স্ট্যাচু অব লিবার্টি- নিউইয়র্ক হারবারের বুকে ৩০৫ ফিট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি দারিয়ে আছে সাম্য, স্বাধীনতা আর মুক্তির প্রতিক হিসেবে। প্রতিবছর ৪০ লাখের বেশি দর্শনার্থী এই ভাস্কর্যের সুন্দর্যে মোহিত হন।নিজেদের কালো অধ্যায়কে পেছনে ফেলে বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়ানোর এক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে এই ভাস্কর্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। জেনে রাখুন এই ভাস্কর্য ছিল ফ্রান্সের জনগণের পক্ষ থেকে মার্কিনী জনগণের জন্য একটি উপহার।
ভাস্কর্যের শুরুর আগের ইতিহাস
স্ট্যাচু অব লিবার্টির মূল নকশাকার ছিলেন ফ্রান্সের এক তরুন নকশাকার ফ্রেড্রিক অগাস্ট বারথোল্ডি। কিন্তু তিনি একে আমেরিকায় স্থাপনের জন্য এই নকশা তৈরি করেননি। তরুন বারথোল্ডি যখন মিশর ভ্রমনে যান সেখানকার চোখ ধাঁধানো সব শিল্প দেখে নিজে কিছু করার স্বপ্ন দেখেন। বারথোল্ডি জানতে পারেন খুব দ্রুত ভূমধ্যসাগর এবং লোহিত সাগরের সংযোগে একটি খাল খনন হবে, যা বয়ে যাবে মিশরের মাঝ বরাবর। এই খাল খনন হলে ইউরোপের নৌযানকে আর আফ্রিকা মহাসাগর ঘুরে আর ভারত তথা এশিয়া মহাদেশে আসতে হবে না, নৌযোগাযোগের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হবে। বহুল আকাংখিত এই খালের নাম হবে সুয়েজ খাল। সুয়েজ খাল নিয়ে আমার একটি ব্লগ খুব দ্রুতই আপনাদের হাতে তুলে দিব ইনশাল্লাহ।
তো যাই হোক বারথোল্ডির ইচ্ছা ছিল সুয়েজ খালের প্রবেশ মুখে তার এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হবে, নাম হবে ইজিপ্ট ব্রিঙ্গিং লাইট টু এশিয়া। কিন্তু নানা জটিলতা, জনবলের অভাব আর সমসাময়িক মহামারির কারনে সুয়েজ খাল সম্পূর্ণ হতে লেগে যায় ১৫ বছর। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল উদ্ভোধন করা হলেও ৬ লক্ষ মার্কিন ডলারের এই ভাস্কর্যের প্রকল্প বাস্তবায়নে সমর্থ ছিলনা মিশর। বারথোল্ডির স্বপ্ন আর বাস্তবায়ন হল না। মিশর থেকে শূন্য হাতে ফিরে গেলেন তিনি। তা নাহলে এই ভাস্কর্যের মালিক মিশরই হতে পারত।
এদিকে ১৮৬৫ সালে ফরাসি রাজনীতিবিদ ও আইনজীবী এডওয়ার্ড ডে ল্যাবুলে বলেন, “যদি আমেরিকার স্বাধীনতা সম্পর্কিত কোনো স্মৃতিফলক তৈরি করা হয়, তাহলে তা হওয়া উচিত আমেরিকা এবং ফ্রান্সের একটি সম্মিলিত প্রকল্প।” এই কথার জের ধরে সোজা তার কাছে চলে গেলেন বার্থোল্ডি। তিনি জানতেন, একমাত্র ল্যাবুলে উদ্যোগ নিলেই আশার আলো দেখতে পারে তার প্রকল্প।
১৮৭১ সালে বারথোল্ডি প্রথমবারের মত আমেরিকায় পা দিয়ে তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য এখানে সেখানে ঘুরতে থাকেন কিন্তু এই বিসাল বাজেট শুনে কেও রাজি হচ্ছিল না। আসলে ঐ সময়ে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা ছিল খুবই নাজুক। এছাড়া সদ্য সমাপ্ত গৃহযুদ্ধ, দাস প্রথার বিলুপ্তি এবং আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যু সবমিলিয়ে আমেরিকার অবস্থাও ততটা ভাল ছিলনা। গৃহযুদ্ধ, দাস প্রথার বিলুপ্তি এবং আব্রাহাম লিংকনের মৃত্যু নিয়ে আমার চমৎকার ব্লগটি পড়ুন এখানে।
আর লাম্বুলে ছিলেন আমেরিকার মহাভক্ত। আমেরিকার গৃহযুদ্ধের ফলাফল, দাসপ্রথার বিলুপ্তি এবং ৪ মিলিয়ন ক্রীতদাসের মুক্তির ব্যাপারে মুক্তির ব্যাপারে তিনি নিজে ছিলেন খুবই আনন্দিত। তিনি কিছু করতে চাচ্ছিলেন আমেরিকার জন্য তাই তিনি বারথোল্ডির ভাস্কর্যের প্রস্তাব স্বানন্দে গ্রহন করেন। ঠিক হয় ভাস্কর্যের অংশের খরচ বহন করবে ফ্রান্স এবং এর ভিত্তি বা ফাউন্ডেশনের খরচ বহন করবে আমেরিকা।
১৮৭৫ সালে ল্যাবুলে ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার তুলে দেন বারথোল্ডির হাতে কাজ শুরু করার জন্য। ভাস্কর্যের আকার ও গঠন ঠিক করে দেন আইফেল টাওয়ারের নকশাকার গুস্তাফে আইফেল। ১৮৮০ সালে মূল ভাস্কর্যের আদলে তৈরি ছোট ছোট মডেল বিক্রয় করে, নানা প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করে এবং নানা দাতা সংস্থার সাহায্য নিয়ে ফান্ড তৈরি করা হয়। ফান্ড তৈরির এই প্রক্রিয়া মোটেই সহজ ছিলনা যেহেতু প্রায় পুরো ফান্ডই মার্কিনী জনগনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছিল। প্রথম দিকে আমেরিকান জনগণের আগ্রহ ছিলনা মোটেই, পরবর্তীতে কবি-সাহিত্যিক এবং প্ত্র-পত্রিকার কল্যানে এটা সম্ভব হয়।
১৮৮৫ সালে ফ্রান্স ও আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তৈরি করা ভাস্কর্যের ৩৫০টি ভিন্ন ভিন্ন অংশ এসে পৌছায় নিউইয়র্কে। ১৮৮৬ সালে ভাস্কর্যটি সবার জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়। উপরের বর্ণনা থেকে বারথোল্ডি এবং ল্যাবুলের অবদান সহজেই বুঝা যাচ্ছে। এই দুইজনের আন্তরিকতা না থাকলে হয়ত স্ট্যাচু অব লিবার্টি কখনই আলোর মুখ দেখত না। পৃথিবীও বঞ্চিত হত এক অপার সৌন্দর্য থেকে।
স্ট্যাচু অব লিবার্টি কোথায় অবস্থিত
স্ট্যাচু অব লিবার্টি- নিউইয়র্ক হারবারের বুকে ৩০৫ ফিট ৬ ইঞ্চি উচ্চতার এই ভাস্কর্যটি দাড়িয়ে আছে সাম্য, স্বাধীনতা আর মুক্তির প্রতিক হিসেবে।
এখনকার সময়ে আমরা একে স্ট্যাচু অব লিবার্টি নামে চিনলেও এর নাম কিন্তু স্ট্যাচু অব লিবার্টি ছিলনা। প্রথমে এর নাম ছিল লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্যা ওয়ার্ল্ড। প্রিয় পাঠক, আজকে আমি আপনাদের জানাব এই ভাস্কর্যের গল্প, কিভাবে একদম শুন্য থেকে একটি মূর্তি একটি জাতির আত্মপরিচয়ের অংশ হয়ে উঠল।
স্ট্যাচু অব লিবার্টির গঠন ও জানা অজানা নানা তথ্য
শুধু স্ট্যাচু অব লিবার্টির উচ্চতা ১৫১ ফুট ১ ইঞ্চি। এটি আমেরিকার সবচেয়ে বড় ভাস্কর্য। এর ভিত্তি তৈরিতে আমেরিকার খরচ হয় ২ লক্ষ ৭৫ হাজার ডলার। এর মাঝ দিয়ে একটি সিড়ি রয়েছে যার মাধ্যমে আপনি চাইলে উপরে উঠতে পারবেন। মূল ভিত্তি সহ মাটি থেকে এর উচ্চতা ৩০৫ ফুট ৬ ইঞ্চি। বাইরের অংশ তামা দিয়ে মোড়ানো হলেও ভেতরের অংশ তৈরি হয় লোহার ফ্রেম দিয়ে। তামার পুরুত্ব ২.৫ মিলিমিটার।
ডান হাতে ধরা মশালটির ভেতরের অংশে ৪২ ফুট লম্বা মই বয়েছে। স্ট্যাচু অব লিবার্টির মাথায় উঠতে হলে আপনাকে ৩৫৪ টি সিড়ির ধাপ বাইতে হবে। ভাস্কর্যের মুকুটে পাবেন ২৫টি জানালা যা দিয়ে আপনি চারদিকের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন। আর এর মুকুটে পাবেন মোট সাতটি স্পাইক যা সাতটি মহাদেশকে বুঝায়। এক হাতে একটি মশাল আরেক হাতে ধরা বই, বইয়ে লেখা আছে একটি তারিখ, ৪ জুলাই ১৭৭৬। এই তারিখেই আমেরিকা ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্ত হয়েছিল, আমেরিকার স্বাধীনতায় অন্যতম অবদান ছিল ফ্রান্সের।
সাধারণ দর্শনার্থীদের চোখে পরবেনা এমন একটা জিনিস হল লেডি লিবার্টির পায়ের কাছে থাকা ভাংগা শিকল। নিচ থেকে এটা দেখা যায় না। এই ভাঙ্গা শিকল হল নিপীড়ন ও দাসত্ব থেকে মুক্তির চিহ্ন।
১৯৮৪ সালে মশালটি পরিবর্তন করা হয়, আগের সাধারণ লোহার পরিবর্তে ২৪ ক্যারেট গোল্ড দিয়ে নতুনভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটার বেগে বাতাস বইলে এই মূর্তিটি ৩ থেকে ৫ ইঞ্চি পর্যন্ত নড়তে থাকে। প্রতিবছর প্রায় ৬০০ বজ্রপাত সহ্য করে টিকে আছে এই ভাস্কর্য। যে দ্বীপে এই ভাস্কর্য স্থাপন করা হয় তার নাম বেডলে আইল্যান্ড হলেও পরবর্তীতে ১৯৫৬ সালে এই দ্বীপের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় লিবার্টি আইল্যান্ড। আর ১৯২৪ সাল পর্যন্ত এই ভাস্কর্যের নাম ছিল লিবার্টি এনলাইটেনিং দ্যা ওয়ার্ল্ড।
আর হ্যা, স্ট্যাচু অব লিবার্টির পায়ের মাপ জানেন? যদি আপনি তার পায়ের মাপে জুতা বানাতে চান তাহলে আপনাকে বানাতে হবে ৮৭৯ নম্বরের। তৈরির সময় এর রং তামাটে হলেও এখন এর রং পরিবর্তন হয়ে সবুজ বর্ণ ধারন করেছে। সামুদ্রিক জলীয় বাস্পের কারনে রাসায়নিক বিক্রিয়ায় এই পরিবর্তন হয়েছে। শুরুতে স্ট্যাচু অব লিবার্টিকে লাইট হাউজ হিসেবে ব্যবহার করা হত কারণ ২৪ মাইল দূর থেকেও এই লাইট হাউজের আলো দেখা যেত।
১৯২৯ ও ১৯৩২ সালে এই ভাস্কর্যের উপর থেকে লাফ দিয়ে দুইজন আত্মহত্যা করে, সেকারনে নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রবেশদ্বার বন্ধ রাখা হয়েছে। এখন আর কেও চাইলেই উপরে উঠে সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবেন না।
উনিশ শতকের দিকে প্রায় ৯০ লাখ মানুষ আমেরিকায় সমুদ্রপথে পাড়ি জমায়, আর সমুদ্র পথে আমেরিকায় ঢুকতেই প্রথমে চোখে পড়ে স্ট্যাচু অব লিবার্টি, তাই স্ট্যাচু অব লিবার্টি আমেরিকার ইমিগ্রেশনের প্রতিক হিসেবে আজও।
১৩৪ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে স্ট্যাচু অব লিবার্টি আমেরিকার সাম্য, স্বাধীনতা আর মুক্তির প্রতিক হিসেবে। অনেক ঘটনার স্বাক্ষি সে, আর কতদিন থাকবে জানিনা। কিন্তু বিশ্বের দরবারে মাথা উচু করে দাঁড়ান স্ট্যাচু অব লিবার্টি এক বার্তা দিয়ে যাচ্ছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে।
ধন্যবাদ সবাইকে।