চেরনোবিল

 

চেরনোবিল বিপর্যয় অনেক আগের ঘটনা হলেও আমাদের মাঝে অনেকেই বিষয়টা সম্পূর্ণ জানে না৷ এটা নিয়ে অনেক লেখা থাকলেও আমাদের ব্লগটি নতুন হওয়াতে এখানে এই বিষয়ে কোনো লেখা নেই৷ তাই পাঠকদের কথা ভেবে বিষয়টা নিয়ে ছোট করে লেখার চেষ্টা করলাম। আশা করি আমাদের পাঠকরা অন্যদের চেয়ে কম পড়ে বেশি জানতে পাড়বে৷

বর্তমান বিশ্বে বিদ্যুৎ একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ ছাড়া কোনো কিছু কল্পনা পর্যন্ত করতে পারি না। এই বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়ে থাকে  অনবায়নযোগ্য উৎস গুলো থেকে৷ কিন্তু একটা সময় যখন এই উৎসগুলো আর ব্যবহার করা যাবে না তখন আমাদের কী হবে? কীভাবে পাবো বিদুৎ? সেই সমস্যার সমাধান হিসেবে আবিষ্কার হয় পারমাণবিক উৎস। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি ও নবায়নযোগ্যতা থাকলেও রয়ে যায় এক বিরাট ঝুঁকি। কোনো রকম অসতর্কতা আমাদের জন্য হতে পারে চরম ক্ষতির কারণ। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ এই চেরনোবিল দুর্ঘটনা।

কি ঘটনা ঘটেছিল সেদিন চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রে

বর্তমানে ইউক্রেনের পৃপিয়াত যা ১৯৮৬ সালে ছিলো সোভিয়েতের অধীনে। ৪ টি চুল্লি নিয়ে সেখানে করা হয়েছিলো চেরনোবিল পারমাণবিক কেন্দ্রটি। ১০০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হতো প্রতিদিন। ২৬ শে এপ্রিল, ১৯৮৬ সালের স্থানীয় সময় ১ টা ২৩ মিনিটে হওয়া বিস্ফোরণের কারণ হিসেবে বলা হয়ে থাকে, অপরিকল্পিত নিউক্লিয়ার পরীক্ষা ও রাতে কর্তব্যরত কর্মীদের অসাবধানতা। ৪র্থ চুল্লিতে চলা পরীক্ষাটিতে অপারেটররা পাওয়ার রেগুলেটিং সিস্টেম বন্ধ করে দেয়। সাথে বন্ধ ছিলো জরুরি নিরপত্তা ব্যবস্থাও। কর্মীরা কোরের সাথে সংযুক্ত কন্ট্রোলিং রডগুলোও বন্ধ করে দেয়। নিরাপত্তা ব্যবস্থা বন্ধ ও অপরিকল্পিত পরীক্ষার ফলে অতিরিক্ত শক্তি নির্গত হচ্ছিলো৷ প্লান্টটি বন্ধ করে দিলে হয়তো বিস্ফোরণ থেকে বাঁচা যেতো। কিন্তু সিনিয়রদের আদেশ ছাড়া বন্ধ করার নিয়ম ছিলো না বলে অপারেটররা এত রাতে তাদের সাথে যোগাযোগ করার সাহস করেনি। যার ফলশ্রুতিতে ইতিহাসের ভয়াবহ এই দুর্ঘটনায় বাধা হতে পারেনি কোনো কিছুই। যেন বিস্ফোরণ এর সকল আয়োজন সাজিয়েই রাখা হয়েছিলো।

ক্ষতির পরিমাণ কত

দুর্ঘটনা মানেই ক্ষতি। কোথাও কম, কোথাও বেশি। আর পারমাণবিক দুর্ঘটনার ক্ষতির পরিণাম কী হতে পারে তা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকেই বুঝতে পেরেছি। সাধারণত পারমাণবিক বিস্ফোরণের ক্ষতি বেশি হয়ে থাকে এর তেজস্ক্রিয়তার কারণে। সরকারি তথ্য মতে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে যার মধ্যে ছিলো ৬ লক্ষ শিশু। দুর্ঘটনার সময়ে সেখানে থাকা ৪ জন শ্রমিক সাথে সাথেই মারা যায়। পরবর্তী ৩ মাসে মারা যায় আরো প্রায় ৩১ জন। পারমাণবিক বিকিরণের কারণে বিভিন্ন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ে আরো ২৩৭ জন। আশেপাশের দেশ যেমনঃ বেলারুশ, ইউক্রেন, ফ্রান্স, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশে তেজস্ক্রিয়তার প্রভাব জীবজগতের উপর পড়ে। গবাদি পশু বিকলাঙ্গতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে।

যে তিনজন ভয়াবহ ক্ষতি থেকে ইউরোপকে বাঁচিয়েছিলো

ক্ষয়ক্ষতি যা হয়েছিলো তার চেয়ে বেশি কিছু হতে পারতো যদি ৩ জন মানুষ তাদের জীবনের ঝুঁকি না নিতো।তাদের এই পদক্ষেপ মানব ইতিহাসে পরমাণুর আরেকটি কলঙ্কজনক অধ্যায় থেকে মুক্তি দিয়েছিলো।

চেরনোবিল দুর্ঘটনা ঘটবার পাঁচ দিন পর ১৯৮৬ সালের মে মাসের ১ তারিখে সোভিয়েত কর্মকর্তারা আবিস্কার করল এক ভয়াবহ তথ্য। যে পারমাণবিক চুল্লীটি বিস্ফোরিত হয়েছে সেটার কোর অর্থ্যাৎ মূল অংশটি তখনও উত্তাপে গলে চলছিল! সেই কোরের মধ্যে তখন ছিল ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানী এবং সেখানে তখনও পারমাণবিক বিক্রিয়া হচ্ছিল। এই ১৮৫ টন পারমাণবিক জ্বালানীর ঠিক নিচেই ছিল ৫ মিলিয়ন গ্যালন ধারণ ক্ষমতার একটি পুল অর্থ্যাৎ জলাশয়। তো সেই পুল আর বিস্ফোরিত চুল্লীর কোরের মধ্যে ছিল কেবলমাত্র একটা কংক্রিট স্ল্যাব, মানে জমাটবাঁধা পাথরের তৈরি ঢাকনা। গলতে থাকা কোরটি নিচের পানি স্পর্শ করলেই ঘটবে এক মহাবিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণ হলে শুধু রাশিয়া নয় ক্ষতিগ্রস্ত হবে ইউরোপের প্রায় অর্ধেক৷ ঐ সময় সেখানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা জানালেন, গলতে থাকা কোরটি ধীরে ধীরে কনক্রিট স্ল্যাবের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করছে এবং প্রতি মুহূর্তে একটু একটু করে পানির কাছে যাচ্ছে। তখন তারা একটি সমাধান দিলো যে, পুলটি যদি খালি করা যায় তাহলে পানির সাথে কোরের সংযোগ আটকানো যাবে। পুলের ভিতর পানি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য যে পাইপ রয়েছে সেটা বন্ধ বা খুলে দেয়ার জন্য একজোড়া গেট ভালব আছে। গেট ভালব খুলে দিলেই পানি গুলো বের হয়ে যাবে৷ আর এর জন্য দরকার হবে ৩ জন মানুষের। কিন্তু গল্পের নায়কের মত বাস্তবের নায়ক কে বা কারা হবেন? কারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করবে? সিনের কোনো হিরো পাওয়া যাবে?

হ্যাঁ, পাওয়া গিয়েছিলো তিনজন বীরকে। ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকো ছিলেন বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রকৌশলী আর বরিস বারানভ ছিলেন প্ল্যান্টের একজন কর্মী। প্রকৌশলী দুজন জানতেন ভালভ দুটো কোথায় আছে, বরিস তাদের সঙ্গী হলেন পানির নিচে কাজ করে এমন একটি ল্যাম্প নিয়ে। পরেরদিন তিনজন সাঁতারের পোশাক পরে নামলেন সেখানে। কিন্তু কিছুদূর যেতেই ল্যাম্পটির আলো ফিকে হয়ে আসলো। তারা চিন্তায় পড়ে গেলেন। তাদের কাজের উপর নির্ভর করছে লক্ষ লক্ষ জীবন। একটু পর আলো একদমই নিভে যাওয়ার ঠিক আগ মুহুর্তে একটি পাইপ চোখ পড়েছিলো তাদের। তারা জানতো ঐটি ধরে এগোলেই ভালবের দিকে যাওয়া যাবে। অনেকটা অনিশ্চয়তার মধ্যে চলতে লাগলেও কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ভালবের সন্ধান পায়। তারা ভালভ দুটো খুলে দিলে পানি বের হয়ে যেতে লাগল পাইপের মধ্য দিয়ে। পুল খালি হতে শুরু করল ধীরে ধীরে। মহাবিস্ফোরণ ঠেকিয়ে দিলেন তিনজন।

তেজস্ক্রিয়তার কারণে তাদের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়লেও পরবর্তীতে ইংল্যান্ডের এক সাংবাদিক তার বইতে দাবি করেন, তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে তাদের মৃত্যু হয়নি। লেথারব্যারো জানান, তাদের একজন বরিস বারানভ হৃদরোগে মারা গেছেন ২০০৫ সালে এবং অন্য দুজন অন্তত ২০১৫ সাল পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন। গণমাধ্যমের বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ভ্যালেরি বেজপালভ এবং অ্যালেক্সি আনানেকো বেঁচে ছিলেন ২০২০ সাল পর্যন্তও। যাই হোক তাদের আত্মত্যাগ মানব সভ্যতা  মনে না রাখলেও তা অস্বীকার করতে পারবে না।

বর্তমান অবস্থা কেমন চেরনোবিল এ

দুর্ঘটনার পর এলাকাটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখান থেকে জনবসতি সড়িয়ে নেয়া হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪১৪৩ বর্গ কিলোমিটার জায়গা নির্দিষ্ট করে সেখানে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়ে থাকলেও সময়ে সময়ে বিজ্ঞানীরা সেখানে গবেষণার কাজে যেতে পারে। বিস্ফোরণের পরেও এই শক্তি কেন্দ্রের ২০০ টনের মত তেজস্ক্রিয় পদার্থ মজুদ থেকে গেছে। এছাড়া বিস্ফোরণের পরপরই তেজস্ক্রিয় পদার্থ সমূহ প্রায় ৮০০ টি স্থানে পুঁতে ফেলা হয় যার কারণে ভূগর্ভস্থ পানিতে এর দূষণের ব্যাপক সম্ভাবনাও আছে।

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো সেখানে এখন প্রাণ ফিরেছে যদিও তা মানুষের নয়, পশুদের। বাইসন, বন্য শূকর, ব্যাজার, ধূসর নেকড়ে, শেয়ালসহ বেশ কিছু পাখি, ঘোড়ার উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাছাড়া ভোমরা, ফড়িং, ঘাস ফড়িং এবং মাকড়সাও দেখা গিয়েছে বলে দাবি করা হয়েছে। দুর্ঘটনার সাথে সাথে মানুষ সরিয়ে নেয়া হলেও অন্যান্য জীব জন্তু সরিয়ে নেয়া সম্ভব হয়নি। স্থানটি জীব বিজ্ঞানীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেউ কেউ এই প্রাণের সন্ধানকে দুর্ঘটনার উজ্জ্বল দিক হিসেবে দাবি করেছেন। তেজস্ক্রিয়তার জন্য মানুষের বসবাস অনুপযোগী স্থানটিতে পশুপাখির এই অস্তিত্ব হয়তো জীব বিজ্ঞানের কোনো নতুন দিক আমাদের সামনে নিয়ে আসবে।

চেরনোবিল আমাদের জন্য সতর্কবার্তা

পারমাণবিক দুর্ঘটনা শুধু রাশিয়াতে না এর আগে এবং পরেও হয়েছে অনেক জায়গাতে। ১৯৭৯ সালে আমেরিকার থ্রি মাইল আইল্যান্ড ও ২০১১ সালে জাপানে ফুকুশিমাতেও ঘটেছিলো এই বিপর্যয়। জার্মানি ২০২২ সালের মধ্যে সকল পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। ইউরোনিয়ামের সবচেয়ে বেশি মজুদ থাকা অস্ট্রেলিয়া  কোনো পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র না বানানোর নীতি গ্রহণ করেছে। কিন্তু ঠিক সেই সময়ে আমরা ঘোষণা দিয়ে বসে আছি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। এর পিছনের ঠিক কি কারণ থাকতে পারে সেটা বোধগম্য নয়।

ব্যয়ের পরিমাণ ৩২ হাজার কোটি টাকা থেকে এখুনি ১ লক্ষ কোটি টাকায় গিয়ে দাড়িয়েছে। শেষ পর্যন্ত এই ব্যয় কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা মুশকিল। অন্যান্য উপায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ যখন দিন দিন কমছে সেখানে নিরাপত্তার অযুহাতে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যয় বেড়েই চলছে। ফ্রান্স ২০০৭ সালে শুরু হওয়া কাজ বন্ধ করে দিয়েছে   এই অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণে। জাপান ও ফ্রান্সের দুটো প্রতিষ্ঠান দেউলিয়াত্বের খাতায় নাম লিখিয়েছে। এইসব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয়তা হ্রাস পায় বলে আমি মনে করি৷ আমরা যদি এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে সতর্ক না হই তাহলে সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তাই নীতিনির্ধারকদের কাছে অনুরোধ তারা যেন বিষয়টি নিয়ে আরো চিন্তা ভাবনা করে৷

পরিশেষে একটাই কথা, অতীত থেকে শিক্ষা   নেয়া উচিত। প্রতিটি দুর্ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয় বরং পুরো বিশ্বের জন্য সতর্কবার্তা। বিশেষ করে আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশ এইসব ক্ষয়ক্ষতি কীভাবে মোকাবিলা করবে তা ভাববার বিষয়।

Previous articleঐতিহ্যবাহী খনার বচন বৃত্তান্ত
Next articleচীন, ভারত ও বাংলাদেশ সম্পর্ক- কে কতটুকু এগিয়ে
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।