বিসিএস

 

ছোটবেলা থেকে আমরা বেশির ভাগই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হলেও শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ মেধাবী, প্ররিশ্রমিরাই ইঞ্জিনিয়ারিং বা ডাক্তারি পড়া শেষ করতে পারে৷ আমরা তাদের থেকে কিছু আশা রাখি। যেমন নিজ দেশেই পাবো ভালো চিকিৎসা কিংবা নিজ দেশের ইঞ্জিনিয়ার দিয়েই তৈরি হবে দেশের কাঠামো।কিন্তু   সম্প্রতি প্রকাশিত হয় বহুল আকাঙ্ক্ষিত ৩৮ তম বিসিএস ফাইনাল ফলাফল। বিসিএস ফলাফলে দেখা গেলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের পদগুলোতে প্রায় সবাই এমবিবিএস বা ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করা ছাত্র।

বিষয়টা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পক্ষে বিপক্ষে তুমুল তর্ক চলছে। ঠিক আর দশটি ব্যাপারের মত আমরা এখানেও বিভক্ত। কেউ আবেগ দিয়ে যুক্তি দেয়ার চেষ্টা করছে তো কেউ তিক্ত ভাষায় বিরোধিতা করছে। কেউ বলছে নিজ পেশা ছেড়ে যাওয়াতে ঐ নির্দিষ্ট খাতগুলোতে বিশেষজ্ঞের অভাব হবে আবার কেউ বলছে সমাজ/সিস্টেম তাদেরকে বাধ্য করেছে। আমি ঠিক কারো পক্ষে বা বিপক্ষে বলছি না, আমি শুধু আপনাদের সামনে কিছু ফ্যাক্ট তুলে ধরার চেষ্টা করবো যেগুলো হয়ত আপনার চিন্তার খোরাক জোগাবে।

ইঞ্জিনিয়ার

সামাজিক সুযোগ সুবিধা

বর্তমানে সরকারি চাকুরি বিশেষ করে প্রশাসনে একটি পদ খুবই লোভনীয়। এই একটি পদ আপনার জীবনকে বদলে দিতে পারে। অন্যান্য পেশা থেকে শুধু নয় নিজের সহকর্মী অর্থাৎ অন্যান্য ক্যাডার থেকেও প্রশাসনের ক্যাডাররা সুযোগ সুবিধা বেশি পাচ্ছে। আর যেহেতু এই পর্যায়ে সর্বোচ্চ মেধাবীদের নিয়োগ দেয়া হয় তাই আমি মনে করি দেশের সর্বোচ্চ মেধাবীদের এই পদটির জন্য আগ্রহ বাড়ছে। ক্যাডার বৈষম্য একটা টার্ম আছে আপনারা যারা নিয়মিত ফেসবুকে থাকেন বা অন লাইন পোর্টালে সংবাদ পড়েন তারা বিষয়টি ভালোভাবেই জানেন। প্রশাসন ক্যাডারে শুরুতেই সহকারী সচিব, এসি ল্যান্ড হিসেবে যোগদান করে, গাড়ি-বাড়ির সুবিধা পাওয়া যায়। অপরদিকে একজন এমবিবিএস পাস করা মানুষ মাত্র ২০ হাজার টাকা পায় বেসরকারি হাসপাতালে। ছুটি নেই, নেই কোনো পদোন্নতি। এরকম লিখে শেষ করা যাবে আছে অনেক কিছুই।

সামাজিক  নিরাপত্তা

একজন ডাক্তার মার খেয়েছে এটা একটা কমন ব্যাপার হয়ে গিয়েছে আমাদের সমাজে। কিছুদিন আগে তো খুনও হলো একজন পৌরসভা প্রকৌশলি। এই নিরাপত্তাহীনতাই কিন্তু মেধাবীদের তাদের পেশা থেকে সড়ে আসতে বাধ্য করছে। একজন ম্যাজিস্ট্রেটের গায়ে হাত তুলেছে এমন খবর আমরা শুনিই না। কারণ এই নিরাপত্তা। নিজ সেক্টরে নিরাপত্তা না পেলে মানুষ নিরাপদ সেক্টর খুজবে এটাই স্বাভাবিক।  নিজ নিজ পেশায় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে সামনে আমাদের জন্য খুবই খারাপ একটা অবস্থা অপেক্ষা করছে।

সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গি

সামাজিক দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে আসলে কিছু বলার নেই। পাশের বাড়ির চাচা, ভাবিদের যন্ত্রণায় বর্তমান যুব সমাজ একদম বিরক্ত। বাবার বন্ধু, অমুক কাজিন কি করলো, পাশের বাসার ছেলে কি করলো, উনি কি বললো ইত্যাদি শুনতে শুনতে আমরা আজ বিরক্ত। আমাদের সমাজে নিজের ইচ্ছা, শখ, মানসিক শান্তির প্রতি কোনো গুরুত্বই দিচ্ছে না৷ কম্পিউটার বিজ্ঞান  থেকে পাস করা ছেলেকে যদি শুনতে হয় বাবা বিসিএসটা দিলে তো? তখন তার মানসিক অবস্থা কেমন হবে? আর বিয়ের বাজারে তো কথাই নেই৷ বিয়েটা করে ফেলেছি আমরা একদম সরকারি চাকরি কেন্দ্রিক।  সরকারি জব না হলে প্রেমিকাকে পাওয়া যাবে না এমন কথা তো আজ চোখ খুললেই দেখা যাচ্ছে। এই দৃষ্টিভঙ্গিই বিসিএস এর প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি করছে।

বিনিয়োগের অভাব

ব্যক্তিগত পর্যায়ে উদ্যোক্তা হতে হলে প্রয়োজন বিনিয়োগের। ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নেয়া এখন কষ্টের ব্যাপার। তাদের গ্যারান্টি দেয়া কিংবা সুদের হার নির্ধারণ কোনোটাই বেকার সমাজের পক্ষে না৷ তাছাড়া আজকাল সেই পরিবেশও পাওয়া যাচ্ছে না। সমাজ, পরিবার কেউ ভরসা করছে না। ফলে অনেকের উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও দিন শেষে ঐ চাকরির পিছনে ছুটতে হয়। ক্ষুদ্র ব্যবসাকে আমরা এখনো আপন করে নিতে পারিনি। ফলাফল উদ্যোগ গ্রহণে ভয় পাচ্ছে বর্তমান প্রজন্ম।

এই পেশা পরিবর্তনের ঝোঁকের ফলাফল দীর্ঘমেয়াদে দেশের জন্য কুফল বয়ে আনবে৷ একটা সময় সেক্টর গুলোতে কোনো বিশেষজ্ঞ থাকবে না। বিদেশ থেকে ভাড়া করে আনতে হবে। ফলে ব্যয় বেড়ে যাবে। প্রতিবছর   প্রতিটি প্রজেক্টে আমরা দেখছি বিদেশিদের প্রাধান্য। এতে করে বিদেশি মুদ্রার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে তারা উন্নত দেশের হওয়াতে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পরিচালিত প্রজেক্ট আমাদের দেশে সফলতা বয়ে আনে না। এতে ভোগান্তি আমাদের নিজেদের৷ আমাদের সাধারণ জনগণের। নিজেদের মেধার, অর্থের, সময়ের সব কিছুরই হচ্ছে অপচয়। শুধু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার না আমরা সব সেক্টরেই ক্ষতির মধ্যে পড়বো৷ বর্তমান বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে গবেষণাগার নেই। যে লাইব্রেরির হওয়া উচিত ছিলো জ্ঞান চর্চার কেন্দ্র সেটি এখন সম্পূর্ণ বিসিএস প্রত্যাশিতদের দখলে। এভাবে একটি জাতি এগোতে পারে না৷ কোনো জাতির উন্নতির ইতিহাসে সরকারি চাকরির ভূমিকা শতভাগ নয়। সবার সম্মেলিত চেষ্টাতেই উন্নত হয় একেকটি দেশ। সেখানে তারা সম্মান দেখায় প্রতিটা মানুষের পেশাকে।  এই ব্যাপারটা না বুঝতে পারছে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা, না বুঝতে পারছেন আমাদের শিক্ষার্থীরা।

এই অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে। এর জন্য শিক্ষার্থী, নীতিনির্ধারক সবাইকে এক সাথে কাজ করতে হবে। বিসিএস অবশ্যই প্রয়োজনীয় কিন্তু এতে সবাইকে প্রয়োজন নেই। এরজন্য প্রয়োজনীয় যে বিষয়গুলোতে নজর দিতে হবে বলে আমি মনে করিঃ

শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন

আমাদের প্রথমে যা করতে হবে, তা হলো শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা। ২০২০ সালে এসেও আমরা যে শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি তা আমাদের উন্নতির পথে প্রধান বাধা বলে আমি মনে করি৷ যে কোনো একটি দেশকে ফলো করে এক্ষেত্রে এগিয়ে যেতে পারলে ভালো হয় বলে আমি মনে করি। একদম গোড়া থেকে একটু একটু করেও যদিও আমরা এগিয়ে যাই আগামি ২০ বছরে আমরা অনেক পরিবর্তন করতে পারবো।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণায় বিনিয়োগ

আজকাল জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় করা হচ্ছে যা জাতির জন্য অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে। প্রথমত প্রতিটি মানুষের উচ্চশিক্ষার প্রয়োজন নেই৷ এতে করে সবাই জব ওরিয়েন্টেড হয়ে পড়তে পারে৷ দ্বিতীয়ত, বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে ছাত্র ছাত্রীদের গবেষণায় আগ্রহী করে তুলতে হবে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে বর্তমানে যেগুলো

সকল পেশায় নিরপত্তা নিশ্চিত করা

সকল পেশায় আপনাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। সবাই চায় নিজেকে নিরাপদ রাখতে। কারণ আমাদের দেশে এখনো একজনের নিরাপত্তার উপর নির্ভর করে আরো ৪/৫ জনের নিরাপত্তা । তাছাড়া নিজের দেশে নিরাপত্তা পাওয়া একজন মানুষের মৌলিক অধিকার। পেশাজীবিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনে আইন করতে হবে আর সেটার কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।

আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি

সবচেয়ে বড় কথা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতেই হবে৷ কারণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি মানুষের চলার পথে অনেক প্রভাব ফেলে। বিসিএস আর দশটি পেশার মতই একটি পেশা। সব সেক্টর থেকেই দেশের, সমাজের সেবা করা যায়। অনেকেই অন্য পেশাতে হালাল ভাবে উপার্জন করছে, জীবনকে উপভো করছে।  কোনো পেশাকেই ছোট করে দেখা যাবে না। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হতে অনেক কষ্ট করতে হয়, অনেক টাকা খরচ করতে হয়৷ বিষয়গুলো মাথায় রেখে আমাদের সেভাবেই আচরণ করা উচিত। আমরা নিজেরা না বদলালে আমাদের আশেপাশের মানুষগুলো ভালো থাকবে না। সমাজে একটি বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে খুব বেশি সময় নিবে না যদি না আমরা আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন না করি।

মানুষকে তার পছন্দ অনুযায়ী কাজ করতে দেয়াই ভালো। এতে সমাজের, দেশের উন্নতি হবে। কেউই নিজের ইচ্ছা, স্বপ্ন বাদ দিয়ে অন্য কিছু করতে চায় না, যদি না আমরা তাকে বাধ্য করি। আমার মতে আমাদের চিন্তাভাবনা ও সিস্টেম আমাদেরকে বাধ্য করছে পেশা পরিবর্তনে। যার কারণে মেধাবীদের মেধার সুফল থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি। ২০২০ সালে এসেও আমরা যে পথে এগিয়ে যাচ্ছি তা দুঃখজনক। আমাদের খুব দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আমাদের প্রজন্মের স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সকলের এগিয়ে আশা উচিত। এতেই দেশ ও জাতির কল্যাণ। আমি আবারো বলছি বিসিএস অবশ্যই জরুরি কিন্তু সবার জন্য না।

Previous articleএসইও কি এবং এসইও নিয়ে বেসিক ধারনা পর্ব ০২ (ব্যাকলিংক)
Next articleআমার উপলব্ধিতে সুফিয়ান স্টিভেনস
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।