দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ – মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। ছিয়াত্তর বছর আগের রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধের আতংক এখনও দাগ কেটে যায় মানুষের মনে। বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে আলোচিত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, প্রভাব ও ফলাফল সহ প্রাসঙ্গিক সকল বিষয় নিয়েই আমাদের আজকের লেখাটি।

আজকের লেখায় যা থাকছে

সেই সময়ে পুরো বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিক শাষণ থেকে মুক্ত হয়ে শান্তির স্লোগান গেয়ে যাচ্ছিল। নতুন সম্ভাবনা  নিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে বিংশ শতাব্দীতে পদার্পণ করেছিল। ঠিক তখনই শান্তির পথে এসে দাড়িয়েছিল এক পাহাড়সম অন্তরায়। নতুন সাম্রাজ্যবাদীদের উগ্র মানসিকতা আর যুদ্ধংদেহী মনোভাব টেনে নেয়া শুরু করে সুদূর ধ্বংসের দিকে।

জার্মানি এবং অন্যান্য উগ্র জাতীয়তাবাদী দেশগুলোর মধ্যে স্বার্থগত দ্বন্দ্বের কারণে বিশ্বযুদ্ধ নামে এই মহাসমরের সূচনা ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের চরম ভয়াবহতা বিশ্বের বিবেককে নাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছিল। তখনই বিশ্বের শান্তিকামী মানুষগুলো বুঝতে পেরেছিল শান্তি প্রতিস্থাপনে একটা আন্তর্জাতিক সংস্থা গঠন করার বিকল্প নেই।

কিন্তু বহুল আকাঙ্ক্ষার লীগ অফ নেশন্স বিশ্ববাসীর সেই আশা পূরণ করতে পারেনি। যার ফলস্বরূপ ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত পুরো বিশ্ববাসীকে সাক্ষী হতে হয় এক মর্মান্তিক ইতিহাসের। একাধিক বিচ্ছিন্ন ঘটনার সমারোহ  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  আদ্যপান্ত জানতে পড়ে ফেলুন আমাদের আজকের আর্টিকেলটি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ

কেন ঘটেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ? এই প্রশ্নের একক কোন উত্তর দেয়া মুশকিল।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  কারণ হিসেবে বেশ কিছু পরিস্থিতি, ঘটনা ও চিন্তাধারাকে চিহ্নিত করা হয়।  সে সময়ের কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা তুলে ধরা হল যেগুলোর জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা তৈরি হয়।

ভার্সাই চুক্তি

জার্মানি মূলত তার যাবতীয় উপনিবেশ হাতছাড়া করেছিল ভার্সাই চুক্তির কারণেই। আর শুধু তাই নয়।  উপনিবেশে যে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ  করা হয়েছিল, তাও  পুরোপুরি বিফলে গেল । এছাড়াও জার্মানি হারিয়েছিল কৃষিযােগ্য জমির শতকরা সাড়ে পনের ভাগ, মজুত কয়লার দুই – পঞ্চমাংশ, উৎপাদন শিল্পের শতকরা দশ ভাগ, খনিজ লােহার দুই – তৃতীয়াংশ। তার ওপর জার্মানির নৌ – বাহিনী,  বিমানবাহিনী ও স্থলবাহিনীর এক বিশাল অংশ হ্রাস করা হয়েছিল।

এককথায় বলতে গেলে জার্মানিকে সব দিক থেকে দুর্বল করাই ছিল ভার্সাই চুক্তির অন্যতম লক্ষ্য। সুতরাং এটা  স্বাভাবিক যে জার্মানি এই চুক্তির শর্ত কখনোই  মনেপ্রাণে স্বীকার করে নেবে না। আর দিনশেষে কার্যক্ষেত্রে তাই ঘটল। চুক্তিতে স্বাক্ষর করেই  জার্মানি তৈরি হতে লাগলো পরবর্তী ঐতিহাসিক  যুদ্ধের জন্য।


দীর্ঘ সময় যুদ্ধ বিরতি

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ফলে  নিরাপত্তা,  গণতন্ত্র ও শান্তি বিপন্ন হতে চলেছিল। আর  প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর যখন ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষরিত হলো তখন দেখা গেল এগুলো আরো বেশি অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এজন্য এই দুই মহাযুদ্ধের মধ্যখানের সময়টাকে শান্তিপূর্ণ সময় না বলে দীর্ঘযুদ্ধবিরতি হিসেবে গন্য করা হয় । গণতন্ত্র , শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষার  এই আগ্রহ শেষ পর্যন্ত যুদ্ধকে অনিবার্য করে তুলেছিল ।

এ সময়ে গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্স এর ধারণা ছিল  গণতন্ত্র ও শান্তি সংকটের মুখে।  অন্যদিকে জার্মানি ভাবছিল, বৃহৎ শক্তির মুখে তাদের তো নিরাপত্তা বলতে এখন কিছুই নেই। তাই তারা এ সময়ে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির দিকে মনোযোগী হয়৷ মোট কথা চিন্তা ভাবনা চরম অমিল ও যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের ভিন্ন ব্যবহার একটি অরাজকতার সৃষ্টি করে।  যা তিলে তিলে বিস্ফোরণে রুপ নেয়

অর্থনৈতিক জাতীয়তাবাদের উত্থান

বলা যায় ভার্সাই চুক্তিই ওই সময়ে জার্মানিকে নিঃস্ব করেছিল। চুক্তি স্বাক্ষরিত করেই জার্মানির একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে, যে কোনো প্রকারে যুদ্ধপূর্ব অবস্থায় ফিরে যাওয়ারকথা।  এদিকে জাপান ও ইতালির মতে তারা  আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সব রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত  হচ্ছে। একারণে তারা অর্থনৈতিক পুনর্গঠনকে বেশি প্রাধান্য দিয়েছিল। পুরো বিশ্বের ওপর প্রাধান্য বিস্তার করা  না গেলে অর্থনৈতিক পুনর্গঠন প্রায় অসম্ভব। এমন চিন্তাভাবনা   থেকে জার্মানি , ইতালি ও জাপান  পুরোপুরি  যুদ্ধের জন্য  মরিয়া হয়ে উঠেছিল।

সম্পূর্ণ নিরস্ত্রীকরণে ব্যর্থ্যতা

শান্তি পুর্নগঠনের জন্য প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর নিরস্ত্রীকরণ কে গুরুত্ব দেয় লিগ অব নেশন্স। তবে তাদের এই সদিচ্ছাকে ফলপ্রসূ করতে বৃহত্তর শক্তিবর্গের পক্ষ থেকে  প্রচুর পরিমাণ সহযোগিতা ও লীগ কর্তৃপক্ষের দৃঢ়তা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার কোনোটাই লিগ অব নেশন্সের কাছে ছিল না। বিশ্বের বৃহত্তর সব শক্তিবর্গ অস্ত্র উৎপাদনের অশুভ প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। তার এই অস্ত্র নিমজ্জিত সাম্রাজ্য গুলোই যুদ্ধের জন্ম দিয়েছিল ।

চরম আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম কারণ হিসেবে  আন্তর্জাতিক নৈরাজ্য কে তুলে ধরছেন অনেক বিশেষজ্ঞ। লীগ অফ নেশন্স যখন  ‘ যৌথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়, তখন লীগের সদস্যবৃন্দ ও অন্যান্য রাষ্ট্র শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য সনাতন পদ্ধতির আশ্রয় নেয়ার পরিকল্পনা করেন। অর্থাৎ জোট তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু  জাপানের  মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ কিংবা  ইতালির ইথিওপিয়া আক্রমণ কোনোভাবেই  যৌথ নিরাপত্তাকে কাজে লাগাতে পারে নি। আর থামাতে পারে নি আগ্রাসী শক্তিকে।  এজন্য লীগের কার্যকারিতা নিয়ে যথারীতি  সন্দেহের উদ্রেক হয়েছিল । লীগের উপর বিশ্বব্যাপী এই অনাস্থা আন্তর্জাতিক নৈরাজ্যকে বাড়িয়ে তুলেছিল ।

উগ্র জাতীয়তাবাদ মনোভাব

তৎকালীন  শাসক হিটলারের বদ্ধমূল  ধারণা ছিল, জার্মানজাতি পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র উৎকৃষ্ট জাতি। এবং অন্যরা নিকৃষ্ট । সুতরাং  নিকৃষ্টের উপর শ্রেষ্ঠের কর্তৃত্ব বজার রাখা তার একটি লক্ষ্যে পরিনত হলো। হিটলারের পরিকল্পনা ছিল এই জার্মানজাতি গোটা ইউরোপের উপর প্রাধান্য বিস্তার করবে। তার এই বিদ্বেষপূর্ণ স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করতেই তিনি এই  সর্বধ্বংসী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।

সর্বাত্মকবাদ চিন্তাধারা

হিটলার ও মুসোলিনি উভয়ের কাছে  গণতন্ত্র ছিল একটা চ্যালেঞ্জ এর মত।   গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা ছিল তাদের লক্ষ এবং তারা চেয়েছিলেন  সর্বাত্মকবাদ বা Totalitarianism- এর পথকে সর্বোৎকৃষ্ট পথ বলে প্রচলিত করতে । তাদের ধারনা ছিল গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না। আর  দেশের দ্রুত বিকাশ সাধনের জন্য সর্বাত্মকবাদ ই একমাত্র উপায়।

এভাবেই  হিটলার ও মুসোলিনি জঙ্গী জাতীয়তাবাদের ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে গােটা ইউরোপের উপর নিজেদের  প্রাধান্য বিস্তারে উদ্যত ছিলেন।  ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রাক্কালে মানবসভ্যতা , শান্তি ও আন্তর্জাতিকবাদ  একেবারেই মূল্যহীন হয়ে পড়েছিল। অন্যদিকে  জার্মানি ,  ইতালির ও জাপানের  কাছে তাদেট নিজেদের সংকীর্ণ জাতীয়তা মনোভাব ছাড়া অন্য কোনো মূল্যবোধ পরিপূর্ণ  মর্যাদা পায়নি।  এগুলোই যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করার প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে গন্য করা হয়।

অন্যন্য কিছু বিচ্ছিন্ন কারণ

এছাড়া ওয়াশিংটন নৌ – সম্মেলন, লাকোর্নো চুক্তি সহ কেলগ ব্রিয়ান্ড চুক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে ঘটেছিল

মূলত ১৯৩৯ সাল থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ এই ছয় বছর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মোট সময়সীমা ধরা হয়।  তবে ১৯৩৯ সালেরও আগের  এশিয়ায় সংগঠিত কিছু সংঘর্ষকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরোক্ষ  অংশ হিসেবে ধরা হয়। এরই পরবর্তীতে ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ডে আক্রমণ ঘটে।  আর  এর ইফলশ্রুতিতে জার্মানির বিরুদ্ধে  ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্য  যুদ্ধ ঘোষণা করে।

যুদ্ধ- পূর্ব রণাঙ্গন

২য় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনসমূহের একটি অংশ ছিল পূর্ব রণাঙ্গন। এর  একপক্ষে ছিল অক্ষশক্তির সদস্যসমূহ। আর তাদের সহযোগী ছিল ফিনল্যান্ড। অন্যদিকে  তাদের বিপরীতে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড এবং মিত্রবাহিনীর অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রসমূহ। মধ্য ইউরোপ, উত্তর-পূর্ব ইউরোপ, পূর্ব ইউরোপ,বাল্টিক অঞ্চল এবং বলকান অঞ্চল ব্যাপী এই যুদ্ধ   সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধের মোট সময়কাল  ১৯৪১ সালের ২২  জুন থেকে ১৯৪৫ সালের ৯ মে পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এই যুদ্ধ টিকে তৎকালীন  সোভিয়েত ও আধুনিক রাশিয়ার দৃষ্টিকোণ থেকে বলা হয়  “মহান দেশাত্মবোধের যুদ্ধ”।  অন্যদিকে জার্মানির দৃষ্টিকোণ থেকে একে ” পূর্ব রণাঙ্গন” বলা হয়।  আর বহির্বিশ্বের  দৃষ্টিকোণে এটি  জার্মান-সোভিয়েত যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পরিণতি

সোভিয়েত এর বিজয়, ৩য় রাইখের নিয়ন্ত্রণের পতন, মিত্রবাহিনীর হাতে জার্মানি দখল, নিরব স্নায়ু যুদ্ধের সূচনা আর পূর্ব ব্লক ও লৌহ-পর্দা (Iron Curtain)-এর সৃষ্টি।  এছাড়াও গ্রীক গৃহযুদ্ধের সূত্রপাতও এখান থেকেই।

ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঘটনাবলী

সাল ১৯৩৯, সেপ্টেম্বর ১। ঠিক সকাল ৪:৩০ মিনিটে জার্মান বাহিনী হঠাৎ করেই  আঘাত হানে  পোল্যান্ডের কয়েকটি স্থাপনায়।  এর মাধ্যমেই  ঐতিহাসিক  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়। এই ঘনটার পরই যুক্তরাজ্য এবং ফ্রান্স দ্রুত   জার্মানির  অপসারণের  দাবী করে।

যুক্তরাজ্য সরকার তার স্বরাষ্ট্র সীমান্ত  খুলে দেয়। এরপর ব্রিটিশ সেনা-সমাবেশের ঘোষণা দেয় এবং প্রায় ১৫ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেয়। বেশ কিছু রাষ্ট্র নিরপেক্ষ থাকার ও শান্তিকামী মনোভাব দেখালেও, ক্রোধে উন্মত্ত সরকারসমূহ পোল্যান্ড আক্রমণের বিরুদ্ধে সাড়া দেয়।  এবং এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রাজনীতি ও কূটনীতির সূচন ঘটে। এদিকে জার্মানি যুক্তরাজ্যের দেওয়া আলটিমেটামের কোনো উত্তর  দেয় না।

ফলে  যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড সকাল ১১:১৫ মিনিটে জার্মানির বিরুদ্ধে  যুদ্ধ ঘোষণা করে।  এবং পরবর্তী তে ফ্রান্সও তাদের সাথে যোগ দেয়। এবং একের পর এক বিচ্ছিন্ন  যুদ্ধ চলতেই থাকে বছর ব্যাপী। এবং দীর্ঘ ৬ বছর পর অবসান ঘটে এই রক্তক্ষয়ী,  মর্মস্পর্শী যুদ্ধের।

হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে ভয়াবহ পরমাণু বোমা হামলা

ঠিক ৭৫ বছর আগে, যুদ্ধ তখন শেষের পথে।   এমন সময়ে আগস্টের ৬ এবং ৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে ফেলেছিল বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা।  বিশ্বে এই প্রথম কোন যুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছিল এমন গণবিধ্বংসী মারণাস্ত্র। এতে মারা গিয়েছিল হাজার হাজার  মানুষ। আর এর প্রভাব এখনও বয়ে বেড়াচ্ছে সেই এলাকাবাসী।

ধারনা করা হয়,  হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে  আক্রমনের ফলে শুধু হিরোশিমা শহরেরই সাড়ে তিন লাখ মানুষের মধ্যে ১ লক্ষ ৪০ হাজার মানুষ  বোমার বিস্ফোরণেই মারা যায়। অন্যদিকে,  নাগাসাকিতে মারা যায়  প্রায় চুয়াত্তর  হাজার মানুষ।

কিন্তু এর শেষ এখানেই নয়। এই পরমাণু বোমার তেজস্ক্রিয়তার ফলে হ পরবর্তী সপ্তাহ, মাস এবং বছরগুলিতে  বহু মানুষ ধীরে ধীরে  মারা গিয়েছিলেন। আর এমন বোমার শিকার হয়েও  যেসব লোক প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন, তাদের জাপানে  “হিবাকুশা” বলে পরিচয় দেয়া হয়।

এই বোমা হামলার ঠিক পরপরই সমগ্র  এশিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের  পরিসমাপ্তি ঘটে। সমাপ্তিটা প্রায় আকস্মিক বটে। এর জের ধরে  ১৪ই আগস্ট জাপান পুরোপুরি  নিঃশর্তভাবে মিত্র বাহিনীর সামনে  আত্মসমর্পণ করে। তবে শুধু পরমাণু বোমার ভয়েই জাপান আত্মসমর্পণ এই মতামত পুরোটা সত্যি নয়। এই বোমাহামলার অনেক আগেই  জাপান  আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হিটলারের ভূমিকা

আডলফ হিটলার, অস্ট্রীয় বংশোদ্ভূত একজন জার্মান রাজনীতিবিদ।  যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন  ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট জার্মান ওয়ার্কার্স পার্টির। তিনি   ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলর ছিলেন। আর ১৯৩৪ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত সে দেশেরই ফিউরার পদে নিয়োগ ছিলেন।

হিটলার ই সেই ব্যক্তি জিনি তার সকল রাজনৈতিক বক্তৃতার মাধ্যমে  জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র বিরোধিতা  ও ইহুদী বিদ্বেষ  ছড়াতে থাকেন।  তিনি  রাষ্ট্রের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন।  সামরিক বাহিনীকে সজ্জিত করেছিলেন নতুন নতুন সব অস্ত্রশস্ত্রে।  আর  সর্বোপরি জার্মানিতে একটি সমগ্রতাবাদী ও ফ্যাসিবাদী একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

হিটলার  “লেবেনস্রাউম”  (জীবন্ত অঞ্চল) দখল করে নেয়ার মত এক বৈদেশিক নীতির  অনুসরন করে যান। তারই নেতৃত্বে  ১৯৩৯ সালে জার্মানরা পোল্যান্ড অধিকার করে। আর এরই ফলশ্রুতিতে ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। এভাবেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়।

মিত্র শক্তির প্রকোপে  ১৯৪৫ সালের মধ্যেই জার্মানি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আর হিটলারের এই একরোখা  রাজ্য জয় ও বর্ণবাদী আগ্রাসনের কারণে প্রাণ হারাতে হয় লক্ষ লক্ষ মানুষকে।  ৬০ লক্ষ ইহুদিকে হিটালরের পরিকল্পনামাফিক হত্যা করা হয়। ইহুদি নিধনের এই অপারেশন টি    হলোকস্ট নামে পরিচিত।

১৯৪৫ সালে ৩০ শে এপ্রিল রেড আর্মি কর্তৃক  বার্লিন দখল হওয়ার সময়ে,   ফিউরারবাংকারে তিনি সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। এবং তার মৃত্যুর মাস খানিক পরেই আত্মসমর্পণ করে জার্মান রা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের ভুমিকা

১৯৩৭ সাল থেকেই জাপান সাম্রাজ্যবাদ এর সূচনা করে চীন। তা ঘটে পার্ল হারবার ঘটনার আগে থেকেই।  সাম্রাজ্যবাদী এই জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে  প্রবেশ করে ১৯৪০ সালের  ২৭ সেপ্টেম্বর। এটি  ছিল  ইতালির ও জার্মানির  সাথে  করা  একটি ত্রিপাক্ষিক চুক্তির ফল। আর এই  যুদ্ধে আমেরিকার প্রবেশ ঘটে ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর, এ পার্ল হারবার আক্রমণের  মাধ্যমে।

এর ই ৭ ঘণ্টার মধ্যে জাপান,আমেরিকা  অধ্যুষিত গুয়াম,  ফিলিপাইন,, ওয়েক আইল্যান্ড   এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মালয়, বোরনিও, সিঙাপুর সহ  হংকং এ   আক্রমণ করে। তাদের  আক্রমণের  উদ্দেশ্য ছিল আমেরিকার নৌবাহিনী কে একদম পঙ্গু করে দেয়া।  ওলন্দাজ  ইস্ট ইন্ডিজের  তেলক্ষেত্র  দখল করা। আর  চীন,  কোরিয়া ও , পূর্ব এশিয়া   উপর প্রতিপত্তি স্থাপন করা।

জাপানের  নৌবাহিনী ৭ ডিসেম্বর, ১৯৪১ এ পার্ল হারবারে আক্রমণ করে ।  আমেরিকার নৌবাহিনী, প্রতিরক্ষা বিমানবাহিনী ও সামুদ্রিক বিমানবাহিনীর  ব্যপক  ক্ষয়ক্ষতি হয় এই আক্রমণে।  আমেরিকা কে অক্ষম করে দিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় জাপান   নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য মূলত এই আক্রমণ। পাশাপাশি নিজেদের জন্য শক্তিশালী নিরাপত্তা জোন গঠনও ছিল তাদের লক্ষ্য। আমেরিকা  যুদ্ধে প্রবেশ করার ৪ দিনের মাথায়,  জার্মানির হিটলার ও ইতালির মুসোলিনি আমারিকার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ঐতিহাসিক   পার্ল হারবার আক্রমণের পরপরই জাপান পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মিত্রশক্তি গুলোর  উপর একের পর এক আক্রমণ করে।

পুরোদমে যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ  চলছে,  তখন জাপান  জৈবঅস্ত্র ব্যবহারের উদ্যোগ নেয়। এই পরিল্পনা মাফিক জাপানি বিমানবাহিনী আয়োজিত,  চীনের নিগাবো গ্রামে বিউবনিক প্লেগ সংক্রমিত একটিভ জীবাণুযুক্ত বোমা নিক্ষেপ করে। ফলে যুদ্ধ শেষ হওয়ার  বছর খানিক পর হাজারেরও অধিক মানুষ মারা যায়। এরপরেও জৈবঅস্ত্র নিয়ে জাপান তাদের নিরলস গবেষণা চালাতে থাকে। আর তাদের এই আক্রমণে  চীনের হাজারের ও বেশি গ্রাম গুলোয় কলেরা ও টাইফয়েড মহামারী চলতে থাকে ।

তবে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা হামলার পরপরই আকস্মিক আত্মসমর্পণ করে জাপান।

বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব

  • পৃথিবীর ইতিহাসে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক ভয়ংকর ধ্বংসযজ্ঞ ঘটনা । এর প্রভাব ছিল মর্মান্তিক  ও সুদূরপ্রসারী । এই যুদ্ধের মাধ্যমেই আমেরিকা ও রাশিয়া সমগ্র  পৃথিবীর ভেতর, বিশ্ব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের অধিকার নেয় । এর পররেই ব্রিটেন, ফ্রান্স, ইতালির মত  ইউরোপীয় দেশ গুলোর  অবস্থান হয় কর্তৃত্বের দ্বিতীয় সারিতে । ইতালিতে গঠিত হয় প্রজাতান্ত্রিক সরকার।  পতন হয় ফ্যাসিবাদের।  পূর্ব জার্মানি এবং পশ্চিম জার্মানি দুইটি হিসেবে বিভক্ত হয়ে যায় জার্মানি।
  • এই  বিশ্বযুদ্ধের পরপরই সাম্যবাদী আদর্শ  পৃথিবীর ব্যাপী  ছড়িয়ে পড়ে । এর মধ্যে  রাশিয়ায় সর্ব প্রথম  সাম্যবাদী আদর্শ জয় লাভ করে হয়। এর পরে পোল্যান্ড, চিন, চেকোশ্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি  দেশ গুলোও একে একে সাম্যবাদী আদর্শ গ্রহণ করে। এবং একটি  প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচয় লাভ করে।  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের   প্রভাবে সমাজতান্ত্রিক বক্তা হিসেবে  পৃথিবীর নানা  দেশে কমিউনিস্ট দলের  আত্মপ্রকাশ ঘটে ।  গোটা পৃথিবীর রাষ্ট্রসমূহ দুইটি  ভাগ হয়ে যায় ।
  • তবে ভারত সহ কিছু দেশ এর মধ্যে নিরপেক্ষ থেকে যায়। দুটি জোটে বিভক্ত হয়ে যাওয়া দেশগুলির মধ্যে এক ধরণের স্নায়ু  যুদ্ধ  শুরু হয়।   যার নাম কোল্ড ওয়ার।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পর,  পরাধীন দেশগুলিতে শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতার লড়াই । বিশেষ করে  কলোনিয়াল অঞ্চল  তাদের স্বাধীনতার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠে।    সাম্রাজ্যবাদী শাসকেরা   বুঝতে পরে যে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির পতন  ঘটতে আর বেশি দেরি নেই ।  ফলে  উপনিবেশগুলিকে স্বাধীনতা দানে তৎপর হয় হয় দেশগুলি । যার ফলে  বেশ কিছু  দেশ স্বাধীনতা লাভ করে । তেমনি ব্রিটেনে ও ভারত,  পাকিস্তানের কর্তৃত্ব ছাড়তে বাধ্য  হয়।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির  পর বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষে  জাতিসংঘ  গঠিত  হয় । এখন  পর্যন্ত এই  সংস্থা বিশ্বের  শান্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষায় ও মানুবজাতির সার্বিক উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবের উল্লেখযোগ্য অংশ  লিটল বয়।  এর ধ্বংসজজ্ঞ এত ব্যপক  ছিল যে, প্রায় ২ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কাঠের যত স্থাপত্ব  ছিল  তা সবই  একেবারে মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। চোখের পলকে পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল পুরো শহর। আর এই  ৭৬ বছর পরেও হিরোশিমা নাগাসাকি শহরের মানুষেরা সেই তেজস্ক্রিয়তার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। এখনো  তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে পঙ্গুত্ব,  বিকলাঙ্গসহ প্রানঘাতি  রোগব্যাধীও দেখা যায়।
  • রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও সংঘর্ষের  কারণে  অগণিতসংখ্যক লোক শরণার্থী হয়েছিলেন এই সময়ে ।  একমাত্র ইউরোপেই ৪০ মিলিয়নেরও অধিক লোক যুদ্ধের পরে  শরণার্থী হয়ে ছিল। যুদ্ধের শেষ মাসে  পাঁচ মিলিয়ন জার্মান বেসামরিক নাগরিক পূর্ব প্রুশিয়া, পোমারানিয়া এবং সিলেসিয়া রাজ্য হতে  রেড আর্মির তীব্র আক্রমণের শিকার হয়।  এরপর   ম্যাকলেনবার্গ, ব্রান্ডেনবার্গ এবং স্যাক্সনিতে শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নেয়।
  • পটসড্যাম সম্মেলনের সিদ্ধান্ত মিত্রশক্তি অনুমোদন  করে না। ফলে  যুগোস্লাভিয়া এবং রোমানিয়ার  হাজার হাজার  জার্মানদেরকে সোভিয়েত ইউনিয়নে দাস শ্রমের কাজে ফেরত পাঠানো হয়।  ইতিহাসে এটি ছিল সর্বোচ্চ   শরণার্থী স্থানান্তর।  এতে প্রায়  ১৫ মিলিয়ন জার্মানদের  অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তাছাড়া দুই মিলিয়নেরও বেশি জার্মান যুদ্ধকালীন সময়ে বিতাড়িত হযন ও  প্রাণ হারান !

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কবে শেষ হয়েছিল

অ্যাডলফ হিটলারের নেতৃত্বে,  জার্মানির নাৎসি বাহিনীর আক্রমণে ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, এশিয়া, ইউরোপ  এবং আফ্রিকা মহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এ ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ  যুদ্ধ। প্রাণহানি ঘটে ৭ কোটির বেশি মানুষ ও সেনাসদস্যদের। ১৪ ই আগস্ট   ১৯৪৫ সালে রণাঙ্গনের লড়াই শেষ হয়ে যায়। আত্মসমর্পণ করে অক্ষশক্তির সর্বশেষ যুদ্ধরত জাপানি সৈন্য দল।  এর মধ্য দিয়েই সেপ্টেম্বর  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক পরিসমাপ্তি হয়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলাফল

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর আমরা  বিশ্বরাজনীতিতে সম্ভাবনাময় ও সদূরপ্রসারী ফলাফল  দেখতে পাই । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের   এই ফলাফল গুলোই নিম্নে আলোচনা করা হলো:

ভিন্ন দুইটি মতাদর্শের বিকাশ

যুদ্ধের পর ইউরোপ দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে পরে। এরা হল  পশ্চিম ইউরােপ এবং পূর্ব ইউরােপ । পশ্চিম ইউরােপে পুঁজিবাদের অর্থাৎ  সংসদীয় গণতন্ত্রের পুনরায়  বিকাশ ঘটে। অপর দিকে পূর্ব ইউরােপে সােভিয়েত এর অনুকরণে নতুন সমাজতন্ত্রের  বিকাশ হয় । এই দুইটি মতাদর্শকে ভিত্তি  করেই গড়ে ওঠে দুটি সামরিক। একটি  জোট ন্যাটো ও অপরটি  ওয়ারশ ।

জার্মানী বিভক্তি

হিটলারের মৃত্যুর  পর জার্মানি দুইটি ভাগে ভাগ হয়ে যায় । ১৯৪৯ সালে জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিমে বিভক্ত হয়।  নাৎসি দলকে  নিষিদ্ধ করা হয়।  এবং তাদের সকল প্রকার ঘৃণ্য আইন  বাতিল হয় । ডানজিগ স্থল  পােল্যান্ডকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। আর নুরেনবার্গ আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয় ।

জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠা

মার্কিন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট ও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিল ১৯৪১ সালে  আটলান্টিক মহাসাগরে,  আগস্টা যুদ্ধ জাহাজে মিলিত। এবং দুজনে  আটলান্টিক সনদপত্রে স্বাক্ষর করেন । ওই সনদে ইঙ্গিত দেয়া হয় একটি বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সংস্থার।  ১৯৪২ সালে আটলান্টিক সনদের প্রতি আস্থাজ্ঞাপন করে মোট ২৬ টি দেশ । ২৬ দেশের মিলিত সম্মেলনে   সর্বপ্রথম জাতিসংঘ বা United Nations শব্দটি নেয়া  হয় ।   সানফ্রান্সিসকো সম্মেলনে ১৯৪৫ সালে জাতিসংঘের সনদ গৃহীত হয়। এবং ১৯৪৫ সালের ২৪ অক্টোবর  জাতিসংঘ সনদ চূড়ান্তভাবে বিশ্ব ব্যাপী গৃহীত হয় ।

যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়নের শক্তির উত্থান

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ হবার ঠিক  আগে ব্রিটেন ও ফ্রান্স ছিল বৃহৎ পরা শক্তি । তবে এই যুদ্ধের পরেই বিশ্বরাজনীতির চেহারা এবং বৃহৎ শক্তির কাঠামাে দুইই পুরোটা বদলে যায় । এই যুদ্ধে ব্রিটেন ও ফ্রান্স  ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় । যুদ্ধের পরবর্তী ধাক্কা  সামলে ওঠা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে ওঠে । এই  সময়টাতেই  যুক্তরাষ্ট্র ধীরে ধীরে তার প্রভাব বিস্তার করা শুরু করে। এবং  বৃহৎ শক্তি হিসেবে নিজেরা  আত্মপ্রকাশ করে। এর পেছনে মূল  কারণ ছিল যুক্তরাষ্ট্রের প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ। পাশাপাশি   সামরিক খাতে ব্যয় করার মতে অনেক  অর্থ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের  পরে পরা শক্তি হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নেরও  উত্থান শুরু হয়। সেভিভিয়েত ইউনিয়নের পরিবর্তনের পোছনে  মূল কারণ ছিল,  দেশটির বিপুল পরিমাণ  সামরিক শক্তি এবং অঢেল সম্পদের প্রাচুর্য।

ফ্যাসিবাদের পতন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনার মূল কীট ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে এই রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর।  মিত্রশক্তি জয়ী হওয়ায় ফ্যাসিবাদ পুরোপুরি  বিলুপ্ত হয়ে যায়  ।

বিশ্বরাজনীতিতে বৃহৎ শক্তি  ফ্রান্স ও ব্রিটেনের পতন

যুদ্ধের পর ব্রিটেন  তার বৃহৎ শক্তি ও  সাম্রাজ্য হারায় । ব্রিটেনের অর্থনীতি অনেকটা ই ভেঙে পড়ে।  তখন বিশ্বের বাজারে ব্রিটিশদের  পণ্য রপ্তানিও  বন্ধ হয়ে যায়। কৃষির ক্ষেত্রগুলো একদম অনাবাদী হয়ে পড়ে। এছাড়াও যুদ্ধ ফেরত সেনাদের ভাতা প্রদান ও পুনর্বাসন নিয়েও সমস্যা দেখা দেয় । ব্রিটেন বাধ্য হয়  তাদের স্থল ও নৌ- বহর হ্রাস করতে। ব্রিটেনের  সামরিকশক্তিও প্রকাশ্যে খর্ব হয়। এভাবে  বিশ্বরাজনীতিতে তাদের প্রভাব কমে যায়।

এসময়ে ফ্রান্সের অবস্থা হয় ব্রিটেনের চেয়েও  বহুগুণ খারাপ ।  ফ্রান্সের শিল্প এবং অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ক্ষেত্রে শৃঙ্খলার অভাব  ও ধর্মঘটে ফ্রান্স ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় ।এভাবে এক পর্যায়ে   বিশ্বরাজনীতিতে ফ্রান্সের গুরুত্বও  কমে যেতে থাকে।

স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা

দ্বিতীয়  বিশ্বযুদ্ধের পরে সারা  বিশ্বে শুরু হয়  মেরুকরণ প্রক্রিয়া । যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের  নিজ নিজ প্রভাব বলয় সৃষ্টি করে। এবং এক সাথে এই দুই পরাশক্তি পারমাণবিক আর  বিধ্বংসী অস্ত্রের বিপুল  ভাণ্ডার গড়ে ততোলে। আক্রমণ করার প্রবণতা  উভয়ের মনে থাকলেও  বিধ্বংসী অস্ত্রের ভয়াবহতা সম্পর্কে দুই রাষ্ট্রই অবগত ছিলেন।  ফলে সূচনা হয় এক ধরনের নিরব  যুদ্ধের।  যা  কিনা ইতিহাসে এখন “স্নায়ুযুদ্ধ”  হিসেবে পরিচিত। এক্ষেত্রে দুই পরাশক্তির মাঝে কোনো যুদ্ধ না হলেও একাধিকবার যুদ্ধের  পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে বিশ্বের  উন্নয়নশীল দেশগুলোও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে  প্রভাবিত হয়েছিল।

মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই যাবৎকালের সবচেয়ে  বিপর্যয়কর ও ভয়াবহ  সংঘাতের নাম হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ । দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় শত শত চাঞ্চল্যকর তথ্য। চোখে পরে আগ্রাসন, একনায়কতন্ত্র, বর্ণবিদ্বেষ,   যুদ্ধ্বচিন্তার  অসংখ্য ভুল সিদ্ধান্ত।  যেসব ভুলের পরিনাম মানবজাতি আজও বহন করে চলেছে ।

ছয় বছর ধরে ঘটে যাওয়া এই ঐতিহাসিক যুদ্ধের সম্পূর্ণ বর্ণনা হাজার কয়েক শব্দে প্রকাশ করা সম্ভব নয়৷ তবুও রক্তক্ষয়ী  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণ, প্রভাব ও ফলাফল এর চিত্র সার্বিকভাবে  তুলে ধরার চেষ্টা করেছি।

আশা করি আমাদের আজকের লেখাটি পড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে সর্বোপরি একটি ধারনা  পেয়েছেন।

Frequently Asked Question (FAQ)

১. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল কতদিন ছিল?

উত্তরঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ব্যাপ্তিকাল ছিল ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৯ থেকে ২ সেপ্টেম্বার ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত।

২. জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে কারা পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল? কবে ফেলেছিল?

উত্তরঃ ১৯৪৫ সালের আগস্টের ৬ এবং ৯ তারিখে যুক্তরাষ্ট্র যথাক্রমে জাপানের হিরোশিমা এবং নাগাসাকি শহরে বিধ্বংসী পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল।

৩.

Previous articleআমি কেন ফেসবুক ঘৃণা করি
Next articleলকডাউন এবং আমার ব্লগ ও ইউটিউব চিন্তা
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।