পরিবারের সবচেয়ে ছোট সন্তান, কিন্তু স্বপ্ন ছিল তার অনেক বড়। আকাশ ছুঁয়ে দেখতে চায় সে। হয়তো সেকারনেই একাকি রাতের আকশের দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন বুনে চলে- বড় হয়ে একদিন ঐ দূর আকশে পারি দিবে। ছোটবেলার স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তর করে কল্পনা শুধু আকাশেই ডানা মেলেননি- আকাশ ভেদ করে মহাকাশে পারি দেয়া প্রথম ভারতীয় মেয়েটির নাম কল্পনা চাওলা। কল্পনা চাওলা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন আসুন পড়ে ফেলি।
কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। তার দ্বিতীয় মহাকাশ যাত্রা থেকে ফেরার সময় দুর্ঘটনায় পৃথিবীর আকাশে সে হারিয়ে যায়। আসুন, আমাদের আজকের ভিডিওতে আমরা কল্পনা চাওলা কিভাবে আকাশে হারিয়ে গিয়েছিলেন সেই কাহিনী জেনে নেই।
প্রিয় দর্শক, রেডিটুরিডিং চ্যানেলে আপনাকে জানাই স্বাদর আমন্ত্রন। আপনারা যারা আজকেই আমাদের চ্যানেলে প্রথম এসেছেন অবশ্যই চ্যানেলটিকে সাবস্ক্রাইব করে নিবেন, ভিডিওতে লাইক দিবেন এবং পাশে থাকা বেল আইকনে ক্লিক করবেন।
কল্পনা চাওলার জন্ম বৃত্তান্ত
১৯৬২ সালের ১৭ই মার্চ। ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের কার্নাল গ্রামে এক হিন্দু পরিবারে কল্পনার চাওলার জন্ম। গ্রীষ্মকালের গরমে তারা যখন বাড়ির ছাদে শুয়ে থাকতেন রাতের আকাশে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা তারাগুলো যেন কল্পনাকে কাছে টানত। ছোট্ট কল্পনা তারাদের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতেন।
বাড়ি থেকে কয়েক কিলমিটার দূরেই ছিল কারনেল ফ্লাইং ক্লাব। সেখান থেকে উড়াল দেয়া বিমানের দিকে প্রতিদিন হাত নাড়িয়ে বিদায় দেয়া সেই ছোট্ট মেয়েটিই ছিলেন কল্পনা চাওলা।
কল্পনা চাওলার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার গল্প
১৯৭৮ সালে দ্বাদশ শ্রেনীতে ভাল ফলাফল করার পরেই তিনি ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। কিন্তু তার বাবার ইচ্ছা ছিল মেয়ে তার শিক্ষক কিংবা ডাক্তার হোক। কিন্তু কল্পনার তীব্র ইচ্ছা শক্তি আর মায়ের উৎসাহে কল্পনা চন্ডিগড়ের পাঞ্জাব ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভারসিটির একমাত্র মেয়ে হিসেবে এ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হন।
১৯৮২ সালে কল্পনা চাওলা এরোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং সম্পন্ন করেন এবং অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য তিনি আমেরিকা চলে যান। একই মহাকাশ প্রকৌশল বিষয়ে স্নাতকোত্তর শিক্ষা সমাপ্ত করেন ১৯৮৪ সালে এবং পরবর্তীতে কল্পনা ১৯৮৬ সালে ইউনিভার্সিটি অফ কলোরাডো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রাপ্ত হন।
কল্পনা চাওলা নাসায় যোগ দিলেন
১৯৮৮ সালে তিনি নাসাতে তার কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯১ সালে তিনি ফরাসী নাগরিক জিন পিয়ের হ্যারিসনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। জিন পিয়ের হ্যারিসন আমেরিকার নাগরিক হবার কারনে তিনিও আমেরিকার নাগরিকত্ব লাভ করেন। ১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে কল্পনা চাওলা নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে নিয়োজিত হোন। ১৯৯৫ সালে মহাকাশচারী হিসেবে জনসন স্পেস সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য মনোনীত হোন।
কল্পনা আওলার প্রথম মিশন
১৯৯৬ সালে তিনি নাসার কলম্বিয়া মিশনে মিশন স্পেশালিস্ট হিসেবে রোবটিক আর্ম অপারেটরের দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। এই মিশন ১৯৯৭ সালের ১৯ নভেম্বর আমেরিকার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে যাত্রা শুরু করে ১৫ দিন মহাকাশে অবস্থান করে। সেটাই ছিল তার প্রথমবারের মতো মহাকাশে পাড়ি দেয়া। সেই স্পেস শাটল ডিসেম্বর ১৯৯৭ সালে পৃথিবীতে ফিরে আসে।। তিনিই প্রথম ভারতীয় মহিলা হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন। এই মিশনে কল্পনা চাওলা ১৫ দিন ১৬ ঘণ্টার বেশি সময়ে মোট ১ কোটি ৬৭ লক্ষ মাইল পথ অতিক্রম করেন।
কল্পনা চাওলার ২য় ও শেষ মিশন
২০০০ সালে এসটিএস-১০৭ মিশনে আবারও তাকে মিশন স্পেশালিষ্ট হিসেবে নির্বাচন করা হয়। প্রাথমিকভাবে এই মিশনটি জানুয়ারি ২০০১ সালে শুরু হবার কথা থাকলেও তা বার বার পিছিয়ে, ১৮বার তারিখ পরিবর্তন করে ২০০৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি শুরু হয়। এই মিশনে কল্পনা সহ মোট ৭জন মহাকাশচারী ছিলেন।
কিন্তু কেন এই মিশনের যাত্রার তারিখ একবার নয় দুইবার নয় মোট ১৮বার পেছান হয়? এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মিশন কেন স্পেস সাটলের যান্ত্রিক ত্রুটি ঠিকমত না সারিয়েই যাত্রার তারিখ ঘোষনা করে তা বারবার পিছিয়ে দেয়া হয়? আপনার মনেও কি এই একই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে? তাহলে ভিডিওর বাকি অংশ না টেনে দেখতে থাকুন। মনে রাখবেন ২০০৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি কলম্বিয়া মহাকাশ যানটির ২৮ তম যাত্রা ছিল। এর আগে কলম্বিয়া মহাকাশ যানটি মোট ২৭বার মহাকাশে সফলভাবে যাত্রা করেছিল। ২৮তম মিশনে এই সাটল তার অন্তিম যাত্রা করে এবং কল্পনা চাওলা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন তা এখানেই রচিত হয়।
কিভাবে মহাকাশ যান আকাশে উড়ে
আপনাকে মহাকাশ যান সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞান অর্জন করতে হবে, বাকি ঘটনাগুলো বুঝতে চাইলে। আসুন প্রথমে সেটি জেনে নেই।
একটি মহাকাশ যানের মোট তিনটি অংশ থাকে।
- অরবিটার যাকে আমরা স্পেস সাটল বলছি।
- এক্সটারনাল ফুয়েল ট্যাংক এবং
- দুইটি সলিড রকেট বুষ্টার।
জেনে রাখুন, পৃথিবীর অভিকর্ষজ ত্বরণের বিপক্ষে কোন বস্তুকে মহাকাশে উৎক্ষেপণ করতে চাইলে আপনাকে ঐ বস্তুকে কমপক্ষে প্রতি সেকেন্ডে ১১.২ কিমি বেগে উপরের দিকে ছুড়ে মারতে হবে তাহলে তা আর পৃথিবীতে ফিরে আসবেনা। একে বলে মুক্তিবেগ। তারমানে মহাকাশ যানকে মহাকাশে যাত্রা করতে হলে তার গতিবেগ হতে হবে কমপক্ষে প্রতি সেকেন্ডে ১১.২ কিমি।
অরবিটারটিকে এক্সটারনাল ফুয়েল ট্যাংক এবং ২টি সলিড রকেট বুষ্টার এর মাধ্যমে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর দুই মিনিটের একটু বেশি সময় পর সলিড রকেট বুষ্টার ২টি বিচ্ছিন্ন করা হয় এবং আট মিনিট পর অরবিটারটিকে ফুয়েল ট্যাংক থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। অরবিটারটি এরপর স্বতন্ত্রভাবে চলাচল করতে থাকে মহাকাশে। মিশন শেষে অরবিটারটি একটি সাধারণ বিমানের মতই পৃথিবীতে ফিরে আসে এবং রানওয়েতে ল্যান্ড করে।
কিভাবে মহাকাশ যান পৃথিবীতে ফিরে আসে
অরবিটারটি পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় বায়ুমন্ডলের মধ্যদিয়ে অতিক্রম করার সময় ঘর্ষণের কারনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। তাই এই অরবিটার বা স্পেস সাটলের চারদিকে তাপ নিরোধক টাইলস ব্যবহার করা হয়। এতে স্পেস সাটলের বাইরের তাপ ভেতরে প্রবেশ করতে পারেনা। নভোচারীরা নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসতে পারে।
সংক্ষেপে এটাই হল মহাকাশে যেকোন অভিযানের মূলমন্ত্র। আসুন আবার মূল আলোচনায় ফিরে আসি।
প্রাথমিকভাবে কল্পনা চাওলার এসটিএস-১০৭ মিশনটি ২০০১ সালে যাত্রা শুরু করার কথা থাকলেও কলম্বিয়া স্পেস সাটলের যান্ত্রিক ত্রুটি যেন সারছিলই না। তার বার বার মোট ১৮বার যাত্রার তারিখ পিছিয়ে বেশ তারাহুড়ো করে ২০০৩ সালের ১৬ই জানুয়ারি কলম্বিয়া মহাকাশ যানটির ২৮ তম যাত্রা শুরু করে। মহাকাশযানটি সফলভাবে উৎক্ষেপণ করা হয় এবং স্পেস সাটলটি ১৫ দিন ২২ ঘণ্টা মহাকাশে অবস্থান করে।
২০০৩ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি। এইদিন স্পেস শাটলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে পুনঃপ্রবেশ করে। কেনেডি স্পেস সেন্টারে অবতরণের ১৬ মিনিট আগেই স্পেস শাটলটি টেক্সাসের আকাশে বিস্ফোরিত হয়। কল্পনা চাওলা এবং তার ৬জন সাথী আকাশেই মৃত্যুবরন করেন।
সুয়েজ খালের ইতিহাস পড়ুন এখানে।
কেন স্পেস শাটলটি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশের পর বিস্ফোরিত হল?
আগেই বলেছি অরবিটার পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করলে ঘর্ষণের কারনে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। সেই তাপ স্পেস সাটলের ভেতরে প্রবেশ করে মহাকাশচারীদের অজ্ঞান করে ফেলে এবং একসময় সাঁটলটি বিস্ফোরিত হয়। কিন্তু কেন? আমি ত আগেই বলেছি স্পেস সাটল চারদিক থেকে তাপ নিরোধক দিয়ে মুড়ানো থাকে। তাহলে কেন এই বিস্ফোরন ঘটল?
পরবর্তীতে তদন্তে দেখা যায়, মহাকাশ যাত্রা শুরুর ৮১.৭ সেকেন্ড পরেই কলম্বিয়া মহাকাশ যানের তাপ নিরোধক একটি টাইলস খুলে অরবিটারের একটি পাখাতে আঘাত করে এবং একটি ছিদ্র তৈরি করে। নাসার বিজ্ঞানীরা লঞ্চ করার সময় ব্যাপারটি দেখে থাকলেও ব্যাপারটি আমলে নেননি। এমনকি তারা নভোচারীদেরকেও ব্যাপারটি জানান নি। তারা পুরো ব্যাপারটি একদমই চেপে যান।
কল্পনা চাওলা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন
শুধু তাই নয়, তারা আরেকটি নভোযান পাঠিয়ে নভোচারীদের উদ্ধারের কোন চেষ্টাও করেননি। অরবিটারে ৩০ দিনের জ্বালানী থাকে। তারা চাইলে আরেকটি নভোযান পাঠিয়ে কল্পনা চাওলা এবং তার সাথীদের উদ্ধার করার চেষ্টা করতে পারতেন। কিন্তু তারা সেটা চাননি। কল্পনা চাওলা কিভাবে মারা গিয়েছিলেন তা আজ সারা পৃথিবীর কাছে আর অজানা নেই।
কল্পনা চাওলা আকাশ ছুঁয়ে দেখতে চেয়েছিলেন। কে জানে, তিনি হয়ত একই সাথে আকশেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চেয়েছিলেন। তার সেই ইচ্ছাও সৃষ্টিকর্তা অপূর্ণ রাখেননি।
কল্পনাকে তার অবদানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেশনাল স্পেস মেডেলের সন্মানে ভূষিত করা হয়। এছাড়া নাসা স্পেস মেডেল, নাসা ডিস্টিংগুইস সার্ভিস মেডেলের সন্মানেও তিনি ভূষিত হন। তার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা রেখে মঙ্গল গ্রহের কলম্বিয়া হিল চেইনের একটি চূড়াকে কল্পনা হিল নাম দেয়া হয়। টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় কল্পনার স্মরনে তাদের ডরমেটরির নাম পরিবর্তন করে কল্পনা চাওলার নামে নামকরণ করে।
কল্পনাকে তার ইচ্ছানুযায়ী উথার ন্যাশনাল পার্কে সমাহিত করা হয়। তার প্রতি সম্মান জানিয়ে ভারত তাদের প্রথম মেটোরোলজিকাল স্যাটেলাইট এর নাম ‘কল্পনা-১’ রাখে।
কল্পনা চাওলা আমাদের আজ আর মাঝে নেই কিন্তু তার আত্মপ্রত্যয় পৃথিবীর প্রতিটি মানুষকে প্রতিনিয়ত স্বপ্নকে ছুঁয়ে দেখতে উৎসাহিত করবে সবসময়। ধন্যবাদ সবাইকে।