জহির রায়হান

‘হাজার বছর ধরে’ উপন্যাসটি পড়েননি এমন লোক খুব কমই আছেন। যারা পড়েননি তাদের অনেকেই এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে নির্মিত সিনেমাটি দেখেছেন। গ্রাম-বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনের অসাধারণ গল্প বর্ণনা করা হয়েছে এই উপন্যাসটিতে। ‘একুশের গল্প’, ‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘হাজার বছর ধরে’ এসবই আমরা পড়েছি পাঠ্যবইয়ের সুবাদে। আর এই লেখাগুলোর মাধ্যমেই আমার সাথে পরিচয় হয় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক জহির রায়হান ।

কিছু কথাঃ জহির রায়হান

১৯৩৫ সালের ১৯ আগস্ট ফেনী জেলায় তাঁর জন্ম। সাহিত্য জগতে তাঁর পদার্পণ ‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ (১৯৬০) উপন্যাসটি দিয়ে। সাদামাটা গল্পকে কিভাবে চমৎকার ভাবে উপস্থাপন করতে হয় তা তাঁর লেখা পড়লেই বোঝা যায়। ১৯৬১ সালে মুক্তি পায় তাঁর নির্মিত প্রথম চলচ্চিত্র ‘কখনো আসেনি’। তাঁর বেশিরভাগেই গল্পেই সূক্ষ্মভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের শোষণ বঞ্চনার কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা পৃথিবীবাসির সম্মুখে তুলে ধরতে নির্মাণ করেছেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নামক তথ্যচিত্র।

নিজের লেখাকে শুধুমাত্র প্রকৃতি-প্রেম, সামাজিক গল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যবহার করেছেন শক্তিশালী সমাজ দর্পণ হিসেবে। ১৯৬৪ সালে তাঁর দ্বিতীয় উপন্যাস ‘হাজার বছর ধরে’ প্রকাশিত হয়। এই উপন্যাসটিই তাঁকে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছায়। মন্তু, টুনি, বুড়ো মকবুল, আবুল, আম্বিয়া চরিত্রগুলো পাঠকের হৃদয়ে স্থায়ী আসন গেড়ে নেয়। এই উপন্যাসটির জন্য ১৯৬৪ সালে তিনি ‘আদমজী সাহিত্য পুরষ্কার’ লাভ করেন।

জহির রায়হান ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন এবং ২১শে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আমতলা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন। ভাষা আন্দোলন তাঁর ওপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল, যার ছাপ দেখতে পাওয়া যায় তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র “জীবন থেকে নেয়া”তে। তিনি ১৯৬৯ সালের গণ অভ্যুত্থানে অংশ নেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি কলকাতায় চলে যান এবং সেখানে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র জীবন থেকে নেওয়ার বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয় এবং চলচ্চিত্রটি দেখে সত্যজিত রায়, মৃণাল সেন, তপন সিনহা এবং ঋত্বিক ঘটক প্রমুখ ভূয়সী প্রশংসা করেন। সে সময়ে তিনি চরম অর্থনৈতিক দৈন্যের মধ্যে থাকা সত্ত্বেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করে দেন।

‘শেষ বিকেলের মেয়ে’ ও ‘হাজার বছর ধরে’ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে – ‘আরেক ফাল্গুন’ (১৯৬৯) বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত কথামালা। ‘বরফ গলা নদী‘ (১৯৬৯) প্রথম প্রকাশ: ‘উত্তরণ’ সাময়িকী। অর্থনৈতিক কারণে বিপর্যস্ত ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্ত পরিবারের অসহায়ত্ব গাথা। ‘আর কতদিন’ (১৯৭০) অবরুদ্ধ ও পদদলিত মানবাত্নার আন্তর্জাতিক রূপ এবং সংগ্রাম ও স্বপ্নের আত্মকথা। ‘কয়েকটি মৃত্যু’, ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ (১৯৭০) এবং ‘তৃষ্ণা’ (১৯৬২)।

‘সময়ের প্রয়োজনে’, ‘একুশের গল্প’ সহ তাঁর মোট ২১টি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়।

ব্যক্তিজীবনে জহির রায়হান তাঁর ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৫০ সালে ‘যুগের পত্রিকা’য় সাংবাদিকতার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি খাপছাড়া, যান্ত্রিক, সিনেমা ইত্যাদি পত্রিকাতেও কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ প্রকাশিত হয়। চলচ্চিত্র জগতে তার পদার্পণ ঘটে ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা ছবিতে সহকারী হিসেবে কাজ করার মাধ্যমে।

কিভাবে হারিয়ে গেলেন জহির রায়হান

জহির রায়হান দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭১ এর ১৭ ডিসেম্বর ঢাকা ফিরে আসেন এবং তার নিখোঁজ ভাই শহীদুল্লাহ কায়সারকে খুঁজতে শুরু করেন, যিনি স্বাধীনতার ঠিক পূর্বমুহূর্তে পাকিস্তানি আর্মির এদেশীয় দোসর আল বদর বাহিনী কর্তৃক অপহৃত হয়েছিলেন। জহির রায়হান ভাইয়ের সন্ধানে মিরপুরে যান এবং সেখান থেকে আর ফিরে আসেননি। ১৯৭২ এর ৩০ জানুয়ারির পর তাঁর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। মিরপুর ছিল ঢাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত বিহারী অধ্যুষিত এলাকা এবং এমন প্রমাণ পাওয়া গেছে যে সেদিন বিহারীরা ও ছদ্মবেশী পাকিস্তানী সৈন্যরা বাংলাদেশীদের ওপর গুলি চালালে তিনি নিহত হন।

মৃত্যু হয়তো কিছু মানুষের কাজের গতিকে রুদ্ধ করে দেয়, কিন্তু বিলীন করতে পারে না। জহির রায়হান তেমনই একজন মানুষ। মৃত্যুর পরও তিনি ১৯৭২ সালে ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরষ্কার’ (মরণোত্তর), ১৯৭৭ সালে ‘একুশে পদক’ এবং ২০০৫ সালে ‘হাজার বছর ধরে’ চলচ্চিত্রের জন্য শ্রেষ্ঠ কাহিনীকার বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (মরণোত্তর) লাভ করেন। তিনি ছিলেন আমাদের সাহিত্য জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, যার অন্তর্ধানে বাংলা সাহিত্যের দীপ্তি অনেকটা অস্তমিত হয়ে যায়। তবে পাঠক হৃদয়ে তিনি বেঁচে রয়েছেন তাঁর অমর কীর্তি দিয়ে, বেঁচে থাকবেন চিরকাল।

Previous articleকফি সমাচার – কিভাবে কফি আবিস্কার হয়?
Next articleকে হবে আগামী বিশ্বের সুপারপাওয়ার