সারা বিশ্বজুড়ে ভেষজ হিসেবে রসুনের ব্যাপক সুনাম রয়েছে। রান্নায় মসলা হিসেবে, বিভিন্ন আচার ও মুখরোচক খাবার তৈরিতে রসুনের ব্যবহার তো আমরা সবাই জানি। কিন্তু স্বাস্থ্যরক্ষায় রসুনের ভূমিকা, রসুনের উপকারিতা নিয়ে আমাদের অনেকেরই অনেক কিছু জানা নেই।
মনে রাখবেন, রসুন শুধু বিভিন্ন রোগ-বালাই দূরই করে না, রোগ-বালাইয়ের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধও গড়ে তোলে। আমরা অনেকেই রসুনের উপকারিতা জেনে আবার অনেকে না জেনেই প্রতিদিন রসুন খেয়ে থাকি। আসুন আজকেই রসুনের উপকারিতা জেনে নেই এবং একই সাথে জেনে নেই ঠিক কতটুকু রসুন আমাদের শরীরের জন্য উপকারি এবং তা কখন ও কিভাবে খাব।
রসুন সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান
রসুন এক প্রকারের পেঁয়াজ জাতীয় ঝাঁজালো সবজি যা রান্নার মসলা এবং ভেষজ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রসুন গাছ সপুষ্পক একবীজপত্রি লিলি শ্রেনীর বহুবর্ষজীবী জাতীয় উদ্ভিদ। রসুনের বৈজ্ঞানিক নাম Allium sativum (অ্যালিয়াম স্যাটিভাম)। ইংরেজিতে রসুনকে বলা হয় Garlic (গারলিক)
জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ এবং সহজেই গুড়া হয়ে যায় এমন সব মাটিতে রসুনের ভাল চাষ করা যায়। রসুন চাষের সময় পানির অভাব থাকলে সেচ দিতে হয়। নিড়ানির সময় বেশ ভাল ভাবে নিড়ানি দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে দিতে হয়।
কাঁচা রসুনে আমিষ, প্রচুর ক্যালসিয়াম ও সামান্য ভিটামিন সি রয়েছে। রসুনের প্রধান সক্রিয় উপাদান অ্যালিসিন নামের সালফারযুক্ত জৈব যৌগ। এই অ্যালিসিনই রসুনের গন্ধ ও বিখ্যাত ভেষজ গুনের প্রধান কারণ।
আরেকটি বিষয় মনে রাখবেন অবশ্যই অক্ষত কাঁচা রসুনে অ্যালিসিন থাকেনা, থাকে অ্যালিইন (অ্যামিনো এসিড) যা প্রোটিন তৈরিতে অংশগ্রহন করেনা। রসুনকে কাটলে বা ক্ষত-বিক্ষত করলে অ্যালিনেজ নামের এক উৎসেচক অ্যালিইন থেকে অ্যালিসিন তৈরি করে। অ্যালিসিন খুবই স্বল্পস্থায়ী, রান্না করলে বা সিদ্ধ করলে অ্যালিসিন নষ্ট হয়ে যায়।
রসুনের ঐতিহাসিক ব্যবহার
সেই প্রাচীন কাল থেকেই রসুনকে ব্যবহার করা হচ্ছে একই সাথে রান্নার মসলা হিসেবে আবার ভেষজ হিসেবে। ১৫০০ সালেই রসুনকে চীন এবং ভারতে রক্ত পাতলা রাখার জন্য ব্যবহার করা হত।
আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিসেবে আমরা যাকে চিনি সেই হিপোক্রেটিসও তৎকালীন সময়ে সারভাইকাল ক্যান্সারের চিকিৎসায় রসুন ব্যবহার করেছিলেন।
গুটি বসন্তের ভ্যাকসিন আবিস্কারক লুই পাস্তুরও রসুনের অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুনের কথা আমাদের বলে গেছেন।
একটু পুরানো দিনের মানুষেরা বলে থাকেন রসুন খেলে গা গরম হয়, পেট পরিস্কার হয়ে যায়- এমন ধারনার আসলে তেমন কোন ভিত্তি নেই।
রসুন কিভাবে খাবেন, কখন খাবেন
প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক হিসেবে প্রতিদিন রসুন খেতে পারেন। কখন এবং কিভাবে রসুন খাবেন? কখন এবং কিভাবে রসুন খেলে রসুনের উপকারিতা সম্পূর্ণরূপে পাবেন, আসুন জেনে নেয়া যাকঃ
রসুন কখন খাবেন
রসুন আপনি যেকোন সময় খেতে পারেন, কিন্তু আপনি যদি রসুনের ভেষজ গুন পুরোপুরি পেতে চান তাহলে আপনাকে রসুন খেতে হবে সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে খালি পেটে।
রসুন কিভাবে খাবেন
আপনি যদি ভেষজ গুনের জন্য রসুন খেতেই চান তাহলে রসুন খাবেন কাঁচা। এবং সাথে আরও একটি অভ্যাস করে নিতে পারেন তা হল খালি পেটে রসুন চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস। সাথে খাবেন প্রচুর পরিমানে পানি। আর পানি নিয়ম মেনে খাবেন। কম পানি যেমন আপনার জন্য ক্ষতিকর আবার তেমনি অতিরিক্ত পানি পানও ক্ষতির কারণ হতে পারে।
মনে রাখবেন আমি বলেছি- চিবিয়ে খেতে, গিলে নয়। একটু আগেই আপনাদের ব্যাখ্যা করেছি- রসুনকে ক্ষত-বিক্ষত করলে এর উপকারি প্রধান উপাদান অ্যালিসিন উৎপন্ন হয়। এবং তা খুব অল্প সময়ের জন্য। তাই রান্না করা রসুন খেয়ে আপনি ভেষজ গুন পাবেননা বলাই যায়।
তাই রসুন খেলে তা চিবিয়ে কিংবা হালকা তেলে ভেঁজে রোষ্ট করে খাওয়াই উত্তম। রান্নার কাজে মসলা হিসেবে বেটে ব্যবহার করলে রান্নার স্বাদ বাড়লেও পুষ্টি গুন মোটেই বাড়েনা।
সুতরাং প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ২/১ কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেয়ে নিন। এটা সুস্থ থাকার একটি মন্ত্র বলতে পারেন।
কি পরিমাণ খাবেন
মনে রাখবেন, অতিরিক্ত কোন কিছুই ভাল নয়। রসুন উপকারি বলে আপনি যত খুশি তত খাবেন তা কিন্তু নয়। খাবার পরিমাণ প্রতিদিন ২/১ কোয়া পরিমাণ।
আপনার হাঁপানি থাকলে রসুন খাবার ক্ষেত্রে সচেতন হতে হবে। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে সাবধান হবেন।
অনেক সময় বিভিন্ন সার্জারির আগে ডাক্তার রসুনের ব্যাপারে আগে থেকেই সাবধান হতে বলেন। তাই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী চলুন।
রসুন খাওয়ার উপকারিতা
আমি আগেই বলেছি রসুন প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক। প্রতিদিন ২/১ কোয়া কাঁচা রসুন চিবিয়ে খেলে আপনার কি উপকারে আসবে আসুন জেনে নেই।
- রসুন রক্ত পরিস্কার রাখার কাজ করে থাকে। সাথে আপনার ত্বককে সুস্থ রাখে। আপনার ত্বকে যদি র্যাশ, নানা ধরনের চুলকানি প্রায়ই হয়ে থাকে তারা অবশ্যই প্রতিদিন ২/১ কোয়া রসুন চিবিয়ে খেয়ে নিবেন সকাল বেলা, সাথে খাবেন প্রচুর পানি।
- শরীরের টক্সিন বের করার কাজেও রসুনের জুড়ি নেই। সকালে একটু উষ্ণ লেবু পানিতে রসুন কুচি আপনার শরীরের টক্সিন দূর করে দিবে।
- ঠান্ডা লাগলে খাবেন গারলিক টি, এতে আপনার ঠান্ডা দূর হবে। প্রতিদিন রসুন খেলে আপনার নাক বন্ধ হবার সমস্যা দূর হবে। সাইনাসাইটিসের কষ্ট থেকেও আপনি রেহাই পাবেন।
- রসুন আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। শরীরের খারাপ ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস আর প্যারাসাইটের মোকাবিলা করতে অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে রসুন মারাত্মক কার্যকর।
- কাঁচা রসুন বা হালকা সিদ্ধ করা রসুন রক্তের খারাপ কোলস্টোরেল প্রায় ১০–১৫ শতাংশ কমাতে সাহায্য করে। তাই আপনার হার্ট সুস্থ থাকবে, আগের চেয়ে অনেক বেশি।
- মুখের ব্রন বা পিম্পল হলে রসুন পাতলা করে কেটে খানিক্ষন ধরে রাখলে ত্বকের জ্বালা কমে যাবে।
- রসুন রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রনে রাখতে সহায়তা করে। আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তাহলে অবশ্যই রসুন খেয়ে দেখতে পারেন।
- রসুন কৃমিনাশক হিসেবে বেশ কার্যকর। ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবে রসুনের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়।
- রসুন চুল পাকা কমায়, আপনার যদি কম বয়সে চুল পাকা শুরু করে প্রতিদিন রসুন খেয়ে দেখতে পারেন।
- শ্বাসনালী মিউকাস মুক্ত করতে এবং এ্যাজমা রোগের উপশমে রসুনের উপকারিতা প্রমাণিত।
- স্নায়বিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে রসুন সাহায্য করে। যকৃত ও মুত্রাশয়ের কাজ স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে রসুন।
- বদহজমের সমস্যা, রক্ত সঞ্চালন স্বাভাবিক রাখা ইত্যাদি কাজে রসুনের জুড়ি মেলা ভার।
- যক্ষা রোগের প্রতিরোধক হল রসুন। আপনার যদি যক্ষা হয়ে থাকে, প্রতিদিন নিয়মিত রসুন খান।
- পুরুষের বীর্যে শুক্রানুর পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে রসুন।
কারা রসুন খাবেন না
যাদের রসুনের এলারজি আছে তাদের জন্য রসুন না খাওয়াই ভাল। আপনি যদি কোন চিকিৎসকের অধীনে কোন প্রকার চিকিৎসার মধ্যে থাকেন তাহলে অবশ্যই সরাসরি ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে রসুন খাবেন।
যেহেতু রসুন এন্টিবায়োটিক তাই চিকিৎসা চলাকালীন না খাওয়াই ভাল।
এছাড়া রসুন রক্ত জমাট বাধার প্রক্রিয়াকে বাধা প্রদান করে। তাই রসুন খেলে রক্তপাত বন্ধ হতে সমস্যা হতে পারে। কারও যদি হজমে সমস্যা হয় তারও রসুন খাওয়া উচিত নয়।
পরিশেষে
রসুন প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিক, এটি আপনার রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ইমিউনিটি সিস্টেম কি কাজে লাগে তা আমরা এই করোনাকালে মোটামুটি সবাই জেনে গেছি।
পরিমাণ মত, সঠিক সময়ে, সঠিক উপায়ে রসুন খান। সুস্থ্য থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
আমার এই ব্লগ যদি আপনার ভাল লাগে কিংবা সামান্য উপকারে লাগে, অবশ্যই নিচের কমেন্ট বক্সে আপনার ভাল লাগা জানিয়ে যাবেন। এর বাইরে কিছু জানার থাকলে তাও আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করব, নিজে না জেনে থাকলে, বিশেষজ্ঞ জনের কাছ থেকে জেনে আপনাকে জানাতে চেষ্টা করব।
ধন্যবাদ সবাইকে।