আহমদ ছফা

স্পষ্টভাষী হিসেবেই সবার কাছে পরিচিত ও প্রিয় আহমদ ছফা । একাধারে ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার ও সাহিত্য এবং রাজনৈতিক  সমালোচক ছিলেন তিনি। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ও সলিমুল্লাহ খানসহ আরো অনেকের মতে, মীর মশাররফ হোসেন ও কাজী নজরুল ইসলামের পরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান লেখক হলেন আহমদ ছফা। সহজ ভাষায় সত্য তুলে ধরাতে গড়ে উঠেছে তার একটি আলাদা পাঠকশ্রেণী। যদিও এই সত্য ও বাকা কথায় সমালোচকও তৈরি করেছেন বেশ কিছু। কিন্তু তাতে কি? পাঠকের মনে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন তিনি। আজ আমরা তার সম্পর্কে কথা বলবো।

জন্ম- আহমদ ছফা

আহমদ ছফা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩০ শে জুন চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার হাশিমপুর ইউনিয়নের গাছবাড়িয়া গ্রামে। তাঁর পিতা হেদায়েত আলী এবং মাতা আসিয়া খাতুন। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আহমদ ছফা ছিলেন বাবা-মার দ্বিতীয় সন্তান।

সাহিত্য পর্যালোচনা -আহমদ ছফা

সাহিত্যের বেশ কয়েকটি শাখায় আহমদ ছফা তার পান্ডিত্য দেখিয়েছেন৷ ছোটগল্প, উপন্যাস, অনুবাদ, কবিতা, প্রবন্ধসহ  ৩০ টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন তিনি।

নিহত নক্ষত্র ও দোলে আমার কনকচাঁপা

তার রচিত ‘নিহত নক্ষত্র’ ছিলো একটি গল্পগ্রন্থ। যেখানে বেশ কিছু ছোট গল্পে মানুষ ও সমাজের পতনকে ইঙ্গিত করেছেন। সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা আমাদের কাছে নক্ষত্রতুল্য৷ তাদেরকে আমরা সম্মান করে থাকি, দোষত্রুটির উর্ধে মনে করে থাকি। কিন্তু সেই মানুষগুলোও যে পরিস্থিতির শিকার হয়ে পতন হতে পারে প্রতিটি গল্পের মূলভাব যেন তাই প্রকাশ করে।  আরেকটি গল্পগ্রন্থ ‘দোলে আমার কনকচাঁপা’ গ্রন্থে ন্যায় অন্যায়ের গল্প লিখেছেন আহমদ ছফা। আছে গ্রামীণ পরিবেশে কৈশোরের স্বপ্নের গল্প।

প্রথম উপন্যাস-সূর্য তুমি সাথি

‘সূর্য তুমি সাথি’ আহমদ ছফা রচিত প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসটিতে আহমদ ছফা সাম্প্রদায়িক সম্প্রতির দেশভাগের সময়কার গ্রাম্য কুসংস্কার, আর্থ-সামাজিক অবস্থা তুলে ধরেছেন

বিখ্যাত উপন্যাস-ওঙ্কার

‘ওঙ্কার’ উপন্যাসটি খুব ছোট একটি লেখা অথচ এর ভাব গাম্ভীর্য যেন আমাদের জাতীয়সত্তাকে নাড়িয়ে দেয়। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বাংলা ভাষার প্রতি মানুষের অসীম ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ এই ছোট উপন্যাসটি।

একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন

‘একজন আলি কেনানের উত্থান-পতন’এ লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে আমাদের দেশে রাজনৈতিক শক্তিকে ব্যবহার করে মানুষের ভাগ্যের উত্থান ও পতন হয়।

মরণবিলাস

মরণবিলাস‘ এ চিত্রায়িত হয়েছে মৃত্যুশয্যায় এক মন্ত্রী যে তার রাজনৈতিক অনুসারী মাওলা বক্সের কাছে তার সারা জীবনে কৃত অপকর্মের বর্ণনা দেয়। মন্ত্রীর অপকর্মগুলো খুন, ব্যভিচার, ও সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘিরে আবর্তিত হয়।

পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ

পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ একটি আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। জাপানি ভাষায় পুষ্প বৃক্ষ এবং বিহঙ্গপুরাণ উপন্যাসের অনুবাদ প্রকাশ পায় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে । পুষ্প, বৃক্ষ, বিহঙ্গ ঘুরে সুশীল সমাজের ব্যবচ্ছেদ হয়েছে তার এই উপন্যাসে।

বাঙালি মুসলমানের মন

‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধটিতে হাজার বছরের বাঙালির ধর্মীয় বিশ্বাস ও কর্মের মাঝে ব্যবধান টুকু তুলে ধরেছেন। বাঙালি মুসলমানদের পিছিয়ে পড়ার কারণ বিশ্লেষণের কারণে গ্রন্থটি পাঠক সমাজে প্রচুর আলোচিত।

বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস

‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’এ বাংলাদেশের মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তা চেতনা অঙ্কনের পাশাপাশি এদের বুদ্ধিজীবীদের নিজস্ব জায়গা থেকে সরে যাওয়ার চরম সমালোচনা করা হয়েছে। তাদের আসল রুপ তুলে ধরার কারণে অনেকের চোখের বিষ হয়েছেন আহমদ ছফা।

গাভী বিত্তান্ত

তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অরাজকতাকে পটভূমি করে লিখেছিলেন ‘গাভী বিত্তান্ত’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে টেন্ডার বাজি, শিক্ষক প্যানেলের অযৌক্তিক আবদার পূরণসহ  অসংখ্য বিষয় ব্যঙ্গাত্মকভাবে তুলে ধরেছেন

আহমদ ছফা ও তার বিচিত্র কর্মকাণ্ড

ঘটনা-০১

একদিন হুমায়ুন আহমেদ দাঁড়িয়ে আছেন,দেখলেন আহমদ ছফা রিক্সায় করে যাচ্ছেন, শুকনা মুখ। হুমায়ুন আহমেদ জিজ্ঞেস করলেন, ছফা ভাই কী ব্যাপার?

,আহমদ ছফা বললেন, না খেয়ে ঘুরতেছি সারাদিন থেকে!

-কেন?

-ক্ষুধা নিয়ে একটা গল্প লিখবো। তাই ক্ষুধা অনুভব করার জন্য সকাল থেকে না খেয়ে ঘুরতেছি।

এরপর সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত না খেয়ে ঘুরলেন,রাত আটটায় অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন রিক্সা থেকে। এই হলো আহমদ ছফা

ঘটনা-০২

একবার ড.আব্দুল হাই আহমদ ছফার নাম পাল্টাতে বলেছিলেন, ছফা তাকে জবাবও দিয়েছিল।

উনি বলছিলেন- ‘ছ’ ‘ট’ চলবে না ‘স’ দন্ত্যস দিয়ে লিখতে হবে।’

ছফা বলেছিলেন- ‘স্যার, আমি সাত বোনের পরে একটা ছেলে, ভাই জন্মাইছি এবং জন্মের পরে আমার আঁকিকাতে সাতটা গরু জবাই করা হয়েছে। সুতরাং আপনার অপছন্দের জিনিস বলে এইটা কাটা যাবে না’

ঘটনা-০৩

আহমদ ছফাকে যেন বাংলা একাডেমী পুরস্কার দেওয়া হয় সেজন্য তলব করেছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। আহমদ ছফা সেই পুরস্কার নেননি, উল্টো হুমায়ূন আহমেদকে বলেছেন- হুমায়ূন, তোমার এত্তবড় সাহস! তুমি আমার জন্য তলব করো পুরস্কারের?

ঘটনা-০৪

আনিস সাবেতের বোনের বিয়ে কুমিল্লা গিয়েছিলেন আহমদ ছফা। কথা চলাকালিন আনিস সাবেত তার একটি উপন্যাস নিয়ে মন্তব্য করেন যা আহমদ ছফার পছন্দ হয়নি। তিনি কথাটি উইথড্র করার জন্য আনিস সাবেতকে অনুরোধ করেন। অন্যথায় ঢাকায় ফেরার হুমকি দেন। এত রাতে গাড়ি পাবেন না ভেবে আনিস সাবেত কথাটি উইথড্র করলেন না। ফলে ছফা পায়ে হেটেই ঢাকায় রওনা করলেন। পথিমধ্যে তার মাথায় একটি উপন্যাসের প্লট চলে আসে। আর সেটি হলো ‘ওঙ্কার’।

ঘটনা-০৫

হুমায়ূন আহমেদের বাবা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। শহীদ পরিবার হিসেবে সরকার থেকে থাকার জন্য বাড়ি পেয়েছিলেন। কিন্তু একটা মহল সরকারের দেয়া বাড়ি থেকে তাদের উঠিয়ে দিতে চাইলে আহমদ ছফা তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেন। পরে আগুন লাগিয়ে দেয়ার হুমকিও দিয়েছিলেন। তার সেই সাহসি কর্মকান্ডের কারণে পরবর্তীতে হুমায়ূন আহমেদ তাদের থাকার জায়গাটি ফেরত পেয়েছিলেন।

ঘটনা-০৬

কলকাতার বই যেন বইমেলায় না প্রবেশ করেন সেজন্য আন্দোলন করেছেন ছফা। এজন্য শওকত ওসমান তাকে বাজে লোক বলেছিলেন। পরে ছফা তাকে নীলক্ষেত নিয়ে গিয়ে দোকানদারদের শওকত ওসমানের নাম জিজ্ঞেস করলে কেউ চিনতে পারেনি।

আহমদ ছফাকে নিয়ে অন্যদের মন্তব্য

মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতে, আহমদ ছফা ‘চুলের ডগা থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত একশ ভাগ খাঁটি সাহিত্যিক’। জাফর ইকবাল আরও লিখেছেন, ‘আমাদের বড় সৌভাগ্য তাঁর মতো একজন প্রতিভাবান মানুষের জন্ম হয়েছিল।’

জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতে, ‘ছফার রচনাবলি গুপ্তধনের খনি এবং তার সাহিত্যকর্ম স্বকীয় এক জগতের সৃষ্টি করে, যে জগতে যেকোনো পাঠক হারিয়ে যেতে পারে।’

আলতাফ শাহনেওয়াজ এক সাক্ষাৎকারে বলছিলেন যে-‘ আহমদ ছফা হলেন বাংলাদেশের গোপাল ভাঁড়! আহমদ ছফা যদি রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ে আমলে জন্মাতেন তাহলে তিনি গোপাল ভাঁড় হতেন আর গোপাল ভাঁড় যদি এই সময়ে জন্মাতেন তাহলে আহমেদ ছফা হতেন।

হুমায়ূন আহমদ আহমদ ছফাকে ‘অসম্ভব শক্তিধর একজন লেখক’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাঁকে নিজের মেন্টর বলে উল্লেখ করেছেন।

আহমদ শরীফ বলেছিলেন ‘সুবিধাবাদীর ‘Life is a compromise’ তত্ত্বে ছফার আস্থা নেই। আজকের বাংলাদেশে এমনি স্পষ্ট ও অপ্রিয়ভাষী আরো কয়েকজন ছফা যদি আমরা পেতাম, তাহলে শ্রেয়তর পথ স্পষ্ট হয়ে উঠত।’

উক্তিতে আহমদ ছফা

আমরা অনেকেই লেখকদের করা নানা উক্তি পছন্দ করে থাকি৷ লেখকরা লেখার সময় তাদের নিজস্ব চিন্তা চেতনা উক্তির মাধ্যমে প্রকাশ করে থাকেন। চলুন তেমন কিছু উক্তি জেনে নেয়া যাক।

  • মানুষ যখন নিজের উপর সুবিচার করতে পারে না তখন এটা ওটা করে মানসিক ক্ষতি পূরণ করার চেষ্টা করে
  • আল্লাহ যাই করেন, বান্দা বিনা প্রতিবাদে মেনে নেওয়া ছাড়া কি করতে পারে।
  • পলিটিক্স করতে হলে বিদ্যাবুদ্ধির চাইতে ঘ্রাণ শক্তিটার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি
  • সমস্ত সাফল্য এবং প্রতিষ্ঠার পেছনে সবসময় একধরণের নিষ্ঠুরতা আত্নগোপন করে থাকে
  • গ্রামদেশে যখন কেউ কারো আন্তরিকতার প্রশংসা করে, সম্ভব অসম্ভব সব কিছুর সীমা ছাড়িয়ে যায়
  • মানুষের মন বড় আজব চিজ, কখনো এক জায়গায় থিতু দাঁড়িয়ে থাকে না
  • তোমার মনকে উন্নত করো তাহলে তোমার আত্নবিশ্বাদ আপনা থেকেই বেড়ে যাবে
  • মেরুদণ্ড বিশিষ্ট মানুষ চেষ্টা করলে সুন্দরভাবে অবশ্যই কাজ সম্পন্ন করতে পারে
  • সাম্যবাদী হওয়া মানে সাহস করা,চিন্তা করা,আশা করা এবং বিশ্বাসকে বাস্তবে রুপ দেয়ার দুঃসাহস পোষণ করা
  • বাংলাদেশে এতো পীর-ফকির- মাজার ভক্তবৃন্দদের গানের শক্তিতেই টিকে আছে
  • মাজারে যারা থাকে তাদের সকলের না হলেও অনেকেরই আলাদা একটি ভূগোল আছে
  • এই দেশে সমাজপতিদের যা করা সম্ভব তা না করে অসম্ভবের পেছনে ধাওয়া করাটাই প্রায় একরকম নেশায় পরিণত করে ফেলেছেন
  • ব্যক্তি ভালো কাজ করল অথচ সমাজে তারিফ করার কেউ রইলো না, মন্দ কাজ করল কেউ ধিক্কার ধ্বনি তুলল না,বুঝতে হবে সমাজে তখন অবক্ষয় চলছে
  • কবিতাতে মনের সূক্ষ্মতম চিন্তাও যত সহজে প্রকাশ করা যায়, গল্প, উপন্যাস, নাটকে তা প্রকাশ করতে অনেক বেশি জবাবদিহি করার কাজ একই ব্যক্তির পক্ষে করা অসম্ভব।

মৃত্যু

২০০১ খ্রিষ্টাব্দের আটাশে জুলাই অসুস্থ অবস্থায় ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। পরদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদে জানাজা শেষে মিরপুরের বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে তার দাফন হয়।

তিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যজগতের অনুপ্রাণিত একজন স্রষ্টা। যার কর্মের মাধ্যমে লেখক, শিল্পী, বুদ্ধিজীবী, চলচ্চিকরসহ অনেকে উৎসাহ পেয়েছেন প্রতিনিয়ত। যদি নাম বলা হয় তার মধ্যে অন্যতম আছেন হুমায়ূন আহমেদ, ফরহাদ মজহার, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, তারেক মাসুদ, সলিমুল্লাহ খানসহ অনেকে। তাকে বলা হয় স্বাধীন বাংলাদেশের সর্বোত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ বুদ্ধিজীবী।

Previous articleফরেক্স ট্রেড শিখুন আর ঘরে বসে আয় করুন অনলাইনে পর্ব -০২
Next articleহাইপোথাইরয়েডিজম সমস্যায় ভুগছেন না তো?
Rasel Khan
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।

2 COMMENTS

  1. খুব ভাল লেখা। আমি উনাকে খুব পছন্দ করি উনার সৎ সাহসের জন্য।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here