ভাইকিং নামটি শুনলেই মনের অজান্তে আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে ইয়া লম্বা, সুঠাম, পেশীবহুল যুদ্ধবাজ ডাকাত কিংবা জলদস্যুদের একটা প্রতিচ্ছবি। গোটা বিশ্বে এরা এতটাই সুপরিচিত যে বিভিন্ন টুরনামেন্টের দলের নামে ভাইকিংস শব্দের ব্যবহার বেশ প্রচলিত। কিন্তু এরা আসলে কারা? এরা কি রুপকথার কোন চরিত্র? পৃথিবীতে আদৌ কি তাদের অস্তিত্ব ছিল? নাকি এরা শুধু গল্পের চরিত্র? সত্যি বলতে কি ভাইকিংসরা আমাদের এই পৃথিবীরই একটি জাতি যারা কলম্বাসের চেয়েও অন্তত ৫০০ বছর আগে আমেরিকা আবিস্কার করেছিল- এখন ইতিহাসবিদদের দ্বারা একথা প্রমানিত সত্য। মূলত আমেরিকার ইতিহাস পড়তে গিয়েই ভাইকিংদের সম্পর্কে জানতে পারি। ভাইকিংদের রয়েছে এক চমৎকার ইতিহাস যা না জানলে আপনার জ্ঞান অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে বলে আমার বিশ্বাস, আসুন জেনে নেই-
ভাইকিংদের নিয়ে জানতে নিচের ভিডিও দেখে জেনে নিন অজানা যত তথ্য
কারা ছিল ভাইকিং- কোথায় ছিল এদের বসবাস
এরাবিয়ান, ইউরোপিয়ান কিংবা বাংগালি জাতির মতই ভাইকিংরাও এক নৃতাত্ত্বিক জাতি। ভাইকিং শব্দটি এসেছে ভিক থেকে যার অর্থ উপসাগর। এথেকে আমরা বুঝতে পারি এদের সাথে সমুদ্রের একটা সম্পর্ক রয়েছে। আসলেই তাই। উত্তর ইউরোপের স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল মানে বর্তমান নরওয়ে, সুইডেন আর ডেনমার্ক ছিল ভাইকিংদের আদি নিবাস। ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পরে ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে। তারা নির্দিষ্ট কোন রাজার অধীনে থাকতনা বরং তারা ছিল গোত্র নির্ভর।রাশিয়ানদের পূর্বপুরুষ এই ভাইকিংরা। সুইডেনের রাস নামক এক ভাইকিং গোত্রের নাম থেকেই রাশিয়া শব্দের উৎপত্তি। উত্তরের মানুষ হিসেবে তারা নরম্যান বা নর্থম্যান নামেও তারা পরিচিত ছিল।
ভৌগলিক কারনে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চল ছিল শীত প্রধান দেশ, মাটি ছিল ভয়াবহ রুক্ষ, উর্বরতা ছিলনা বললেই চলে। অধিকাংশ ভাইকিংরা কৃষি কাজের সাথে যুক্ত থাকলেও একসময় তাদের পক্ষে কঠিন হয়ে যায় কৃষিকাজ করে টিকে থাকা। তাই একসময় অনেকটা বাঁচার তাগিদেই তারা সাগর পাড়ি দিয়ে অন্যদেশে লুটপাট আর দখলে অভ্যস্ত হয়ে যায়। লুটের মাল যত বেশি হবে তত আরামে কাটবে তাদের শীতের মৌসুম, একারনে লুটের কাজে তারা ছিল নির্মম আর অসভ্য। ইউরোপের মানুষ ভাইকিং নামটি এতই ভয় পেত যে, তারা মনে করত ভাইকিং এর পাল্লায় কেও পড়লে তার মৃত্যু নিশ্চিত। জলদস্যু হিসেবে এরা এতটাই নাম কামিয়েছিল।
ভাইকিংরা শারীরিকভাবে ছিল প্রচন্ড শক্তিশালী, লম্বা এবং পরিশ্রমী এবং প্রখর মেধার অধিকারী। মজার ব্যাপার হল ভাইকিংরা ছিল মূর্খ জাতি, যেকারনে তাদের কোন লিখিত ইতিহাস নেই। তবে তারা বিভিন্ন নৌযান তৈরিতে তারা ছিল অভিজ্ঞ। প্রথম দুই শতাব্দি তারা ছিল বহু দেবদেবীর উপাসক কিন্তু পরবর্তীতে তারা আসেপাশের দেশের খৃস্টধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভাইকিংদের দেব-দেবতাদের মাঝে ওডীন, থর, টাইর, লোকি, ম্যানি, সাগা প্রমুখ উল্লেখ্য। সপ্তাহের সাতদিনের ইংরেজি নামের ছয়দিনই ভাইকিংদের দেব-দেবীর নামের সাথে জড়িত।
ইতিহাসে ভাইকিংরা ধূর্ত ব্যবসায়ি, অকুতোভয় যোদ্ধা এবং জলদস্যুদের একটি দল হিসেবেই বিশেষ পরিচিত। আর এরাই ধীরে ধীরে পতন ঘটায় ইংল্যান্ড, ফ্রান্সের মত ক্ষমতাধরদের।
যুদ্ধবাজ ভাইকিংদের যুদ্ধজাহাজ
জানলে অবাক হতে হয়, ভাইকিংরা ছিল মূর্খ এক জাতি কিন্তু যুদ্ধে এবং সমুদ্রপথে তারা ছিল অজেয় শক্তি। শারীরিকভাবে তারা লম্বা এবং ব্যাপক পরিশ্রমী হবার কারনে যুদ্ধক্ষেত্রে তারা সুবিধা পেত। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সেনাবাহিনীতে তাদের চাকুরি করার ইতিহাস পাওয়া যায়। ভাইকিংরা সম্পূর্ণ নিজেদের শক্তি আর কৌশল অবলম্বন করে অনেক নতুন নতুন দেশ আবিস্কার করত যেখানে ম্যাপ বানানো ত দুরের কথা লেখালেখির অভ্যাসই তাদের ছিলনা। এমনকি কম্পাস ছাড়াই তারা হাজার হাজার মাইল সুমদ্রপথ তারা পারি দিত শুধুমাত্র লুট করার উদ্দেশ্যে। দিনের আকাশের সূর্য আর রাতের আকাশের চাঁদ-তারকাই ছিল তাদের দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার একমাত্র দিকনির্দেশনা। নতুন কোন দেশ আবিস্কার করলে ফেরত এসে অন্য নাবিকদের বর্ণনা করত, সেই বর্ণনা শুনেই নতুনেরা যাত্রা করত। এভাবেই তারা শুধুমাত্র শুনে শুনেই এক প্রজন্ম থেকে অন্য প্রজন্মে জ্ঞান আহরন করত।
তাদের জাহাজের একটা সাধারণ নকশা হল সামনের দিকে ড্রাগন এর মাথা থাকত। একারনে একে ড্রাগন জাহাজ বলা হত। একটু লম্বা ধাঁচের জাহাজ হত, এই নকশার জাহাজের প্রচন্ড গতি এবং সমুদ্রে সহজেই বাক নিতে পারত। একেটি জাহাজে ৫০-৬০ জন যোদ্ধা থাকত। দুই পাশে ১৬+১৬=৩২ জন দাড় বাইত।
ভাইকিংদের হামলার ইতিহাস
স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলের আবহাওয়া প্রতিকূল হওয়ায় এবং মাটিও কৃষিকাজের জন্য উপযোগী না হবার দরুন ভাইকিংরা নতুন নতুন দেশ আবিষ্কারের জন্য বের হয়ে যেত, তারা খুব উৎসাহের সাথে যাত্রা শুরু করলেও বেশিরভাগ সময় কেও ফিরে আসতো না। কিন্তু যদি কোন নতুন দেশ আবিষ্কারের পর একজন অভিযাত্রিও ফেরত আসত পরের মৌসুমে সেই রুটে রওয়ানা হয়ে যেত জাহাজের বিশাল বহর। লুটপাট আর ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শেষে তারা ফিরে আসত বিপুল ধন সম্পদ নিয়ে।
ভাইকিং হামলার প্রথম ইতিহাস পাওয়া যায় ৭৯৩ সালে উত্তর পূর্ব ইংল্যান্ডে। মূলত তখন থেকেই শুরু হয় ইংল্যান্ডের ভাইকিং এইজ। ভাইকিংরা এরপর হামলা করতে থাকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ইংল্যান্ড ছিল তাদের আক্রমনের অন্যতম প্রধান টার্গেট। তারা জানত সূর্যাস্তের দিকে টানা সাতদিন জাহাজ চালালেই একটা সবুজ দেশ দেখা যায় কিন্তু পথের দিশা পেতে বেগ পেতে হচ্ছিল তাদের। অবশেষে ৭৯৩ সালে তারা সফলভাবে লুটপাট চালিয়ে ফেরত আসতে সক্ষম হয়। মোটামুটি এগারশ শতকের মধ্যেই তারা ইংল্যান্ড হাতে নিয়ে আসে। এছাড়া আয়্যারল্যান্ডের তারা স্থায়িভাবে বসবাস শুরু করে।
ভাইকিংদের ইতিহাসের সমাপ্তি
ইউরোপের বিভিন্নপ্রান্তে ভাইকিংরা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করার পর তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করে। আর তাছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির কারনে তারা দস্যুবৃত্তি এবং ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র যাত্রা ছেড়ে দেয়। এভাবেই ধীরে ধীরে প্রবল শক্তিশালী একটি জাতি হারিয়ে যায় কালের গহ্বরে। এরা সরাসরি মানব সভ্যতার কোন ইতিহাস রচনা করতে না পারলেও রোমান সভ্যতার পতনের পর এরাই নতুন সভ্যতার ভিত রচনা করেছিল।
ভাইকিংদের নিয়ে অনেক কাহিনী ও গল্প প্রচলিত রয়েছে, তাদের জীবনকে উপজীব্য করে হলিউডে অনেক মুভি তৈরি হয়েছে। আইরিশ-কানাডিয়ান টেলিভিশন সিরিজ রয়েছে ভাইকিং নামে- যেখানে ভাইকিংদের জীবন ও ইতিহাস নিয়ে দেখান হয়েছে। আপনারা চাইলে দেখতে পারেন।
ধন্যবাদ। আশাকরি ভাল লেগেছে।
তথ্যসুত্র ও ছবিঃ ইন্টারনেট।
হোমপেইজে ভিজিট করুন।
I love historical topics.. Thanks and keep continue..
Thanks a lot
অসাধারন লেখা
ধন্যবাদ