উহুদের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল

ইসলামের ইতিহাসে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘটনা হল উহুদের যুদ্ধ। আমাদের প্রিয় নবী করিম সা. তাঁর নিজ গোত্রের কাছ থেকেই ভয়াবহ আক্রমণের শিকার হন। যেই আক্রমন মদীনার মুসলমানদেরকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। এই যুদ্ধেের সাথে জড়িয়ে আছে অজস্র স্মৃতি, ত্যাগ, শিক্ষা, যুদ্ধকৌশল,মুনাফিকের ধোঁকা সহ আরো অনেক ঘটনা। এক কথায় উহুদের যুদ্ধ ছিল মুসলমানদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা, তাই ইসলামের ইতিহাসে এই যুদ্ধটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ একটি যুদ্ধ।

আজকের লেখায় যা থাকছে

বদরের যুদ্ধের পর পরই  এই যুদ্ধ সংঘটিত হয় । মূলত বদরের যুদ্ধে পরাজয়ের প্রতিশোধ হিসেবেই কুরাইশরা  মদীনা আক্রমণের পরিকল্পনা করে। সেই থেকেই এই যুদ্ধের সূত্রপাত। ইসলামের ইতিহাসের প্রতিটি ঘটনা আমাদের জন্য মূল্যবান।  কারণ এদের মধ্যেই নিহিত আছে আমাদের জন্য অজস্র শিক্ষা। তাই এই ইতিহাস গুলো জানা আমাদের জন্য অত্যন্ত জরুরি।

আজকে আপনাদের সামনে তুলে ধরব,  উহুদের যুদ্ধের সমস্ত চিত্র। আপনারা জানতে পারবেন, কেন ঘটেছিল ঐতিহাসিক উহুদের যুদ্ধ?  কি ছিল উহুদের যুদ্ধের ফলাফল? 

টাকা ছাড়াই সদকার সোয়াব হাসিলের শ্রেষ্ঠ পাঁচ উপায় জানতে নিচের ভিডিও দেখুন।

উহুদের যুদ্ধ কেন সংঘটিত হয়েছিল

হযরত মুহাম্মদ (সাঃ), ৬১৩ সাল থেকে ৬২২ সাল পর্যন্ত মক্কাতে ইসলামের প্রচার চালিয়ে যান । এই সময়ে তিনি খুব স্বল্প  সংখ্যক লোককে ইসলাম ধর্মের অনুসারী করতে সক্ষম হন। বরং এ সময়ে তিনি মক্কার তৎকালীন সবচেয়ে প্রভাবশালী শাসক গোষ্ঠী, কুরাইশদের  তীব্র প্রতিহিংসার  সম্মুখিন হন । বছরের পর বছর আমাদের প্রিয় নবী ও সদ্য মুসলিম ভাই বোনেরা এই  নির্যাতন সহ্য করে৷ অবশেষে ৬২২ সালে মুসলিমরা মক্কা ত্যাগ করে।  এরপর মদিনা (পুর্ব নাম “ইয়াসরিব”, যার অর্থ “শহর”) তে গিয়ে নিজেদেরকে পুনরায়   প্রতিষ্ঠিত করে এবং সফলকাম হয়।

এরপরই ৬২৪ সালে বদরের যুদ্ধ তে, তুলনামুলকভাবে বেশি সংখ্যক  মক্কা বাহিনীর বিপরীতে অল্প কয়েকজন সৈন্য নিয়ে গঠিত মুসলিম বাহিনী জয়লাভ করে। বদর যুদ্ধে পরাজয়ের মেনে নিতে না পারা ও  প্রতিশোধ গ্রহণের চিন্তাই উহুদের যুদ্ধের দিকে মোড় নেয়।  একই সঙ্গে ইসলাম ধর্মকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার উদ্দেশ্যও কাজ  করছিল মক্কার যোদ্ধাদের মনে। এই অভিপ্রায়ে মক্কার তিন হাজার যোদ্ধা মদিনা অভিমুখে অভিযান শুরু করে। এভাবেই সংঘটিত হয় উহুদের যুদ্ধ ।

টাকা ছাড়া সদকার সোয়াব হাসিলের শ্রেষ্ঠ পাঁচ উপায়।

উহুদের যুদ্ধ কত সালে সংঘটিত হয়

ইসলামের প্রথম  যুগ, হিজরির ৭ শাওয়াল (২৩ মার্চ ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) , শনিবার  উহুদ পর্বতের সংলগ্ন স্থানে উহুদের যুদ্ধ  সংঘটিত হয়।এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে।   ইসলামের ইতিহাসে সংঘটিত হওয়া প্রধান যুদ্ধসমূহের মধ্যে উহুদের যুদ্ধ ছিল ২ য়। এর আগে ৬২৪ সালে,  দুইপক্ষের মধ্যে ঐতিহাসিক   বদরের যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল।

উহুদের যুদ্ধের সম্পূর্ণ  পটভূমি

বদর যুদ্ধে মুসলমানরা ঠিকই জয়লাভ করলো। কিন্তু এই বিজয়ের  মাধ্যমে তারা যেনো ভীমরুলের চাকে ঢিল ছুঁড়লো। কাফিরদের সাথে করা প্রথম যুদ্ধেই মুসলমানরা দৃঢ়তার সঙ্গে  মুকাবেলা করেছিল। আর কাফিরদেরকেও শোচনীয় ভাবে পরাজিত হতে হয়েছিল। ভীত পায়ে পিছু হটতে হয়েছিল।

কাফেরদের এই পরাজয়  মুসলমানদের বিরুদ্ধে সমগ্র আরব জনগোষ্ঠীকে প্রচণ্ড রকম উত্তেজিত করে দিলো। যারা এই নতুন আন্দোলনের শত্রু ছিল , তারা যেন এ ঘটনার পর আরো বেশি ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তার ওপর মক্কার যে সব কুরাইশ সর্দার রা বদরের যুদ্ধে নিহত হয়েছিল, তাদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অসংখ্য দলনেতা  অস্থির হয়ে উঠলো।

কারণ আরবের ইতিহাস ঘাটলে দেখা যায়,  তৎকালীন সময়ে যেকোন এক ব্যক্তির রক্তই পুরুষানুক্রমে যুদ্ধের কারণ হয়ে দাঁড়াতো। আর এই যুদ্ধে  তো এমন মূল্যবান কিছু নেতা  নিহত হয়েছিল যে, তাদের রক্তমূল্য অসংখ্য যুদ্ধে ও আদায় হতে পারতো না। তাই চারদিকে ভয়ংকর যুদ্ধের  আলামত দেখা যেতে লাগলো।

ইহুদীদের যে সব দল ইতঃপূর্বে মুসলমানদের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর  করেছিলো, তারা আর চুক্তির কোন মর্যাদা রক্ষা করলো না। এমন কি তারা খোদা,নবুয়্যাত আখিরাত এবং কিতাবের প্রতি ঈমান পোষণের প্রতি তীব্র অনীহা প্রকাশ করে।

যেখানে তাদের মুসলমানদের সাথে অধিকতর নৈকট্য থাকা উচিত ছিলো,সেখানে মুশরিক,  কাফের কুরাইশদের প্রতিই তাদের সমস্ত সহানুভূতি উপচে পড়তে লাগলো। এক পর্যায়ে  তারা খোলাখুলিভাবে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্যে কুরাইশদের কে কুমন্ত্রণা  দিতে শুরু করলো।

বিশেষ করে কাব বিন আশরাফ নামক বনী নাযির গোত্রের এক সরদার এ ব্যাপারে মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করল।  এবং অন্ধ শত্রুতায় লিপ্ত হলো। এ থেকে স্পষ্ট হল যে, ইহুদীরা না পড়োশী হিসেবে কোন কর্তব্য পালন করবে৷ আর না হযরত (সা:) এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তির কোনো মর্যাদা রক্ষা করবে।

মক্কার অগ্রযাত্রা

মক্কার মুশরিকদের অন্তরে শুরু থেকেই মুসলমানদের ওপর  প্রতিশোধ নেবার আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছিল । তাদের বিভিন্ন গোত্রের  সর্দারগণ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্যে ইতোমধ্যে প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করেছিল। প্রতিটি গোত্রের মনেই ক্রোধ ও উত্তেজনা কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছিল।

এমন উত্তেজনাপূর্ন  অবস্থায় ইহুদীগণ কর্তৃক মক্কাবাসীকে যুদ্ধের জন্যে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা ঠিক আগুনে তেল ছিটানোর মত কাজ করলো। ফলে বদর যুদ্ধের পর একটি বছর অতিক্রান্ত হতে না হতেই যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হল।

এক বছরের মধ্যে মক্কার কুরাইশদের যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। ৬২৫ সালের ১১ মার্চ ৩,০০০  যোদ্ধা নিয়ে গঠিত মক্কার বাহিনী, আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে মদিনার দিকে যাত্রা আরম্ভ  করে। এই বাহিনীর সাথে আরো ছিল ৩,০০০ উট এবং ২০০টি ঘোড়া ।

উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উতবাসহ মক্কার প্রায় ১৫ জন নারীও এই যুদ্ধক্ষেত্রে আগমন করে। কুরাইশ নেতাদের কাছে মন হত,  যে নারীরা সাথে থাকলে তাদের সম্মান রক্ষার জন্য যোদ্ধারা  আমরণ লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা পাবে।

মক্কার দলটি  সরাসরি মদিনা আক্রমণ করে নি।  শহরের নিকটে আকিক উপত্যকা অতিক্রম করে কিছুটা ডানে তারা  উহুদের নিকটবর্তী আয়নাইনে তাদের  শিবির স্থাপন করে। এ সময়ে হিন্দ বিনতে উতবা একটি ঘৃণিত   প্রস্তাব রাখেন।

তিনি অনুরোধ করেন যে, মুহাম্মাদ এর মায়ের কবর যাতে ধ্বংস করে দেয়া হয়। কিন্তু এর পরিণাম  খুবই ভয়াবহ হতে পারে।  মদীনার মুসলমানদের আগেই ক্ষেপিয়ে তোলা হবে  ভেবে নেতারা প্রস্তাবে সম্মতি জানাননি।

যুদ্ধে মদিনার প্রস্তুতি

৩ হিজরীর শাওয়াল মাসের ১ম সপ্তাহে হযরত (সা:) কয়েকজন লোককে যুদ্ধের সঠিক খবর সংগ্রহের জন্যে মদিনার বাইরে প্রেরণ করলেন। তারা ফিরে এসে জানাল যে, কুরাইশ বাহিনী মদিনার খুব কাছাকাছি চলে এসেছে। এমনকি তাদের সঙ্গে আনা ঘোড়গুলো মদিনার একটি চারণ ভূমি পর্যন্ত খেয়ে সাফ করে ফেলেছে।

অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পেরে, নবী করীস (সা:) সাহাবীদের কাছে পরামর্শ চাইলেন। কুরাইশ বাহিনীর মুকাবেলা কি মদিনায় বসেই করা হবে , নাকি বাইরে গিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করা হবে ?

এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক  হল। যুদ্ধের পদক্ষেপ নিয়ে মুসলিমদের মধ্যে বেশ কিছুটা মতপার্থক্য ছিল। মুহাম্মাদ (সঃ) সহ কিছু সাহাবীর মত ছিল শহরের ভেতর থেকেই প্রতিরোধ করা।

অন্যদিকে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিবসহ কিছু সাহাবির দাবি ছিল  বাইরে অগ্রসর হয়ে খোলা ময়দানে লড়াই করলে ভবিষ্যতে তারা সহজে আক্রমণ করতে সাহস করবে না। এর ফলে  সিন্ধান্ত হয় মদিনার বাইরে গিয়ে শত্রুর মোকাবেলার করা হবে।

যুদ্ধ প্রস্তুতি শেষে মুসলিমরা উপত্যকার শেষ প্রান্তের উহুদ পর্বতে শিবির স্থাপন করে। এই অবস্থানে মুসলিমদের সামনে  ছিল মক্কার বাহিনী।  আর  পেছনে ছিল উহুদ পর্বত।  অর্থাৎ মদিনা ও মুসলিম বাহিনীর মধ্যবর্তী স্থানে মক্কার বাহিনী অবস্থান করছিল।

উহুদ যুদ্ধে কতজন অংশ নেন

মদীনা থেকে যাত্রার সময়ে,  মুসলিম বাহিনীর মোট সেনাসংখ্যা ছিল ১,০০০। এর মধ্যে ১০০জন যোদ্ধা  বর্ম পরিহিত ছিল।  আর  ৫০জন যোদ্ধা  ছিল অশ্বারোহী। নবী করিম  (সঃ) মুসলিম বাহিনীকে মোট তিনভাগে বিভক্ত করেন। এগুলি হল,

  • মুহাজির বাহিনী,
  • আউস বাহিনী ও
  • খাজরাজ বাহিনী।

এই তিনটি বাহিনীর সেনাপতি ছিলেন,  মুসআব ইবনে উমায়ের, উসাইদ ইবনে হুজাইর ও হুবাব ইবনে মুনজির।

শুরুতে  ১,০০০ মুসলিমের বাহিনী মদিনা থেকে যুদ্ধের জন্য বের হয়। দলটি শাওত নামক স্থানে পৌছানোর পর, আবদুল্লাহ ইবনে উবাই তার ৩০০ অনুসারী নিয়ে দলত্যাগ করে। ইতিপূর্বে তিনি শহরের বাইরে গিয়ে যুদ্ধে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন।  এর ফলে মাত্র ৭০০ সৈনিক নিয়ে মুসলিমরা উহুদের পর্বতের দিকে যাত্রা শুরু করে।

উহুদ যুদ্ধের প্রারম্ভিক অবস্থা

যুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রারম্ভিক অবস্থায় আনসারদেরকে আবু সুফিয়ান একটি বার্তা পাঠান। বার্তায় জানান যে, তারা যদি মুহাজির মুসলিমদেরকে ত্যাগ করে তাহলে তাদের কোনো রকম  ক্ষতি করা হবে না।আর তাদের শহরও আক্রমণ করা হবে না। কিন্তু আনসাররা গর্বের সহিত এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে।

কুরাইশরা তাদের প্রতিটি  সৈন্যকে খুব দক্ষ  প্রশিক্ষণ দিয়েছিলো। যুদ্ধের সূচনা-পর্বেই কুরাইশ মহিলারা দফ বাজিয়ে অত্যন্ত  আবেগ ও উদ্দীপনাময় কবিতা আবৃতি করতে লাগলো। তারা তাদের  যোদ্ধদেরকে বদর যুদ্ধে নিহতদের রক্তের বদলা নেবার জন্যে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় অনুপ্রেরণা দিতে লাগল। এরপর শুরু হলো যুদ্ধ।

উহুদের যুদ্ধে মুনাফেকের প্রতারণা

কুরাইশগণ মদিনার  উহুদ পাহাড়ের পাদদেশে তাদের ছাউনি ফেলার  একদিন পর হযরত (সা:) জুম’আর নামাজ বাদ এক হাজার সাহাবী নিয়ে মদিনা থেকে রওয়ানা করলেন। এদের মধ্যে  ছিলেন এক বিশ্বাসঘাতক আবদুল্লাহ বিন উবাই। এ লোকটি দৃশ্যত মুসলমান ছিল।

তবে কার্যত ছিল একজন মুনাফিক। এর প্রভাবাধীনে  আরো অনেক মুনাফিক মুসলমানদের সঙ্গে যাত্রা করেছিল। কিছুদূর গিয়েই আবদুল্লাহ বিন উবাই তিন’শ লোক নিয়ে হঠাৎ বলল, ‘যুদ্ধ হবে না’ ।  এবং বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। এখন মাত্র সাত শ সাহাবী বাকী রইলেন। এমনি নাজুক অবস্থায় মুনাফিকদের এই ধোঁকা  ছিল গুরুতর মনস্তাত্ত্বিক আঘাতের শামিল ।

যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক লড়াই

মুসলিম বাহিনীর সেনাবিন্যাস

যুদ্ধক্ষেত্রে পৌছানোর  কিছু সময় পরই সেনাবিন্যাস করা হয়। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের ইবনে নুমানের নেতৃত্বে ৫০ জন দক্ষ তীরন্দাজের একটি দল করা হয়। এই দলটি  কানাত উপত্যকার দক্ষিণে মুসলিম শিবিরের পূর্বদক্ষিণে দেড়শো মি. দূরে জাবালে রুমাত নামক একটি ছোট পাহাড়ে অবস্থান করে।

তাদের কাজ ছিল মুসলিম বাহিনীকে পেছনের গিরিপথের দিক থেকে আক্রমণের হাত থেকে রক্ষা করা। তাদের  এই অবস্থানের কারণে বাম পার্শ্বেও আক্রমণের  ঝুঁকি  অনেকটাই কমে যায়। অন্যদিকে ডান  পার্শ্ব উহুদ পর্বতের কারণে পুরোপুরি  সুরক্ষিত ছিল।

এর ফলে মুসলিমদের প্রতিপক্ষের হাতে আবদ্ধ হওয়ার কোনো ঝুঁকি ছিল না।মুহাম্মাদ (সঃ) তার তীরন্দাজদের আদেশ করেন যাতে তিনি নির্দেশ দেয়ার পূর্ব পর্যন্ত তীরন্দাজরা কোনো অবস্থায় তাদের স্থান থেকে সরে না আসে।

বাকি সৈন্যদের আরো কয়েকটি ভাগে বিন্যস্ত করা হয়। মদিনা বাহিনীর ডান পাশের নেতৃত্ব মুনজির ইবনে আমর কে রাখা হয়। এবং বাম পার্শ্বের নেতৃত্ব দেয়া হয়, যুবাইর ইবনুল আওয়ামকে। মিকদাদ ইবনে আসওয়াদকে নিযুক্ত করা হয় যুবাইরের সহকারী হিসেবে। বাম পার্শ্বের যোদ্ধাদের দায়িত্ব ছিল মক্কার বাহিনীর ডান পার্শ্বের নেতৃত্বে থাকা খালিদ বিন ওয়ালিদের অশ্বারোহীদের প্রতিরোধ করা। এছাড়াও একদম সম্মুখসারিতে দক্ষ সব সৈনিকদের নিযুক্ত করা হয়।

মক্কার কুরাইশদের সেনাবিন্যাস

মক্কার বাহিনীর মূল অংশের নেতৃত্বে ছিলেন আবু সুফিয়ান। তিনি বাহিনীর একদম মধ্যস্থলে নিজ কেন্দ্র তৈরী করে নেন। এছাড়া বাম ও ডান পার্শ্বের নেতৃত্বে ছিলেন ইকরিমা ইবনে আবি জাহল এবং খালিদ বিন ওয়ালিদ।  পদাতিক সৈন্য  এবং তীরন্দাজদের নেতৃত্বে ছিলেন সাফওয়ান ইবনে উমাইয়া ও আবদুল্লাহ ইবনে রাবিয়াহ। আরবদের পুরনো রীতি অনুযায়ী বনু আবদ আদ-দার গোত্রের একটি দল মক্কার বাহিনীর পতাকা বহন করছিল।

মূল যুদ্ধ

মক্কার পক্ষে প্রথম আক্রমণ চালায় মদিনাত্যাগী আবু আমর। কিন্তু  মুসলিমদের অনবরত তীরের বৃষ্টিতে আবু আমর ও তার লোকেরা পিছু হটে মক্কার সারির পেছনের দিকে সরে আসে। এরপর মক্কার পতাকাবাহক তালহা ইবনে আবি তালহা  সরাসরি  দ্বন্দ্বযুদ্ধের আহ্বান করেন।

তার আহ্বানে  যুবাইর ইবনুল আওয়াম  এগিয়ে যান এবং তালহাকে হত্যা করেন।  যেহেতু মক্কার পতাকা বহনের দায়িত্ব তাদের পরিবারের উপর ন্যস্ত ছিল সেহেতু তালহার ভাই ও পুত্রসহ ছয়জন একের পর এগিয়ে আসে এবং প্রত্যেকেই নিহত হয়।

মুসলিমরা মক্কার সৈনিকদের সারি ভেঙে ফেলতে সক্ষম হয়। খালিদ বিন ওয়ালিদের নেতৃত্বে মক্কার অশ্বারোহীরা তিনবার মুসলিম বাহিনীর বাম পার্শ্বে আক্রমণ চালাতে চেষ্টা করে কিন্তু বেশি অগ্রসর হতে পারেনি।এর ফলে যুদ্ধক্ষেত্রে মুসলিমরা  খুবই সুবিধাজনক অবস্থান লাভ করে।

কিন্তু এসময় মুসলিম তীরন্দাজদের একটি বড় অংশ নির্দেশ অমান্য করে।  আর পাহাড় থেকে নেমে মূল বাহিনীর সাথে যোগ দেয়। ফলস্বরূপ বাম পাশের প্রতিরক্ষা  দুর্বল হয়ে পড়ে।মক্কার অশ্বারোহীরা এই সুযোগ কাজে লাগায়। বিশৃঙ্খল অবস্থায় অনেক মুসলিম মারা যায়।

মক্কার বাহিনীর আক্রমণের ফলে মুহাম্মাদ (সা.) ও আহত হন। আর তার একটি দাঁতও ভেঙে যায়। কিন্তু তখন একটি গুজব ছড়ায় যে তিনি নিহত হয়েছেন।

হিন্দ ও তার সঙ্গীরা এসময় মুসলিমদের লাশ টুকরো টুকরো করে। শহীদদের লাশের কান, নাক কেটে পায়ের গয়নার মত পরিধান করে। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হামজা ইবনে আবদুল মুত্তালিব বর্শার আঘাতে নিহত হয়েছিলেন। হিন্দ নিহত হামজার কলিজা বের করে চিবিয়েছিলেন।

মুসলিমরা  পর্বতে আশ্রয় নিলে, আবু সুফিয়ানের সাথে উমরের কিছু উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়  শুরু হয়। কথোপকথনের সময় আবু সুফিয়ান এই দিনকে সরাসরি বদরের প্রতিশোধ বলে নিশ্চিত   করেন। প্রতি উত্তরে উমর জানিয়ে দেন যে, মুসলিমদের নিহতরা জান্নাতি  এবং কাফির নিহতরা জাহান্নামি হবে।

এরপর মক্কার বাহিনী মক্কাভিমুখী হয়ে চলে যায়। আর মদিনার মুসলিমরা নিহত সৈনিকদেরকে যুদ্ধের ময়দানে দাফন করে দেন।

হযরত বেলাল (রাঃ) এর কাহিনী জানুন এখানে।

উহুদের যুদ্ধে কতজন সাহাবী শহীদ হন

উহুদের যুদ্ধ ৭০ জন সাহাবী শাহাদাত বরণ করেন। এর মধ্যে হামজাহ, মুসআব বিন উমাইর এবং হানযালা (রাঃ) ছিলেন অন্যতম। এছাড়াও উহুদ যুদ্ধে আরও যারা শহীদ হয়েছেন তাদের মধ্যে রয়েছেন জাবের (রাঃ) এর পিতা আব্দুল্লাহ্ বিন আমর বিন হারাম, আমর বিন ছাবেত,আমর ইবনুল জামুহ।

উহুদের যুদ্ধে প্রায় ২২-৩৭ জন কাফের নিহত হয়।

উহুদের যুদ্ধের ফলাফল

আমরা জানি প্রথম দিকে মুসলিমরা সুবিধাজনক স্থানে ছিল। কিন্তু  এক পর্যায়ে যুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ কুরাইশদের হাতে চলে যায়। বিশৃখল অবস্থায় পড়ে যায় মুসলিম সৈন্যরা।  এরপর তারা  পর্বতে জমায়েত হতে সক্ষম হয়। তবে  কুরাইশরা এরপর আর অগ্রসর হয়নি।

তাছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে বিজয়ীদের তিনদিন অবস্থানের যে  তৎকালীন রীতি ছিল তাও পালন করে নি। নিজদের মক্কায়  ফিরে যায় । ফলে যুদ্ধ শেষে মুসলিমদের তুলনামূলক বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়।  কিন্তু পরিশেষে কুরাইশদের সুবিধাজনক অবস্থান সত্ত্বেও যুদ্ধের ফলাফল অমীমাংসিত রয়ে যায়।

উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পরাজয়ের কারণ

ধন সম্পদের মোহ

উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের বিপর্যয়ের আর একটি বড় কারণ হলো, মুসলিমরা যুদ্ধের ঠিক মাঝখানেই সম্পদের মোহে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে কিছু  মুসলমানরা মালামাল  সংগ্রহে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল। তাদের  নেতা হযরত আবদুল্লাহ বিন জুবাইর বারবার তাদেরকে বিরত থাকার নির্দেশ দিলেন।

এবং হযরত (সা:) এর কথাও ক্ষনে ক্ষনে স্মরণ করিয়ে দিলেন। কিন্তু কতিপয় লোক ছাড়া কেউ তার কথায় কর্ণপাত করল  না। ফলে শত্রু মোকাবিলায় অনেকটাই ব্যর্থ হতে হল।

মুনাফিকের ধোঁকা

প্রথম দিকেই মুসলিমদের সাথে কিছু মুনাফিক যুদ্ধে অংশ নেয়। যারা একদম প্রাথমিক অবস্থায় যুদ্ধ থেকে পেছনে হটে যায়। তাদের এই প্রতারণা ছিল উহুদের যুদ্ধে মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার বড় একটি কারণ।

উহুদের যুদ্ধের শিক্ষা

আল্লাহর উপরে নির্ভরশীলতা

মুসলমানরা যখন যুদ্ধের জন্যে যাত্রা করেছিল ,তখন তাদের  যুদ্ধের সামান্তপত্র ছিল কম।আর এক তৃতীয়াংশ সৈন্যও বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। এই নাজুক পরিস্থিতিতে কিছু লোকের মনোবল খুব দ্রুত  ভেঙ্গে পড়তে লাগলো । এমন সময়ে আল্লাহর প্রতি ঈমান এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসা মুসলমানদেরকে দুশমনদের মুকাবেলায় এগিয়ে গেল।  এ উপলক্ষে হযরত মুহাম্মদ (সা:) মুসলমানদের কে  সান্ত্বনা প্রদান করেন।

এখানে মুমিনদেরকে শেষ বারের মতো বুঝিয়ে দেয়া হলো যে, প্রকৃতপক্ষে বস্তগত শক্তির ওপর ভরসা করা কোনো মুসলমানের কাজ নয়। তাদের শক্তির আসল উৎসই হচ্ছে মহান আল্লাহর প্রতি ঈমান।  এবং তার সাহায্যের ওপর ভরসা করা।

যুদ্ধক্ষেত্রে দৃঢ মনোবলের প্রয়োজনীয়তা

মানুষের সব রকম  দুর্বলতার উৎস হচ্ছে মৃত্যু-ভয়।  তাই এ যুদ্ধের মাধ্যমে  মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দেয়া হলো যে, তোমাদের মৃত্যু-ভয়ে পলায়ন করা নিতান্তই অর্থহীন। কারণ মৃত্যুর জন্যে নির্ধারিত সময় না আসা পর্যন্ত কোন প্রাণীই মৃত্যু বরণ না।

অন্য কথায় , আল্লাহর নির্ধারিত সময়ের আগে না কেউ মারা  যাবে না।  এ থেকে আমরা শিক্ষা পাই,  যে ব্যক্তি শুধু দুনিয়াদারির জন্যে তার শ্রম-মেহনত নিয়োজিত করে, তার যা কিছু প্রাপ্য তা সে দুনিয়ায়ই পেয়ে থাকে। আর যে ব্যক্তি আখিরাতের কল্যাণের জন্যে নিজেকে নিয়োজিত করে ,আল্লাহ তাকে আখিরাতেই প্রতিফল দান করবেন।

সুদ হারাম হবার তাৎপর্য

উহুদের যুদ্ধে সম্পদের মোহে আকৃষ্ট হবার কারণে যুদ্ধের মোড় ঘুরে গিয়েছিল।  তাই আল্লাহ তাআলা মুসলমানদের হৃদয় থেকে ধনের মোহ দূরীভূত করার উদ্দেশ্যে মোহ সৃষ্টির একটি বড় কারণকে নিশ্চিহ্ন করে দিলেন। অর্থাৎ এ সময়ে ইসলামে সূদকে সম্পূর্ণ  হারাম ঘোষণা করা হলো।

কারণ যরা সূদী কারবার করে, তাদের হৃদয়ে ধনের মোহ এমনি বদ্ধমূল হয়ে যায়। তাদের হৃদয় আর কোন মহৎ কাজের উপযোগী থাকে না। এই সূদের ফলেই মানুষের মনে লালসা, কার্পণ্য , আত্মকেন্দ্রিকতা এবং  ধনের মোহ সৃষ্টি হয়।

উহুদের যুদ্ধের গুরুত্ব

উহুদের  যুদ্ধর মাধ্যমেই পারস্য ও সিরিয়া বিজয়ের পূর্বে আরবদের যুদ্ধকৌশলের কিছু দিক স্পষ্ট হয়। ধারণা করা হয় আরবরা মূলত ঝটিকা আক্রমণ করে। তবে  এক্ষেত্রে তা হতে দেখা  যায় না। মক্কার বাহিনী এখানে অশ্বারোহীদের পরিপূর্ণ  ভাবে ব্যবহার করেছে।

মুহাম্মাদ (স.) সেনাপতি হিসেবে যুদ্ধে দারুন কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যা যুদ্ধকৌশলের শিক্ষা হয়ে থাকবে৷  উহুদ পর্বত কে  যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে বেছে নেয়া টাই  ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। খোলা ময়দানে লড়াইয়ের ফলে  পদাতিকদের  আক্রমণের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল।

তাই তিনি সৈন্যদের  পেছনের দিকে উহুদ পর্বতকে রেখে লড়াই করেন। এর ফলে পেছনের দিক থেকে আর কোনো আক্রমণ আসেনি।  অশ্বারোহী প্রধান বাহিনীর বিরুদ্ধে পদাতিক  বাহিনীর  লড়ায়ের কৌশল কেমন হওয়া উচিত এই যুদ্ধে তার নমুনা দেখতে পাওয়া যায়।

যেকোন যুদ্ধ কিংবা আন্দোলনে চালিকা শক্তিরুপে একজন কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব  থাকে। ইসলামী আন্দোলনের জন্যে নবীদের ভুমিকাও ছিল এমন৷ প্রিয় নবীর মহান ব্যক্তিত্ব হৃদয়ের  ভেতর জীবিত  থাকলেই কেবল মুমিনগণ  আল্লাহর দ্বীনের ঝাণ্ডা সমুন্নত করতে পারবে।

অন্যথায় নবীর প্রত্যক্ষ নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হলে তারা বিপর্যস্ত হবে। উহুদের যুদ্ধ থেকে আমরা এই বড় শিক্ষাটিই পাই। যেকোনো সংগ্রামে আল্লাহর ওপর ভরসা করা,  ইসলামি শরীয়ত মেনে চলা, নবীর দেখানো পথ অনুসরণ করাই মুমিনের কাজ।

আমরা আজকে উহুদের যুদ্ধের সমস্ত চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে উপস্থাপন করেছি। যাতে করে আপনি জানতে পারেন-  উহুদের যুদ্ধের কারণ ও ফলাফল। আশা করি এই ঘটনা থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা  নিজের বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে পারবেন। আর অন্যদের মাঝেও এই মহান যুদ্ধের তাৎপর্য এবং শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে পারবেন।

ধন্যবাদ সবাইকে।

এই লেখাটি পড়ে উপকৃত হয়ে আপনি যদি রেডিটুরিডিং ব্লগকে ডোনেট করতে চান তাহলে বিকাশ-০১৬১৪১৭১৭৬৫ অথবা নগদ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ অথবা ইউক্যাশ-০১৭১৪১৭১৭৬৫ এ আপনার ডোনেশন পাঠাতে পারেন।

অথবা,

আমাদের ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করেও আমাদের উৎসাহিত করতে পারেন। ইউটিউব চ্যানেল লিংক এখানে। আশা করি অবশ্যই ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে আমাদের সহযোগীতা করবেন। তাহলে আমরা উৎসাহিত হয়ে আরও লেখা পাবলিশ করব।

Previous articleহযরত বেলাল (রাঃ) – ইসলামের ইতিহাসের এক অনন্য ব্যক্তিত্ব
Next articleগুগল এ সর্বাধিক সার্চ করা ১০০০ প্রশ্ন – “Most Asked Questions On Google”
যে ব্যর্থ সে অজুহাত দেখায়, যে সফল সে গল্প শোনায়। আমি অজুহাত নয় গল্প শোনাতে ভালবাসি। আসুন কিছু গল্প শুনি, নিজের গল্প অন্যকে শুনাই।