খনার বচন

 

খনার বচন ইংরেজির Proverb,Saying এর অনেকটা একই অর্থ বিশিষ্ট। অর্থাৎ,এটা হল উক্তি বা বাক্য। কিন্তু বচন শব্দটি  ভিন্নার্থেও ব্যবহৃত হয়ে থাকে। খনার বচনে প্রাচীনত্বের সুস্পষ্ট ছাপ বিদ্যমান। কালের পরিক্রমায় বাংলা ভাষার বিবর্তনের সাথে সাথে খনার বচনেও ভাষাগত পরিবর্তন ঘটেছে।খনার বচন রচনার সময়কাল নিয়ে যে অনুমান করা যায় তা হল অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে খনার বচন রচিত হয়েছে। অনেকেই  মনে করেন যে জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী এক মহিলার নাম খনা। এই খনার রচিত ছড়াগুলোয় খনার বচন নামে পরিচিত।

সাইকোলজিক্যাল ট্রিক্স নিয়ে আমার আরেকটি লেখা পড়ুনঃ সেরা ১৪টি সাইকোলজিকাল ট্রিকস -যা আপনার জীবনকে একধাপ এগিয়ে দিবে

খনার পরিচয়

আজ থেকে বহু বছর পূর্বে জন্ম-নেয়া একজন ঐতিহাসিক মানুষ খনা। সে শুভক্ষণে জন্মগ্রহণ করেছিলেন  বলে তার নাম খনা হয়েছে। লোকমুখে প্রচলিত আছে যে তার আসল নাম লীলাবতী। খনা জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর রচিত ছড়াগুলি খনার বচন নামে কৃষকের মুখে মুখে যুগ যুগ ধরে টিকে আছে ।অনেকে মনে করেন যে পশ্চিমবঙ্গের খনামিহিরের ঢিবি ছিল খনার নিবাস। পৃথিবীর আদি কৃষিভিত্তিক ব্যবস্থা ছিল প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল। খনার বচনেও  প্রকৃতির ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান।

প্রাচীনকালে উর্বরা জমি হয়ে ওঠে সমৃদ্ধির প্রতীক। খনার বচনের  প্রভাব এখন‌ও অনেক জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। খনার বচনে ছন্দ বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। ছন্দ বৈচিত্রের প্রয়োজনে অনেক সময় শব্দ বিকৃত করা হয়েছে। কিছু কিছু খনার বচনকে কবিতার মত অনেক দীর্ঘ , আবার এক চরন বিশিষ্ট খনার বচন পরিলক্ষিত হয় ।এগুলো সাধারনত প্রবাদ  নামে পরিচিত । তবে দুই থেকে চার চরন বিশিষ্ট খনার বচন অধিক বিদ্যমান। বলা হয় খনা তার ছড়ার চরণগুলো গাছের পাতায় লিখে পাঠ  করতেন। আর তারপর কৃষকের মুখে মুখে যুগ-যুগ ধরে সেগুলো টিকে গেছে।

খনার জীবন

অনেকে বলে থাকেন যে প্রাচীনকালে লঙ্কার  কিছু রাক্ষস খনার পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলে এবং তারা শুধু খনাকে বাঁচিয়ে রাখে মায়ার বশবর্তী হয়ে। তারা খনাকে লঙ্কায়  নিয়ে যায় এবং সেখানে তাকে বড় করতে থাকে। লঙ্কায় খনার  বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যায় ।এগুলো দেখে রাক্ষসগুলো সিদ্ধান্ত নেয় তাকে জ্যোতির্বিদ্যা শেখাবে। সেজন্য খনাকে জ্যোতির্বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলে রাক্ষসরা। এমন সময়ে রাজা বিক্রমাদিত্যের নবরত্ন সভার অন্যতম পন্ডিত বড়াহ একটি পুত্র সন্তান লাভ করেন। কিন্তু পুত্রের আয়ু গণনার সময় ভুলবশত একশত বছরের জায়গায় মাত্র এক বছর আয়ু দেখতে পান। তাই মনের দুঃখে তার পুত্রকে তামার পাত্রে করে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন। ঘটনাক্রমে শিশুপুত্রটি ভাসতে ভাসতে লঙ্কা দ্বীপের কাছাকাছি চলে আসে। রাক্ষসরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় লঙ্কা দ্বীপে এবং সেখানেই তাকে বড় করে তুলতে থাকে। সেখানে রাক্ষসরা শিশু পুত্রটির নাম রাখে মিহির।মিহির সেখানে বুদ্ধির পরিচয় দিতে থাকে। এসব দেখে রাক্ষরা তাকেও জ্যোতির্বিদ্যা শেখায় । রাক্ষসদের কাছে মনে হয় মিহির এবং খনা দুজন দুজনের জন্য উপযুক্ত। এরপর একদিন বিবাহ স্থির করা হয় তাদের দুইজনের। একসময় মিহির ও খনা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়।

রাক্ষসদের সাথে থেকে থেকে খনা এবং মিহির কোনরকমে দিন  কাটাচ্ছিলেন।কিন্তু তাদের কাছে রাক্ষসদের বিভিন্ন অনাচার ও কুৎসিত কাজকর্ম করা বিরক্তিকর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাই তারা চেষ্টা করতে থাকে রাক্ষসদের থেকে দূরে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ।কিন্তু তাদের পক্ষে এ কাজটা প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছিল । কারণ চারপাশে সমুদ্র এবং রাক্ষস প্রহরীরা  বিদ্যমান ।তাই তারা অনেক চিন্তাভাবনা করতে থাকে। একদিন খাওয়ার সময় মাহেন্দ্রক্ষণ উপস্থিত হল।সেই মাহেন্দ্রক্ষণে তারা যাত্রা শুরু করলেন এবং সেই রাক্ষসদের থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেন।

এভাবেই খনা মানুষের মাঝে এসে তার জ্যোতির্বিজ্ঞানের জ্ঞান ছড়া আকারে প্রদান করেন। তাঁর রচিত ছড়াগুলি মানুষকে তাদের ফসলের ভাগ্য নির্ধারণ করতে সহায়তা করেছে। গ্রাম বাংলার মানুষ খনার বচনের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদনশীলতা নির্ধারণ করার চেষ্টা করেছে এবং আজও বিভিন্ন গ্রামীণ মানুষের মধ্যে খনার বচনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

খনার বচনের  প্রভাব

অসংখ্য খনার বচন যুগ যুগান্তরে মানুষের সমাজ সংস্কৃতির সাথে মিশে আছে।খনার বচনকে অনেকে সংশয় মুক্তির পথ প্রদর্শক হিসেবে মনে করে। গ্রাম বাংলার সাধারণ মানুষ মেনে থাকেন ফসলের উৎপাদন সম্পর্কিত বিভিন্ন ধারণার সাথে খনার বচন ওতপ্রোতভাবে ভাবে মিশে আছে। কোন সময়ে কেমন ফসল হবে, কেমন বৃষ্টি হলে ফসলের ক্ষতি হবে বা ভালো হবে ,ফসলের জন্য আগাম সতর্কবার্তা কি অবলম্বন করতে হবে তা এই খনার বচন এর মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষ অনুমান করে আসছেন যুগ যুগান্তর ধরে ।  বহুকাল ধরে গ্রাম বাংলার মানুষ খনার বচন পালন করে আসছেন। কৃষক শ্রেণীর মানুষের মুখে মুখে খনার বচন যুগ-যুগান্তর ধরে টিকে আছে।

খনার বচনের কয়েকটি উদাহরণ

ষোল চাষে মূলা, তার অর্ধেক তুলা;
তার অর্ধেক ধান, বিনা চাষে পান।

অর্থঃ ১৬ দিন চাষ করার পর সেই জমিতে মূলা চাষ করলে ভাল জাতের ফলন পাওয়া যায়। তুলা লাগানোর জমিতে ৮ দিন চাষ করতে হবে, ধানের জমিতে ৪ দিন চাষ করে ধান লাগালে ভাল ফলন পাওয়া যায়। পানের জমিতে চাষের প্রয়োজন হয় না।

যদি বর্ষে আগুনে,রাজা যায় মাগনে।

অর্থঃ আগুনে অর্থাৎ অগ্রাণে, আর, মাগুনে মানে ভিক্ষাবৃত্তির কথা বোঝাতে ব্যবহৃত, অর্থাৎ যদি অঘ্রাণে বৃষ্টিপাত হয়, তো, রাজারও ভিক্ষাবৃত্তির দশা, আকাল অবস্থায় পতিত হওয়াকে বোঝায়।

যদি বর্ষে মাঘের শেষ, ধন্য রাজার পুণ্য দেশ।
অর্থঃ মাঘের শেষের বৃষ্টিপাতে রাজা ও দেশের কল্যাণ।

শীষ দেখে বিশ দিন কাটতে মাড়তে দশ দিন।

অর্থঃযে দিন ধানের শীষ বের হবে তার থেকে ঠিক কুড়ি দিন পর ধান কাটতে হবে। ধান মাড়াই ও ঝাড়াই করতে হবে দশ দিনের মধ্যে এবং তারপর নিয়ে গোলায় তুলবে।

সরিষা বনে কলাই মুগ,বুনে বেড়াও চাপড়ে বুক।

অর্থঃ একই জমিতে যদি সরিষা ও মুগ বা সরিষা ও কলাই একসাথে বোনা যায় তাহলে দুটি ফসলই একসাথে পাওয়া যায়।

দিনে রোদ রাতে জল দিন দিন বাড়ে ধানের বল।

অর্থঃ দিনের বেলা প্রখর রোদ আর রাত্রে বৃষ্টি হলে ধানের জমি উর্বর হয় ও ধানের ফলন ভাল হয়।

আউশের ভুঁঁই বেলে, পাটের ভুঁই আঁটালে।

অর্থঃ বেলে মাটিতে আউশ ধান এবং এঁটেল মাটিযুক্ত জমিতে পাট ভাল হয়।

Previous articleকথা বলুন মাত্র ৩০ পয়সা প্রতি মিনিট সাথে ১০টাকা বোনাস !!
Next articleচেরনোবিল – পৃথিবী বিখ্যাত বিপর্যয় ও আমাদের সতর্কতা