ব্যক্তিগতভাবে আমি ইতিহাস পড়তে খুব ভালবাসি, যেকোন ধরনের ইতিহাস। আর আমার দৃষ্টিতে ইতিহাস মানেই হল ক্ষমতার হাতবদল। আমার আজকের ব্লগে আপনাদের প্রাচীন মিশরের এক বিখ্যাত ফারাও রাজার ইতিহাস জানাব। ফারাও সম্রাট তুতেনখামেন। প্রায় ৮/৯ বছর আগে আমি প্রথম পড়েছিলাম এই ফারাওকে নিয়ে। আজকের ব্লগ লিখতে গিয়ে আরও ডিটেইল জানলাম। তো চলুন চলে যাই আজ থেকে প্রায় সারে তিন হাজার বছর আগের সময়ে। আশা করছি আপনাদের খুবই ভাল লাগবে।
কে এই তুতেনখামেন?
মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাস যদি আমরা পর্যালোচনা করি, তাহলে অন্যান্য রাজাদের তুলনায় তুতেনখামেনকে আমরা পাব তুলনামূলক কম পরিচিত। ফারাও এর শেষ সম্রাট ছিলেন তুতেনখামেন যিনি মাত্র নয় বছর বয়সে মিশরের সম্রাট হিসেবে দায়িত্ব কাধে তুলে নেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ১০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তিনি মাত্র ১৯ বছর বয়সে খ্রিষ্টপূর্ব ১৩২৪ সালে রহস্যজনকভাবে মারা যান।
ইউরোপিয়ান প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে তিনি কিং টুট নামে বিশেষ পরিচিত। এখন পর্যন্ত যত মমি আবিষ্কৃত হয়েছে প্রায় সবগুলোতেই চোর-ডাকাতের হাত পরলেও তুতেনখামেনের মমিটি ছিল আশ্চর্যজনকভাবে অক্ষত। অবাক ব্যাপার তাইনা? রহস্য আরও রয়েছে প্রিয় পাঠক, পড়তে থাকুন।
তুতেনখামেনের পিতৃপরিচয়
সাম্প্রতিক প্রত্নতাত্ত্বিকদের আবিস্কার অনুসারে তুতেনখামেনের পিতা ছিলেন আখেনাতেন। আখেনাতেন ছিলেন সূর্যের উপাসক এবং তিনি তার প্রজাদের উপর এই ধর্ম চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। এজন্য তিনি তার নিজস্ব বংশ পরিবর্তন করে আতেন বংশে নিজের নাম লিখান। কিন্তু তখনকার মিশরীয়রা ছিল বায়ুর উপাসক। ইতিহাসবিদেরা মনে করেন একারনেই তার পতন ঘটে। তার মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু নাকি তাকে হত্যা করা হয়েছিল তা এখনও নিশ্চিত নয়।
তুতেনখামেনের স্ত্রীর নাম ছিল আনখেসেনপাতিন, ইতিহাসবিদদের মতে আনখেসেনপাতিন তুতেনখামেনের সৎ বোন ছিল। তখনকার ফারাওদের মাঝে ভাই-বোনের বিয়ের রীতি প্রচলিত ছিল।মুলত তারা নিজেদেরকে দেবতাদের বংশধর মনে করত এবং খাটি বংশরক্ত বজায় রাখার জন্য তারা এই প্রথা চালু করে। এমনকি গবেষকরা মনে করেন এবং তারা এব্যাপারে নিশ্চিত তুতেনখামেনের মা আনখেসেনপাতিন ছিল তার পিতার নিজের কন্যা। জেনে রাখা ভাল ফারাওরা আজাচারে অভ্যস্ত ছিল, যা ছিল তাদের ধংসের কারণ।
সম্রাট হিসেবে তুতেনখামেন
পিতার মৃত্যুর পর তুতেনখামেন মাত্র ৯ বছর বয়সে মিশরের সম্রাটের দায়িত্ব নেন। তার আসল নাম ছিল তুতেন খাতেন সম্রাটের দায়িত্ব নেয়ার সাথে সাথে প্রজাদের সমর্থন ফিরে পাবার জন্য নিজের নাম পরিবর্তন করে নেন। নতুন নাম তুতেনখামেন। এবং স্ত্রীর নাম পরিবর্তন করে রাখেন আনখেসেনপাতিন আমুন।
এখানে একটা ব্যাপার না বললেই নয়, আতেন হল সূর্য দেবতা, আমুন হল বায়ু দেবতা। তখনকার ফারয়াওদের নামের একটা অংশ দেবতাদের নামে হত। প্রজারা এতে রাজাদের অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক দেবতা ভাবত। সম্রাট হবার সাথে সাথে তুতেনখামেন তার পিতার ধর্ম জনগণের উপর চাপিয়ে দেবার পথ থেকে সরে আসে এবং প্রজাদের ধর্মকেই গ্রহন করে সেকারনেই নামের বংশ পরিবর্তন করে নেয়।সম্রাট হিসেবে তুতেনখামেন অনেক পুরান প্রথা পাল্টিয়ে নতুন প্রথারর প্রচলন করেন।
তুতেনখামেনের মৃত্যুর কারণ
মাত্র ১৯ অছর বয়সে রহস্যজনকভাবে তিনি মারা যান। তার মমির উপর গবেষনা করে জানা যায় মাথায় ভারী কিছুর আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছিল, বহুদিন এই তত্ব চালু থাকলেও কেও কেও বলেন ঘোড়ার গাড়ি থেকে পরে গিয়ে তার মৃত্যু হয়েছিল। তার কবরে আকা ছবিতে তাকে যুদ্ধের ছবি দেখে কেও কেও অনুমান করেন তার মৃত্যু যুদ্ধে হয়েছিল। শিকারের ছবি দেখে কেও অনুমান করেন শিকার করার সময় কোন বন্য প্রানির আঘাতে তার মৃত্যু হয়েছে।
ডিএনএ টেস্ট থেকে তার রক্তে লোহিত কনিকার অভাব দেখে অনেকে মৃত্যুর কারণ ভিন্ন বলেও মনে করেন। অনেক গবেষক ম্যালেরিয়াকে তার মৃত্যুর কারণ মনে করে থাকেন। অজাচারে অভ্যস্ত হবার কারণে তুতেনখামেন জন্মগত ত্রূটি নিয়ে জন্মগ্রহন করেন এবং এজন্য অল্প বয়সে হাড়ের ব্যাধিতে তার মৃত্যু হতে পারে বলে ধারণা করা হয়, এটিই সবচেয়ে প্রতিষ্ঠিত ধারণা। যাই হোক তার মৃত্যুর সঠিক কারণ এখনও অজানা কিংবা প্রত্নতত্ববিদেরা কেও একমত হতে পারেন নি।
তুতেনখামেনের অভিসাপ
দীর্ঘ পাঁচ বছর খোজার পর ১৯২২ সালে নভেম্বর মাসে প্রথম তুতেনখামেনের সমাধিতে প্রবেশ করেন পুরাতত্ববিদ হাওয়ারড কার্টার। তার সাথে ছিলেন লর্ড কার্নাবর্ন । অনেক্ চেষ্টার পরে ১৯২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তার তুতেনখামেনের সমাধির দরওয়াজা ভাংতে সক্ষম হন। একটি সোনার তৈরি চেম্বারে আরও কয়েকটি কফিনের সাথে ১৩৫ কেজি ওজনের একটি কফিনে তুতেনখামেনের মমিক্রিত দেহ পাওয়া যায়। তার মাথা ও কাধ সোনার একটি মুখোস দিয়ে ঢাকা ছিল, বুকের উপর ছিল কিছু শুকনা ফুল। তুতেনখামেনের মমির সাথে তারা একটি লেখাও আবিস্কার করেন যেখানে লেখা ছিল “রাজার শান্তি ভংগকারিদের মৃত্যু ঘটবে”।
মমি আবিষ্কারের পর থেকেই একের পর এক রহস্যময় ঘটনা ঘটতে থাকে। তুতেনখামেনের জড়িত প্রত্যেকেরই রহস্যময় মৃত্যু ঘটতে থাকে। এটা নাকি তুতেনখামেনের অভিসাপেই ঘটে। একারনেই এসব ঘটনা তুতেনখামেনের অভিসাপ নামে পরিচিত। আপনি চাইলে বিশ্বাস করতেও পারেন নাও করতে পারেন।
তবে কয়েকটি ঘটনা জেনে রাখুন
ঘটনা ১। কার্টার আমেরিকা থেকে আসার সময় যেই হলুদ ক্যানারি পাখি নিয়ে আসেন যা তাকে সমাধি খুজতে সাহায্য করে। একটি কোবরা সাপ পাখিটিকে খেয়ে ফেলে। ফারাওদের সুরক্ষার প্রতিক হল কোবরা এবং শকুন।
ঘটনা ২। তুতেনখামেনের মমি উদ্ধারের কাজে অর্থলগ্নিকারি ব্যক্তি লর্ড কার্নাবর্ন যখন জানতে পারলেন তুতেনখামেনের মমি আবিস্কার হয়েছে তার খুব কাছের বন্ধুর বাধা উপেক্ষা করে মিশরে চলে আসেন এবং সমাধিতে প্রবেশ করেন। তার বন্ধু ছিলেন হস্তরেখা বিশারদ। যাইহোক, তিনি সমাধিতে প্রবেশের পর আর বেশিদিন বাঁচেন নি। মশার কামড়ে তিনি অসুস্থ হয়ে যান। দাড়ি সেভ করার সময় মশার কামড়ের স্থানটি কেটে যায় এবং ইনফেকশন হয়ে একসময় তিনি নিউমোনিয়াতে ইনফেকশনের মাত্র ৭ সপ্তাহের মাঝেই তিনি মারা যান।
ঘটনা ৩। এর কিছুদিন পরেই এই অভিযানের আরেক নেত্রিত্বস্থানীয় প্রত্নতত্ববিদ আরথার মেস হোটেল রুমে সবাইকে অবাক করে দিয়ে অল্প সময়ের মাঝেই মারা যান। মৃত্যুর আগে তিনি খুব ক্লান্তি অনুভব করছিলেন।
ঘটনা ৪। লর্ড কার্নার্বনের বন্ধু জর্জ গাউল্ড তার প্রিয় বন্ধুর মৃত্যুর কথা শুনে মিশর আসেন এবং সমাধি দেখার পরদিনই প্রচন্ড জ্বরের কবলে পরে ১২ ঘন্টার মাঝেই মারা যান।
এর বাইরেও আরও অনেক ঘটনা রয়েছে যেগুলো উল্লেখ করছিনা, তবে একথা ঠিক আভিসাপ বলে যদি কিছু থেকেই থাকে সবার আগে আভিসাপ লাগার কথা মমি উদ্ধারের কাজের নাটের গুরু হাওয়ারড কার্টারের। কিন্তু আশ্চর্যই বলতে হবে একমাত্র তারই স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল। অনেকেই বলে থাকেন মিশরের প্রতি তার ভালবাসাই তাকে অভিসাপ থেকে রক্ষা করেছে, তুতেনখামেনের মমি আবিষ্কারের পর লর্ড কার্নাবর্ন সবকিছু ইংল্যান্ডে নিয়ে যেতে চান কিন্তু হাওয়ারড কার্টার এর বিরোধিতা করেন। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তিনি মিশর নিয়ে কাজ করেছেন।
ধারণা করা হয় তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর খুব দ্রুততার সাথে তাকে সমাহিত করা হয়, দেওয়ালের রং ঠিকমত শুকানো হয়নি এবং সমাধিতে দেওয়া খাবার ও রং থেকে কোন জীবানু ছড়িয়ে পরতে পারে। যার আক্রমনে এদের মৃত্যু হয়ে থাকতে পারে, আভিসাপ কিছু না। কিন্তু এটি কোন প্রতিষ্ঠিত সত্য নয়।
তুতেনখামেনের সমাধিতে কি কি ছিল
সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার হল হাজার হাজার বছর পরেও সবকিছু ছিল চকচকে পরিস্কার, যেন গতকাল মাত্র কেও পরিস্কার করে গেছে। সমাধির আশে পাশের রুমে পাওয়া যায় মহামুল্যবান সব প্রাচিন স্বর্ণের দ্রব্য সামগ্রি, স্বর্ণের মূর্তি, স্বর্ণালংকার, ছোট স্বর্ণের নৌকা, সোনার মুখোস, হাটার লাঠি, সুগন্ধি ইত্যাদি। সব কিছুই স্বর্ণ মন্ডিত। চামড়ার তৈরি দ্রব্যগুলোও নষ্ট হয়নি। তুতেনখামেনকে একাই সমাধিস্ত করা হয়েছিল।অন্যদুটি কফিনে দুটি ভ্রূণ মমি করা ছিল, ডিএনএ টেস্টে ভ্রূণ দুটো তার কন্যা বলে জানা যায়। দেয়ালের ছবিতে তাকে শিকার ও যুদ্ধরত অবস্থায় দেখা যায়।
সম্পত্তির পরিমান এতই বেশি ছিল যে তুতেনখামেনের সমাধি আবিষ্কারের পর সবাই খুব অবাক হয়ে যায়। কারণ তুতেনখামেন ফারাও রাজাদের মাঝে খুব অল্প সময় রাজত্ব করেন এবং খুবই অপরিচিত ছিলেন তিনি। তার সমাধিতেই যদি এত সম্পত্তি থাকে তাহলে বড় বড় ফারাও রাজাদের সমাধিতে না জানি কত সম্পত্তি ছিল? কিন্তু ততদিনে সব ফারাও রাজাদের সমাধি চোর-ডাকাতেরা লুট করে নিয়ে গেছে। তুতেনখামেন তুলনামূলক কম পরিচিত হওয়ায় তার সমাধি একমাত্র অক্ষত অবস্থায় আবিস্কার করা গেছে।
তুতেনখামেনের মমি থেকে পাওয়া
- মাথা: সম্পূর্ণ মুন্ডিত।
চোখ: বিস্তৃত।
কান: ৭.৫ মিলিমিটার ব্যাস বিশিষ্ট ছিদ্র যুক্ত।
করোটি: সম্পূর্ণ খালি। (মস্তিষ্ক)
আক্কেল দাঁত: সামান্য উত্থিত।
উচ্চতা: ৫ ফুট ৬ ইঞ্চি।
বয়স: প্রায় ১৮।
তুতেনখামেনের মৃত্যুর পর কে রাজা হন
গবেষকরা বিশ্বাস করেন তুতেনখামেনের দুটি মৃত কন্যা সন্তান জন্ম হয় এবং তার কোন বংশধর না থাকায় পরবর্তী রাজা হন “আয়”। আয় ছিলেন তখনকার রাজাকে সহযোগিতা করার জন্য সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ব্যক্তি মানে পরামর্শদাতা। আয় রাজা হবার পর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন তুতেনখামেনের যাবতীয় পরিচয় ধ্বংস করে দেন যাতে ইতিহাস থেকে তার নাম মুছে যায় তার পরেও কিছু কিছু জায়গায় তার নাম রয়ে যায়। আয় এর পর ক্ষমতা দখল করেন “হোরেম-হ্যাব”।
তথ্যসূত্র ও ছবি ইন্টারনেট।
রেডিটুরিডিং ব্লগে ইতিহাস বিষয়ক আরও ব্লগ পড়ুন।