আজকাল মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবারের মায়েদের একটি কমন সমস্যা হল তাদের বাচ্চা খেতে চায় না। এটা নিয়ে তারা প্রায়শই ডাক্তারের শরণাপন্ন পর্যন্ত হয়ে থাকেন। বাচ্চা খেতে চায় না এটাই ডাক্তারের কাছে তার প্রধান অভিযোগ। তারা বুঝতেই চাননা একটি শিশু আসলে একজন মানুষ, এবং ক্ষুধা লাগা তার একটি জৈবিক প্রক্রিয়া। ক্ষুধা ব্যাপারটি স্বাভাবিকভাবেই হয়ে থাকে, এর জন্য কোন ঔষধের প্রয়োজন নেই। আজকের ব্লগে আমি আলোচনা করব আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন ?
সাথে যেনে নেব ক্ষুধা নিয়ে কিছু অজানা তথ্য। আসুন শুরু করা যাক- চাইলে ভিডিওতেও দেখে নিতে পারেন।
বাচ্চার না খাওয়া নিয়ে বাবা-মায়ের ধ্যান ধারনা
অধিকাংশ বাবা-মায়েরা ধারনা করে থাকেন তাদের বাচ্চা খাচ্ছে না মোটেই, বিশেষ করে শহরের ফ্লাট বন্দি বাবা-মায়েরা। আর এই সমস্যা এখনকার সমাজে একটা সংক্রামক পর্যায়ে চলে গেছে। এ ব্যাপারে তারা যেটা বলে থাকেন- আমার বাচ্চা তো কিছুই খায় না।
আশেপাশের মানুষ কি বলে
আপনার বাচ্চা খাচ্ছে না- একথা শুনে আশেপাশের মানুষ কি বলে? তারা বলবে- না খেলে বাচ্চা বেঁচে আছে কিভাবে? কিংবা বলে আগেকার জামানায় মায়েদের অনেকগুলো বাচ্চা সামলাতে হত তাই কে খেল আর কোনটা না খেয়ে আছে দেখার সুযোগই পেত না। এখনকার মায়েদের যেহেতু একটি বা দুইটি বাচ্চা তাই সারাদিন এদের পেছনেই লেগে থাকে। কেওবা বলে- একদিন না খাইয়ে রাখুন পরের দিন দেখবেন এমনি এমনি খাবার চেয়ে খাবে।
উপরের কথাগুলো একদিকে যেমন সঠিক আবার এর মাঝে ভুলও আছে। একটু পরেই সেটা নিয়ে আলোচনা করছি।আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন জানতে পড়তে থাকুন।
আসুন জেনে নেই মানুষের ক্ষুধা কেন লাগে
একজন মানুষের খাওয়া আর না খাওয়ার পুরো ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রন করে মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসে থাকা দুইটি অংশ- ফিডিং সেন্টার আর স্যাটাইটি সেন্টার। পেট খালি হলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমে যায় আর মস্তিস্কের ফিডিং সেন্টার উত্তেজিত হয়ে সিগন্যাল প্রদান করে আর আমরা ক্ষুধাবোধ করি এবং খাবার খাই। আর পেট ভর্তি থাকলে, রক্তে গ্লূকোজের মাত্রা যথেষ্ট থাকলে স্যাটাইটি সেন্টারের উত্তেজনার কারণে সিগন্যাল প্রদান করে এবং আমরা খাওয়া বন্ধ করি। এটা একটা স্বাভাবিক জৈবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু এখানে একটা কথা থেকে যায়।
অটোমেটিক নার্ভাস সিস্টেম অন্যকোন নির্দিষ্ট সিগন্যালের কারনে উত্তেজনা তৈরি করে স্যাটাইটি সেন্টার সিগন্যাল প্রদান করতে পারে, সেক্ষেত্রে পেট খালি থাকলেও মস্তিস্কের ফিডিং সেন্টার সিগন্যাল দেবেনা ক্ষুধার। বরং দেখা দেবে উদ্বেগ কিংবা উত্তেজনা। এছাড়া শুধু স্যাটাইটি সেন্টার নয় ক্ষুধার জন্য আরও কিছু নিয়ামক আছে যেমন মনের অবস্থা, পরিবেশ, পরিবার ইত্যাদি।
আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন, জানুন।
বাচ্চা কেন খেতে চায় না?
বড় মানুষের ক্ষেত্রে ক্ষুধার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নেয় রক্তে গ্লূকোজ স্বল্পতা কিন্তু ছোটদের বেলায় রক্তে গ্লূকোজ স্বল্পতার পাশাপাশি বাচ্চার মানসিক অবস্থা এবং বেড়ে ওঠার পরিবেশ অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে। তখন মন মেজাজ ভাল না থাকলে পেট খালি থাকলেও বাচ্চা খেতে চাইবে না।
একারনেই দেখা যায়, যেসব বাচ্চা ছোট পরিবারে থাকে, বাবা-মা কিংবা প্রিয়জনের সংগ কম পায়, কিংবা অন্য বাচ্চাদের সাথে খেলার সুযোগ হয়না তারা খেতে চায় না। আপনি যতই পুতুল কিংবা খেলনা দিয়ে তাকে বসিয়ে রাখুন না কেন বাচ্চার মন বিগড়ে থাকবে, মনের অস্থিরতার প্রভাবে ফিডিং সেন্টার উত্তেজিত থাকবে, ক্ষুধার বোধ হারিয়ে যাবে, ফলাফল হিসেবে বাচ্চা ক্ষেতে চাইবে না।
এছাড়াও বারবার একই খাবার কিংবা অরুচিকর খাবারও বাচ্চার মনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে এবং বাচ্চার না খাওয়ার প্রবনতাকে বাড়িয়ে দেয়। জোর করেও বাচ্চাকে খাওয়ানো যায় না।
বাচ্চাকে জোর করে খাওয়ালে তার ফলাফল কি
আর জোর করে খাওয়াতে গেলে হিতে আরও বিপরীত হতে পারে। এতে লহাওয়ার প্রতি অনীহা আরও বাড়ে। আর আধুনিক মায়েরা এই ভুলটাই করে থাকেন। তারা না খেতে চাওয়া বাচ্চাদের বকা-ঝকা করে বাচ্চার খাওয়ার প্রতি আরও অনীহা তৈরিতে সহায়ক ভূমিকা রাখেন।
ক্ষুধা বাড়ানোর ঔষধ
বাচ্চা খাচ্ছে না, খেতে চায় না- এই অভিযোগ নিয়ে অনেক বাবা-মাই চলে যান ডাক্তারের কাছে। তারা ঔষধ চান। ডাক্তারকে এক প্রকার বাধ্য করেন ঔষধ লিখতে। যদিও চিকিৎসা বিজ্ঞানে এর কোন ঔষধ নেই। একপ্রকার বাধ্য হয়েই ডাক্তার এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধ লিখে দেন।
হয়ত ডাক্তার লিখলেন ৭ দিন খেতে, বাবা-মা যদি দেখে ঔষধে কাজ হচ্ছে ঐ ঔষধই মাসের পর মাস খাইয়ে যান। ছোট বাচ্চার ঔষধ নিয়ে মোটেই বারাবারি করবেন না। এই ব্লগ টি পড়ে আসতে পারেন। কাজে লাগবে আবশ্যই। আপনার বাচ্চা খেতে না চাইলে কি করবেন? আরও পড়ুন।
কি থাকে এই এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধে
বেশিরভাগ এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধে থাকে সাইপোহেপ্টাডিন নামক ঔষধ, কিছু এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধে থাকে অল্পমাত্রায় এ্যাল্কোহল। সাথে থাকে নানা প্রকার ভিটামিন আর খনিজ সহ নানা উপাদান। খাবার আগে এই অল্পমাত্রায় এ্যাল্কোহল পেটে গেলে পাকস্থলিতে পাচক রস নিঃসরন বেড়ে খিদে সামান্য বাড়ে।কিছু এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধে থাকে ভিটামিন আর খনিজের সাথে লাইসিন নামের এক রাসাইনিক পদার্থ। লাইসিন এক প্রকার এমিনো এসিড বা প্রোটিন যা আমরা স্বাভাবিক খাবারের সাথে এমনিতেই যথেষ্ট পরিমানে পেয়ে থাকি।
এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধের ফলাফল
বেশিরভাগ এ্যাপাটাইজার জাতীয় ঔষধে থাকে সাইপোহেপ্টাডিন নামক ঔষধ, যা আসলে মোটেই খিদা বাড়ানোর ঔষধ নয়। এটি আসলে এন্টিহিস্টামিন ও এন্টিসেরোটোনিন গোত্রের একটি ঔষধ। মস্তিস্কের হাইপোথ্যালামাসে সেরোটোনিন নামের স্নায়ুসঞ্চালকের কাজকে প্রতিহত করে। এবং প্রতিহত করে শরীরের হিস্টামিন নামক এলারজি-সহায়কের প্রভাবকে। এছাড়া চর্ম রোগে সাইপোহেপ্টাডিন ব্যবহারের উল্লেখ আছে।
এই ঔষধ খেলে ক্ষিদে বাড়ে কিন্তু বাচ্চার খাওয়াও বাড়ে, সাথে বাড়ে ওজন। ঔষধ খেতে থাকলেও দ্বিতীয় সপ্তাহে ওজন কমে যায় আর সঠিক মাত্রায় এই ঔষধ খেলেও ঝিমুনি ভাব, ঠোট শুকিয়ে যাওয়া, ঘুমাতে না পারা, মাথা ঘুরা, কাপুনি ইত্যাদি নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। এমন কি বড়দেরও নানা উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
একটানা এই ঔষধ বাচ্চার স্বাভাবিক বিকাশের জরুরী হরমোনকে বাধাগ্রস্ত করে। বাচ্চার শরীর ও মনের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে। এতে স্বাভাবিক বিকাশের বিপর্যয় ঘটা তাই মোটেই অসম্ভব নয়। অনেকদিন এই ঔষধ সেবনে দেখা দিতে পারে মিডিয়াস্টাইনাল ফাইব্রোসিস এর মত ভয়ংকর সমস্যা। বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে বাচ্চার স্বাভাবিক খিদে পাওয়ার জৈবিক প্রক্রিয়া। এছাড়া এই ঔষধ একটানা খেলে বাচ্চার স্বাভাবিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার আসংকা তৈরি হয়।
তাহলে বাচ্চা না খেতে চাইলে বাবা-মায়েরা কি করবেন
তাহলে বাচ্চা না খেতে চাইলে বাবা-মায়েরা কি হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন? না তা কখই নয়। তাদের খুঁজে বের করতে হবে না খাওয়ার পেছনের কারন। যদি শারীরিক সমস্যার কারনে বাচ্চা খেতে না চায় তাহলে মূল সমস্যা খুঁজে বের করতে হবে। তানাহলে, বাচ্চার মানসিক দিকটার খোঁজ নেয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। বাচ্চার মানসিক বিকাশ হচ্ছে কিনা, প্রিয়জনের সংগ পাচ্ছে কিনা, চারপাশের পরিবেশ ঠিক আছে কিনা সেদিকে নজর দিন। খেলাধুলার সুযোগ করে দিন। তাকে আনন্দের সাথে বড় হতে দিন।
আর যদি আপনার বাচ্চা একেবারেই খেতে না চায় তাহলে প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। যখন তখন খাবার দিয়ে তার খিদে নষ্ট করে ফেলবেন না। সাধারণত দুই থেকে তিন বছর বয়দের বাচ্চাদের প্রতিবার খাবারের মাঝে দুই থেতে তিন ঘণ্টা বিরতি থাকা খুবই দরকার। এই সময়ের মাঝে যদি অন্য কোনো খাবার সে না খায়, তবে সময়মত শিশুর ক্ষুধা লাগার কথা।
আমাদের শিশুরা বেড়ে উঠুক স্বাভাবিক নিয়মে এবং তার বিকাশ ঘটুক সম্পূর্ণরূপে। আশাকরি আমাদের আজকের ভিডিওটি ভাল লেগে থাকলে ভিডিওটিতে লাইক দিয়ে আমাদের চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব করুন।
আশা করি আজকের ব্লগ আপনাদের কাজে লাগবে। ধন্যবাদ।
তথ্যসূত্রঃ বই- ওষুধ যখন রোগ বাড়ায়, লেখক- ডাঃ শ্যামল চক্রবর্তী
Nice
Thank You
বন্ধুবর খুবই কার্যকর একটা লেখা ।
ধন্যবাদ বন্ধু, ঘুরে ফিরে আবার এসো।