পানামা খাল

এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে মালামাল বা পণ্য পরিবহনের জন্য সমুদ্র পথের বিকল্প নেই। ১৮৬৯ সালের ২৫ এপ্রিল সুয়েজ খাল খননের কাজ শেষ হবার পর ইউরোপ থেকে এশিয়ার সমুদ্রপথের দূরত্ব ১৯৮০০ কিলোমিটার থেকে কমে আসে মাত্র ১১৬০০ কিলোমিটারে। এতে একই সাথে সময় ও তেল খরচ দুইই বাঁচে। ফরাসিদের এই প্রকল্পের এই সফলতার পর যুক্তরাষ্ট্র উত্তর আমেরিকার সাথে ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দূরত্ব কমাতে বিকল্প একটি জলপথ তৈরির চিন্তা করতে থাকে যা পরবর্তীতে পানামা খাল নামে পরিচিতি পায়।

প্রিয় পাঠক, রেডিটুরিডিং ব্লগে আপনাকে স্বাগতম। আমাদের আজকের ব্লগটি তৈরি করেছি পানামা খালের পরিচিতি, ইতিহাস এবং এর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক গুরুত্ব নিয়ে। আশা করি আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে দেখবেন।

পানামা খাল

যারা পুরো কন্টেন্ট না পড়ে ভিডিও দেখে জেনে নিতে চান তারা নিচের ভিডিও লিংক এ দেখে নিতে পারেন।

পানামা খাল কোথায় অবস্থিত

পানামা খাল আমেরিকা মহাদেশকে দ্বিখন্ডিত করেছে এবং একই সাথে প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরকে একত্রিত করেছে। একটি মহাদেশকে দুইভাগ করে দুইটি মহাসাগরকে কৃত্তিমভাবে একত্রিত করেছে এই পানামা খাল।

এটি মধ্য আমেরিকার পানামা প্রজাতন্ত্রে অবস্থিত। পানামার উত্তরে রয়েছে কোস্টারিকা, দক্ষিনে কলোম্বিয়া, পশ্চিমে প্রশান্ত মহাসাগর এবং পূর্বে আটলান্টিক মহাসাগর।

আটলান্টিক মহাসাগর থেকে প্রশান্ত মহাসাগরের গভীর জল পর্যন্ত এই খালে মোট দূরত্ব ৮২ কিলোমিটার, যা পার হতে পণ্যবাহী জাহাজের সময় লাগে প্রায় ১২ ঘন্টা।

পানামা খাল কোথায় অবস্থিত

পানামা খাল খননের ইতিহাস

কাগজে কলমে পানামা খাল খনন শুরু হয় ১৯০৪ সালে এবং শেষ হয় ১৯১৪ সালে কিন্তু এর ইতিহাস আরও অনেক বিস্তৃত। আসুন জেনে নেই পানামা খাল খননের সম্পূর্ণ ইতিহাস।

স্প্যানিস অভিযাত্রি ভাস্কো নুয়েঞ্জ ডি বালবোয়াই হলেন ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি যিনি এই দুই মহাসাগরকে একত্রিত করার ধারণা দেন। তৎকালীন স্প্যানিস রাজা তাঁর এই ধারনাকে এককথায় উড়িয়ে দেন। ১৫৩৪ সালে আরেক রাজা ৫ম চার্লস বালবোয়াইয়ের প্রস্তাবটি যাচাইয়ের জন্য এক কমিটি গঠন করেন। কমিটি এই প্রস্তাব যাচাই বাছাই করে খান খননের এই প্রকল্পকে অবাস্তব বলে জানায়।

এরপর কয়েক শতাব্দি আর কেও এই খাল খননের উৎসাহ দেখায়নি। ১৮৬৯ সালে সুয়েজ খাল খনন সম্পন্ন হবার পর এই জলপথের দিকে নজর পরে ফ্রান্স এবং আমেরিকার।

পানামা খাল খননের কাজ
আমেরিকানরা পানামা খাল খনন কাজে রেলপথের ব্যবহার করেছে

প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগকারি এই খাল খননের জন্য আমেরিকা নিকারাগুয়াকে বাছাই করে। কিন্তু নিকারাগুয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ফরাসি ইঞ্জিনিয়ার ফিলিপ বোনাও ভারিল্লার চেষ্টায় আমেরিকা এই খালকে পানামায় তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয়।

জেনে রাখুন, পানামার দুই পাশের দুই মহাসাগরের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার সাথে পানামার উচ্চতার পার্থক্য রয়েছে যা ২৬ মিটার। যা ছিল এই খাল খননের প্রধান চ্যালেঞ্জ। শুধু মাটি কেটে খাল খনন করে দুই মহাসাগরকে সংযুক্ত করার মত সহজ কাজ এটি নয়।

প্রায় ১২০ বছর আগে কি সেই টেকনোলোজি, যা ব্যবহার করে এই খাল খনন করা হল? যা আজও স্ফলতার সাথে আমাদের বিশ্বকে আজও সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে? প্রিয় পাঠক, পড়তে থাকুন।

১৮৮১ সালে। পানামা খাল খননের কাজ শুরু করে ফ্রান্স। এর আগে ফরাসিরাই সাফল্যের সাথে সুয়েজ খাল খনন করে। সুয়েজ খাল খননের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে তারা পানামা খালের ডিজাইন করে কিন্তু কাজ শুরু করার পরই তারা বুঝতে পারে পানামার পাহাড়ি অঞ্চল মিশরের সমতল অঞ্চল থেকে আলাদা। তাছাড়া নানা মহামারি ও বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশ তাদের অনুকূলে ছিলনা। কমপক্ষে ২০,০০০ মানুষের জীবন ধ্বংস করে তারা এই প্রকল্প থেকে স্থফা দিয়ে চলে যায় ১৮৮৯ সালে।

১৯০৩ সালে আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট প্রায় ৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে ফরাসিদের কাছ থেকে এই প্রকল্প কিনে নেয়।

বলে রাখা ভাল, পানামা তখন ছিল কলোম্বিয়ার অধীনে। পানামা ঐ সময় কলোম্বিয়া থেকে স্বাধিন হতে চেষ্টা চালাচ্ছিল। আমেরিকার প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বিনা রক্তপাতে পানামা কলোম্বিয়া থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। বিনিময়ে পানামা খালের পূর্ণ নিয়ন্ত্রন পায় আমেরিকা।

আরও বলে রাখি আমেরিকা সেই সময়ে এক উঠতি পরাশক্তিতে পরিনত হচ্ছে। ১৯০৪ সালে আমেরিকা পানামা খালের কাজ শুরু করে। আমেরিকার জন্য পানামা খাল তৈরি করা ছিল একটি চ্যালেঞ্জ এবং একই সাথে গৌরবের। ১৯১৪ সালে আমেরিকা এস্টিমেটেড খরচের চেয়ে ৪৪৪ শতাংশ বেশি ব্যয়ে পানামা খাল খননের কাজ শেষ করে।

১৯১৪ সালে পানামা খাল
১৯১৪ সালে পানামা খাল চালু হয়

ফরাসিদের খাল খননের প্রকৌশলগত ত্রুটি

আগেই বলেছি পানামা অঞ্চল ভৌগলিক ভাবে পাহাড়ি অঞ্চল। দুই পাশের সমুদের পানির উচ্চতার সাথে এর পার্থক্য ২৬ মিটার। ফরাসিরা পাহাড় কেটে খাল খনন করার পরিকল্পনা নেয় কিন্তু ভূমিধস, প্রচুর বৃষ্টিপাত, মহামারি এবং ২২০০০ শ্রমিকের মৃত্যুতে কুপকাত হয়ে ফরাসিরা আমেরিকানদের কাছে প্রকল্পটি বিক্রি করে দেয়।

আমেরিকানরা কাজ শুরু করার পরপরই বুঝতে পারে, খাল খনন করে পাহাড় কেটে পানামা খাল সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। পাহাড় কেটে সমতল ভূমি করে খাল খনন করার ফরাসি পরিকল্পনা ভূল ছিল। এতে ভূমিধস সহ আরও অন্যান্য প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখিন হতে হবে।

একারনে জাহাজকে পাহাড়ের ওপর পাশে নেবার জন্য পাহাড় কেটে খাল খনন না করে জাহাজকেই পাহাড়ের উপর তুলে পার করার সিদ্ধান্ত নেয়।

এটা করার জন্য আরেকটি নতুন বড় প্রকল্পের সৃষ্টি হয়, যার নাম গাতুন হ্রদ প্রকল্প। ঐ সময়ে এটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কৃত্তিম হ্রদ।

আমেরিকান নকশায় পানামা খাল তৈরি

আগেই বলেছি আমেরিকানরা কাজ শুরুর পরেই খালের নকশার পরিবর্তন আনে। আমেরিকার নকশা অনুযায়ী পানামা খালে জাহাজ ঢুকার পর তাকে তিনটি বদ্ধ জলাশয়ে প্রবেশ করান হয় এবং ধাপে ধাপে এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে পানির উচ্চতা ২৬ মিটার বাড়িয়ে গাতুন হ্রদে নেয়া হয় এবং গাতুন হ্রদ দিয়ে জাহাজ চালিয়ে আবার তিনটি বদ্ধ জলাশয়ের মাধ্যমে জাহাজকে সাগরে ভাসিয়ে দেয়া হয়।

বদ্ধ জলাশয়ের দুইপাশে দুইটি গেট থাকে। জাহাজ এক জলাশয় থেকে অন্য জলাশয়ে নেবার জন্য পানির উচ্চতার পরিবর্তনের জন্য পাশে জমানো পানি ব্যবহার করা হয়। এই জলাশয়গুলোকে লক সিস্টেম বলে।

এছাড়া মহামারি ঠেকাতে আমেরিকানরা কাজের আগেই পানামার বৃষ্টিস্নাত জংগলে মশা নিধনে নামে। কারণ তারা বুঝে গিয়েছিল ফরাসি প্রকল্পের ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ ম্যালেরিয়ায় শ্রমিকের মৃত্যু। প্রায় ৭০,০০০ শ্রমিকের দীর্ঘ ১০ বছরের পরিশ্রমের পর ১৯১৪ সালে পানামা খাল খননের কাজ শেষ হয়। ধারণা করা হয় প্রতি দশ জন শ্রমিকের একজন নির্মাণ কাজ চলাকালে মারা যায়।

আগেই বলেছি গাদন হ্রদের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৬ মিটার। এই হ্রদের পানির মূল উৎস শাগ্রে নদী। এই নদীর দুই পাশে বাঁধ দিয়ে এই হ্রদ তৈরি করা হয়েছে। ৭.২ বিলিয়ন কিউবিক ফুট পাথর ও মাটি কেটে এই হ্রদ তৈরি। এটি সুয়েজ খাল থেকে পরিমানের দিক থেকে তিনগুন বেশি। জাহাজ মোট ৩৩ কিলোমিটার পথ এই হ্রদ দিয়ে পার হয়।

পানামার ডিজাইন
জাহাজকে পাহাড়ে তোলার প্রযুক্তি

পানামা খালের উচ্চ শুল্কহার

পানামা খাল পার হতে হলে আপনাকে পৃথিবীর যেকোন জলপথের চেয়ে অনেক বেশি শুল্ক বা ট্যাক্স দিতে হবে। এই ৮২ কিলোমিটার জলপথ পাড়ি দিতে হলে আপনাকে সময় দিতে হবে প্রায় ১২ ঘন্টা। পানামা খালকে বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে ব্য্যবহুল জলপথ।

পানামা খাল পার হবার সময় জাহাজের ক্যাপটেনকে তাঁর জাহাজের দায়িত্ব খালের অভিজ্ঞ চালকদের দিয়ে দিতে হয়। এর কারন খালটি জাহাজ চলাচলের জন্য মোটেই অতটা চওড়া নয়। খালের অভিজ্ঞ চালকেরা তাদের সুদক্ষ হাতে খাল পারাপার করে দেন দুইপাশের রেলপথ ও ক্রেনের সহায়তায়। এছাড়া পানির স্তর স্বাভাবিক রাখতে কাজ করে অত্যন্ত শক্তিশালী কয়েকটি পাম্প।

পানামা খালের ক্যাপাসিটি

কোন জাহাজ লক সিস্টেমের চেয়ে বড় হলে সেই জাহাজ পানামা দিয়ে পার হতে পারেনা। আবার বড় জাহাজ না হলে উচ্চ শুল্ক দিয়ে জাহাজ মালিকেরাও পোষাতে পারেনা। একারনে ২০১৬ সালে লক সিস্টেমের সাইজ বাড়ান হয়।

এখনকার সময়ে একটি জাহাজ সরবচ্চো ৩৬৬ মিটার লম্বা এবং ৫১ মিটার প্রস্থের হতে পারবে। এছাড়াও জাহাজের ওজন বেশি হলে তা এই লক সিস্টেমে ভাসিয়ে রাখার জন্য উপযুক্ত গভীরতার প্রয়োজন হয়। ২০১৬ সালে এই লক সিস্টেমের গভীরতাও বাড়ান হয়।

আগে পানামা খালের ওজনের ক্যাপাসিটি ছিল ৫০০০ টিইইউ এখন তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১৫০০০ টিইইউ। এর আগে এই লকগুলো ছিল ১১০ ফুট চওড়া। একসাথে দুইটি জাহাজ চলতে পারতনা।

পানামা খালের গুরুত্ব

আমেরিকার পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে পানামা খালের ব্যবহার ১৫০০০ কিলোমিটার পথ কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া উত্তর আমেরিকার উপকূল থেকে দক্ষিন আমেরিকার উপকূলে যাবার পথ কমিয়েছে ৩৫০০ কিলোমিটার।

এই খাল দিয়ে প্রতি বছর জাহাজ চলাচল করে প্রায় ১৪০০০ প্রতি বছর। যা সারা পৃথিবীর জাহাজ চলাচলের ৫ শতাংশ আর আমেরিকার মোট জাহাজ চলাচলের ৫৫ শতাংশ।

পানামা প্রজাতন্ত্র এই খাল থেকে প্রতি বছর রাজস্ব আয় করে ৭০-৮০ কোটি মার্কিন ডলার যা পানামার মোট জাতীয় আয়ের এক তৃতীয়াংশ।

আমেরিকার সমুদ্রপথে পূর্ব থেকে পশ্চিম উপকূলের যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম হল এই পানামা খাল। আমেরিকার সামরিক ও বানিজ্যিক সকল নৌচলাচল বহুলাংশে পানামা খালের উপর নির্ভরশীল।

পানামা খালের মালিকানা

পানামা খাল নির্মাণের শুরু থেকেই আমেরিকা পানামা খালের মালিকানা দখল করে ছিল। পানামা খালের অবস্থান পানামা প্রজাতন্ত্রে থাকা সত্বেও আমেরিকার এর সকল দায়িত্বে ছিল। ১৯৬০ সালে পানামায় মার্কিন বিরোধী আন্দোলন শুরু হলে এক চুক্তির মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে ৬০% মালিকানা পানামা প্রজাতন্ত্রের হাতে তুলে দেয় এবং পানামা খালকে আন্তর্জাতিক নৌপথ হিসেবে ঘোষনা করা হয়। এরপর ১৯৯৯ সালে পানামা খালকে সম্পূর্ণরূপে পানামা প্রজাতন্ত্রের হাতে হস্তান্তর করা হয়।

এখন পানামা খালের একক মালিকানা পানামা প্রজাতন্ত্রের।

পানামা খালের বিকল্প খাল

পানামার প্রতিবেশি রাষ্ট্র নিকারাগুয়া। পানামা খালের উচ্চ শুল্কহার ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার বিবেচনায়, নিকারাগুয়া উৎসাহিত হচ্ছে তাদের দেশের মাঝ দিয়ে আরেকটি খাল খননের। চীন এতে আর্থিক ও প্রকৌশলগত সহযোগিতাও দিতে ইচ্ছুক। যদিও সবাই জানে এই প্রজেক্ট কতটা চ্যালেঞ্জিং ও খরচের ব্যাপার। হয়ত অদূর ভবিষ্যতে পানামার বিকল্প হতেও পারে। যতদিন তৈরি না হচ্ছে পানামা খালই প্রশান্ত মহাসাগর ও আটলান্টিক মহাসাগরের সংযোগকারী খাল হয়ে থাকবে।

সবাইকে ধন্যবাদ।

Previous articleহযরত আদম আঃ পৃথিবীর প্রথম মানব ও নবীর জীবন কাহিনী ও আমাদের শিক্ষা
Next articleপারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সেরা দশটি দেশ কারা?
Mamun
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here