ধূমপান

 

প্রতিবছর বাজেট হলে সবচেয়ে আলোচনা হয় তামাকজাত দ্রব্য নিয়ে। কারণ প্রতিবছরই দাম বাড়ানো হয় এই পণ্যটির। কারণ একটিই। আর তা হলে মানুষ যেন এই সকল পণ্য থেকে দূরে থাকে। কিন্তু এতে দিনশেষে লাভের খাতায় শূন্য। কারণ না কমে এর উৎপাদন, না কমে এর ক্রেতা। এই ক্ষতিকর পণ্যটির ব্যবহার আমরা কমাতে পারিনি। এর ক্ষতিকর দিক জেনেও এর সেবন দিনকে দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশই প্রকাশ্যে ধূমপান নিষিদ্ধ করা আছে। আমাদের দেশেও রয়েছে জরিমানার ব্যবস্থা। কিন্তু কে মানছে এই আদেশ? কেউ না। আমরা আজ আলোচনা করবো ধূমপান তথা তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারেরর কারণ, ক্ষতিকর দিক ও কীভাবে এর থেকে বেরিয়ে আসা যায় সেই সব বিষয় নিয়ে।

ধূমপান হচ্ছে তামাক জাতীয় দ্রব্যাদি বিশেষ উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শ্বাসের সাথে তার ধোঁয়া শরীরে গ্রহণের প্রক্রিয়া। সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণসহ মোটামুটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ নানা রোগের অন্যতম প্রধান কারণ এবং ধারক ও বাহক। সক্রিয় ধূমপান :ধূমপায়ী যে অবস্থায় জলন্ত সিগারেট বা বিড়ি বা চুরুট থেকে উদ্ভূত ধোঁয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে টেনে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করায় তাকে সক্রিয় ধূম্পান বলে। নিস্ক্রিয় ধূমপান :ধূমপানের সময় ধোঁয়ার যে অংশ চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনৈচ্ছিকভাবে মানুষের দেহে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে নিস্ক্রিয় ধূমপান বলে।

আসুন  জেনে নেই কেন এত নিষেধাজ্ঞা ধূমপানের উপর

ধূমপানের রয়েছে অসংখ্য ক্ষতিকর দিক। এর কোনো উপকারিতা আজো প্রমাণিত না হলেও মানুষ এটাকে ওষুধের মত ব্যবহার করে থাকে। নিজের অজান্তে কিংবা জেনে শুনেই তারা এই বিষ নিয়ে থাকে। দেশে দেশে কেন এত নিষেধাজ্ঞা? কেন এত আইন করা হয় ধূমপান থেকে বিরত রাখতে?? কয়েকটি কারণ জেনে নেয়া যাক

ধূমপান মৃত্যু ঘটায়

বলা হয়ে থাকে ধূমপানের আরেক নাম মৃত্যু। প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যায় ধূমপানের কারণে সৃষ্ট জটিলতায়। ধূমপানে রয়েছে নিকোটিন সহ ৫৬ টি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ। প্রতি বছর ধূমপানে মৃত্যু হয় প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষের । বাংলাদেশে সংখ্যাটি হলো ১ লক্ষ প্রায়। আর পরোক্ষ ধূমপানে মৃত্যু ২৪ হাজার প্রায়। ধূমপান যে শুধু ধূমপায়ি ব্যক্তির জন্যই ক্ষতিকর ব্যাপারটি মোটেই তেমন নয়। এটি পরোক্ষ ভাবে আশেপাশের সবার ক্ষতির কারণ। প্রায় কয়েক লক্ষ শিশু এর ধোঁয়ার কারণে নানা রকম জটিলতায় ভুগে থাকে।

ধূমপান ক্যান্সারের কারণ

তামাক ব্যবহারে প্রাথমিক ঝুঁকি হলো হলো বিভিন্নরকম ক্যান্সার, বিশেষত ফুসফুস ক্যান্সার,কিডনির ক্যান্সার, ল্যারিংসের ক্যান্সার,মূত্রথলির ক্যান্সার, খাদ্যনালীর ক্যান্সার,অগ্ন্যাশয়ের ক্যান্সার ও পাকস্থলী ক্যান্সার, নারীর জরায়ু ক্যান্সারের সাথে তামাক ও পরোক্ষ ধূমপানের একটা সম্পর্ক গবেষণার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একজন পুরুষ ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে ৮৫ বছরের পূর্বে ফুসফুস ক্যান্সারে মৃত্যুর সম্ভাবনা ২২.১% একজন নারী ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে তা ১১.৯%। অধূমপায়ীর ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা যথাক্রমে ১.১% ও ০.৮% প্রায়

ধূমপান বন্ধ্যত্ব তৈরি করে

ধূমপান ডিম্বাশয়ের জন্য ক্ষতিকর এবং বন্ধ্যত্বের অন্যতম কারণ। সিগারেটের নিকোটিনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান ইস্ট্রোজেনহরমোন তৈরিতে বিঘ্ন ঘটায়। এই হরমোনটি ডিম্বাশয়ে ফলিকল উৎপাদন ও ডিম্বপাত নিয়ন্ত্রণ করে। এছাড়া ধূমপান জরায়ু ও ভ্রূণের আরো অনেক ক্ষতি করে। এই ক্ষতির পরিমাণ নির্ভর করে ধূমপানের সময়কাল ও পরিমাণের উপর। কিছু ক্ষতি অপূরণীয় তবে ধূমপান ত্যাগ করলে অনেক ক্ষতি প্রতিরোধ করা সম্ভব। ধূমপায়িনী নারীর বন্ধ্যা হওয়ার সম্ভাবনা ৬০% বেশি।

ধূমপান যৌন অক্ষমতার জন্য দায়ি

অধূমপায়ীর তুলনায় ধূমপায়ীরা যৌন অক্ষমতায় ভুগার হার ৮৫ শতাংশ বেশি। এটি লিঙ্গ উত্থান অক্ষমতার (Erectile dysfunction) প্রধান কারণ। ধূমপানের ফলে অ্যাথেরোসক্লেরোসিস হয়ে রক্তনালী সরু হয়ে যাওয়ার ফলে এমন হয়।

মানসিক চাপ তৈরি করে ধূমপান

ধূমপায়ীরা অপেক্ষাকৃত বেশি মানসিক চাপে ভুগেন। কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে ধূমপায়ীর মানসিক চাপ আস্তে আস্তে বাড়ে এবং ধূমপান পরিত্যাগ করার পর তা ক্রমশ হ্রাস পায়। তাই মানসিক চাপ কমাতে চাইলে ধূমপান ছাড়ুন।

সংক্রমণ

দৈনিক বিশ বা এর অধিক সিগারেট সেবনে সংক্রমণের সম্ভাবনা দুই থেকে চারগুণ বেড়ে যায়, বিশেষত ফুসফুস সংক্রমণ।চলতি ধূমপায়ীর ক্ষেত্রে নিউমোকক্কাল সংক্রমেণর সম্ভাবনা চারগুণ বাড়ে। ধূমপানের ফলে শ্বসনতন্ত্রের গাঠনিক পরিবর্তন ও ইমিউন সিস্টেমের পরিবর্তন ঘটে ফলে সংক্রমণের প্রকোপ বৃদ্ধি পায়। এইডস রোগীদের ক্ষেত্রে  ধূমপান করলে কাপসি সারকোমার ঝুঁকি বাড়ে।

ধূমপান মানেই কস্টে অর্জিত অর্থের অপচয়

ধূমপান মানে আপনার মাথার ঘাম পায়ে ফেলা টাকার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। আপনার রক্ত পানি করা টাকা আপনি চোখের সামনে পুড়িয়ে নষ্ট করছেন, যা আপনার কোনা কাজেই আসছেনা বরং আপনার শারীরিক এবং মানসিক ক্ষতি করে যাচ্ছে অনবরত। প্রতিদিন একজন মানুষ যে পরিমাণ টাকার ধূমপান করেন তা দিয়ে অনায়াসেই পুষ্টিকর খাবার কিনে খাওয়া যেতে পারে।

কেন ধূমপায়ীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে

ধূমপানের এতক্ষতিকর দিক থাকা সত্বেও দিন দিন ধূমপায়ীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃদ্ধি পাচ্ছে তামাকের বিক্রি। অনেকগুলো কারণ থাকলেও যে কয়টি কারণ আমাদের সমাজে বেশি দেখা যায় তা হলোঃ

সঙ্গদোষ

আমাদের সমাজের টিনেজারদের বড় একটা অংশ ধূমপানে আগ্রহী হয় সঙ্গদোষের কারণে। স্কুল, কলেজ পড়ুয়া ছাত্ররা বন্ধুর দেখাদেখি মজা করে একদিন দুইদিন খেতে খেতে সেটা নেশায় পরিণত করে ফেলে। তাছাড়া তাদের একটা অংশ আবার সিগারেট খাওয়াকে স্মার্টনেস বলে প্রচার করে থাকে। ফলে অনেক সাধারণ, অবুঝ টিনেজার ধূমপানের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

সহজপ্রাপ্যতা

সহজপ্রাপ্যতাও ধূমপানের অন্যতম কারণ। অলিতে গলিতে, ফুটপাতে, পাড়ার প্রতিটি দোকানে তামাকজাত দ্রব্য পাওয়া যাচ্ছে। সহজপ্রাপ্যতার কারণে চাইলেই যে কেউ সেটা ক্রয় করতে পারছে। ফলে কোনো কষ্ট ছাড়াই হাতের কাছে পেয়ে তারা এটি সেবন করছে।

হতাশা

হতাশা/ডিপ্রেশন থেকে মানুষ ধূমপানের দিকে ঝুঁকে থাকে। নেশার জগত কিছু সময়ের জন্য বাস্তবতা থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখে৷ অই সময়টা মানুষ নিজের সুখ, দুঃখ, যাবতীয় সমস্যা থেকে নিজেকে মুক্ত ভাবে। আজকাল হতাশা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে পড়েছে। চাকরি, সংসার, রিলেশন নিয়ে মানুষের মাঝে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এগুলো থেকে নিজেকে সাময়িক দূরে রাখতে মানুষ ধূমপান করে থাকে৷

এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায়

ধূমপানের ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে আমাদের উচিত এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা। আমাদের সমাজে প্রতিনিয়ত এর প্রভাব যেভাবে বাড়ছে তা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে বিশেষজ্ঞরা। ধূমপান মুক্ত সমাজ গড়তে হলে সবাইকে একসাথে কাজ করতে হবে। একক ভাবে কেউ এই অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে পারবে না। সবাইকে সবার অবস্থান থেকে চেষ্টা করতে হবে।

সামাজিক উদ্যেগ

সামাজিক ভাবে এই অবস্থা প্রতিরোধ করা সবচেয়ে সহজ এবং কার্যকরী বলে আমি মনে করি। সামাজ মানেই সহযোগিতা। সমাজের সবাই মিলে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারলে ধূমপান থেকে মানুষকে বিরত রাখা অসম্ভব নয়। সামাজিক ভাবে এর ক্ষতিকর দিক গুলো মানুষকে বুঝাতে হবে, প্রচার করতে হবে নাটক, সিনেমা কিংবা সংবাদে।

আইনের সঠিক প্রয়োগ

আমাদের দেশে আইন আছে সব অপরাধ কিংবা ক্ষতিকর বিষয়ের। কিন্তু নেই সঠিক প্রয়োগ। তাই প্রচলিত আইনের সঠিক ব্যবহার করতে হবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গদের। পাবলিক প্লেসে, পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করা নিষিদ্ধ। তাছারা ১৮ বছর বয়সের নিচে কারো কাছে তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করাও নিষেদ্ধ। কিন্তু এই বিষয়গুলো শুধু আইনেই রয়ে গেছে। যথার্থ প্রয়োগ নেই বললেই চলে। তাই আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিবর্গের কাছে বিনীত অনুরোধ তারা যেন এই সকল আইন বাস্তবায়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তাছাড়া বর্তমান আইনেও কাজ না হলে পরবর্তীতে কঠিন আইন প্রণয়ন করতে হবে।

ধূমপায়ী ব্যক্তির করণীয়

আমাদের ইচ্ছা শক্তি আমাদের অনেক দূরে নিয়ে যায়। ইচ্ছা শক্তি ব্যতিত সহজ কাজটিও কঠিন মনে হয়। তাই ধূমপায়ী ব্যক্তিকে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক ভেবে এটা থেকে বিরত থাকতে হবে। এই ক্ষেত্রে বিষয়টি এত সহজ না হলেও কিছু চ্যালেঞ্জ তাকে গ্রহণ করতে হবে। যেমনঃ ধূমপানে সাহায্য করে এমন ব্যক্তিদের থেকে দূরে থাকতে হবে। ধূমপানে আকৃষ্ট করে এমন বিষয় থেকে নিজে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। ধূমপান ছেড়ে দিয়েছে এমন ব্যক্তিদের সাথে পরামর্শ করতে হবে। আর নিজ ধর্ম অনুযায়ী ধর্মীয় কাজের সাথে থাকতে হবে।

ধূমপানের ক্ষতিকর দিক কম বেশি আমরা সবাই জানি। কিন্তু তবুও আমরা সচেতন নই। বিষয়টিকে আমরা সাধারণভাবেই দেখি। এই মনমানসিকতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসা উচিত। সুন্দর সমাজ, আগামীর প্রজন্মকে সুন্দর করে গড়তে ধূমপান মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। তাই আসুন ধূমপানকে না বলি, ধূমপান মুক্ত সমাজ গড়ি।

 

Previous articleব্লগ কি? ব্লগ থেকে কি সত্যি উপার্জন করা যায়?
Next articleসেরা ১৪টি সাইকোলজিকাল ট্রিকস -যা আপনার জীবনকে একধাপ এগিয়ে দিবে
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।