দেশ ভাগ

দেশ ভাগ ছিলো  উপমহাদেশের রাজনীতিতে  সবচেয়ে আলোচিত-সমালোচিত একটি ঘটনা। এমনকি বর্তমানেও এটি নিয়ে চলে নানা তর্ক বিতর্ক। নানা ঘটনার জন্ম দেয়া দেশ ভাগের এই স্বীদ্ধান্তে অনেকেই খুশি হলেও কিছু মানুষের আবেগের সাথে মিশে ছিলো দেশ ত্যাগের যন্ত্রণা। এই বিষয়গুলো পর্যবেক্ষণ করে মনে লালিত করেছিলো একদল। যারা পরবর্তীতে তা দিয়ে রচনা করেছিলো কালজয়ি কিছু উপন্যাস, গল্প, সিনেমা। তৎকালীন দেশ ভাগের সমস্যা, দেশভাগের কারণ, দাঙ্গা, স্বপ্ন ভঙ্গ, প্রেম ভালোবাসা, সামাজিক অবস্থা নিয়ে এমন কিছু উপন্যাস হলো সংশপ্তক, কালো বরফ ও আগুন পাখি। দেশ ভাগের সময়ের সার্বিক অবস্থা বর্তমান প্রজন্মের কাছে এর চেয়ে ভালো উপায়ে তুলে ধরার আর বিকল্প কোনো পথ নেই।

দেশ ভাগের উইকিলিংক পড়ুন এখানে

সংশপ্তক – শহীদুল্লা কায়সার

বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় উপন্যাসের একটি শহীদুল্লা কায়সার রচিত সংশপ্তক। ইংরেজ আমলের অন্তিমকাল দিয়ে শুরু হয়ে উপন্যাসটির কাহিনি শেষ হয়েছে পাকিস্তান আমলের সূচনা দিয়ে। পূর্ববঙ্গের গ্রামাঞ্চল প্রাধান্য পেলেও কলকাতা ও ঢাকার প্রেক্ষাপটও খানিকটা চিত্রায়িত করার চেষ্টা করেছেন লেখক। দেশ ভাগ ছাড়াও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর দুর্ভিক্ষ, পাকিস্তান-আন্দোলন, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সবকিছুই লেখক তার অসাধারণ লেখনির মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

উপন্যাসের প্রধান কাহিনি শাখা প্রশাখা সমেত এক সৈয়দ পরিবারকে নিয়ে। এক সৈয়দ যখন স্ত্রী কন্যা ফেলে দরবেশ হয়েছেন অন্যজন তখন প্রাচীনপন্থী নানা সংস্কারের সাথে আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় করে এগিয়ে গিয়েছেন। দ্বিতীয় জনের পুত্র জাহেদ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েছেন। যুক্ত হয়েছে পাকিস্তান তৈরির আন্দোলনে। কিন্তু সেই আন্দোলন যখন প্রকৃত মুক্তি এনে দিতে পারেনি তখন যুক্ত হন বামপন্থী রাজনীতিতে দেশকে স্বাধীন করার উদ্দেশ্যে। আরেক সৈয়দ হঠাৎ করে বাড়িতে ফিরে এক বয়স্কের কাছে বিয়ে দেয় রাবুর৷ যা থেকে পরে জাহেদের হস্তক্ষেপে মুক্তি পায় রাবু।

মালু নামের আরেকটি চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। যার জীবনকে চিত্রায়িত করা হয়েছে শৈশবের গ্রামের পরিবেশ থেকে প্রাপ্ত বয়সের রাজনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতা দিয়ে। লেখক উপন্যাসটি শেষ করেছেন বাম রাজনীতিতে সংশ্লিষ্টতার কারণে জাহেদের গ্রেপ্তার এবং তার প্রতি রাবুর দেহাতীত ভালোবাসার স্থিতিতে।

কালো বরফ – মাহমুদুল হক

দেশভাগের পটভূমিতে লেখা হলেও উপন্যাসটিতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় দাঙ্গার চেয়ে দেশভাগের কারণে ব্যক্তিগত  কষ্ট বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। উপন্যাসে তাই আমরা দেখি শেকড় হারাবার বেদনায় তিনি বিমর্ষ, বারংবারই ঘুরে ফিরে দেখাতে চেয়েছেন তার ছিঁড়ে যাওয়ার রহস্য। গল্পের শুরু এক শিশুর শৈশবের নানা মজার কাহিনি নিয়ে। যে ছোট বেলায় আঙুল চুষতো, পুঁটি নামের এক মেয়ের অদ্ভূত কান্ডে অভিভূত হতো৷ তার নানা চিন্তা-ভাবনার মধ্যে দিয়ে আশেপাশের পৃথিবীকে দেখতো ভিন্ন ভাবে।

তারপরেই লেখক চলে যান এক পুরুষের সংসারে। যেখানে ভালোবাসা আছে, আছে অভিমান। একজন নারী চরিত্রের সার্থক অঙ্কন করেছেন লেখক। মধ্য বয়সী কলেজ প্রফেসর  আবদুল খালেক- স্ত্রী রেখা ও ছেলে টুকুকে নিয়ে তার সংসরে মন বসে না। বারবার মনে পরে কৈশরকালের কথা। দেশভাগের কারণে তার স্বপ্ন ভঙ্গের কথা। স্মৃতির পাতায় বর্তমানে বার বার আহত হন আবদুল খালেক। যে কিনা লেখকের প্রতিরূপ।

আগুনপাখি – হাসান আজিজুল হক

লেখকের জীবনের একমাত্র উপন্যাস দেশ ভাগের পটভূমিতে রচিত এই ‘আগুনপাখি’। রাঢ়বঙ্গের ধূলি ধূসরিত জনপদের এক নারীর জবানীতে উঠে এসেছে জীবন মন্থনের অমৃত ও গরল যা সমষ্টির নিজেরই বিষয়। তুলে ধরা হয়েছে গড়িয়ে আসা বিবিধ রাজনৈতিক তরঙ্গ উপলব্ধি ও জাগরণ,  বিশ্বযুদ্ধের অসহ্য তাপ, মানবতা লাঞ্চিত মন্বন্তর, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শেষাবধি দেশ ভাগ ঝলসে দেয় কোটি কোটি হৃদয়। মাটিকে ভালোবেসে এক নারীর বসতভিটে আগলে দেশত্যাগ করতে না চাওয়া ভ্রান্ত রাজনীতির ভেদনীতি ও লড়াকু জীবন।

পুরো উপন্যাসটিই লেখক রচনা করেছেন এক নারীর জবানীতে৷ যার মধ্যে ছিলো তার শৈশন, কৈশর, বিবাহ পরবর্তী জীবন৷ মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে, সংসারে দ্বিতীয় মার অবদান, নিজের বিয়ে, বিয়ের পরের সংসার, স্বামী-ছেলের রাজনীতিতে যোগদান ও তৎকালীন অবস্থা। স্বামীর আগ্রহে যে স্বশিক্ষিত মেয়েটি পরিবারের সুখের কথা ভেবে তার নিজস্ব গয়না স্বামীর হাতে তুলে দিতে পারে, দেশকে ভালোবেসে সেই দেশেই থেকে যাওয়ার ক্ষমতাটিও যে তার আছে তার স্পষ্ট রুপ এই উপন্যাসটি।

ফিকশন পড়ে দেশভাগের পরিস্থিতি অনুধাবন করতে চাইলে  এই তিনটি বইয়ের বিকল্প নেই বলেই আমি মনে করি। দেশভাগ নিয়ে পড়তে ইচ্ছুক পাঠকদের সাহিত্যের অংশটুকু অসম্পূর্ণ থেকে যাবে এই  উপন্যাস তিনটি ছাড়া। তাই অপেক্ষা না করে আজই বসুন বইগুলো নিয়ে।

Previous articleনাকের এলার্জি- কেন হয়? এর চিকিৎসা কি?
Next articleহেক্সিসল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার- কেন ও কেন নয়!
Rasel Khan
আমি মোঃ হাবিবুর রহমান রাসেল৷ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ অধ্যয়নরত। বই পড়তে ভালোবাসি। বইয়ের গ্রুপ গুলোতে মাঝে মাঝে রিভিউ লিখি৷ যা পড়ি, তা সবাইকে জানাতে ইচ্ছে করে। সেই আগ্রহ থেকেই টুকটাক লেখার চেষ্টা করি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here