Alexander the great

ইতিহাসে অনেক আলোচিত বিজেতার নাম স্থান করে নিয়েছে। আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট  তেমনি এক বহুল আলোচিত বিজেতার নাম। যিনি খুব কম বয়সেই জাদুকরী অর্জন দেখিয়েছিলেন৷ সুদূর গ্রীস থেকে যিনি জয় করেছিলেন ভারতবর্ষ পর্যন্ত। মাত্র ৩২ বছর বয়সে নাম লিখিয়েছিলেন অপরাজেয় জেনারেলদের দলে। তার সংক্ষিপ্ত জীবনের আশ্চর্যজনক জয় ও তার জীবন সম্পর্কে জানতে আশা করি লেখাটি সাহায্য করবে রেডিটুরিডিং ব্লগের পাঠকদের।

আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট-  জন্ম ও পরিবার

খ্রীস্টপূর্ব  চারশো বছর আগের কথা। গ্রিস তখন ছোট ছোট রাষ্ট্রে বিভক্ত ছিলো। তেমন একটির অধিপতি ছিলো ফিলিপ।  ফিলিফ ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী, সাহসী, বীর ও রণকুশলী। সিংহাসনে বসে সুদক্ষ সেনাবাহিনী তৈরি করতে খুব বেশি সময় লাগেনি তার৷ তার ঘরেই জন্ম নেয় জগৎ খ্যাত আলেকজান্ডার। বলা হয়ে থাকে আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব  ৩৫৬ সালে আলেকজান্ডারের জন্ম। তার মা ছিলেন কিছুটা অস্বাভাবিক প্রকৃতির। সম্রাট ফিলিপকে তিনি প্রসন্নভাবে গ্রহণ করতে পারেনি।

আরও পড়ুনঃ অটোম্যান সাম্রাজ্যের পতনের কারণ।

শৈশব ও শিক্ষা

ছেলেবেলা থেকেই আলেকজান্ডারের দেহ ছিলো সুগঠিত।বাদামি চুল, হালকা রং। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক বিষয় ছিলো তার শরীর থেকে এক প্রকার সুগন্ধ বের হতো। সমকালীন অনেকেই বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।

শৈশবে আলেকজান্ডারকে লানিকে নামক একজন সেবাব্রতী পালন করেন। পরে অলিম্পিয়াসের আত্মীয় লিওনাইদাস এবং দ্বিতীয় ফিলিপের সেনাপতি লুসিম্যাকোস শিক্ষাপ্রদান করেন। অন্যান্য সম্ভ্রান্ত ম্যাসিডনীয় কিশোরদের মতই তাকে পড়া, যুদ্ধ করা, শিকার করা প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষাপ্রদান করা হয়।

তেরো বছর বয়স হলে দ্বিতীয় ফিলিপ আলেকজান্ডারের শিক্ষার জন্য আইসোক্রাতিস ও স্পিউসিপাস নামক দুইজন গ্রিক শিক্ষাবিদকে গণ্য করেন কিন্তু তারা এই কাজে অস্বীকৃত হন।

অবশেষে দ্বিতীয় ফিলিপ গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে আলেকজান্ডারের শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেন এবং মিয়েজার মন্দিরকে শ্রেণীকক্ষ হিসেবে প্রদান করেন। আলেকজান্ডারকে শিক্ষাপ্রদান করায় দ্বিতীয় ফিলিপ অ্যারিস্টটলের শহর স্তাগেইরা পুনর্নির্মাণের ব্যবস্থা করেন। তিনি এই শহরের সকল প্রাক্তন অধিবাসী যারা দাস হিসেবে জীবনযাপন করছিলেন, তাদের ক্রয় করে মুক্ত করেন ও নির্বাসিতদের শাস্তি মুকুব করেন।

মিয়েজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আলেকজান্ডারের সাথে প্রথম টলেমি সোতের, হেফাইস্তিওন, কাসান্দ্রোস ইত্যাদি ম্যাসিডোনিয়ার সম্ভ্রান্ত পরিবারের কিশোরেরা শিক্ষালাভ করেন, যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরবর্তীকালে আলেকজান্ডারের বন্ধু এবং সমর অভিযানের সেনাপতি হিসেবে পরিগণিত হন।

অ্যারিস্টটল তাদের চিকিৎসাবিদ্যা, দর্শন, নীতি, ধর্ম, তর্কবিদ্যা ও কলা সম্বন্ধে শিক্ষাপ্রদান করেন। তার শিক্ষায় আলেকজান্ডারের হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যের প্রতি প্রগাঢ় প্রেমের উন্মেষ ঘটে, যা তিনি তার ভবিষ্যতের সকল অভিযানে সঙ্গে নিয়ে যেতেন।

আলেকজান্ডারের ক্ষমতা গ্রহণ

আলেকজান্ডারের বয়স যখন ১৬, তখন ফিলিপ বাইজানটাইন অভিযানে বের হন। যাওয়ার আগে ক্ষমতা দিয়ে যান আলেকজান্ডারের কাছে। ফিলিপের অনুপস্থিতিতে আশেপাশের কিছু রাষ্ট্র বিদ্রোহ ঘোষণা করে। কিশোর আলেকজান্ডার সেই বিদ্রোহ কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন।

পরবর্তীতে ফিলিপের সাথে সম্পর্ক খারাপ হতে থাকে আলেকজান্ডারের। বলা হয়ে থাকে এর পিছনে তার মায়ের প্ররোচনা রয়েছে। ফিলিপ যখন আততায়ীর হাতে নিহত হন তখন আলেকজান্ডারের বয়স বিশ বছর। ফিলিপ নিহত হওয়ার পরেই সিংহাসন অধিকার করেন আলেকজান্ডার।

আলেকজান্ডারের অভিযান

ক্ষমতা গ্রহণের সময়ে ম্যাসিডোনিয়ার চতুর্দিকে শত্রুরাষ্ট্র। সবাই যখন আলেকজান্ডারকে মিত্র সম্পর্ক স্থাপনে উৎসাহ দিলো তখন তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে বিশাল সেনাবাহিনী গঠন করে সেই রাষ্ট্রগুলো জয় করে নিলেন। প্রথমে জয় করেন থেবেস৷ সেখান থেকে কর্নিথ। বাড়তে থাকে তার সেনাবাহিনীর আকার৷ তারপর আক্রমণ করলেন পারস্য।

তখন পারস্য ছিলো সবচেয়ে উন্নত ও শক্তিশালী সাম্রাজ্য। যে কেউ পারস্য আক্রমণে ১০০ বার চিন্তা করতো। খ্রীস্টপূর্ব ৩৩৪ সালে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে পারস্য আক্রমণের জন্য যাত্রা করেন। হেলসম্পটে এলে পারস্য সম্রাটের সেনাবাহিনীর সাথে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে দারিয়ুস পলায়ন করে।

কিন্তু পরবর্তীতে দারিয়ুস  আবার আক্রমণ করে আলেকজান্ডারকে। কিন্তু দারিয়ুসের সৈন্যদের মধ্যে ছিলো সংহতির অভাব। তাছাড়া তারা রণকুশলীয়ও ছিলেন না আলেকজান্ডারের মত।

এবারো পরাজিত হয়ে স্ত্রী পরিবার সহ দারিয়ুস পালিয়ে গেলে পারস্য অধিকার করেন আলেকজান্ডার। সেই সময় পার্সেপোলিশ ছিলো পারস্যের রাজধানী শহর৷ পৃথিবীর অন্যতম সমৃদ্ধ শহর হিসেবে পরিচিত ছিলো নগরটি। সব সম্পদ অধিকারে নিয়ে বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দিলেন।

তারপর  সিরিয়া ও মিশর জয় করেন৷ সমুদ্র বেষ্টিত শহর জয় করে অসাধারণ সামরিক কৌশলের পরিচয় দেন।  তায়ার ধ্বংস করার পর মিশর অভিমুখী অধিকাংশ শহর দ্রুত সমর্পণ করে। আলেকজান্ডার জেরুজালেম শহরের কোন ক্ষতি না করে দক্ষিণে মিশরের দিকে যাত্রা করেন।

আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট
আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট

কিন্তু গাজা শহরে তাকে প্রচন্ড বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত সুরক্ষিত এই শহর অধিকার করতে তিনবার চেষ্টা করে সফল হলেও আলেকজান্ডার তার কাঁধে গুরুতর ভাবে আহত হন। টায়ারের মতোই গাজা শহরের সকল কর্মক্ষম পুরুষদের হত্যা করে নারী ও শিশুদের দাস হিসেবে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

৩৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্ডার মিশর অভিমুখে যাত্রা করলে তাকে মুক্তিদাতা হিসেবে স্বাগত জানানো হয়। লিবিয়ার মরুভূমিতে সিওয়া মরুদ্যানেতাকে দেবতা আমুনের পুত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। আলেকজান্ডারের স্বর্গীয় ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করতে মুদ্রায় তার প্রতিচ্ছবিতে তার মাথায় ভেড়ার শিং থাকত। মিশরে থাকার সময় তিনি আলেকজান্দ্রিয়া প্রতিষ্ঠা করেন।

হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতবর্ষে প্রবেশ করেন আলেকজান্ডার। সেখানে ছিলো অসংখ্যো ছোট ছোট রাষ্ট্র৷ তারা নিজেরা লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকতো। আলেকজান্ডার পুষ্কলাবতী নগর দখল করে নিলে আশেপাশের সব রাজারা বশ্যতা স্বীকার করেন নেন।

কিন্তু রাজা পুরু যুদ্ধ চালিয়ে যান।  আলেকজান্ডারের রণনিপুণ বাহিনির কাছে পরাজিত হয় পুরু। তাঁকে আলেকজান্ডারের কাছে নিয়ে আশা হলে আলেকজান্ডার পুরুকে প্রশ্ন করলো, “আপনি আমার কাছে কেমন ব্যবহার আশা করেন?’ পুরু জবাব দিলো, “একজন রাজা অন্য রাজা থেকে যে ব্যবহার আশা করেন, আমিও সেই ব্যবহার আশা করি।“ পুরুর বীরত্ব, তাঁর নির্ভীক উত্তর শুনে এতখানি মুগ্ধ হলেন যে, তাঁকে মুক্তি দিয়ে শুধু তাঁর রাজ্যই ফিরিয়ে দিলেন না , বন্ধুত্ব স্থাপন করে আরো কিছু অঞ্চল উপহার হিসেবে দিয়ে দিলেন।

আলেকজান্ডার ও ডায়েজেনিস

যখন আলেকজান্ডার কর্নিথে ছিলেন, দেশের সমস্ত জ্ঞানীগুণী মানুষেরা নিয়মিত তাকে অভিনন্দন জানাতে আসত। কিন্তু আলেকজান্ডার মহাজ্ঞানী ডায়েজেনিসের সাথে সাক্ষাতের জন্য উৎসুক হয়ে উঠেছিলেন।  তিনি আলেকজান্ডারের কাছে গেলেন না৷ শেষে আলেকজান্ডার নিজেই গেলেন তাঁর কাছে। বাড়ির সামনে একটি খোলা জায়গায় শুয়ে রোদ পোহাচ্ছিলেন বৃদ্ধ দার্শনিক। আলেকজান্ডার তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললেন, আপনি কি আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করেন?

ডায়েজেনিস শান্ত স্বরে বললেন, “আপনি আমার আর সূর্যের মাঝে আড়াল করে দাঁড়াবেন না, এবং বেশি আর কিছু প্রার্থনা করি না।” সামান্যতম ক্রুদ্ধ হলেন না আলেকজান্ডার। বৃদ্ধ দার্শনিকের নির্লোভ স্পষ্ট উত্তর শুনে শ্রদ্ধায় বলে উঠলেন, আমি যদি আলেকজান্ডার না হতাম তাহলে ডায়েজেনিস হতে চাইতাম।

আলেকজান্ডারের মৃত্যু

ক্রমাগত যুদ্ধের ফলে সৈনিকরা ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। তারা তাদের নিজ গৃহে ফিরে যেতে আগ্রহ প্রকাশ করে৷ তাই ইচ্ছা থাকলেও আর অগ্রসর হওয়া সম্ভব হয়নি আলেকজান্ডারের৷ অনিচ্ছা সত্ত্বেও স্বদেশে ফেরার পথে ব্যাবিলনে বিশ্রাম নেন তারা। কিন্তু ২রা জুন খ্রিস্টপূর্ব ৩২৩ সালে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ১১ দিন পর মারা যান আলেকজান্ডার। ম্যালেরিয়াতে মারা যায় বলে অনেকেই ধারণা করে থাকলেও কেউ কেউ বিষ প্রয়োগে হত্যার অনুমান করে থাকে।  মৃত্যু সময় তার বয়স হয়েছিলো ৩২, মতান্তরে ৩৩।

মৃত্যুশয্যায় বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার তাঁর সেনাপতিদের ডেকে বলেছিলেন, “আমার মৃত্যুর পর আমার তিনটা ইচ্ছা তোমরা পূরণ করবে।এতে যেন কোনো ব্যত্যয় না ঘটে। আমার প্রথম অভিপ্রায় হচ্ছে, শুধু আমার চিকিৎসকেরা আমার কফিন বহন করবেন। এতে মানুষ যেন বুঝতে পারে চিকিৎসকরা জীবন দিতে পারে না।

আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট
মৃত্যু শয্যায় আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট

আমার দ্বিতীয় অভিপ্রায়, আমার কফিন যে পথ দিয়ে গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে, সেই পথে আমার কোষাগারে সংরক্ষিত সোনা, রুপা ও অন্যান্য মূল্যবান পাথর ছড়িয়ে দিতে হবে। এতে মানুষ যেন বুঝতে পারে এত ধন সম্পদ কিছুই জীবন রক্ষা করতে পারে না।

আমার শেষ অভিপ্রায়, আমার কফিন বহনের সময় আমার দুই হাত কফিনের বাইরে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। যেন মানুষ বুঝতে পারে এত সব মহা মূল্যবান সম্পদের কিছুই আমার সাথে যাচ্ছে না।”

নিরপেক্ষতা বিচারে আলেকজান্ডার কে নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে৷ কেউ কেউ তাকে শুধু ধ্বংসের কারিগর হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন৷ তবে তার সামরিক কৌশল ও সাহসিকতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন নেই।

Previous articleডিজিটাল মার্কেটিং কি ? কিভাবে ডিজিটাল মার্কেটিং করবেন?
Next articleকফি সমাচার- বিভিন্ন ধরনের কফি রেসিপি
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।