বেজ বাদকের পদে বেশ কয়েকজন মানুষের আনাগোনা হয় কুইনে, কারো সাথে খাপ খাচ্ছিল না ব্যান্ডের অন্যান্যদের। অবশেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে জন ডিকনকে সাদরে গ্রহণ করার পর তাদের স্থায়ী একটি পরিস্থিতি গড়ে উঠে, চারজনের এই ঐতিহাসিক লাইন-আপই ছিল কুইনের স্বর্ণযুগ। জন ডিকন আসবার পর অবিলম্বে প্রথম এলবামের জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা শুরু করেন তারা।

ফ্রেডি বুলসারা থেকে ফ্রেডি মারকিউরি হবার পেছনের রহস্য হলো “My Fairy King” গানের দু’টি লাইন – “Mother Mercury, look what they’ve done to me”… সে সময়ে কুইনের সদস্যরা চারটি গান রেকর্ড করেন, কিন্তু কোনো রেকর্ড কোম্পানি তাদের বিষয়ে আগ্রহী ছিল না। ১৯৭১ সালের ২ জুলাই চারজন প্রথম লাইভ শো করেন লন্ডনের অদূরে একটি কলেজে।

রক ব্যান্ড কুইন- অভ্যুত্থান

কুইন এর লোগো ডিজাইন হয়েছিল ফ্রেডি মারকিউরির হাতে, তাদের প্রথম এলবাম মুক্তি পাবার কিছুদিন আগে তিনি লোগোটি ডিজাইন করেছিলেন – ব্যান্ডের চার সদস্যের সবার রাশি চিহ্ন মিলিয়ে তৈরি করা হয় লোগোটি। ১৯৭২ সালে কুইন নেপচুন প্রোডাকশনের ব্যবস্থাপনায় থেকে রিহার্সাল চালাতে থাকে। পরের বছর ট্রাইডেন্ট স্টুডিওর সাথে চুক্তি করে তারা, সে বছরের জুলাই মাসে তাদের ডেব্যু এলবাম মুক্তি পায় – এলবামের নাম দেয়া হয়েছিল ব্যান্ডের নামে। মুক্তির পর ক্রিটিক্সদের কাছে সমূহ প্রশংসা পায় কুইন। এলবামের লীড সিঙ্গেল “Keep Yourself Alive” গানটি রোলিং স্টোনের পক্ষ থেকে অত্যন্ত সমাদৃত হয়েছিল।

কুইনের দ্বিতীয় এলবাম “Queen II” মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। ব্রিটিশ এলবাম চার্টে পঞ্চম স্থান দখল করে নেয় এই এলবাম। ফ্রেডি মারকিউরির লেখা গান “Seven Seas Of Rhye” ছিল কুইন এর প্রথম হিট গান। ইতিবাচক ও নেতিবাচক দু ধরণের প্রতিক্রিয়াই পেতে শুরু করে কুইন। তখনকার সময়ের কিংবা সর্বসময়ের সব মিউজিক থেকে কুইন এর গানের আলাদা ধরণ ছিল, তাদের বিশেষত্ব ছিল তারা কেবল গান করতো না, গান নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা আর গবেষণা চালাতো ক্রমাগত।  নতুন ধরণের কিছু আনার চেষ্টায় রত ছিল তারা, যেকোনো এক ক্ষেত্রে বাঁধা থাকতে চায় নি। “টিপিক্যাল” থেকে দূরে সরে যাওয়া তখন ছিল সাহসিকতার কাজ, কারণ সবাই নতুনত্ব গ্রহণ করতে চায় না। সেই চ্যালেঞ্জ সাদরে গ্রহণ করেছিল কুইন, আর করেছিল বলেই নিজেদের পদচারণা রক জগতে স্থায়ীভাবে চিহ্নিত করে নিয়েছে তারা।

১৯৭৪ সালে কুইন এর তৃতীয় এলবাম “Sheer Heart Attack” মুক্তি পায়, এই এলবামের মাধ্যমেই প্রথম আন্তর্জাতিক পরিচিতির স্বাদ লাভ করে তারা। বিভিন্ন জনরার গানের ছোঁয়া ছিল এই এলবামটিতে। এলবামের সিঙ্গেল “Killer Queen” বিলবোর্ড হট ১০০ চার্টে বারো নাম্বারে জায়গা করে নেয়।

এছাড়া “Now I’m Here”, “Stone Cold Crazy” এই গানগুলোও আলাদা আলাদাভাবে নজর কাড়ে সবার, এলবামটি জায়গা করে নেয় বহু চার্টে। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে তারা একটি ওয়ার্ল্ড ট্যুর শুরু করে, বেশ কিছু জায়গায় শো করে তারা। সে বছর মুক্তি পায় তাদের “A Night At The Opera” এলবামটি। তখন পর্যন্ত এই এলবামটি ছিল সর্বকালের সবচেয়ে খরচবহুল এলবাম এবং ব্রিটেনের ইতিহাসে সেরা পঞ্চাশটি এলবামের একটি ধরা হয় একে।

“The Prophet’s Song” ও “Love Of My Life” গান দু’টি প্রচুর খ্যাতি অর্জন করে। কুইন এর ইতিহাসেও যে গানটিকে ভক্তরা সেরা সৃষ্টি হিসেবে আখ্যা দিয়ে আসছেন সেই “Bohemian Rhapsody” ছিল এই এলবামের গান। কুইন এর নাম উচ্চারণ করলে আজও পাশাপাশি ভেসে উঠে “Bohemian Rhapsody”-র নাম, এটি এখন পর্যন্ত একমাত্র সিঙ্গেল যেটি দু’টি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে দু’বার মিলিয়ন সেলার হয়েছিল এবং যুক্তরাজ্যে দু’বার ক্রিসমাস নাম্বার ওয়ান হয়।

১৯৭৬-এ মুক্তি পায় “A Day At The Races” যেটাতে স্থান পেয়েছিল তাদের আরেকটি যুগান্তকারী গান “Somebody To Love’, সাথে ব্রায়ান মে-র “Tie Your Mother Down”। সে বছরই লন্ডনের হাইড পার্কে কুইনের একটি ফ্রি কনসার্ট হয়েছিল, যাতে উপস্থিত ছিল দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। ১৯৭৭ এ মুক্তি পাওয়া এলবাম “News Of The World” বরাবরের মতোই অগণিত সাফল্য লাভ করে – এলবামের “We Will Rock You” এবং “We Are The Champions” গান দু’টি বিশ্বজুড়ে স্পোর্টস এন্থেম হিসেবে ব্যবহৃত হয় পরবর্তীতে।

১৯৭৮ সালে মুক্তি পায় “Jazz” এলবাম এবং পরের বছর মুক্তি পায় তাদের প্রথম লাইভ এলবাম “Live Killers”… সে বছরই বের হয়েছিল তাদের আরেকটি সুখ্যাত সিঙ্গেল “Crazy Little Things Called Love”, যা তাদের আশির দশকের প্রথম কাজ “The Game” এ স্থান পেয়েছিল ও প্রশংসা কুড়িয়েছিল – “Another One Bites The Dust” এর সঙ্গে সঙ্গে।

১৯৭৪ সাল থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত ব্যান্ডের সেরা কাজগুলো নিয়ে কুইন রিলিজ করে তাদের কম্পাইলেশন এলবাম “Greatest Hits”, মে ২০২০ সালের হিসাব অনুযায়ী যেটি ৩৮৪ সপ্তাহ ধরে জায়গা নিয়ে আছে ইউএস বিলবোর্ড ২০০-তে।

ব্যান্ডের প্রথম মেম্বার হিসেবে রজার টেইলর ১৯৮১-তে সোলো এলবাম বের করেন – “Fun In Space” নামে। পরের বছর কুইন-এর “Hot Space” মুক্তি পায়, যেটি তাদের সত্তরের দশকের গানের ধরণ থেকে কিছুটা সরে গিয়ে রক, পপ রক, ডান্স, ফাংক এবং আর এন্ড বি-র মিশ্রণ হিসেবে উপস্থাপিত হয়।

১৯৮৩ সালে লাইভ শো করার বদলে তারা নিজেদের সোলো ক্যারিয়ার এবং সাইড প্রজেক্টে মন দেন, পরের বছরে তাদের এগারোতম স্টুডিও এলবাম “The Works” মুক্তি পায়। এলবামের সবচেয়ে সাফল্য পাওয়া গান ছিল “Radio Ga Ga, “I Want To Break Free” এবং “”Hammer To Fall” – যার মধ্যে দ্বিতীয়টি ছিল একটি ব্রিটিশ সোপ অপেরা “করোনেশন স্ট্রীট” এর প্যারোডি। কন্ট্রোভার্সির কারণে এটি এমটিভি থেকে ব্যানড হয়।

কুইনের সবচেয়ে ঐতিহাসিক পারফরম্যান্স ছিল ১৯৮৫ সালের লাইভ এইড কনসার্টের পারফরম্যান্স। ১৩ই জুলাই, ১৯৮৫ সালে হওয়া এই কনসার্টের ছিল ১.৯ বিলিয়ন টিভি দর্শক, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে উপচে পড়া ৭২,০০০ দর্শকের হাততালি ও উল্লসিত চিৎকারে সেদিন যেন ভেসে গিয়েছিল ওয়েম্বলি। আরো অনেক বিখ্যাত ও সুপরিচিত ব্যান্ড ও গায়ক থাকবার পরেও দর্শক-শ্রোতাদের হৃদয় পুরোপুরি কেড়ে নিয়েছিল কুইন, দিনের হাইলাইট ছিল তারাই। বলা হয় “We Will Rock You” গানে মারকিউরির “Aaaaaay-o” এবং তার উত্তরে শ্রোতাদের জবাব মিলিয়ে করা “Call-and-response A capella” অংশটি যেন কাঁপিয়ে দিয়েছিল পুরো বিশ্বকে।

১৯৮৬ সালের প্রথমদিকে তাদের “A Kind Of Magic” এলবামটি রিলিজ হয়। কুইনের প্রতিটি কনসার্টে তখন উপচে পড়া ভীড়, সমস্ত সিঙ্গেল কিংবা এলবাম বিক্রি হচ্ছে চোখের পলকে – রেকর্ডের পর রেকর্ড গড়তে শুরু করে তারা। ১৯৮৯ সালে মুক্তি পায় “The Miracle” যেই এলবামের একই নামের গানটিতে ব্রায়ান মে-র গিটার সোলো এখনো একটি আইকনিক পারফরম্যান্স হিসেবে পরিগণিত হয়।

ফ্রেডি ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছিলেন

এতোকিছুর মধ্যেই সকলের চোখে ধরা পড়তে শুরু করে ফ্রেডির অসুস্থতা। যদিও ফ্রেডি নিজে কখনো স্বীকার করতেন না তিনি অসুস্থ। ১৯৯০ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষবারের মত তিনি মিডিয়া কিংবা জনগণের সামনে আসেন ব্রিট এওয়ার্ডের খাতিরে। ১৯৯১ সালে কুইন এর “Innuendo” এলবামটি মুক্তি পায়, যাতে ছিল “The Show Must Go On” গানটি। এই গান এবং আগেকার পারফর্ম্যান্সগুলো থেকে ভেসে উঠতে থাকে একটি চিত্র, ফ্রেডি ধীরে ধীরে ছেড়ে যাচ্ছিলেন সবাইকে, মারা যাচ্ছিলেন এইডসে – কিন্তু তার জীবনের সবচেয়ে বড় প্যাশন গান কখনো ছেড়ে দেন নি। অসুস্থতা লুকিয়ে রেখেই কাজ করে যাচ্ছিলেন দিনের পর দিন। কোনোকিছু ছাপিয়ে উঠতে পারে নি তার স্বপ্ন ও পরিশ্রমকে – নিজের অপ্রতিরোধ্য মৃত্যুও নয়। তার মধ্যে ভয় ছিল না কখনো, সঁপে দিয়েছিলেন কুইনের গানের মধ্যে নিজেকে। অক্টোবর, ১৯৯১ তে মুক্তি পায় “Greatest Hits II” এবং তার পরপরই নভেম্বর মাসে ফ্রেডি তার অসুস্থতার কথা খোলাখুলি জানান। একদিন পরই এইডস রিলেটেড ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ায় মারা যান তিনি।

কুইনের সাথে ফ্রেডির শেষ কাজ ছিল “Made In Heaven” এলবামে, যেটি ১৯৯৫-তে মুক্তি পায়। দু’বছর পর তার জন্য কুইনের অন্য সদস্যরা “No-One But You” গানটি রেকর্ড করে যা “Queen Rocks” এলবামে যুক্ত হয়। সে বছর জানুয়ারিতে জন ডিকন শেষবারের মত উপস্থিত হন সকলের সামনে, এরপর তিনি অবসর নেন স্থায়ীভাবে। বলা হয় ফ্রেডির মৃত্যু তাকে আঘাত করেছিল অনেক বেশি, যেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব হয় নি।

রক ব্যান্ড কুইন জীবিত আছে পঞ্চাশ বছর ধরে

ব্যান্ডের প্রথম দু’জন সদস্য ছিলেন ব্রায়ান এবং রজার, শেষ দু’জন সদস্য হিসেবে তারাই এখন চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন কুইনকে। ফ্রেডির স্বপ্ন ব্যর্থ হয় নি, কুইন জীবিত আছে পঞ্চাশ বছর ধরে, লীড সিঙ্গার হিসেবে সময়ে সময়ে একেকজন গায়ক এসেছেন – কাজ করেছেন কুইন এর সাথে। তার মধ্যে Paul Rodgers ছিলেন অন্যতম, বর্তমানে চলছে Queen+Adam Lambert। ব্যান্ডটির আবেদন কোনোদিন কমে নি পাঁচ দশক পার হবার পরেও, বরং সময়ের সাথে সাথে ভক্তকূল বেড়েছে আরো। আশা করা যায় অসংখ্য কালজয়ী সৃষ্টি নিয়ে কুইন আরো বহু বছর বেঁচে থাকবে একইভাবে।

Previous articleআমি কিভাবে ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করলাম পর্ব-০১
Next articleস্নায়ু রোগ- এপিলেপসি ও পারকিনসন