বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
Famine in Bangladesh

অনেকেই করোনা ভাইরাস সংক্রমণ পরবর্তী সময়ে পৃথিবীতে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার আশংকা করছেন, কেওবা আশংকা করছেন বেকারত্বের হার কয়েকগুন হবার এবং ফলাফলস্বরুপ ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ হবার আশংকা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায়না। রেডিটুরিডিং ব্লগের পাঠকদের জন্য তাই আজকের ব্লগে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হবে।

দুর্ভিক্ষ কাকে বলে

কোন নির্দিষ্ট এলাকায় খাদ্যের সংকট কিংবা সরবরাহের অভাবে ওই এলাকার মানুষের অনাহারজনিত চরম অবস্থাকেই দুর্ভিক্ষ বলে। এর কারণ হিসেবে খরা, বন্যা, জলতছাস, অতিবৃষ্টি, পঙ্গপাল, ফসলের রোগ, মড়ক, ত্রুটিপূর্ণ পরিবহন ব্যবস্থা, যুদ্ধ, মহামারী ইত্যাদি হতে পারে। আমরা নিকট অতীতে উত্তর কোরিয়া, সোমালিয়া, ইয়েমেন, সাউথ সুদান ইত্যাদি জায়গায় দুর্ভিক্ষ দেখলেও বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ গত ৩০/৪০ বছরে আমরা দেখিনি।

বাংলার দুর্ভিক্ষের ইতিহাস

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে মহাস্থানগড়ের শিলালিপিতে এই অঞ্চলে প্রথম দুর্ভিক্ষের খবর পাওয়া যায়। কিন্তু পরবর্তীতে কয়েক শতাব্দিতে আর কখনও দুর্ভিক্ষের তথ্য পাওয়া যায় নি। কিন্তু ধরে নেয়া হয় প্রায়শই এই অঞ্চলের মানুষ দুর্ভিক্ষতুল্য দারিদ্রের মাঝেই বাস করত। বড় কোন দুর্ভিক্ষের তথ্য যদিও অজানা।

আমাদের আজকের এই বাংলাদেশের ভুখন্ডে বিগত কয়েকশ বছরের মাঝে কয়েকবার দুর্ভিক্ষ হানা দেয়।

ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

বাংলা ১১৭৬ সন, ইংরেজি ১৭৭০ খ্রিস্টাব্দ। তখন ছিল চরম অর্থনৈতিক মন্দা। অত্যাধিক বৃষ্টিপাত এবং বন্যায় কৃষক সেবার ফসল ঘরে তুলতে পারেনি। এর উপর রাজস্ব ব্যবস্থা এবং খাদ্যবাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্তের ফলে সাধারণ মানুষের অবস্থা চরমে পৌছে। ব্রিটিশ শাসকেরা পুরো ব্যাপারটিকে প্রাকৃতিক বিপর্যয় বলে দাবি করে। বিভিন্ন সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, ১৭৬৮ সালে রাজস্ব আদায় হয় ১৫.২১ মিলিয়ন রুপি এবং ১৭৭১ সনের আদায়কৃত রাজস্ব ছিল ১৭৬৮ সনের চেয়ে ৫২২,০০০ রুপি বেশি। অর্থাৎ, ব্রিটিশ শাসকেরা এবং তাদের দোসররা দুর্ভিক্ষের বছরও রাজস্ব আদায়ে কোন ছাড় দেয়নি। এই দুর্ভিক্ষে মোট জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ মানে প্রায় ১০ মিলিয়ন মানুষ মারা যায়। এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত।

Bengal Famine 1770
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর

১৮৯৬-১৮৯৮ এর দুর্ভিক্ষ

১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে বাংলার কিছু এলাকায় দুর্ভিক্ষ দেখা যায় তবে প্রধান ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চল ছিল উড়িষ্যা। এসময় দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলগুলোতে কৃষিশ্রমিকদের মজুরি কমে যায়। সেবারই প্রথমবারের মতো দুর্ভিক্ষের কারণ খতিয়ে দেখা এবং সমাধানসূচক পরামর্শের জন্য বর্ধিত ক্ষমতাসহ ফেমিন কমিশন নামে একটি কমিশন গঠন করা হয়। এছাড়াও ১৮৯৬-১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সহ বিহার, বোম্বে, অযোদ্ধা, মধ্যদেশ ও পাঞ্জাব দুর্ভিক্ষে আক্রান্ত হয়।

বাংলায় এর মূল কারণ ছিল অনাবৃষ্টি। বাজারে খাদ্যের সরবরাহ থাকলেও তা সাধারনের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। বাজারে খাদ্যশস্যের দাম বহুগুণ বেড়ে গেলেও, সরকারের দিক থেকে তা নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ ছিল না। ১৮৯৭ সনের ডিসেম্বরে স্যার জে.বি লায়াল-এর নেতৃত্বে একটি ফেমিন কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের পর্যবেক্ষণে জানা যায় যে বিগত ২০ বছরে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বাড়লেও কৃষি-শ্রমিক পেশাজীবীদের মজুরি সেই অনুপাতে বাড়ে নি।

পঞ্চাশের মন্বন্তর

১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলা ১৩৫০ সনে এই অঞ্চল আরেকটি দুর্ভিক্ষের কবলে পরে। ১৯৩৮ সাল থেকে একনাগারে ফসলহানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ আরও কিছু আনুষঙ্গিক ঘটনার কারণে বাংলার মানুষ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। খাদ্যশস্য আমদানি বন্ধ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিঘ্ন, সরকারের ব্যর্থতা ইত্যাদি সব মিলিয়ে বাংলার সার্বিক অবস্থার চরম অবনতি হয়। এই দুর্ভিক্ষে ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ না খেয়ে মারা যায়। সমগ্র বাংলাদেশেই এই দুর্ভিক্ষ আঘাত হানে। এই দুর্ভিক্ষ পঞ্চাশের মন্বন্তর নামে পরিচিত।

Bengal Famine 1943
পঞ্চাশের মন্বন্তর

স্বাধীন বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ

সর্বশেষ ১৯৭৪ সাল, স্বাধীন বাংলাদেশ দুর্ভিক্ষের শিকার হয়। ১৯৭৪ সালে সারা পৃথিবীতে খাদ্য ঘাটতি দেখা দিলেও বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কারণ খাদ্য ঘাটতি ছিলনা। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের অন্যতম কারণ ছিল আকস্মিক দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, দুর্বল খাদ্য বন্টন ব্যবস্থা, যুদ্ধ পরবর্তী রুপান্তর অবস্থা, বিধ্বস্ত অর্থনীতি, প্রত্যাগত শরণার্থীর পুনর্বাসন, মুদ্রাস্ফিতি, মাথাপিছু আয় ক্রমান্বয়ে হ্রাস, ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি। দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকারি ব্যবস্থা তেমন কার্যকর ছিলনা। মোট মৃতের সংখ্যা আনুমানিক ১০০,০০০-৪৫্‌০০০ জন বেসরকারি হিসেবে। সরকারি হিসেবে ২৭০০০ জন মাত্র। দুর্ভিক্ষের পাশাপাশি ম্যালেরিয়া, ডায়েরিয়া এবং কলেরাও মৃত্যুর কারণ ছিল।

Famine in Bangladesh 1974
১৯৭৪ সালের বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ।

সব মিলিয়ে এই ছিল সংক্ষেপে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। ইতিহাস থেকে আমরা দেখতে পাই এই অঞ্চলে যখনই দুর্ভিক্ষ হয়েছে শাসকশ্রেণী কখনোই সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করতে পারে নাই, বরং মধ্যস্বত্বভোগিরা সবসময়েই নিজেদের পকেট ভারী করেছে।

করোনা ভাইরাস মহামারী  পরবর্তী সময়ে গোটা পৃথিবীব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দার কথা শোনা যাচ্ছে এবং যেহারে  কর্মসংস্থানের সঙ্কট  তৈরি হচ্ছে তাতে আমাদের অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়।

করোনাকালে করনীয়

আমাদের হাতে যেহেতু এখনও সময় আছে আমরা এখন থেকেই দুর্ভিক্ষ মোকাবেলার জন্য তৈরি হতে পারি। দুর্ভিক্ষের মূল সংকট যেহেতু খাদ্য, আমরা চাইলেই আমাদের চারপাশের প্রতি ইঞ্চি জমির সুষ্ঠ ব্যবহার নিশ্চিত করে খাদ্যাভাব পূরণ করতে পারি। সরকারীভাবে অনাবাদি সকল জমি আবাদের আওতায় আনতে তো হবেই ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদের সচেষ্ট হতে হবে।

যেহেতু সারা পৃথিবীতেই একই সময়ে সংকট শুরু হবে, মনে রাখতে হবে বিদেশের সাহায্য আমরা তেমন পাবনা।

ধন্যবাদ সবাইকে।

বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ব্লগটি ভাল লেগে থাকলে আপনার ফেসবুকে শেয়ার করতে ভুলবেন না। নিচের ফেসবুক শেয়ার বাটনে ক্লিক করে সহজেই শেয়ার করুন।এছাড়াও আমার ব্লগে কমেন্ট করে আপনার অনুভূতি প্রকাশ করতে পারেন।

এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হয়ে আপনি যদি রেডিটুরিডিং ব্লগকে ডোনেট করতে চান তাহলে বিকাশ-০১৬১৪১৭১৭৬৫ অথবা নগদ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ অথবা ইউক্যাশ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ এ আপনার ডোনেশন পাঠাতে পারেন।

অথবা,

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেও আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন। ইউটিউব চ্যানেল লিংক এখানে। আশা করি অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সহযোগীতা করবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হয়ে আরও লেখা পাবলিশ করব।

হোমপেইজে যাওয়ার জন্য ক্লিক করুন

Previous articleWindows 10 এ Auto Update বন্ধ করতে পারছেন না? সহজ ৩টি ধাপ অনুসরণ করুন।
Next articleকরোনা ভাইরাস নিয়ে আমরা কীভাবে বেঁচে থাকব?
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।