হরর সিনেমা মানেই যে রক্তারক্তি-খুনোখুনি কিংবা রক্তজল করে দেয়া কোনো ভূত বা আত্মার উপস্থিতি থাকতে হবে সেই ধারণা থেকে আমরা বেশ আগেই বেরিয়ে এসেছি। হরর জগতটা বিশাল – বহুমাত্রিক। যুগ যুগ ধরে চলে আসা এই Genre তে অতৃপ্ত আত্মার প্রতিশোধ, আপনার ঘরের কোণায় লুকিয়ে থাকা ভয়ানক কিছুর উপস্থিতি, পুরানো বাড়ির চিলেকোঠার লুক্কায়িত প্রাচীন আর ঐতিহাসিক গল্পের আবেদন যেমন রয়েছে – ঠিক তেমনি রয়েছে এই অস্বাভাবিকতার চেয়েও বেশি অমানবিক ও বিকৃত মানবরূপ, আত্মার চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো মহাজাগতিক প্রাণীর কাহিনী, কিংবা কুসংস্কারের অন্ধকার ছায়া। প্রচলিত থেকে আলাদা ধরণের এবং ভীষণ উপভোগ্য ছয়টি হরর সিনেমা নিয়ে আজকের এই লেখা।
Movie : A Quiet Place Director : John Krasinski, Stars :Emily Blunt, John Krasinski, Millicent Simmonds
ধরুন, পৃথিবীটা আর আপনার প্রতিদিনকার পরিচিত, স্বাভাবিক জায়গা নেই। দিনের পর দিন ভয়ে আতঙ্কে নিঃসীম নীরবতায় দিন কাটাচ্ছেন, একটি শব্দ উচ্চারণ করারও উপায় নেই – কথা বলা তো দূরে থাক। কেন না যেই টুঁ শব্দ করবেন – চারদিক থেকে এসে আপনাকে জেঁকে ধরবে এক নাম-না-জানা প্রাণীর দল। যারা ওঁত পেতে আছে শিকারের জন্য, চোখ তাদের অন্ধ কিন্তু প্রতিটি শব্দ তাদের কানে পৌঁছায় বহুদূর থেকেও।
এমনই একটি গল্প নিয়ে পরিচালক জন ক্রাসিনস্কি ২০১৮ সালে নির্মাণ করেছেন “A Quiet Place”। স্বাভাবিকভাবেই পুরো সিনেমায় প্রায় কোনো কথাবার্তা নেই। কিন্তু এই ডায়লগের অভাবটা চোখে তো পড়বেই না, বরং এই নীরবতার জন্য আপনি ক্রমে ক্রমে নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে থাকবেন। বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী এবং রোমাঞ্চের মিশেল – সাথে পরিচালক এবং অভিনেতাদের দক্ষতায় গড়ে উঠেছে চমৎকার একটি সিনেমা। ভয়ের সাথে সাথে পারিবারিক সম্পর্কেরও গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক ফুটে উঠেছে এখানে।
সব ভুলে কিছুক্ষণ এক শব্দহীন ভয়ের জগতে ঘুরে আসতে চাইলে দেখে ফেলতে পারেন “A Quiet Place”। সুখবর হলো, এই বছর সেপ্টেম্বরে মাসে সিনেমার পার্ট টু মুক্তি পেতে যাচ্ছে।
Movie : Hereditary Director : Ari Aster, Stars : Toni Collette, Milly Shapiro, Gabriel Byrne
বর্তমানকালে পরিচিতি পাওয়া বেশ কয়েকজন পরিচালকের একজন হলেন অ্যারি অ্যাস্টার। প্রচলিত হররের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে এসে দারুণ ভিন্নধর্মী কিছু নিয়ে কাজ করছেন তিনি – সেক্ষেত্রে তার প্রথম সৃষ্টি ছিল ২০১৮ সালে মুক্তি পাওয়া হরর সিনেমা “Hereditary”।
গ্রাহাম পরিবারের সদস্যদের ঘিরে গড়ে উঠেছে এই সিনেমার গল্প। তাদের উপর যেন হঠাৎ নেমেছে এক অভিশাপ, একটির পর একটি উদয় হতে থাকা দুর্ঘটনা এবং আঘাত পরিবারের সকলের মানসিক অবস্থাকে করে ফেলতে থাকে অসহনীয়। সেই সাথে শুরু হয় অতিপ্রাকৃত কিছুর উৎপাত। “হেরেডিটারি” একারণেই আপনার মনে দাগ রেখে যাবে যে এটি শুধু একটি হরর সিনেমা নয়। একটি পরিবারের ভেঙে পড়া, হারানোর দুঃখ-দুর্দশা সবকিছুর সাথে আপনি একাত্ম হতে পারবেন। বিষাদময় দৃশ্যগুলো আপনার ভেতরকার অনুভূতিকে নাড়িয়ে দিতে সক্ষম। প্রত্যেক অভিনেতা এতো জীবন্তভাবে চরিত্রগুলোকে ফুটিয়ে তুলেছেন – সেটার প্রশংসা নতুনভাবে আর না করলেও চলে। বেশ স্বাভাবিকভাবে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে কাহিনী গভীর হতে থাকবে এবং শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ধরে রাখবে আপনাকে। বলে রাখি – সমাপ্তিটা আরো দারুণ কিছু নিয়ে অপেক্ষা করছে।
সেরা ৫টি সাউথ কোরিয়ান রোমান্টিক মুভি, পড়ুন এখানে।
Movie : Midsommar Director : Ari Aster Stars : Florence Pugh, Jack Reynor, Vilhelm Blomgren
যে অ্যারি অ্যাস্টারের কথা বলছিলাম, তারই আরেকটি নিখুঁত সৃষ্টি হলো “মিডসমার”। “হেরেডিটারি”-র পর ২০১৯ সালে নির্মিত হয় মিডসমার। নিজের শৈল্পিক ধরণ বজায় তো রেখেছেনই তিনি, বরং আগের চেয়ে তার কাজের উৎকর্ষ আরো বেড়ে গিয়েছে বলে মনে হয়েছে এই হরর সিনেমা দেখতে গিয়ে।
এক প্রেমিক-প্রেমিকা যুগল তাদের বন্ধুদের সাথে গ্রীষ্মের ছুটিতে সুইডেন বেড়াতে যায়। বেড়াতে যাওয়ার পেছনে উদ্দেশ্য ছিল বন্ধুদের মধ্যে একজনের পৈতৃক বাড়ির ঐতিহ্যগত অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া। অনুষ্ঠানটি হয় নব্বই বছর পর পর গ্রীষ্মের মাঝামাঝি সময়ে। এবং স্বাভাবিকভাবেই সেখানে কিছু প্রথা মেনে চলা হয়। সবকিছু শুনে বেশ উত্তেজনার সাথে রওনা হয়েছিল তারা, কিন্তু পৌঁছাবার পর থেকে সেখানকার অসঙ্গতিগুলো অল্প অল্প করে ধরা পড়তে শুরু করে। নতুন কোনো অভিজ্ঞতা অর্জনের আশায় করা ভ্রমণ পরিণত হয়ে উঠে দুঃস্বপ্নে।
শুধুমাত্র চোখ ধাঁধানো সিনেমাটোগ্রাফির জন্য হলেও যদি কোনো মুভি দেখতে চান, তবে “মিডসমার”-এর নাম আসবে সবার আগে। বুদাপেস্টে নির্মাণ করা সিনেমাটির চোখ জুড়িয়ে যাওয়া দৃশ্য, উল্লিখিত প্রথাভিত্তিক অনুষ্ঠানটির জন্য চরিত্রগুলোর সকলের কস্টিউম আর সাজগোজ সবকিছু যেন চোখে একটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দিয়ে যায়। হরর যে শুধু রাতের আঁধারে হয় না, ঝকঝকে দিনের আলোতেও লুকিয়ে থাকতে পারে ভয়াবহ কিছু – তার প্রমাণ হলো এই সিনেমা৷ “ফোক হরর” জন্রার সাথে এখানে আপনাকে পরিচয় করিয়ে দেবেন অ্যারি অ্যাস্টার।
Movie : Get Out Director : Jordan Peele Stars: Daniel Kaluuya, Allison Williams, Bradley Whitford
কৃষ্ণাঙ্গ আফ্রিকান-আমেরিকান যুবক ক্রিস। তার প্রেমিকা একজন আমেরিকান শ্বেতাঙ্গ। প্রেমিকার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করবার জন্য এক সপ্তাহান্তের ছুটিতে তার বাড়িতে যায় ক্রিস। সেই বাড়ির পরিবেশ যেন ঠিক স্বাভাবিক নয়, তার প্রেমিকার পরিবারের লোকজনের ব্যবহার-কথাবার্তা কিংবা অন্যান্যদেরও। বাড়িতে কাজের লোকগুলো প্রত্যেকে কৃষ্ণাঙ্গ – কোনো শ্বেতাঙ্গ কাজের লোক নেই। এবং কাজের লোকেদের আচরণ অদ্ভুত ধরণের। ক্রিস প্রথমে বুঝতে পারে না কিসের মধ্যে এসে জড়িয়ে পড়েছে সে। কিন্তু আস্তে আস্তে খোলাসা হতে থাকে তিক্ত সত্য।
বর্তমান সময়ে দেখার জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত একটি হরর সিনেমা হলো “গেট আউট”। যখন চারদিকে আলোচনা হচ্ছে বর্ণবিদ্বেষ নিয়ে, তখন এটি আসলে দেখা উচিত৷ এখানে পরিচালক বর্ণবিভেদের দিকটি তুলে ধরেছেন মুন্সিয়ানার সঙ্গে। মুক্তি পাবার পর থেকে তুমুল আলোচনার বিষয় ছিল এটি, অত্যন্ত ইতিবাচক মন্তব্য পেয়েছিল ফিল্ম ক্রিটিকসদের কাছ থেকে। এটুকু বলা যায়, দেখতে বসে হতাশ হবার কোনো সুযোগ নেই।
Movie : Us Director : Jordan Peele Stars : Lupita Nyong’o, Winston Duke, Elisabeth Moss
ধরুন, কোনো এক রাতে আপনার বাড়িতে হানা দিলো এক আগন্তুক। আক্রমণ করে বসলো আপনাকে। সবচেয়ে আতঙ্কের ব্যাপার ঘটলো যখন আপনি তাকালেন আগন্তুকের মুখের দিকে এবং দেখলেন সেটি হুবহু আপনারই মুখ! কেমন হবে সেটা?
এডিলেইড উইলসন বড় হয়েছে তার সাগরপাড়ের পৈতৃক বাড়িতে। যদিও শৈশবের স্মৃতি তার জন্য ঠিক সুখকর ছিল না। কিছু একটা ঘটেছিল তার সাথে ছোটবেলায়। প্রাপ্তবয়স্ক জীবনে এসে স্বামী এবং ছেলেমেয়েকে নিয়ে সে আবার ফিরে যায় বাড়িটিতে। প্রথম থেকেই তার কেমন যেন অস্বস্তিকর অনুভূতি হচ্ছিল। যেন আবার কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে এখানে, খারাপ কিছু! খুব দ্রুতই সত্য হলো আশঙ্কা। এক রাতে চারজন আগন্তুক এসে আক্রমণ করলো তাদের। কিন্তু তার চেয়েও গা শিউরে উঠা ব্যাপার হলো তখন, যখন দেখা গেলো আগন্তুক চারজনের চেহারা ঠিক উইলসন পরিবারের চার সদস্যের মতো! কিন্তু এটা তো সম্ভব নয়, একই রকম চারজন কিভাবে হতে পারে? কি হবে তারপরের ঘটনা?
“গেট আউট” সিনেমার পরিচালকেরই দ্বিতীয় সিনেমা “Us”। ” গেট আউট”-এর তুলনায় এটির আবেদন কম হতে পারে কিছুটা, কিন্তু তারপরেও কম উপভোগ্য মোটেই নয়। সিনেমার সৃষ্টিশীল ধরণের কাহিনী ভালো লাগার জন্য যথেষ্ট ছিল। প্রতি মুহূর্তে আপনি ভাবতে থাকবেন না জানি কি হয় এরপর! একদমই আনপ্রেডিক্টেবল একটি গল্প।
Movie : Let The Right One In Director : Tomas Alfredson Stars : Kåre Hedebrant, Lina Leandersson, Per Ragnar
সিনেমার পটভূমি ১৯৮১ সালে। বারো বছর বয়স্ক বালক অস্কার মায়ের সাথে বসবাস করে স্টকহোমে। কিছুটা চুপচাপ এবং সংবেদনশীল ধরণের অস্কার সহপাঠীদের কাছে থেকে নির্যাতনের শিকার হয়, নিজে নিজে কল্পনা করে প্রতিশোধ নেবে একদিন তার উপর হওয়া সব অত্যাচারের। হঠাৎ একদিন তার পরিচয় হলো এলির সাথে। প্রায় সমবয়সী মেয়েটি তার প্রতিবেশী। প্রথমদিকে এলি জানায় তারা একে অপরের বন্ধু হতে পারবে না। কিন্তু সময় গড়াবার সাথে সাথে তাদের মধ্যে গড়ে উঠতে লাগলো বন্ধুত্ব। আর তখন এলি অস্কারকে জানালো নিজের ব্যাপারে একটি গোপন কথা।
প্রথমেই যেটা বলতে হয় – আপনার পরিচিত কোনো হরর সিনেমার সাথে এর তুলনা করতে পারবেন না। এমন কি উপরের পাঁচটা সিনেমার থেকেও এটি ভিন্ন কাতারে পড়ে অনেকটা। সুইডিশ এই সিনেমার দর্শকদের ইতিবাচক নেতিবাচক বিভিন্ন মত দেখা যায় সিনেমাটি নিয়ে – তবে আজ ব্যতিক্রমী কিছু নিয়েই আলাপ বলে এর কথা তোলা চলে।
এই সিনেমায় যে আবহ গড়ে তোলা হয়েছে সেটি অসম্ভব রকমের চমকপ্রদ। এলি এবং অস্কারের মধ্যকার বন্ধুত্ব সিনেমার একটি উল্লেখযোগ্য দিক। একটি সম্পর্ক কিভাবে আপনার নিজেকে চেনায় সাহায্য করতে পারে এবং নিজের ভেতরকার শক্তিকে বের করে নিয়ে আসতে পারে এই দিকটি দেখানো হয়েছে। উল্লেখ না করলেই নয় – বেশ ধীরগতির একটি সিনেমা এটি, ধুমধাড়াক্কা কিছুর আশায় থাকলে ভুল করবেন। কিন্তু শৈল্পিক মাধুর্যের কিছু দেখতে চাইলে এর তুলনা নেই।
বলা হয়ে থাকে, সিনেমা আপনার মনের খোরাক যোগায়। আর এই ধরণের সিনেমাগুলো সত্যিকার অর্থেই মনের খোরাক। চিন্তা করার মতো কিছু না কিছু থাকে, কিংবা মনে গেঁথে যাওয়া কোনো ধারণাকে বদলে নেয়া অথবা নতুন করে ঝালিয়ে নেবার সুযোগ।