সুয়েজ খাল
সুয়েজ খাল

সুয়েজ খাল – নাম শুনেননি এমন কাওকে খুঁজে পাওয়া আসলেই মুসকিল। সামান্য সাধারন জ্ঞান আছে এমন যে কেও সুয়েজ খালের কথা শুনলেই পৃথিবীতে এর গুরুত্ব সহজেই অনুমান করতে পারবেন। খাল কেটে কুমির আনা প্রবাদ প্রচলিত থাকলেও সুয়েজ খাল কেটে পৃথিবীতে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় জাহাজ চলাচলের কী যে উন্নয়ন সাধিত হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমার আজকের ব্লগে আমি আপনারদের জানাব সুয়েজ খাল খননের ইতিহাস, সুয়েজ খাল এর অবস্থান এবং এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব

পড়ুন আর আপনার জ্ঞান ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করুন। আশা করি ভাল লাগবে।

সুয়েজ খাল কোন দেশে অবস্থিত

সুয়েজ খাল কোথায় অবস্থিত জানতে ইচ্ছে করছে নিশ্চই আপনার। সুয়েজ খাল মিশরের সীনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত একটি কৃত্তিম খাল। এটি ভুমধ্যসাগরকে লোহিত সাগরের সাথে সংযুক্ত করেছে। উত্তরে ইউরোপ থেকে দক্ষিনে এশিয়া উভয় প্রান্তে পন্যপরিবহনে এটি জলপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। প্রথম যখন সুয়েজ খাল খনন করা হয় তখন এটি ছিল ১৬৪ মিটার দীর্ঘ আর গভীরতা ছিল ৮ মিটার মাত্র। পরবর্তীতে সংস্কার করে ২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী এটি ১৯০.৩ মিটার দীর্ঘ এবং গভীরতা ২৪ মিটার। সবচেয়ে সরু স্থানেও এটি ২০৫ মিটার চওড়া। এটি এক লেন বিশিষ্ট খাল হলেও এতে ২টি বাইপাসের ব্যবস্থা রয়েছে, বাল্লাহ বাইপাস এবং গ্রেট বিটার লেক। সমুদ্রের পানি অবাধে এর মাঝ দিয়ে প্রবাহিত হয়।

সুয়েজ খাল
সুয়েজ খাল কোন দেশে অবস্থিত

সুয়েজ ক্যানেলের মালিকানা এবং পরিচালনার দায়িত্বে আছে মিশরের সুয়েজ ক্যানেল অথরিটি। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী সুয়েজ খাল শান্তিকালীন কিংবা যুদ্ধকালীন যেকোন সময় যেকোন দেশের পতাকাবাহী জাহাজের জন্য সবসময় খোলা থাকবে। দীর্ঘ ১০ বছর নির্মাণ কাজের পর ১৮৬৯ সালের ২৫ এপ্রিল এর কাজ শেষ হলে একই বছর ১৭ নভেম্বর জাহাজ চলাচলের জন্য উম্মুক্ত করে দেয়া হয়।

প্রায় ২৫ হাজার জাহাজ এই নৌপথ প্রতিবছর ব্যবহার করে থাকে যা থেকে মিশর আয় করে ৪৭৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৩ সাল নাগাত এই আয় দাড়াবে ১৩.২২৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

সুয়েজ খালের ইতিহাস

সুয়েজ খাল কে খনন করেন? সুয়েজ খাল খননের ইতিহাস আসলেই অনেক লম্বা।

কথিত আছে খ্রিস্টপূর্ব ১৮৯৭ থেকে ১৮৩৯ সালের মধ্যবর্তী সময়ে এই খাল খননের কাজ প্রথম শুরু করেন ফারাও রাজা দ্বিতীয় নিকো, কাজ শুরুর পর তিনি স্বপ্নে দেখেন এই খাল মিশরের জন্য বিপদ বয়ে আনবে তাই তিনি এর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন।

সর্বশেষ ফারাও তুতেনখামেনকে নিয়ে আমার একটি ব্লগ আছে যা খুবই তথ্যনির্ভর, যারা প্রাচীন ইতিহাস পড়তে ভালবাসেন  তারা অবশ্যই পড়বেন।

তারপর এই খাল খননের কথা ভাবেন পারস্যের শাসক প্রথম দারিয়াস। এরপর অনেকদিন আর কেও এই খাল খননের কথা ভাবেননি। এরিস্টটলের লিখিত বক্তব্যেও এই খাল খননের কথা উল্লেখ পাওয়া যায়।

সুয়েজ খালের ম্যাপ
সুয়েজ খালের ম্যাপ

ষোলশ শতকের দিকে তুরকি প্রধানমন্ত্রী মুহম্মদ পাশা (১৫৬৫-১৫৭৯) সেয়েজ খাল খননের চিন্তা করেন। কিন্তু মিশরীয়দের কুসংস্কার, ব্যয় বহনে অস্বীকৃতি এবং প্রকল্প দীর্ঘমেয়াদি হবার কারনে বাস্তবায়ন সম্ভব হয়না।

এরপর ১৭৯৮ সালে লেপোলিয়ন বনাপারট মিশর অভিযানে আসার পর ভুমধ্যসাগরকে লোহিত  সাগরের সাথে যুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন কিন্তু দুই সাগরের পানির উচ্চতার পার্থক্য ১০ মিটার হওয়ার কারনে তিনি এই চিন্তা বাদ দেন।

আধুনিক সুয়েজ খাল খননের মূল উদ্যোক্তা ছিলেন ফরাসি প্রকৌশলী ফারদিনান্দ দি লেসেন্স।  ১৮৫৪ সালে বিভিন্ন দেশের প্রকৌশলীরা মিলে এর নকশা তৈরি করেন। সায়িদ পাশা ছিলেন তাখন মিশরের ক্ষমতায়।

মিসর ও সুদানের শাসক মিলে ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম সুয়েজ চ্যানেল কোম্পানি গঠন করেন এবং অবশেষে  খালের খনন কাজের যাত্রা শুরু হয় ১৮৫৯ সালের ২৫ এপ্রিল।

সুউয়েজ খাল নির্মাণে ১.৫ মিলিয়ন শ্রমিক নিয়োজিত ছিল এবং এদের মধ্যে লক্ষাধিক শ্রমিক নির্মাণকালে নিহত হয়। ১৮৭৫ সালে মিশর অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পরলে ব্রিটিশরা এতে বিনিয়োগ করে এর নিয়ন্ত্রন নিয়ে নেয় এবং নিরাপত্তার বিভিন্ন অজুহাতে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্য নিয়োগ করে। ১৯৩৬ সালে মিশর স্বাধীন হবার পরও তা অব্যাহত থাকে এবং ১৯৫৬ সালের ১৩ই জুলাই পর্যন্ত তা বহাল থাকে।

এছাড়াও এই  খাল মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন সময়ে অশান্তি ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে পার করতে হয়েছে। এর মাঝে ব্রিটিস-মিশরীয় অস্থিরতা এবং আরব ইসরাইলের যুদ্ধ অন্যতম।

১৯৫৬-১৯৫৭ এবং ১৯৬৭-১৯৭৫ সালে সুয়েজ খাল দিয়ে নৌযান চলাচল বন্ধ ছিল।

সুয়েজ খালের গুরুত্ব কি

সুয়েজ খাল নির্মাণের আগে ইউরোপ থেকে দক্ষিন এশিয়া আসতে হলে কোন জাহাজকে গোটা আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হত। এতে জাহাজ কম্পানিকে গুনতে হত মোটা অংকের টাকা, সময় লাগত ৪০-৫০ দিন।

সুয়েজ খাল খননের পর দুরত্ব কমে যায় সাত হাজার কিলোমিটার। আগে যেখানে ৪০-৫০ দিন সময় লাগত সেখানে সুয়েজ খাল দিয়ে আসার পর মাত্র ২০ দিনেই এই দুরুত্ব অতিক্রম করা সম্ভব হয়।

পৃথিবীর সুমদ্র বানিজ্যের ৫ ভাগ জাহাজ এই সুয়েজ খাল ব্যবহার করে। প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার জাহাজ সুয়েজ খাল দিয়ে যাতায়াত করে থাকে। নিচের ছবি থেকে সহজেই অনুমেয় এর অর্থনৈতিক গুরুত্ব।

সুয়েজ খালের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
https://globalriskinsights.com/suez-canal/

নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম নীতি মেনে বিশ্বের যেকোন জাহাজ এই খাল দিয়ে যাতায়াত করতে পারে। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী যুদ্ধ কিংবা শান্তি যেকোন পরিস্থিতিতেই এই খাল সবার জন্য উম্মুক্ত।

বাংলার সুয়েজ খাল

বাংলার সুয়েজ খাল  বলা হয় গাবখান চ্যানেলকে। এটি ঝালকাঠি জেলায় অবস্থিত। গাবখান চ্যানেলটি বাংলাদেশের একমাত্র কৃত্রিম নৌপথ যা বাংলার সুয়েজখাল নামে পরিচিত। সন্ধ্যা ও সুগন্ধা নদীর সংযোগ কারি কৃত্রিম খালটি ১৮ কিমি দৈর্ঘ্য। চ্যানেলের দু’পাশে রয়েছে  সবুজের সমারোহ। দেশে যতগুলো নৌ চ্যানেল আছে, সৌন্দর্যের দিক থেকে গাবখান চ্যানেল অন্যতম। প্রায় ২০০ বছরের প্রাচীন এ নৌপথের সৌন্দর্যটুকু মুগ্ধতা অসীম।

বাংলার সুয়েজ খাল
বাংলার সুয়েজ খাল

এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হয়ে আপনি যদি রেডিটুরিডিং ব্লগকে ডোনেট করতে চান তাহলে বিকাশ-০১৬১৪১৭১৭৬৫ অথবা নগদ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ অথবা ইউক্যাশ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ এ আপনার ডোনেশন পাঠাতে পারেন।

অথবা,

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেও আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন। ইউটিউব চ্যানেল লিংক এখানে। আশা করি অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সহযোগীতা করবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হয়ে আরও লেখা পাবলিশ করব।

Previous articleস্ট্যাচু অব লিবার্টি-সাম্য, স্বাধীনতা আর মুক্তির প্রতিক এবং সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।
Next articleঘুমের ইতিবৃত্ত। ঘুম এক প্রশান্তির নাম, এক রহস্যে ঘেরা দ্বীপ
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।