খাটি মধু

মধু এক বিস্ময়কর সৃষ্টি। প্রাচীন কাল থেকেই এর নানামুখী ব্যবহার হয়ে আসছে৷ প্রাচীন কালের অন্যতম সেরা ওষুধ এই মধু৷ কেবল সুস্বাস্থ্যের উপকরণ হিসেবেই নয়, মধুর রয়েছে ধর্মীয় ও আধ্যাত্মিক গুরুত্ব। আজকের ব্লগে আমি মধুর ব্যবহার ও উপকারিতা নিয়ে আলোচনা করব।

ইসলাম ধর্মমতে, ‘মৌমাছির পেট থেকে বিভিন্ন রঙের পানি নির্গত হয়, যাতে মানুষের জন্য রয়েছে রোগের প্রতিকার।’ তাছাড়া প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রে মধুর ওষুধি ও আধ্যাত্মিক গুণের উল্লেখ আছে। প্রাকৃতিক মধুর নানা গুণ গবেষকরা গবেষণায় পেয়েছেন। অনেকে চিনির বিকল্প হিসেবে মধু ব্যবহার করে থাকে৷

মধু পরিচিতি

মধু এক ধরণের  মিষ্টি ও ঘন তরল পদার্থ।এটি মৌমাছি ও অন্যান্য পতঙ্গ ফুলের নির্যাস হতে তৈরি করে মৌচাকে সংরক্ষণ করে। এটি একটি ঔষধিগুণ সম্পন্ন একটি ভেষজ তরল।  খাদ্য প্রস্তুতের সময়ে চিনির চেয়ে মধুর ব্যবহার উপকারি৷  নানান উপকারিতার কারণে অনেকে চিনির চাইতে মধুকেই পছন্দ করে থাকেন।

বাংলাদেশের সুন্দরবনের মধু স্বাদ, রং, হালকা সুগন্ধ এবং ঔষধিগুণাবলীর জন্য প্রসিদ্ধ। সুন্দরবনের বেশিরভাগ মধু কেওড়া গাছের ফুল থেকে উৎপন্ন। সুন্দরবনের মাওয়ালী সম্প্রদায়ের লোকেরা মৌচাক থেকে মধু সংগ্রহ করে এবং তা বিক্রয় করে জীবন নির্বাহ করে। মধু কখনো নষ্ট হয় না। হাজার বছরেও এর গুণগত  মান ঠিক থাকে৷

মধু
মৌমাসির মধু সংগ্রহ

মধুর পুষ্টিগুণ

মধুতে রয়েছে পঁয়তাল্লিশটিরও বেশি পুষ্টিগুণ। এর মধ্যে ২৫-৩৭ শতাংশ থাকে গ্লুকোজ। তাছাড়া ৩৪-৪৩ শতাংশ ফ্রুক্টোজ, ৫-১২ শতাংশ মন্টোজ, ২২ শতাংশ এমাইনো এসিড। আরো রয়েছে ভিটামিন ভিটামিন-এ, ভিটামিন বি১, বি২, বি৬, আয়োডিন, জিংক, কপার ইত্যাদি।

খাঁটি মধু চেনার উপায়

মধু
মধুর চাক

মধুতে প্রায় ৪৫টি খাদ্য উপাদান থাকে। খাঁটি মধু পানির গ্লাসে ড্রপ আকারে ছাড়লে তা সরাসরি ড্রপ অবস্থায়ই গ্লাসের নিচে চলে যায়। কয়েক ফোঁটা মধু একটি ব্লটিং পেপারে নিলে ব্লটিং পেপার কর্তৃক মধু শোষিত হবে না। ভেজাল মধু ব্লটিং পেপারকে আর্দ্র করে তোলে।

মধু চাষ
মধু চাষ হচ্ছে, যা খুবই জনপ্রিয়

মধুর নানাবিধ ব্যবহার

মধু আপনি অসংখ্য কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। এটি একটি বহুমুখী উপকারী ভেষজ তরল। রোগের জন্য, এমনি খাবার হিসেবে, কিংবা রুপ চর্চাতে এর ব্যপক ব্যবহার রয়েছে। চলুন জেনে নেই তেমন কিছু ব্যবহার।

ত্বকে মধুর ব্যবহার

আজকাল ইয়াং জেনারেশন ত্বক নিয়ে অনেক কনসার্ন। গরমের দিনে অতিরিক্ত তৈলাক্ত ভাব আর শীতের দিনে অতিরিক্ত রুক্ষতা নিয়ে অনেকেই অস্বস্তিতে ভুগে থাকে৷

মধু ব্যবহারে আপনি এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে পারেন সহজে৷ নিয়মিত ময়দার সাথে মধু দিয়ে পেস্ট বানিয়ে মুখে ব্যবহার করুন৷ ঘুমানোর আগে মুখে তৈরিকৃত পেস্ট মেখে সকালে উঠে ধুয়ে ফেলুন৷ দেখবেন আপনার চেহারায় নমনীয়তা চলে আসবে।

শিশুদের জন্য মধু

মধু শিশুদেহে খুবই উপকারী। অতীতে তো বটেই এখনো গ্রামের মানুষ শিশুদের নানা ভাবে মধু সেবন করিয়ে থাকে। এতে করে শিশু কাল থেকেই শরীরে রোগ জীবাণু কম বাসা বাধে।

দুর্বল শিশুদের ক্ষেত্রে দুধের সাথে মধু মিশিয়ে দিনে দুই বেলা খাওয়ালে তাদের দুর্বলটা কেটে যেতে পারে। তাছাড়া এটি শিশুর শারীরিক গড়ন, রুচি বৃদ্ধি, ওজন বৃদ্ধি ও পেট ভালো রাখতে সাহায্য করে থাকে।

আমাশয়ে মধু

রক্ত মিশ্রিত পায়খানা সাথে পেট কামরানো থাকলে তাকে সাধারণত আমাশয় ধরা হয়। আমাশয় হলে শরীর দুর্বল লাগে, ব্যথা করে সাথে মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে। মধু আমাশয় নিরাময়ে ভূমিকা রাখে।

কচি বেলের সাথে আম গাছের বাকল মিশিয়ে বেটে নিবেন। তার সাথে গুর ও মধু মিশিয়ে পেস্ট বানাইয়ে সেবন করবেন৷ ইন শা আল্লাহ আপনার রোগ নিরাময় হবে।

কুল বা বড়ই গাছের ছাল চূর্ণের সাথে মধু মিশিয়ে খেলেও উপকার পাবেন।

বাতের ব্যথায় মধু

জয়েন্ট ব্যথা আজকাল কমন। বাতের কারণে এই ব্যথা বেশি হয়ে থাকে৷ নিয়মিত ওষুধ খেলে ভালো থাকে কিন্তু ওষুধ বাদ দিলেই আবার আগের মত। কিন্তু কতদিন ওষুধে চলা যায়?

যে অবাঞ্চিত রসের কারণে বাতের ব্যথা হয়ে থাকে তা অপসারণ করতে মধুর পুষ্টিগুণ সাহায্য করে থাকে৷ তাই নিয়মিত মধু সেবনে আপনার এই ব্যথা থেকে মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

অনিদ্রা কাটাতে মধু

বর্তমান জেনারেশনে অনিদ্রা যেন নিয়মিত সমস্যা। এতে মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকে৷ ভালো ঘুমের জন্য ঘুমের আগে দুধ বা পানির সাথে এক চামচ মধু মিশিয়ে খেয়ে ফেলুন।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মধু

শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি না থাকলে অল্পতেই অসুস্থ হয়ে যেতে হয়৷ অনেক সময় সাধারণ সমস্যাতেও মৃত্যু হয়। তাই শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি।

নিয়মিত মধুর ব্যবহার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। গবেষকেরা প্রমাণ করেছেন যে মধুতে একাধিক পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। এই পুষ্টি উপাদান গুলো রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে থাকে।

যৌন সমস্যায়

স্বাভাবিক যৌন সমস্যা সমধানে মধু অনেক কার্যকরী। তবে অস্বাভাবিক হলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে৷ আজকাল অনেকে নানাবিধ পার্শ্ব কারণে এই সমস্যা ভুগে থাকে।

এক গ্লাস দুধের সাথে এক চামচ মধু টানা দুই মাস পান করুন৷ আপনার স্বাভাবিক যৌন সমস্যা হলে অবশ্যই সমাধান পাবেন। দুধ ছাড়া হালকা গরম পানিতে মিশিয়েও খেতে পারবেন।

ওজন কমাতে

দৈনন্দিন জীবনে অতিরিক্ত ওজন অনেকের জন্যই অভিশাপ স্বরুপ। অতিরিক্ত ওজন নিয়মিত কাজে বাধা হয়ে দাড়ায় অনেকের৷ তাছাড়া সামাজিক বুলিং এর স্বীকার হয়ে অনেকেই থাকে মানসিক চিন্তায়।

এই সমস্যা থেকে সমধান পেতে আপনি মধুর সাহায্য  নিতে পারেন। প্রতিদিন সকালে হালকা গরম পানিতে একটু মধু মিশিয়ে পান করুন।  সাথে কালোজিরা দিতে পারেন৷ আশা করা যায় একটা সময় পর আপনি এর ভালো ফল পাবেন৷ মেডিসিন নেয়ার চেয়ে এটা সম্পূর্ণ ঝুঁকি মুক্ত৷

দাঁতের ব্যথা ও প্রদাহ কমাতে মধু

মধুতে থাকে প্রাকৃতিক অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। মধু থেকে নিঃসৃত হয় যা হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড অ্যান্টি-মাইক্রবিয়াল হিসেবে কাজ করে। এটি ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়ার জন্মে বাধা দেয়।  ফলে মধু খেলে দাঁতের ব্যথাভাব ও প্রদাহ কমে ও পাকস্থলীও ভালো রাখে।

অনিয়মিত ঋতুস্রাব

অনিয়মিত ঋতুস্রাব দৈনন্দিন কাজে ব্যাগাত ঘটায়। তাছাড়া বিষয়টি মানসিক অবস্থাতেও ইফেক্ট করে। এতে করে মুড সুইং সহ নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়৷

একচামচ মধুর সাথে একচামচ তুলসী পাতার রস নিন৷ সাথে একটু গোল মরিচের গুরো৷ মিশিয়ে সপ্তাহে ৩ দিন সেবন করুন৷ আশা করা যায় সমাধান পাবেন৷

বৈদেশিক মুদ্রা আহরণে সহায়ক

এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৪ সালে বিশ্বব্যাপী ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধু রপ্তানি হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো সবচেয়ে বেশি মধু আমদানি করে থাকে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে সুন্দরবনের মধু। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাজার সৃষ্টি এবং মধু আহরণে সংশ্লিষ্ট মৌয়ালদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে খাঁটি মধু আহরণের ব্যবস্থা করতে পারলে এর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।

সুন্দরবনে প্রকৃতিক মধু সংগ্রাহক মৌয়ালরা ছাড়াও বিসিক থেকে প্রশিক্ষণ নেয়া মৌ চাষির সংখ্যা বর্তমানে প্রায় ৯ হাজার। এসব চাষির খামারে বছরে গড়ে পাঁচ হাজার টন মধু উৎপাদন হয়।

২০১৪-১৫ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ৫৫০ মেট্রিক টন অর্থাৎ ৫৫ কোটি টাকার মধু ভারত, আরব আমিরাত ও অন্যান্য দেশে রপ্তানি হয়েছে। এটি দিন দিন আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। (সূত্রঃ https://rb.gy/fv684a)

মধু সম্পর্কিত হাদিস

হযরত মুহাম্মদ সা. মধু খুব পছন্দ করতেন৷ তিনি নিজে তা ব্যবহার করতেন এবং অন্যদের ব্যবহার করতে উৎসাহ দিতেন। হাদিসে বিষটি এভাবে এসেছে,

হযরত আয়িশা (রা) হতে বর্ণিত , হযরত মুহাম্মদ সা. মিষ্টি ও মধু খুব ভালোবাসতেন। (সহীহ আল বুখারী)

কোরআনে মধু সম্পর্কিত আয়াত

মধু সম্পর্কে পবিত্র কোরাআনেও আয়াত নাযিল হয়েছে। কিছু আয়াত দেখে নেয়া যাক।

আপনার রব মৌমাছিদেরকে তার অন্তরে ওহী (ইংগিত) করেছেন যে, গৃহ নির্মাণ কর পাহাড়ে, বৃক্ষে ও মানুষ যে গৃহ নির্মাণ করে তাতে।

(নাহল:৬৮)

 

অতঃপর চোষণ করে নাও প্রত্যেক প্রকার ফল হতে, তৎপর তোমরা রবের সহজ সরল পথে চলতে থাকো; আর তার উদর হতে নানা বর্ণের পানীয় (মধু) নির্গত হয়; যাতে মানুষের জন্য আরোগ্য রয়েছে। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল সমপ্রদায়ের জন্য রয়েছে নিদর্শন।

(সূরা নাহল, আয়াত  ৬৯)।

মধু ব্যবহারে সাবধানতা

মধুর ব্যবহার ও উপকারিতা থাকলেও মধু ব্যবহার করতে হবে পরিমাণমত। অতিরিক্ত মধু পেটে গ্যাস উৎপন্ন করতে পারে৷ তাছাড়া শরীরে জ্বালা ভাব, অস্থিরতা তৈরিতেও অতিরিক্ত মধু সেবন ভূমিকা রাখে।

অতিরিক্ত ব্যবহার না করে, নিয়মিত পরিমিত মধুর ব্যবহার আপনার জীবনের অনেক সমস্যাই দূর করবে৷ চলুন মধু সেবন করি, সুস্থ থাকি।

 

Previous articleসাহিত্য এবং সিনেমায় গথিক হরর
Next articleসর্ব রোগমুক্তির এক উপায়- কালোজিরা
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।