সুপারপাওয়ার

করোনা মহামারী পরবর্তী বিশ্বে কে হতে চলেছে সুপারপাওয়ার? এই নিয়ে অনেকেই অনেক কথা বলে থাকেন। চীন,রাশিয়া,ইন্ডিয়া নাকি অন্য কেউ,কে হবে সুপারপাওয়ার এই নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা ,অনেক পরিসংখ্যান আমাদের সামনে উপস্থিত হয়। তবে সুপারপাওয়ারের ধারনাটা অনেক ব্যাপক এবং বিস্তৃত। হঠাৎ করেই যে কারো পক্ষে সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠা সম্ভব নয়।সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠার দৌড়ে দরকার একটি দেশের প্রভূত অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক শক্তি। চলুন দেখে নেওয়া যাক করোনা পরবর্তী সময়ে  সুপারপাওয়ার হয়ে ওঠা কোন দেশের পক্ষে সম্ভব।

বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ধীরে ধীরে আমেরিকা বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।আমেরিকা এবং রাশিয়ার মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়কালে এক ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে ওঠে ।সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয় অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে। তারপর আমেরিকা কেন্দ্রীক হয়ে পড়ে পুরো বিশ্ব ।আমেরিকার গণতন্ত্রের জনপ্রিয়তা সারা বিশ্ব জুড়েই ছিল। ফলে রাশিয়াও গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে বাধ্য হয় ।রাশিয়া বর্তমানে অর্থনীতির ধাক্কা সামলে উঠতে সক্ষম হয়েছে ।আমেরিকা নিজের দেশকে শ্রেষ্ঠ প্রমাণ করতে বর্তমানে অন্যান্য দেশকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দমন করছে। এর ফলে আমেরিকা এবং ইইউ এর মধ্যকার বিবাদ বেড়ে যাচ্ছে।  ইইউ বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমেরিকার শূন্যতা পূরণ করার জন্য ইমানুয়েল ম্যাখোঁ বা অ্যাঞ্জেলা মার্কেল কে ব্যবহার করছে।তাছাড়া চীনের কাছে এখন প্রচুর অর্থবিত্ত রয়েছে । অর্থনীতির পাশাপাশি চীন  বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করছে। তারা উত্তর কোরিয়া এবং পাকিস্তানের মতো দেশে অনেক টাকা ঢালছে।  রাশিয়াও এখন আগের চেয়ে অনেক শক্তিশালী পুতিনের নেতৃত্বে ।রাশিয়া আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সেটা বলাই বাহুল্য ।ফলে পরবর্তী বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণ মূলত কয়টি শক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

সুপারপাওয়ার হবার দুটি প্রধান সূচক

বিশ্বের  সুপারপাওয়ার কে হবে সেটি প্রধানত দুটি সূচক দ্বারা নির্ধারিত হয়। সেই দুটি সূচকের নিয়ন্ত্রণ যার হাতে থাকবে সেই মূলত বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করবে। দুটি সূচকের একটি হল অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ এবং অপরটি হল রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ।

বর্তমান সুপারপাওয়ার আমেরিকার বৈশ্বিক প্রভাব

আমেরিকা বিশ্বের অনেক দেশ থেকে তেল-গ্যাস আমদানি করে নিজেদের জ্বালানির নিশ্চয়তা বিধান করেছে।বিশ্বে উড়োজাহাজের প্রধান সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান হল বোয়িং। এই বোয়িং কোম্পানি থেকে প্রায় সারা বিশ্বে উড়োজাহাজ সরবরাহ করা হয়ে থাকে। উড়োজাহাজ শিল্পে এই কোম্পানির অবদান ব্যাপক। বিভিন্ন রকমের স্যাটেলাইট বিভিন্ন কাজে লাগায় আমেরিকা। তাছাড়া বিশ্বের প্রথম সামরিক শক্তিধর দেশ আমেরিকা। তাদের তাক লাগানো প্রযুক্তির অস্ত্রশস্ত্র দুনিয়াতে শাসন কায়েমের পথ অনেকটাই সুগম করেছে। তাছাড়া আমেরিকান ডলার আন্তর্জাতিক লেনদেনের অন্যতম উপায়। বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মার্কিন ডলারকে আন্তর্জাতিক মুদ্রায় পরিণত করার ফলে সুপার পাওয়ার হওয়ার দৌড়ে আমেরিকা অনেক এগিয়ে গিয়েছিল।

উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম চালিত কম্পিউটারের চাহিদা সারা বিশ্বব্যাপী আছে। এই উইন্ডোজ কম্পিউটার অপারেটর সিস্টেমের মালিকানায় একজন আমেরিকান নাগরিক। তার নাম বিল গেটস। তিনি একজন ধনী ব্যক্তি । তাছাড়া বর্তমান পৃথিবীতে অ্যাপল কোম্পানির কম্পিউটারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে।  অ্যাপল কোম্পানিটি মূলত আমেরিকান কোম্পানী। আজ আমরা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বিশ্বকে হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি ।এই সোশ্যাল মিডিয়ার ধারণা উৎপত্তি হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। তবে সোশ্যাল মিডিয়ার বিভিন্ন দিক নিয়ে অনেক আলোচনা সমালোচনা রয়েছে। আমরা অনেক সময় অনলাইন ভিত্তিক ই-কমার্স সাইট ব্যবহার করে নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে থাকি। এই ই-কমার্স সাইট প্রতিষ্ঠার ধারণা আমেরিকা থেকে এসেছে । এতক্ষণ যা কিছু কথা বললাম সেগুলো বিকাশের পেছনে ইন্টারনেটের অবদান রয়েছে। ইন্টারনেট ছাড়া বর্তমান জীবন প্রায় অচল। আমেরিকা থেকেই ইন্টারনেটের উৎপত্তি হয়েছে।

বিশ্ব অর্থনীতিতে চীন

বর্তমান বিশ্বের অর্থনীতিতে চীনের অনেক অবদান রয়েছে।বর্তমানে বিশ্বের অনেকদেশ বিভিন্ন পণ্যের জন্য চীনের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল কারণ পণ্য সরবরাহের সাপ্লাই চেইন চীনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাছাড়া দুনিয়ায় সবচেয়ে কম দামে পণ্য উৎপাদন করার ক্ষেত্রে চীন সুনাম কুড়িয়েছে।চীন সাধারণত অনেক ধরনের প্রোডাক্ট বাজারে রপ্তানি করে থাকে। মূলত গত শতকের আশির দশকে চীনে এক প্রকারের শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল। বিশ্বের বিভিন্ন কোম্পানি সেসময় সস্তা শ্রম দেখে চীনে বিনিয়োগ করে। তাছাড়া চিনে অবস্থিত স্পেশাল ইকোনমিক জোন গুলো চীনের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশে বর্তমানে চীনা পণ্য পৌঁছে গেছে। আমেরিকা তাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর 70% আমদানি করে থাকে চীন থেকে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চীনের ওপর শুল্ক বাধা আরোপ করার পরে চীনে উৎপাদিত পণ্যের দাম বেড়ে যায় ।ফলে যেসব কোম্পানি তাদের পণ্য চীনে উৎপাদন করত তারা একসময় বুঝতে পারে একমাত্র চীনের উপর নির্ভরশীল থাকার কারণেই তাদের পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে সেইসব কোম্পানি অন্যান্য দেশের অনুসন্ধান করতে থাকে যাতে তাদের পণ্য উৎপাদন করা যায়। সেইসব কোম্পানি ভারত, ভিয়েতনাম কিংবা আফ্রিকার মতো দেশগুলোকে টার্গেট করে থাকে। চীন যেহেতু উন্নত দেশের কাতারে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে ফলে তাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে । ফলে সস্তা শ্রম আর সহজলভ্য থাকছে না। বর্তমানে আগের তুলনায় চীনে উৎপাদিত পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়েছে । বিভিন্ন কোম্পানির চীন থেকে পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যদি বিভিন্ন কোম্পানি চীন থেকে চলে যায় তবে এ বিষয়টি নিয়েও ভাবছে চীন।সেই লক্ষ্যে চীন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিনিয়োগ করছে। বিভিন্ন কোম্পানি যদি তাদের কারখানা চীন থেকে সরিয়ে নেয় তবে তাতেও যেন চীন অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে না ফেলে সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করছে। তাছাড়া যেসব কোম্পানির চীন ছেড়ে যাবার কোনো সম্ভাবনা নেই তারা যেন খুব সহজে পণ্য পরিবহন করতে পারে অন্যান্য দেশে সেজন্য  অনেক টাকা খরচ করে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগ হাতে নিয়েছে চীন।

চীন এবং আমেরিকার জনগণের মাথাপিছু আয়ের  তুলনা

আমরা জানি, বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ দেশ চীনের জনসংখ্যা প্রায় 130 কোটি ।চীনের জনগণের মাথাপিছু আয় 10,872.00 মার্কিন ডলার। সুতরাং বোঝাই যাচ্ছে তারা মধ্যম আয়ের দেশ। চীনের অর্থনীতির আকার 15 ট্রিলিয়ন ডলার।এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর অন্যতম ক্ষমতাধর দেশ। সেই দেশটির মোট জনসংখ্যার প্রায় 33 কোটি। তাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় 67,426.00 মার্কিন ডলার। আমেরিকা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে উন্নত দেশ। আমেরিকা মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে চীনের থেকে অনেকটা এগিয়ে আছে। চীনের জনগণের মাথাপিছু আয় আমেরিকার জনগণের থেকে কম। আমেরিকা মূলত ধনী দেশগুলোর অন্তর্ভুক্ত। তাদের অর্থনীতির মোট আকার  চীনের থেকে অনেক বেশি ।তাদের অর্থনীতির আকার এর পরিমাণ প্রায় 22 ট্রিলিয়ন ডলার।মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে একটি দেশের অর্থনীতির সক্ষমতা বিবেচনা করা হয় । একজন চীনা নাগরিকের মাথাপিছু আয় একজন আমেরিকান নাগরিকের মাথাপিছু আয় এর সাত ভাগের এক ভাগ।

বিশ্বের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থা

বর্তমানে বিশ্বের রাজনীতিতে একটি ধারা দেখা যাচ্ছে। সেটি হল যেন তেন ভাবে অন্য কোনো শ্রেণীকে দমন করে নিজেদেরকে সর্বশ্রেষ্ঠ ভাবার প্রবণতা। এই প্রবণতা খুবই খারাপ। নিজের দেশকে শ্রেষ্ঠ মনে করে অন্য দেশকে দমন করে কখনোই পৃথিবীতে শান্তি সমৃদ্ধি সাধিত হয় না।

আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য নীতির কারণে আমেরিকা সারা বিশ্বের কাছেই সমালোচিত হচ্ছে। তাছাড়া সিরিয়া ,ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকান সৈন্যরা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। তাছাড়া আমেরিকা যাদের ক্ষতিগ্রস্ত করছে সেখানে চীন ও রাশিয়া উপস্থিত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের চীন ও রাশিয়া সামরিক সহযোগিতা এবং অর্থ দিয়ে আমেরিকার শূন্যস্থান পূরণ করছে।

আমেরিকার বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ 20 হাজার বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে ।তাছাড়া আমেরিকাতে বর্তমানে মাদকাসক্ত ও গৃহহীন মানুষের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। আমেরিকায় বর্ণ বৈষম্য ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে।

অন্যদিকে করোনা মহামারী সংকটে আমেরিকা তাদের নিজেদের দেশের পরিস্থিতি সামলাতে ব্যর্থ হয়েছে। অন্যদিকে চীন নিজেদের দেশের পরিস্থিতি সামলেও বাকি বিশ্বের জন্য মেডিকেল সরঞ্জামাদিসহ বিভিন্ন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। মূলত প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্যান্য ক্ষেত্রে আমেরিকা বিশ্বের কাছে সবার আগে উপস্থিত হলেও করোনা পরিস্থিতিতে উল্টো ঘটনা ঘটেছে। আমেরিকার শূন্যতা পূরণ করেছে চীন।

তবে কি সুপারপাওয়ার হতে যাচ্ছে চীন? চীন অবশ্যই অনেক উন্নতি করছে। তারা পুরো পৃথিবীতে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটাচ্ছে। নিজের দেশের জনগণের জীবনমানের অব্যাহত উন্নয়ন বজায় রাখছে। তাদের দেশের জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়ে যাচ্ছে। চীন তাদের জনসংখ্যার লাগাম টেনে ধরতে সক্ষম হয়েছে। সামরিক সক্ষমতায়ও এখন চীন অনেক এগিয়ে গেছে।

ভারত ও চীনের সামরিক শক্তির তুলনামূলক চিত্র দেখতে এখানে ক্লিক করুন। সকল দেশের সামরিক শক্তির তুলনা দেখুন এই লিংকে

পাশ্চাত্যের অনেক কূটনীতিক মনে করেন করোনা সংকটকে কেন্দ্র করে চীন চাইছে পুরো বিশ্বে তাদের আধিপত্য কায়েম করতে ।তবে এটা অবশ্যই ঠিক যে করোনাভাইরাস মহামারী আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বৈশ্বিক ব্যবস্থায় কি দুর্বলতা রয়েছে। চীন-আমেরিকা বর্তমানে বিশ্বের দুই প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। ক্ষমতা কখনোই চিরস্থায়ী নয়। একজন থেকে আরেকজনে ক্ষমতা চিরকালই স্থানান্তর হয়ে এসেছে। অবশ্য‌ই মহামারী পরবর্তী বিশ্বে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়ে সুপারপাওয়ার পরিবর্তনের হাওয়া পৃথিবীতে লাগতে পারে।

Previous articleজহির রায়হান- একজন শব্দের জাদুকর
Next articleনাকের এলার্জি- কেন হয়? এর চিকিৎসা কি?