বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে “পান্তাভাতের জল, তিন পুরুষের বল”। আগে কথাটি শ্রেফ প্রবাদ বলে উড়িয়ে দিলেও আজকের দিনের বিজ্ঞানীরাও কথাটির সাথে একমত। পান্তা ভাতের উপকারিতা নিয়ে তাই আমাদের আজকের ব্লগ।
কিভাবে এল পান্তা ভাত
আগেকার দিনে রাতের রান্না করা ভাত অতিরিক্ত হয়ে গেলে তা যেন নষ্ট হয়ে না যায় তাই ভাতে পরিমান মত পানি দিয়ে ভিজিয়ে রেখে দিত যা পরের দিন সকালে খাওয়া হত। এতে করে অধিক গরমের সময়ও ভাত নষ্ট হয়ে যেত না, সকালে নাস্তায় বেশ আরাম করে খাওয়া যেত। সাথে মিশানো হত স্বাদ অনুযায়ি লবন, কাঁচা কিংবা শুকনা মরিচ ইত্যাদি। এতে পান্তা ভাতের স্বাদ বেশ জমত।
গ্রামের মানুষের কাছে পান্তা ভাত আজও জীবনেরই অংশ। পহেলা বৈশাখে শহরের মানুষ শখ করে পান্তা ভাত খেলেও শহর কিংবা গ্রামের মানুষের কেওই এর পুষ্টিগুণ নিয়ে তেমন অবগত নয়।
বাচ্চা খেতে চায় না? বাচ্চাদের স্বাস্থ্য নিয়েও ভাবুন। এখানে বিস্তারিত পড়ুন।
পান্তা ভাতের রেসিপি
শহরে যারা পহলা বৈশাখে পান্তা ভাত কিনে খান তারা আসলে পান্তা আসল স্বাদ পান না। দোকান কিংবা হোটেলে ওইদিন গরম ভাতে পানি দেয়া ভাতকেই পান্তা ভাত বলে চালিয়ে দেয়া হয়। আসল পান্তা ভাতের স্বাদ পেতে হলে আপনাকে নিচের নিয়ম অনুসরণ করতেই হবে।
- যদি পরের দিন পান্তা ভাত্ত খেতে চান তাহলে আগেরদিন ভাত রান্না করুন।
- পাতিলের ভাত হাত দিয়ে নেড়ে ঝড়ঝড়া করে নিন। খেয়াল রাখুন ভাত যেন দলা আকারে না থাকে।
- এবার প্রয়োজন মত পানি দিয়ে ভাত ডুবিয়ে দিন।
- এবার ঢাকনা দিয়ে ঢেকে রাখুন সারা রাত।
- সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবেন পান্তা ভাত তৈরি।
পান্তা ভাতের উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
পান্তা ভাতের পুষ্টিগুণ নিয়ে আসলে আমরা কেও অবগত নই। কী আছে পান্তা ভাতে? আসুন জেনে নেই। জানলে অবাক হবেন পান্তা ভাতে ফ্রেস গরম ভাতের চেয়ে পুষ্টিগুণ থাকে প্রচুর পরিমানে বেশি। আয়রন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামের পরিমান পান্তা ভাতে বেশি থাকে।
এটা আমার নিজস্ব কথা নয়, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের পুষ্টি ইউনিটের বিশ্লেষণ এবং ভারতের আসাম রাজ্যের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অণুজীববিদ্যা বিভাগ এর গবেষণায় পান্তাভাতের পুষ্টিগুণের এই তথ্য পাওয়া গেছে।
পান্তা ভাতের খনিজ উপাদান
আমরা যে পদ্ধতিতে চাল পানি দিয়ে সিদ্ধ করে ভাত রান্না করি তার মাঝে ফাইটিক এসিড থাকে যা কিনা বিভিন্ন প্রকার খনিজ লবন যেমন -আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক ইত্যাদির সাথে যুক্ত থাকে এবং যা এইসব খনিজ বা মিনারেল লবণকে দেহে শোষন করতে বাধা দিয়ে থাকে।
কিন্তু যেই আপনি ভাতকে সারা রাত্র ভিজিয়ে রাখবেন তখনই ভাতের শর্করা গাঁজনের কারনে লেকটিক এসিড তৈরি হয় যা ভাতের সকল খনিজ লবণকে হাজার গুণ বাড়িয়ে দেয়।
জানলে অবাক হবেন, ১০০ গ্রাম ভাতকে যদি ১২ ঘণ্টা পানিতে ভিজিয়ে রাখেন এতেই
- লৌহ বা আয়রনের পরিমাণ ৩.৪ মিলিগ্রাম থেকে ৭৩.৯১ মিলিগ্রাম হয়, যা বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত।
- আর পান্তা ভাতে খনিজ সোডিয়ামের পরিমাণ কমে গিয়ে ৪৭৫ মিলিগ্রাম থেকে ৩০৩ মিলিগ্রাম হয়।
- জিংকের পরিমাণও বেড়ে যায় অনেক গুণ।
- পটাশিয়ামের পরিমাণও ৭৭ মিলিগ্রাম থেকে বেড়ে হয় ৭৯৯ মিলিগ্রাম।
পান্তা ভাতের ভিটামিন
আমাদের পান্তা ভাত ভিটামিন B6 এবং B12 এর ভাল উৎস যা রক্ত উতপাদনে সাহায্য করে এবং আপনি জালে অবাক হবেন যে অন্য কোন খাবারে এত সহজে এত পরিমাণে এই ভিটামিন পাওয়া যায় না।
হজমে সহায়ক পান্তা ভাত
পান্তা ভাত আমাদের শরীরে অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করে। হজমে সহায়তা করে, কারণ ভাত দীর্ঘক্ষন ভিজিয়ে রাখার কারনে এতে প্রচুর পরিমানে উপকারি ব্যাকটেরিয়া তৈরি হয় যা আপনার পেট পরিষ্কার রাখে। কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। শরিরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বাড়ে।
ত্বক সজীব রাখে পান্তা ভাত
আমাদের প্রিয় পান্তাভাত কোলাজেন তৈরি করে যা ত্বকের ইলাস্টিসিটি রক্ষা করে এবং নতুন কোষ তৈরি করে। ত্বককে রাখে সজীব ও প্রানবন্ত। জলীয় খাবার বলে পান্তা ভাত শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করে।
শক্তির যোগান দেয় পান্তা ভাত
আমরা সবাই জানি আমাদের শরীরের শক্তির যোগান দেয় শর্করা জাতীয় খাবার। পান্তা ভাত এই শর্করা যোগান দিতে অন্য সবার চেয়ে উপরে। আপনি যদি এর সাথে আলু ভর্তা যোগ করেন তাহলে ত কথাই নেই। পান্তা ভাত খেলে শরীর হালকা এবং কাজে বেশি শক্তি পাওয়া যায়
কোন কোন দেশ পান্তা ভাত খায়
শুধুমাত্র বাংলাদেশের মানুষ পান্তা ভাত খায় সেটি ভাবলে আপনি ভুল জানেন। ইতিহাস বলে আজ থেকে প্রায় ৫,০০০ বছর আগে বাংলাদেশের এই অঞ্চলসহ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ভাত প্রধান খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হতে শুরু করে। যদিও এখনকার দিনে অনেক দেশেই ভাতের প্রচলন নেই।
বাংলাদেশ ছাড়া আমাদের পাশের দেশ ভারতের ওডিশা, আসাম, পশ্চিমবঙ্গসহ দক্ষিণ এশিয়ার কয়েকটি দেশে জনপ্রিয় একটি খাবারের নাম আমাদের এই পান্তাভাত। এছাড়াও ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে পান্তাভাত খাওয়ার চল আছে যা আমাদের অনেকেরই অজানা।
পান্তা ভাত কেন খাবেন
আপনাদের জানার সুবিধার্থে এক নিঃশাষে পান্তা ভাতের উপকারিতা জানিয়ে রাখছিঃ
- দেহে দ্রুত শক্তির যোগান দেয় পান্তা ভাত।
- দেহে খনিজ লবন ও পানির চাহিদা মেটায় পান্তা ভাত।
- হজমে সহায়তা করে পান্তা ভাত।
- কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে পান্তা ভাত।
- ত্বক সজীব রাখে পান্তা ভাত।
- আমাদের শরীরে অম্ল ও ক্ষারের সমতা রক্ষা করে পান্তা ভাত।
- খাদ্যনালীর প্রদাহ উপশম করে এবং শরীরের তাপের ভারসাম্য বজায় রাখে পান্তা ভাত।
কি দিয়ে খাবেন পান্তা ভাত
পান্তা ভাত কি দিয়ে খাবেন? আমাদের দেশে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী পান্তা ভাত খাওয়ার জন্য সাথে কাঁচা মরিচ অথবা শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ এবং সাথে প্রয়োজন মত লবন নিয়ে নিতে পারেন।
তাছাড়া পান্তা ভাতের সাথে আপনি আপনার রুচিমত বিভিন্ন মাছ ভাজা, সবজি, মাছের ঝোল কিংবা মাংসও খেতে পারেন।
অনেকেই ইলিশ মাছ এবং নানা রকম ভর্তা দিয়ে পান্তা ভাত খেতে খুব পছন্দ করে থাকেন।
পান্তা ভাত নিয়ে ভুল ধারণা
অনেকেই পান্তা ভাত খাওয়াকে গরীবের খাবার মনে করে থাকেন। এটা ভেবে থাকলে আপনি বোকার স্বর্গে বাস করেন। অন্যান্য খাবের মতই এতা একটি খাবার, এর সাথে ধনী-গরীবের খাবার বলে কোন কথা নেই।
ব্যাপারটিকে একটু এভাবে ভাবুন- গ্রাম-বাংলায় রাতের খাবার ভাত অতিরিক্ত হলে সেই ভাত নষ্ট না করে পরের দিন খাবার জন্যই ভাতে পানি দিয়ে পান্তা করে রাখা হত।
ভাত বেশিক্ষণ থাকলে তা পচে খাবার অনুপযোগী হয়ে যায়। আর যদি পানি দিয়ে রাখা হয় গাজনকারি ব্যাক্টেরিয়া সেখানে ল্যাকটিক এসিড তৈরি করে যার ফলে পান্তা ভাতের অম্লত্ব বাড়িয়ে দেয়। সেকারনে পচনকারি ও অনান্য ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া, ছত্রাক ভাত নষ্ট করতে পারে না।
এটা শ্রেফ খাদ্য সংরক্ষণ করার একটি পদ্ধতি। এর সাথের দারিদ্রতার কোনই সম্পর্ক নাই। অযথাই পান্তা ভাতকে গরীবের খাবার ট্যাগ লাগাবেন না। এইসব ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে পান্তা খাওয়ার উপকারিতা নিয়ে ভাবার সময় এসে গেছে।
পান্তা ভাত ও আমাদের পহেলা বৈশাখ পালন
পহেলা বৈশাখে তো এই পান্তা খাওয়ার উৎসব শুরু হয়ে যায়। শহরের মানুষেরা এই পান্তা ভাত খায় ঐতিহ্য হিসাবে ইদানিং আমাদের দেশে পহেলা বৈশাখে শহর কিংবা গ্রামে সব জায়গাতেই এই চল শরু হয়ে গেছে যদিও পান্তা ভাতের সাথে পহেলা বৈশাখের কোন সম্পর্ক নাই। এটা শ্রেফ একটা নতুন কালচার ছাড়া আর কিছুই না।
পহেলা বৈশাখে মাটির প্লেট বা কাসার থালে নানা রকম ভর্তা ও ইলিশ মাছ খাওয়াটা একটা হাল ফ্যাশন ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে হ্যা, ইলিশ মাছ যেকোন বাংগালির প্রিয় খাবার এটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বললেন, ‘পয়লা বৈশাখে পান্তা খাওয়া বাঙালির সংস্কৃতিতে ছিল না, তবে সংস্কৃতি রূপান্তরশীল। তাই নববর্ষে পান্তা-ইলিশ আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে।’
পান্তা ভাত খাওয়ার পার্শ্ব পতিক্রিয়া
আপনি যদি শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকেন, আপনার যদি ডায়াবেটিস কিংবা অন্য কোন রোগ থেকে থাকে অবশ্যই পান্তা খাবার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে নিবেন।
পান্তা গ্যাস্টিক রোগীর জন্য উপকারি হলেও ডায়াবেটিক রোগীর জন্য খুবই ক্ষতিকর। তাই বয়স্ক এবং ডায়াবেটিক রোগীরা পান্তা ভাত এড়িয়ে চলবেন।