ইহুদি জাতির ইতিহাস ২

জায়োনিস্ট, ইহুদি এবং ইসরায়েলি- তিনটি ভিন্ন ভিন্ন নাম। অথচ তাদের ধর্ম একটি। আর সেই ধর্মের নাম হলো ইহুদি। আর এই ইহুদি জাতির ইতিহাস যেন এক পথভ্রষ্টতার ইতিহাস। এটি আনুমানিক ৪ হাজার বছরেরও অধিক পুরনো একটি ইতিহাস। বিশাল এই আখ্যানে জড়িয়ে রয়েছে মানব সভ্যতার একটি বড় সংকট। পৌত্তলিক ও একেশ্বরবাদীদের দ্বন্দ্বের এক ইতিহাস এটি। ক্ষমতা, রাজনীতি ও ঘৃণ্য অপরাধের এক গল্প হতে চলেছে এটি। আজকের এই গল্প এমনি এক ইতিহাস যা আপনার চোখকে কপালে তুলবে।

আজকের লেখায় যা থাকছে

ইতিহাসের অন্যতম এই নিকৃষ্ট দিক আপনার আমাদের থেকে বহু বছর ধরে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু কেন? কারা এই ইহুদি জাতি? আপনি কি সঠিক জানেন, ইহুদি জাতির ইতিহাস কি? কোত্থেকেই বা এদের উৎপত্তি? কী তাদের উদ্দেশ্য? কেনই-বা তারা দিনকে দিন এত ক্ষমতাধর হয়ে উঠছে পৃথিবীর বুকে?

আমাদের আজকের আর্টিকেলে আমরা এসব প্রশ্নের উত্তরই খোঁজার চেষ্টা করবো। লেখাটি একটু বড় হতে পারে। সঠিক ইতিহাস জানতে এই সামান্য মেহনত আশা করি করতে প্রস্তুত আপনি। 

তবে চলুন শুরু করা যাক। 

ইহুদি ধর্মের গোরাপত্তনের ইতিহাস

সেমেটিক বা মধ্যযুগীয় সভ্যতা থেকে অন্যতম প্রাচীন ধর্ম হিসেবে পরিচিত ইহুদি ধর্মের জাতির পিতা এবং ইসলাম ধর্মের জাতির পিতা একজনই। আর তিনি হলেন হযরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম। হযরত ইব্রাহীম আলাইহিস সালাম এর দুই পুত্র হলেন হযরত ঈসহাক আলাইহিস সালাম এবং হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর হাত ধরে যে দুটি বংশের গোরাপত্তন ঘটে সেই দুই বংশের মানুষ এর মাধ্যমে মহান রাব্বুল আলামিন পৃথিবীর বুকে দুটি ধর্মের বিস্তার ঘাটান।

পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে বংশে জন্মগ্রহণ করেন সেই কুরাইশ বংশের পূর্বপুরুষগণ ছিলেন হযরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম এর বংশধর।

অপরদিকে হযরত ইসহাক আলাই সাল্লাম এর পুত্র ছিলেন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। যার অপর নাম ছিল ইসরাইল। মূলত ইহুদী ধর্মের প্রচলন হযরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম এর হাত ধরেই শুরু হয়। কুরআনিক এ ধর্মকে মহান আল্লাহ তা’আলা বনি ইসরাইল নামে সম্বোধন করেছেন।

এই বংশে অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করা হয়েছে। এখন হয়তো খুব স্বাভাবিকভাবেই আপনার মনে প্রশ্ন জাগছে, বনি ইসরাইল কিভাবে ইহুদী হয়ে গেল? আশা করি এই প্রশ্নের উত্তর ধীরে ধীরে আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।

ইহুদি জাতির আদি পিতা ইবরাহিম (আ.) : আল্লাহর সঙ্গে চুক্তি

ইসলামে ইবরাহিম (আ.)কে মুসলিমদের জন্য একজন গুরুত্বপূর্ণ নবী এবং পিতামহ হিসেবে গণ্য করা হয়। তিনি তিনটি আব্রাহামিক ধর্ম—ইসলাম, খ্রিস্টধর্ম, এবং ইহুদি ধর্মের আদি পিতা হিসেবে পরিচিত। কুরআন অনুসারে, ইবরাহিম (আ.) ছিলেন এক আল্লাহতে বিশ্বাসী, এবং তিনি আল্লাহর নির্দেশনা মেনে তার নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করেন। ইবরাহিম (আ.)এর সাথে আল্লাহর চুক্তির মধ্যে ছিল, যে তিনি এবং তার বংশধররা শুধুমাত্র এক আল্লাহর ইবাদত করবেন এবং তাদের মধ্য থেকে নবী ও রাসুল প্রেরিত হবেন।

ইবরাহিম (আ.)কে আল্লাহ তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য পুরস্কৃত করেছিলেন। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো তার পুত্র ইসমাইল (আ.)কে আল্লাহর নির্দেশে কুরবানির ইচ্ছা। ইসমাইল (আ.)এর পরিবর্তে আল্লাহ একটি পশু কুরবানি হিসেবে পাঠান, যা ইসলামে ঈদুল আযহার মূল প্রতীক। কুরআনে ইবরাহিম (আ.)এর চুক্তির কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে যে, তিনি তার সন্তানদের এক আল্লাহর পথে পরিচালিত হতে এবং আল্লাহর আদেশ মেনে চলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই চুক্তি মুসলিম জাতির সাথে তার বিশেষ সম্পর্কের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।

ইবরাহিম (আ.) এর পুত্র ইসহাক (আ.) এবং তার পৌত্র ইয়াকুব (আ.) ইসলামে বিশেষভাবে সম্মানিত। ইয়াকুব (আ.) এর ১২ জন পুত্র ইসরায়েলের বারো গোত্রের ভিত্তি স্থাপন করেন। ইসলামিক বিবরণে, ইয়াকুব (আ.)এর জীবনের বিভিন্ন ঘটনা এবং তার সাথে আল্লাহর সম্পর্কের বর্ণনা পাওয়া যায়।

ইসলামে ইয়াকুব (আ.)এর জীবনের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, তিনি আল্লাহর আদেশ অনুসারে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সততা ও নিষ্ঠা পালন করেছিলেন। ইয়াকুব (আ.) এর পুত্রদের মধ্যে ইউসুফ (আ.) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

কুরআনে উল্লেখ আছে যে, ইয়াকুব (আ.) তার পুত্র ইউসুফ (আ.)কে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, এবং তার পুত্রদের মধ্যে ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। এই ঈর্ষার ফলস্বরূপ, তারা ইউসুফ (আ.)কে একটি কূপে ফেলে দেয় এবং পরে মিসরের একজন বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়।

ইয়াকুব (আ.) ইসলামে একজন নবী হিসেবে পরিচিত, যিনি আল্লাহর প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস রাখতেন এবং তার পুত্রদেরকে একেশ্বরবাদ এবং আল্লাহর পথে পরিচালিত হতে নির্দেশনা দিতেন। তার জীবনের প্রতিটি ঘটনা মুসলিমদের জন্য শিক্ষামূলক এবং উদাহরণস্বরূপ বিবেচিত হয়, বিশেষত আল্লাহর আদেশ মেনে চলার ক্ষেত্রে।

ইউসুফ (আ.) এর মিসর অভিমুখে যাত্রা এবং ইহুদি জনগণের মিসরে আগমন

ইসলামের দৃষ্টিতে, ইউসুফ (আ.) এর জীবনের ঘটনাগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং কুরআনে বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। ইয়াকুব (আ.) এর পুত্র ইউসুফ (আ.) তার পিতার প্রিয় ছিলেন, যার ফলে তার অন্যান্য ভাইদের মধ্যে ঈর্ষা সৃষ্টি হয়। তারা তাকে প্রথমে একটি কূপে ফেলে দেয় এবং পরে তাকে মিসরের একটি বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। মিসরে তিনি আল্লাহর অনুগ্রহে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হন এবং সেসব চ্যালেঞ্জে উত্তীর্ণ হয়ে মিসরের ফারাওয়ের কাছ থেকে সম্মান এবং আস্থা অর্জন করেন। এর ফলস্বরূপ, তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন।

ইসলামি বিবরণ অনুসারে, ইউসুফ (আ.) আল্লাহর বিশেষ রহমত প্রাপ্ত হন, যা তাকে দুর্ভিক্ষের সময়ে খাদ্য সঞ্চয় ও বিতরণে দক্ষ করে তোলে। তার ভাইয়েরা যখন মিসরে খাদ্য সাহায্য চেয়ে আসে, তখন তাদের সঙ্গে ইউসুফ (আ.)এর পুনর্মিলন হয়। এই ঘটনা থেকে বোঝা যায় যে, আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস ও ধৈর্যের ফলে যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে সাফল্য অর্জন করা সম্ভব।

ইয়াকুব (আ.) ও তার পরিবার মিসরে বসবাস শুরু করেন, যা পরবর্তীতে ইহুদি জাতির মিসরে দীর্ঘদিন বসবাস এবং তাদের বন্দিদশার প্রেক্ষাপট তৈরি করে। ইসলামে ইউসুফ (আ.) এর জীবন-কাহিনী বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আল্লাহর প্রতি অবিচল বিশ্বাস এবং তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার একটি অনন্য উদাহরণ।

প্রথম দিকে, ইহুদিরা মিসরে শান্তি ও সমৃদ্ধির সাথে বসবাস করছিল। কিন্তু কয়েক প্রজন্ম পর, মিসরে নতুন এক ফারাও ক্ষমতায় আসে। এই নতুন শাসক হযরত ইউসুফ (আ) এর অবদানের কথা ভুলে গিয়ে ইহুদিদের সাথে শত্রুভাবাপন্ন আচরণ শুরু করে। ইহুদিরা দ্রুত বংশবৃদ্ধি করতে থাকায় ফারাও তাদের সংখ্যা নিয়ে ভীত হয়ে পড়ে। তিনি ভাবেন, যদি ইহুদিরা শক্তিশালী হয়ে ওঠে, তাহলে তারা হয়তো মিসরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে বা শত্রুদের সঙ্গে মিত্রতা করতে পারে।

এই ভয়ের কারণে ফারাও ইহুদিদের উপর অত্যাচার শুরু করে। তাদের বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হয়, এবং মিসরের বিভিন্ন নির্মাণ কাজের জন্য কঠোর পরিশ্রম করানো হয়। ইহুদিদের জীবন ধীরে ধীরে দাসত্বে পরিণত হয়। ইহুদিদের উপর এই অত্যাচার ও নিপীড়নের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়—ফারাও আদেশ দেয় যে, প্রতিটি নবজাতক পুরুষ সন্তানকে হত্যা করা হবে, যাতে করে ইহুদিদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি না পায়। নারীদের জীবিত রাখা হয় তাদের শ্রমশক্তি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য।

মুসা (আলাইহিস সালাম) এর জন্ম ও শৈশব

ফারাওয়ের এই নির্মম আদেশের মধ্যেই হযরত মুসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন। মুসা (আ) এর মা বুঝতে পারেন যে, তার সন্তান বিপদের মুখে রয়েছে। আল্লাহর নির্দেশে তিনি মুসা (আ) কে একটি ঝুড়িতে রেখে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই ঝুড়িটি ভেসে ফারাওয়ের প্রাসাদের কাছে পৌঁছে যায়। ফারাওয়ের স্ত্রী আসিয়া (আলাইহাস সালাম) শিশুটিকে খুঁজে পান এবং তার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকে সন্তানস্নেহে গ্রহণ করেন। তিনি ফারাওকে মুসা (আ) কে দত্তক নিতে রাজি করান। এভাবে মুসা (আ) বড় হতে থাকেন ফারাওয়ের প্রাসাদে, শাসকের সন্তান হিসেবে।

মুসা (আ) এর নবি হিসেবে আবির্ভাব

যুবক হওয়ার পর, মুসা (আ) তার ইহুদি পরিচয় সম্পর্কে সচেতন হন। একদিন তিনি দেখতে পান একজন মিশরীয় একজন ইহুদির সাথে ঝগড়া করছে এবং তাকে মারধর করছে। মুসা (আ) সেই মিশরীয়কে আঘাত করেন, এবং দুর্ঘটনাক্রমে তিনি মারা যান। মুসা (আ) এর জন্য মিসর তখন আর নিরাপদ ছিল না, তাই তিনি মাদইয়ান নামক স্থানে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি একজন সৎ মানুষ হযরত শোয়ায়েব (আ) এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার সাথে বসবাস শুরু করেন। মুসা (আ) শোয়ায়েব (আ) এর কন্যাকে বিয়ে করেন এবং বেশ কয়েক বছর মাদইয়ানে কাটান।

মাদইয়ানে থাকাকালীন, একদিন মুসা (আ) তুর পাহাড়ের পাশে আগুন দেখতে পান। তিনি সেখানে গেলে আল্লাহ তাকে নবি হিসেবে মনোনীত করেন এবং মিসরে ফিরে গিয়ে তার জনগণকে মুক্ত করার আদেশ দেন। আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) কে লাঠির আকারে একটি মু’জিযা (অলৌকিক ক্ষমতা) প্রদান করেন, যা তিনি ফারাওকে দেখাবেন।

ফারাওয়ের সাথে মুসা (আ) এর সংঘর্ষ

মুসা (আ) মিসরে ফিরে আসেন এবং তার ভাই হারুন (আ) কে সাথে নিয়ে ফারাওয়ের কাছে যান। তারা আল্লাহর পক্ষ থেকে ফারাওকে আদেশ দেন যে, ইহুদি জনগণকে মুক্তি দিতে হবে এবং আল্লাহর পথে আসতে হবে। ফারাও মুসা (আ) এর কথা প্রত্যাখ্যান করেন এবং তাকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেন। তখন মুসা (আ) আল্লাহর প্রদত্ত মু’জিযা দেখান, যেমন লাঠি সাপ হয়ে যাওয়া এবং হাত থেকে উজ্জ্বল আলো বের হওয়া। ফারাও এবং তার জাদুকররা প্রথমে এ সব মু’জিযা দেখে হতবাক হয়, কিন্তু তারা তাৎক্ষণিকভাবে এগুলোকে যাদু বলে ঘোষণা করে এবং মুসা (আ) কে মিথ্যা প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

আল্লাহর নিদর্শন এবং ফারাওয়ের দুর্ভোগ

ফারাও এবং তার জনগণের অবাধ্যতার জন্য আল্লাহ তায়ালা মিসরের উপর একের পর এক বিপর্যয় পাঠান। এই বিপর্যয়গুলোর মধ্যে ছিল:

  • রক্তের বিপর্যয়: মিসরের সমস্ত পানি রক্তে পরিণত হয়।
  • ব্যাঙের আক্রমণ: মিসরে ব্যাপক সংখ্যক ব্যাঙের আবির্ভাব ঘটে।
  • জোঁকের আক্রমণ: চারিদিকে জোঁক ছড়িয়ে পড়ে।
  • পঙ্গপালের আক্রমণ: পঙ্গপাল এসে মিসরের সমস্ত ফসল ধ্বংস করে দেয়।
  • অন্ধকার: মিসর তিন দিনব্যাপী গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়।

ফারাও প্রত্যেক বিপর্যয়ের পর মুসা (আ) এর কাছে আবেদন করেন, কিন্তু যখনই বিপর্যয় দূর হয়, তিনি আবারও মুসা (আ) এর কথা অমান্য করেন।

ইসরায়েলিদের মুক্তি এবং লোহিত সাগর অতিক্রম

শেষ পর্যন্ত, আল্লাহ মুসা (আ) কে তার অনুসারীদের নিয়ে মিসর ত্যাগ করার নির্দেশ দেন। মুসা (আ) তার অনুসারীদের নিয়ে রাত্রিকালে মিসর থেকে বের হয়ে যান। তারা যখন লোহিত সাগরের (রেড সি) কাছে পৌঁছে যান, তখন পেছনে ফারাওয়ের বিশাল সেনাবাহিনী তাদের ধাওয়া করে। মুসা (আ) আল্লাহর নির্দেশে তার লাঠি দিয়ে সাগরকে আঘাত করেন, আর সাগর দুই ভাগ হয়ে যায়। ইহুদি জনগণ শুকনো পথ ধরে সাগরের ওপার পৌঁছে যায়।

ফারাও এবং তার সেনাবাহিনীও সেই পথ ধরে তাদের অনুসরণ করতে থাকে, কিন্তু তারা সাগরের মাঝখানে পৌঁছানোর পর আল্লাহ সাগরের পানি আবার একত্রিত করে দেন, এবং ফারাওসহ তার সমগ্র সেনাবাহিনী ডুবে যায়।

ইসরায়েলিদের মুক্তির সূচনা

হযরত মুসা (আলাইহিস সালাম) মিসরে আল্লাহর পক্ষ থেকে বার বার ফারাওকে সতর্ক করেন যে, ইসরায়েলি (বনি ইসরাইল) জনগণকে মুক্তি না দিলে তাদের উপর আল্লাহর শাস্তি আসবে। তবে, ফারাও অহংকার ও অবিশ্বাসে অটল ছিল এবং মুসা (আ) এর কথায় কোনো গুরুত্ব দেয়নি। একের পর এক আল্লাহর নাজিলকৃত শাস্তি যেমন পানি রক্তে পরিণত হওয়া, ব্যাঙ, জোঁক, পঙ্গপাল, এবং অন্ধকার মিসরের ওপর নেমে আসলেও, ফারাও তার অবস্থান থেকে সরে আসেনি।

মুসা (আ.) এর নির্দেশে মিসর ত্যাগ

অবশেষে, আল্লাহ মুসা (আ) কে নির্দেশ দেন যে, তিনি এবং তার অনুসারীরা মিসর ত্যাগ করে লোহিত সাগরের (রেড সি) দিকে যাত্রা করবেন। মুসা (আ) রাতে তার অনুসারীদের নিয়ে মিসর থেকে বের হয়ে যান। তাদের যাত্রা গোপনে হলেও, ফারাও এ খবর জানতে পারেন এবং তিনি বিশাল এক সেনাবাহিনী নিয়ে তাদের ধাওয়া করতে থাকেন।

লোহিত সাগরের অতিক্রম এবং ফারাওয়ের ধ্বংস

মুসা (আ) এবং তার অনুসারীরা লোহিত সাগরের তীরে পৌঁছালে, তারা সামনে সাগর এবং পেছনে ফারাওয়ের সেনাবাহিনী দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তখন আল্লাহ মুসা (আ) কে তার লাঠি দিয়ে সাগরকে আঘাত করার নির্দেশ দেন। আল্লাহর কুদরতে, সাগরের পানি দুই ভাগ হয়ে যায় এবং মাঝখানে শুকনো একটি পথ তৈরি হয়। মুসা (আ) এর নেতৃত্বে ইসরায়েলি জনগণ এই পথ দিয়ে সাগরের ওপারে নিরাপদে পৌঁছান।

ফারাও এবং তার সেনাবাহিনীও এই পথ দিয়ে তাদের অনুসরণ করে, কিন্তু যখন তারা সাগরের মাঝখানে পৌঁছে যায়, আল্লাহর আদেশে পানি আবার একত্রিত হয়ে যায় এবং ফারাওসহ তার সমগ্র সেনাবাহিনী সাগরে ডুবে যায়। এইভাবে, আল্লাহ তায়ালা ফারাও এবং তার অত্যাচারী সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করেন এবং ইসরায়েলি জনগণকে মুক্তি দেন।

নতুন যুগের সূচনা এবং মুসা (আ) এর নেতৃত্ব

ইহুদি জনগণ ফারাওয়ের অত্যাচার থেকে মুক্ত হয়ে নতুন একটি স্বাধীন জীবন শুরু করে। মুসা (আ) তাদের আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালনা করতে থাকেন। এই সময়ে, মুসা (আ) আল্লাহ থেকে তাওরাত নামক পবিত্র গ্রন্থ প্রাপ্ত হন, যা ইহুদি ধর্মের মৌলিক আইন ও বিধান নির্ধারণ করে।

তাওরাতের আইন অনুসারে, ইহুদি জনগণকে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং ঈমানের উপর প্রতিষ্ঠিত জীবনযাপন করতে বলা হয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে তারা মুসা (আ) এর নির্দেশ অমান্য করে এবং আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হয়। তবে মুসা (আ) ধৈর্যের সাথে তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেন।

মুসা (আলাইহিস সালাম) এর নেতৃত্বে ইহুদি জনগণের মিসর থেকে মুক্তি পাওয়া একটি মহান ঘটনা। এটি কেবলমাত্র একটি ঐতিহাসিক ঘটনা নয়, বরং এটি আল্লাহর প্রতি ঈমান, ধৈর্য, এবং নেতৃত্বের শক্তির একটি অসামান্য উদাহরণ। মুসা (আ) এর জীবন, তার সংগ্রাম, এবং তার প্রচেষ্টা মানবজাতির জন্য শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে যুগ যুগ ধরে আলোচিত হয়ে আসছে। ইহুদি, খ্রিস্টান, এবং ইসলাম ধর্মে মুসা (আ) এর স্থান অত্যন্ত সম্মানের।

তুর পাহাড়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা

ইসরায়েলিদের মুক্তির পর মুসা (আ) তাদের আল্লাহর নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত করতে থাকেন। তারা বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়ানোর পর সিনাই মরুভূমিতে পৌঁছান, যেখানে তুর পাহাড় অবস্থিত। আল্লাহ মুসা (আ) কে তুর পাহাড়ে আসতে নির্দেশ দেন, যেখানে তিনি আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি কথা বলবেন এবং তাওরাত প্রাপ্ত হবেন।

মুসা (আ) আল্লাহর আদেশ অনুযায়ী তুর পাহাড়ে চড়েন। যাওয়ার আগে তিনি তার ভাই হারুন (আ) কে তার অবর্তমানে ইসরায়েলি জনগণের দায়িত্ব গ্রহণ করতে বলেন।

তাওরাত প্রাপ্তি এবং আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ

মুসা (আ) তুর পাহাড়ে পৌঁছে সেখানে ৪০ দিন ৪০ রাত অবস্থান করেন। এই সময়ে আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) এর সাথে সরাসরি কথা বলেন এবং তাকে তাওরাত প্রদান করেন। তাওরাত ছিল ইসরায়েলি জনগণের জন্য আল্লাহর দেওয়া বিধি-বিধান, যা তাদের জীবনের সব ক্ষেত্রে অনুসরণ করতে হবে। তাওরাতের এই শিক্ষা তাদের সমাজ, ধর্ম, এবং আইনের ভিত্তি গড়ে তোলে।

মুসা (আ) এর আল্লাহর সঙ্গে এই সাক্ষাৎ ছিল একটি অনন্য এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামের দৃষ্টিতে, মুসা (আ) কে “কালিমুল্লাহ” বলা হয়, অর্থাৎ যিনি আল্লাহর সঙ্গে কথা বলেছেন। তাওরাত প্রাপ্তির এই মুহূর্তটি ইসরায়েলি জাতির জন্য এক বিশাল নিয়ামত ছিল, যা তাদের ধর্মীয় জীবনের ভিত্তি তৈরি করে।

ইসরায়েলিদের অবাধ্যতা এবং তাদের পরিণতি

তুর পাহাড়ে আল্লাহর সঙ্গে মুসা (আ) এর সাক্ষাৎ চলাকালীন, ইসরায়েলি জনগণ মুসা (আ) এর অবর্তমানে অধৈর্য হয়ে পড়ে। তারা মনে করতে শুরু করে যে, মুসা (আ) আর ফিরে আসবেন না। কিছু ইসরায়েলি তখন হারুন (আ) এর কাছে গিয়ে একটি মূর্তি তৈরি করার প্রস্তাব দেয়, যা তারা পূজা করতে পারে। হারুন (আ) তাদের বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু কিছু মানুষ তার কথা শোনেনি। তারা সোনা গলিয়ে একটি বাছুরের মূর্তি তৈরি করে এবং তা পূজা করতে শুরু করে।

মুসা (আ) যখন তুর পাহাড় থেকে ফিরে আসেন, তিনি এই অবাধ্যতা দেখে অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি তাওরাতের ফলকগুলো ফেলে দেন এবং ইসরায়েলি জনগণকে আল্লাহর কঠিন শাস্তি সম্পর্কে সতর্ক করেন। যারা এই মূর্তি পূজা করেছিল, তাদের অনেকেই আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হয়।

ইসরায়েলিদের জন্য তাওরাতের শিক্ষা

মুসা (আ) পরবর্তীতে তাওরাতের শিক্ষা পুনরায় ইসরায়েলিদের সামনে উপস্থাপন করেন। তাওরাতের শিক্ষায় ছিল একেশ্বরবাদ, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য, নৈতিকতার প্রতি গুরুত্ব, এবং সামাজিক ও ধর্মীয় আইন। মুসা (আ) ইসরায়েলি জনগণকে বারবার আল্লাহর দিকে ফিরে আসার আহ্বান জানান এবং তাদেরকে সতর্ক করেন যে, যদি তারা আবারও আল্লাহর বিধান অমান্য করে, তাহলে তারা শাস্তির সম্মুখীন হবে।

বনী ইসরায়েলের প্রতিশ্রুত ভূমি (ফিলিস্তিন) অভিমুখে যাত্রা

ইসলামিক ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, বনী ইসরায়েলকে আল্লাহ তায়ালা একটি বিশেষ ভূমির প্রতিশ্রুতি দেন, যা বর্তমানে ফিলিস্তিন নামে পরিচিত। এই ভূমি ছিল একটি পবিত্র স্থান, যেখানে আল্লাহর বাণী মেনে চলা এবং সৎ জীবনযাপন করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল। বনী ইসরায়েলদের এই প্রতিশ্রুত ভূমিতে বসবাস করার জন্য আল্লাহর নির্দেশনা ছিল, তবে এ জন্য তাদের আল্লাহর আদেশ পালন করতে হবে এবং তার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করতে হবে।

মুসা (আ.) এর নেতৃত্বে যাত্রা শুরু

ফারাওয়ের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, মুসা (আলাইহিস সালাম) বনী ইসরায়েলকে নিয়ে ফিলিস্তিন অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। তারা দীর্ঘ সময় ধরে মরুভূমি পাড়ি দেন। আল্লাহ তায়ালা তাদের এই দীর্ঘ যাত্রার সময়ে নানা রকম মু’জিযা (অলৌকিক ঘটনা) প্রদান করেন। যেমন, তাদের জন্য আকাশ থেকে মান্না ও সালওয়া (বিশেষ খাদ্য) পাঠানো হয়, যখন তারা খাদ্যের অভাবে কষ্ট পাচ্ছিল।

তাদের পানির সংকট মেটাতে মুসা (আ) আল্লাহর নির্দেশে তার লাঠি দিয়ে একটি পাথর আঘাত করেন, এবং সেখান থেকে বারোটি ঝর্ণা প্রবাহিত হয়, যা বনী ইসরায়েলের বিভিন্ন গোত্রের জন্য পানি সরবরাহ করে।

প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশের নির্দেশ

অবশেষে, মুসা (আ) এবং তার অনুসারীরা প্রতিশ্রুত ভূমির কাছাকাছি পৌঁছান। আল্লাহ তায়ালা মুসা (আ) কে নির্দেশ দেন যে, তিনি বনী ইসরায়েলদেরকে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করার জন্য প্রস্তুত করবেন। তবে, এই ভূমিতে প্রবেশ করার আগে তাদের একটি বড় চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে।

এই ভূমিতে ইতোমধ্যে বসবাসকারী একটি শক্তিশালী জাতি ছিল, যারা যুদ্ধ করার জন্য প্রস্তুত ছিল। আল্লাহ বনী ইসরায়েলকে নির্দেশ দেন যে, তারা যদি সাহসিকতার সাথে এই জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে, তাহলে আল্লাহ তাদেরকে বিজয়ী করবেন এবং প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশ করার অনুমতি দেবেন।

বনী ইসরায়েলের অবাধ্যতা: ফিলিস্তিনে প্রবেশে অনীহা

যখন মুসা (আ) বনী ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করার নির্দেশ দেন, তখন তারা ভীত হয়ে পড়ে এবং তাদের অনীহা প্রকাশ করে। তারা বলে, “হে মুসা! সেখানে একটি বিশাল ও শক্তিশালী জাতি বসবাস করে। আমরা কখনো তাদের সাথে যুদ্ধ করতে পারব না।” তারা আরও বলে, “তুমি এবং তোমার রব গিয়ে যুদ্ধ কর, আমরা এখানে বসে আছি।” এই অবাধ্যতা এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করার জন্য, আল্লাহ তাদের উপর ক্রুদ্ধ হন।

বনী ইসরায়েলের ৪০ বছরের ভ্রমণ

বনী ইসরায়েলের এই ভীতুতা এবং আল্লাহর আদেশ পালন করতে না চাওয়ার কারণে, আল্লাহ তাদেরকে ৪০ বছর ধরে মরুভূমিতে ঘুরে বেড়ানোর শাস্তি দেন। এই ৪০ বছরের মধ্যে তাদের পূর্ববর্তী প্রজন্ম, যারা আল্লাহর আদেশ মানতে অস্বীকার করেছিল, তাদের বেশিরভাগই মারা যায়। নতুন প্রজন্মের জন্যই প্রতিশ্রুত ভূমিতে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত রাখা হয়।

আল্লাহর অন্যান্য শাস্তি এবং বনী ইসরায়েলের অবাধ্যতা

বনী ইসরায়েলদের মধ্যে বার বার অবাধ্যতা দেখা যায়। তুর পাহাড়ের ঘটনা, যেখানে তারা মূর্তি পূজা করতে চেয়েছিল, এর মধ্যে অন্যতম। এছাড়া তারা মুসা (আ) এর আদেশ মানতে চায়নি, এবং আল্লাহর দেওয়া বিভিন্ন নিয়ম-কানুনের বিরোধিতা করে।

আরেকটি ঘটনা হলো, আল্লাহ তাদের খাবার হিসেবে মান্না ও সালওয়া প্রদান করেন, যা ছিল এক ধরনের বিশেষ খাদ্য। কিন্তু তারা এই খাদ্য নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করে এবং মিসরের বিভিন্ন সবজি, ফলমূল ও খাদ্যের কথা স্মরণ করে। আল্লাহ তাদের এই চাহিদাকে অসন্তোষ ও অবাধ্যতার প্রতীক হিসেবে দেখেন এবং এর জন্য শাস্তি দেন।

মুসা (আ.) এর ধৈর্য এবং বনী ইসরায়েলের পরিণতি

মুসা (আ) এই সমস্ত অবাধ্যতার মুখে ধৈর্য ধারণ করেন এবং বারবার তাদেরকে আল্লাহর পথে ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানান। কিন্তু বনী ইসরায়েলদের একটি বড় অংশ বারবার আল্লাহর আদেশ অমান্য করে।

বনী ইসরায়েলের প্রতিশ্রুত ভূমি অভিমুখে যাত্রা এবং তাদের বিভিন্ন অবাধ্যতা ইসলামের দৃষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষণীয় বিষয়। এটি আমাদের শেখায় যে, আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং তার প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্য প্রদর্শন করা কতটা জরুরি। আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাদের বারবার সুযোগ দেন, কিন্তু তার অবাধ্যতার পরিণতি কখনোই শুভ হয় না। মুসা (আলাইহিস সালাম) এর নেতৃত্বে বনী ইসরায়েলের এই দীর্ঘ যাত্রা এবং তাদের অবাধ্যতার শাস্তি মানবজাতির জন্য একটি শিক্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

বনী ইসরায়েলের নবীদের প্রতি আচরণ

ইসলামের দৃষ্টিতে, বনী ইসরায়েল আল্লাহর প্রেরিত অনেক নবীকে অস্বীকার করেছে এবং এমনকি তাদের মধ্যে কিছু নবীকে হত্যা করেছে। আল্লাহ তায়ালা বারবার তাদের মধ্যে নবী পাঠিয়েছেন, যারা তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু বনী ইসরায়েলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ ছিল বিদ্রোহী, এবং তারা নবীদের কথার প্রতি গুরুত্ব দেয়নি।

নবীদের প্রতি এই বিদ্রোহী আচরণের সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো, তারা হযরত ইয়াহইয়া (আ) এবং হযরত যাকারিয়া (আ) এর মতো পবিত্র নবীদের হত্যা করেছে। কুরআনে ইহুদি জাতির নবীদের হত্যার এই ইতিহাসকে তাদের জন্য একটি বড় পাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।

হযরত ইয়াহইয়া (আ) এর হত্যা

ইসলামি ঐতিহাসিক সূত্র অনুযায়ী, হযরত ইয়াহইয়া (আ) (যিনি খ্রিস্টানদের মতে জন দ্য ব্যাপ্টিস্ট নামে পরিচিত) ছিলেন একজন মহান নবী। তিনি মানুষকে সৎ জীবনযাপনের দিকে আহ্বান করেছিলেন এবং পাপ থেকে বিরত থাকার উপদেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু তার কঠোর সতর্কবাণী এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি অবিচল আনুগত্যের কারণে, তিনি শাসকদের দ্বারা নির্যাতিত হন। হযরত ইয়াহইয়া (আ) কে হত্যা করা হয়, যা বনী ইসরায়েলের জন্য আল্লাহর রোষের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

হযরত যাকারিয়া (আ) এর হত্যা

হযরত যাকারিয়া (আ) ছিলেন হযরত ইয়াহইয়া (আ) এর পিতা এবং একজন সম্মানিত নবী। বনী ইসরায়েল তার প্রচারকাজে বাধা দেয় এবং তাকে নির্যাতন করে। শেষ পর্যন্ত তারা তাকে হত্যা করে। ইসলামের দৃষ্টিতে, এটি ছিল আল্লাহর নবীদের প্রতি বনী ইসরায়েলের চরম অবাধ্যতার একটি প্রমাণ।

ইহুদি জাতির অন্যায় কাজ

বনী ইসরায়েল আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করা ছাড়াও অন্যান্য অনেক অন্যায় কাজ করেছে, যা আল্লাহর রোষের কারণ হয়েছিল। তারা আল্লাহর বিধানকে উপেক্ষা করেছে, সমাজে দুর্নীতি ছড়িয়েছে, মিথ্যাচার করেছে এবং আল্লাহর আদেশ পালনে ব্যর্থ হয়েছে। কুরআনে বলা হয়েছে যে, বনী ইসরায়েল বারবার আল্লাহর পক্ষ থেকে প্রাপ্ত দান-অনুগ্রহকে ভুলভাবে ব্যবহার করেছে এবং আল্লাহর বিধানের প্রতি বিদ্রোহ করেছে। তারা আল্লাহর দেওয়া শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে এবং নিজেদের জন্য নানা বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যা আল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে ছিল।

আল্লাহর শাস্তি

বনী ইসরায়েলের অন্যায় কাজের জন্য আল্লাহ তাদের উপর নানা শাস্তি দিয়েছেন। কুরআনে এবং হাদিসে বিভিন্ন ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে বনী ইসরায়েলকে আল্লাহর শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়েছে।

  • বনী ইসরায়েলের মরুভূমিতে ৪০ বছরের শাস্তি: মুসা (আ) এর নেতৃত্বে ফিলিস্তিনে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে আল্লাহ তাদের ৪০ বছর ধরে মরুভূমিতে ঘুরতে বাধ্য করেন। এই সময়ে তাদের মধ্যে যারা অবাধ্য ছিল, তারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
  • রাজত্ব হারানো: বনী ইসরায়েল তাদের রাজত্ব হারিয়েছে এবং আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন জাতির হাতে পরাজিত হতে দিয়েছেন। এটি তাদের পাপের পরিণতি হিসেবে বিবেচিত হয়।
  • নানাবিধ শারীরিক ও মানসিক শাস্তি: আল্লাহ তাদের মধ্যে নানা রকম শারীরিক এবং মানসিক শাস্তি নাজিল করেছেন, যেমন রোগ-ব্যাধি, দুর্ভিক্ষ, এবং ভ্রান্ত পথ অনুসরণ।

ইসলাম শিক্ষা দেয় যে, যারা আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করে এবং আল্লাহর আদেশ অমান্য করে, তারা অবশ্যই শাস্তির সম্মুখীন হবে। বনী ইসরায়েলের এই ইতিহাস ইসলামি শিক্ষায় একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, যা মানুষের জন্য শিক্ষা এবং সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করে। আল্লাহর আদেশ মেনে চলা এবং তার নবীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা, ইসলামি দৃষ্টিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা এই বিধান অমান্য করে, তারা আল্লাহর শাস্তির অধিকারী হয়।

ইসরায়েলিদের ব্যাবিলনে নির্বাসন এবং ইহুদিদের ছত্রভঙ্গ

ইসলামের দৃষ্টিতে, বনী ইসরায়েলের ওপর আল্লাহর অনেক অনুগ্রহ ছিল, তবে তারা বারবার আল্লাহর আদেশ অমান্য করেছে এবং পাপের পথ অনুসরণ করেছে। আল্লাহ তাদেরকে সঠিক পথে পরিচালিত করার জন্য অনেক নবী পাঠিয়েছেন, কিন্তু ইসরায়েলিরা তাদের নবীদের হত্যা করেছে, মিথ্যা উপাসনা শুরু করেছে, এবং দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে।

তাদের এই অবাধ্যতার কারণে আল্লাহ তাদের ওপর বিভিন্ন শাস্তি নাজিল করেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শাস্তিগুলোর একটি ছিল ব্যাবিলনে নির্বাসন, যা ইসলামের দৃষ্টিতে একটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক ঘটনা।

ব্যাবিলনের শক্তি এবং নেবুচাদনেজার

ব্যাবিলন ছিল মেসোপটেমিয়া অঞ্চলের একটি শক্তিশালী সাম্রাজ্য, যা বর্তমানে ইরাকের অন্তর্ভুক্ত। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে, ব্যাবিলনের রাজা নেবুচাদনেজার (আরবি: বুখতুন্নাসর) বনী ইসরায়েলের ওপর আক্রমণ চালান। কুরআনে স্পষ্টভাবে এই ঘটনার উল্লেখ নেই, তবে ইসলামের ঐতিহাসিক ও তাফসির গ্রন্থগুলোতে এই ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায়।

নেবুচাদনেজার একটি বড় সেনাবাহিনী নিয়ে জেরুজালেম আক্রমণ করেন এবং শহরটি ধ্বংস করে দেন। ইসরায়েলিরা দীর্ঘদিন ধরে অবাধ্যতা ও অন্যায় কাজ করার ফলে, আল্লাহ তাদের এই শাস্তি প্রদান করেন।

ইসরায়েলিদের জেরুজালেম থেকে বিতাড়ন

নেবুচাদনেজারের বাহিনী জেরুজালেম দখল করার পর, তারা শহরটিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে। ইহুদিদের প্রধান উপাসনালয়, যা “সলোমনের মন্দির” (আল মসজিদুল আকসা) নামে পরিচিত, সেটিও ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এই আক্রমণের পর, ব্যাবিলনের সেনারা অনেক ইহুদিকে বন্দী করে এবং তাদেরকে জেরুজালেম থেকে নির্বাসিত করে ব্যাবিলনে নিয়ে যায়।

এই নির্বাসনের ফলে ইহুদিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অনেক ইহুদি তখন মিশর, সিরিয়া, এবং অন্যান্য জায়গায় আশ্রয় নেয়।

ব্যাবিলনে নির্বাসিত জীবন

ইহুদিরা ব্যাবিলনে দীর্ঘ সময় ধরে নির্বাসিত জীবন যাপন করে। তাদের জন্য এটি ছিল কঠিন সময়। তারা তাদের নিজস্ব ভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল এবং ব্যাবিলনের শাসকদের অধীনে কঠোরভাবে বাস করছিল। ব্যাবিলনের সংস্কৃতি এবং ধর্মের প্রভাব তাদের ওপর পড়ে এবং তাদের ধর্মীয় পরিচয় বজায় রাখা কঠিন হয়ে যায়।

ইসলামের দৃষ্টিতে, এই নির্বাসন ইহুদিদের জন্য একটি শাস্তি ছিল। তারা নিজেদের পাপের কারণে এই কঠিন সময়ের সম্মুখীন হয়েছিল। আল্লাহ তাদেরকে বারবার সতর্ক করেছিলেন, কিন্তু তারা তাওবা না করায়, আল্লাহ তাদেরকে এই কঠিন পরীক্ষায় ফেলেছিলেন।

ব্যাবিলন থেকে মুক্তি

প্রায় ৭০ বছর পর, পারস্যের রাজা কুরুশ (আরবি: কিরাস) ব্যাবিলন দখল করে এবং ইহুদিদের মুক্তি দেন। তিনি তাদেরকে নিজেদের ভূমিতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেন এবং সলোমনের মন্দির পুনর্নির্মাণের অনুমতি দেন। ইহুদিদের একটি অংশ তখন জেরুজালেমে ফিরে আসে এবং মন্দির পুনর্নির্মাণ করে।

ইহুদিদের ছত্রভঙ্গ এবং ইসলামের দৃষ্টিকোণ

ইসলামের দৃষ্টিতে, ইহুদিদের এই নির্বাসন এবং ছত্রভঙ্গ তাদের পাপের পরিণতি হিসেবে দেখা হয়। তারা আল্লাহর নির্দেশনা অনুসরণ না করে নবীদের হত্যার মতো গুরুতর পাপ করেছিল। আল্লাহ তাদেরকে শাস্তি দেওয়ার জন্য ব্যাবিলনের মাধ্যমে এই নির্বাসনের ব্যবস্থা করেন। ইসলামে ইহুদিদের এই ঘটনা থেকে শিক্ষা নেওয়া হয় যে, আল্লাহর আদেশ মানতে ব্যর্থ হলে এবং নবীদের প্রতি বিদ্রোহ করলে তার কঠিন পরিণতি হতে পারে। বনী ইসরায়েল এই নির্বাসনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিল যে, আল্লাহর প্রতি আনুগত্য এবং তার আদেশ পালন করা অত্যন্ত জরুরি।

ঈসা (আ.) এর জন্ম এবং বনী ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ঈসা (আ.) এর অলৌকিক জন্ম

ইসলামের দৃষ্টিতে, ঈসা (আলাইহিস সালাম) এর জন্ম একটি অলৌকিক ঘটনা। তার মা মরিয়ম (আ) ছিলেন একজন পবিত্র এবং ধার্মিক নারী, যিনি আল্লাহর নিকট বিশেষ মর্যাদাপ্রাপ্ত ছিলেন। মরিয়ম (আ) তার জীবনের অধিকাংশ সময় উপাসনালয়ে কাটাতেন, এবং সেখানেই আল্লাহর ফেরেশতা জিবরাইল (আ) তাকে ঈসা (আ) এর জন্মের সুসংবাদ দেন।

ফেরেশতা জিবরাইল (আ) তাকে জানান যে, আল্লাহ তার মাধ্যমে একটি অলৌকিক সন্তান দান করবেন, যার নাম হবে ঈসা (আ)। মরিয়ম (আ) অবাক হন এবং বলেন, “কীভাবে আমার সন্তান হবে, যখন কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করেনি?” ফেরেশতা তাকে উত্তর দেন যে, “এটা আল্লাহর আদেশ, এবং তিনি যা চান, তাই ঘটে।” (সূরা মারিয়াম: ১৯:১৬-২১)

এইভাবে, আল্লাহর আদেশে ঈসা (আ) জন্মগ্রহণ করেন কোনো পিতার সহায়তা ছাড়াই। এটি আল্লাহর এক বিশেষ নিদর্শন এবং ঈসা (আ) এর জন্ম ইসলামের দৃষ্টিতে একটি বড় মু’জিযা হিসেবে পরিগণিত হয়।

ঈসা (আ.) এর জন্মের পর মরিয়ম (আ) এর পরীক্ষা

ঈসা (আ) এর জন্মের পর মরিয়ম (আ) কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হন। সমাজের মানুষ তার প্রতি সন্দেহ করতে শুরু করে এবং তাকে অবমাননাকর মন্তব্য করতে থাকে। কিন্তু মরিয়ম (আ) আল্লাহর আদেশ অনুসারে চুপ থাকেন এবং শিশুটিকে নির্দেশ দেন কথা বলার জন্য। ঈসা (আ) নবজাতক অবস্থায়ই কথা বলতে শুরু করেন এবং ঘোষণা করেন যে, তিনি আল্লাহর নবী এবং তিনি আল্লাহর পথে মানুষকে আহ্বান জানাবেন। (সূরা মারিয়াম: ১৯:২৯-৩৩)

বনী ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া

ঈসা (আ) এর অলৌকিক জন্ম এবং মরিয়ম (আ) এর পুত্র হওয়ার খবর বনী ইসরায়েলের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তারা মরিয়ম (আ) এর পবিত্রতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে এবং ঈসা (আ) কে অবিশ্বাস করতে থাকে।

বনী ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে আল্লাহর নবীদের অস্বীকার করে আসছিল, এবং তারা ঈসা (আ)কেও অস্বীকার করে। তারা মনে করেছিল যে, ঈসা (আ) তাদের প্রতিষ্ঠিত শাসনব্যবস্থা এবং ধর্মীয় নিয়মাবলীকে চ্যালেঞ্জ করছেন। ঈসা (আ) তাদের দুর্নীতি এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলতেন, যা বনী ইসরায়েলের অনেক নেতার জন্য ছিল অসহনীয়।

ঈসা (আ) এর বার্তা

ঈসা (আ) বনী ইসরায়েলের কাছে আল্লাহর একত্বের বার্তা নিয়ে আসেন এবং তাদের ভুলপথ থেকে সরে আসার আহ্বান জানান। তিনি তাদের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা, সাম্য, এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের শিক্ষা দেন। তিনি অলৌকিক ঘটনাও প্রদর্শন করেন, যেমন মৃতদের পুনর্জীবিত করা, অন্ধদের চোখে দৃষ্টি ফেরানো, এবং কুষ্ঠরোগীদের সুস্থ করে তোলা।

তবে, বনী ইসরায়েলের অধিকাংশ অংশ ঈসা (আ) এর এসব মু’জিযা ও বার্তাকে অবিশ্বাস করতে থাকে এবং তার বিরোধিতা করে। তারা মনে করেছিল যে, ঈসা (আ) তাদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে বিপন্ন করছেন, তাই তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে।

ঈসা (আ) এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং আল্লাহর রক্ষা

বনী ইসরায়েলের নেতারা ঈসা (আ) এর ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা এবং প্রভাব দেখে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং তাকে হত্যা করার পরিকল্পনা করে। তারা রোমান শাসকদের কাছে মিথ্যা অভিযোগ করে যে, ঈসা (আ) বিদ্রোহের চেষ্টা করছেন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আহ্বান জানায়।

তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে, আল্লাহ ঈসা (আ)কে রক্ষা করেন এবং তাকে সরাসরি আসমানে তুলে নেন। কুরআন অনুযায়ী, ঈসা (আ)কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি, বরং আল্লাহ তাকে তার কাছে তুলে নিয়েছেন এবং তার পরিবর্তে অন্য একজনকে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়েছিল, যার চেহারা ঈসা (আ) এর মতো করা হয়েছিল। (সূরা নিসা: ৪:১৫৭-১৫৮)

ইহুদি নেতাদের ঈসা (আ.)কে ক্রুশবিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র

ঈসা (আ.) এর প্রচার ও ইহুদি নেতাদের বিদ্বেষ

ঈসা (আ.) ছিলেন একজন আল্লাহর নবী, যিনি বনী ইসরায়েলের মধ্যে প্রচার করতে আসেন। তিনি আল্লাহর একত্বের বার্তা প্রচার করেন এবং ইহুদিদের ধর্মীয় ভুল এবং সমাজের অবিচারগুলো সংশোধনের চেষ্টা করেন। ঈসা (আ.) এর শিক্ষার মূল লক্ষ্য ছিল বনী ইসরায়েলকে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনা এবং তাদের মধ্যে প্রকৃত ধর্মীয় মূল্যবোধ জাগ্রত করা।

তবে, বনী ইসরায়েলের নেতারা ঈসা (আ.) এর এই প্রচারে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তারা মনে করেছিল যে, ঈসা (আ.) তাদের ধর্মীয় ক্ষমতা এবং প্রভাবকে হুমকির মুখে ফেলছেন। এছাড়া, ঈসা (আ.) এর অলৌকিক ক্ষমতা, যেমন মৃতদের জীবিত করা এবং রোগীদের সুস্থ করা, নেতাদের মধ্যে ঈর্ষার সৃষ্টি করেছিল। তারা তাকে মিথ্যাবাদী এবং বিপজ্জনক বিদ্রোহী হিসেবে চিত্রিত করতে শুরু করে।

ষড়যন্ত্র এবং রোমান শাসকদের প্রভাব

ইহুদি নেতারা ঈসা (আ.)কে নির্মূল করার ষড়যন্ত্র শুরু করে এবং রোমান শাসকদের কাছে তাকে ধরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তারা রোমানদের বোঝাতে চেষ্টা করে যে, ঈসা (আ.) তাদের জন্য একটি বড় হুমকি, যিনি রোমান শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারেন। এই কারণে, রোমান শাসকরা ঈসা (আ.)কে গ্রেপ্তার করে এবং তাকে ক্রুশবিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

আল্লাহর হেফাজত ও ক্রুশবিদ্ধের পরিবর্তন

তবে, ইসলামের দৃষ্টিতে, ঈসা (আ.)কে ক্রুশবিদ্ধ করা হয়নি। কুরআন স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, আল্লাহ ঈসা (আ.)কে ক্রুশবিদ্ধের শাস্তি থেকে রক্ষা করেছেন। কুরআনের সূরা নিসা (৪:১৫৭-১৫৮) আয়াতে বলা হয়েছে যে, তারা ঈসা (আ.)কে হত্যা বা ক্রুশবিদ্ধ করেনি, বরং আল্লাহ তাকে সরাসরি আসমানে তুলে নিয়েছেন এবং তাদের মধ্যে কাউকে ঈসা (আ.) এর মতো দেখানো হয়েছিল। ফলে, ইহুদি নেতারা তাদের ষড়যন্ত্রে সফল হয়নি।

ঈসা (আ.) এর প্রত্যাবর্তন

ঈসা (আ.) এর জীবিত আসমানে উত্তোলন

ইসলামে বিশ্বাস করা হয় যে, ঈসা (আ.) মৃত্যুবরণ করেননি, বরং আল্লাহ তাকে জীবিত আসমানে তুলে নিয়েছেন। তিনি বর্তমানে আসমানে আছেন এবং পৃথিবীর শেষ সময়ে তার প্রত্যাবর্তন হবে। এই বিষয়টি ইসলামি ঐতিহ্য ও বিশ্বাসের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

দাজ্জালের আগমন এবং ঈসা (আ.) এর প্রত্যাবর্তন

ইসলামী বিশ্বাস অনুযায়ী, কিয়ামতের পূর্বে দুনিয়াতে দাজ্জাল নামক এক বিশাল ফিতনা সৃষ্টি হবে। দাজ্জাল নিজেকে ঈশ্বর হিসেবে ঘোষণা করবে এবং অনেক মানুষকে তার দিকে আকৃষ্ট করবে। সে প্রচণ্ড শক্তিশালী হবে এবং পৃথিবীতে অনেক ধ্বংসযজ্ঞ চালাবে।

এই সময়, আল্লাহ ঈসা (আ.)কে পৃথিবীতে পুনরায় প্রেরণ করবেন। তিনি শাম (বর্তমান সিরিয়া) এর পূর্ব দিকে সাদা মিনারায় অবতরণ করবেন এবং তার হাতের মধ্যে একটি তীর থাকবে। তিনি মুসলমানদের ইমাম মাহদির সাথে মিলিত হবেন এবং দাজ্জালকে হত্যা করবেন। তার প্রত্যাবর্তন মুসলিম উম্মাহর জন্য বড় রক্ষা এবং শান্তির সূচনা করবে।

ঈসা (আ.) এর ভূমিকা এবং পৃথিবীতে অবস্থান

ইসলামের দৃষ্টিতে, ঈসা (আ.) পৃথিবীতে ফিরে এসে আল্লাহর নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা করবেন এবং ইসলামের ন্যায়বিচার ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি সমস্ত ভ্রান্তি ও মিথ্যা ধর্মীয় বিশ্বাসের অবসান করবেন এবং মানুষকে এক আল্লাহর প্রতি ইমান আনার আহ্বান জানাবেন।

ঈসা (আ.) এরপর দীর্ঘ সময় পৃথিবীতে অবস্থান করবেন এবং এই সময়ে ইসলাম একটি বিশ্বব্যাপী ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে। তিনি বিবাহ করবেন, সন্তানসন্ততি জন্ম দেবেন, এবং একজন সাধারণ মানুষের মতো জীবনযাপন করবেন। শেষে, তিনি স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করবেন এবং মুসলমানদের মতে, তাকে মদিনায় নবী মুহাম্মদ (সা.) এর কবরের পাশে সমাহিত করা হবে।

মদিনায় ইহুদি সম্প্রদায় এবং ইসলামের প্রসার

মদিনার প্রাথমিক অবস্থা

মদিনা, যা তখন ইয়াসরিব নামে পরিচিত ছিল, ছিল এক বহু-ধর্মীয় এবং বহু-সাংস্কৃতিক শহর। এখানে আরবদের বিভিন্ন গোত্র এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের বেশ কয়েকটি শক্তিশালী গোত্র বাস করত। ইসলামের আগমনের পূর্বে, মদিনার ইহুদি সম্প্রদায় ছিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে বেশ প্রভাবশালী। তাদের ছিল শক্তিশালী বাণিজ্যিক অবস্থান, এবং তারা বহু জমি ও সম্পত্তির মালিক ছিল।

ইসলামের আগমন এবং মদিনার মুসলিম সমাজ

মক্কায় নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তার অনুসারীদের উপর ক্রমাগত নির্যাতনের ফলে, আল্লাহর নির্দেশে নবী (সা.) মদিনায় হিজরত করেন। মদিনার মুসলিম এবং ইহুদি সম্প্রদায়ের মধ্যে তখনো সরাসরি কোন বিরোধ দেখা দেয়নি। মদিনায় আগমনের পর, নবী (সা.) এক নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ শুরু করেন, যেখানে মুসলিম ও ইহুদি গোত্রেরা একসাথে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে পারে।

মদিনার সনদ

নবী মুহাম্মদ (সা.) মদিনায় পৌঁছানোর পর, তিনি এক নতুন সমাজ গঠনের জন্য একটি ঐতিহাসিক চুক্তি করেন, যা “মদিনার সনদ” নামে পরিচিত। এই সনদ ছিল এক প্রকার সংবিধান, যা মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মধ্যে পারস্পরিক সহাবস্থান ও শান্তি রক্ষার জন্য প্রণীত হয়েছিল।

এই সনদের মাধ্যমে, মদিনার সব সম্প্রদায়কে সম্মান, স্বাধীনতা, এবং নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, সব সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে না এবং বাইরের কোনো শত্রুর আক্রমণে সবাই একসাথে প্রতিরোধ করবে।

বনী কুরাইজা এবং অন্যান্য ইহুদি গোত্রের সাথে সম্পর্ক

বনী কাইনুকা এবং বনী নাদীরের সাথে সম্পর্ক

ইসলামের প্রাথমিক সময়ে, মদিনার ইহুদি গোত্রগুলোর মধ্যে বনী কাইনুকা এবং বনী নাদীর ছিল গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমদিকে, তারা মদিনার মুসলমানদের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়, তবে সময়ের সাথে সাথে তাদের মধ্যে বিশ্বাসঘাতকতা শুরু হয়।

বনী কাইনুকা: বনী কাইনুকা গোত্র ছিল মদিনার অন্যতম ইহুদি গোত্র, যারা মূলত স্বর্ণকার এবং ব্যবসায়ী ছিল। তারা মদিনার সনদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শুরু করে। নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদেরকে এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন।

বনী নাদীর: বনী নাদীর গোত্রও মদিনার সনদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং মুসলমানদের হত্যার ষড়যন্ত্র করে। নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদেরকেও মদিনা থেকে বহিষ্কার করেন। তারা খায়বারে আশ্রয় নেয় এবং মুসলিম বিরোধী ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে।

বনী কুরাইজা এবং তাদের বিশ্বাসঘাতকতা

বনী কুরাইজা ছিল মদিনার একটি শক্তিশালী ইহুদি গোত্র, যারা মদিনার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে বসবাস করত। তারা শুরুতে মদিনার সনদ মেনে চলে এবং মুসলিমদের সাথে শান্তিপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখার প্রতিশ্রুতি দেয়। তবে, খন্দকের যুদ্ধের সময়, যখন মক্কার কুরাইশ বাহিনী মদিনার উপর আক্রমণ করে, তখন বনী কুরাইজা মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং কুরাইশ বাহিনীর সাথে গোপনে যোগ দেয়।

এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণে মুসলমানদের অবস্থান বিপদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কিন্তু আল্লাহর সাহায্যে তারা এই আক্রমণ প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। যুদ্ধে পরাজয়ের পর, নবী মুহাম্মদ (সা.) বনী কুরাইজা গোত্রের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেন। তাদের ষড়যন্ত্রের কারণে মদিনার সুরক্ষা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হয়েছিল, এবং ইসলামী আইন অনুযায়ী তাদের বিচার করা হয়। বনী কুরাইজার পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় এবং তাদের নারীদের ও শিশুদের বন্দী করা হয়।

খায়বারের যুদ্ধ

বনী নাদীর এবং অন্যান্য বহিষ্কৃত ইহুদি গোত্র খায়বারে অবস্থান নিয়ে মুসলিমদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চালিয়ে যেতে থাকে। নবী মুহাম্মদ (সা.) খায়বারের দিকে অভিযান চালান এবং খায়বারের ইহুদি গোত্রকে পরাজিত করেন। খায়বারের যুদ্ধ ইসলামের জন্য একটি বড় বিজয় ছিল, এবং এখান থেকে প্রাপ্ত সম্পদ মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক অবস্থাকে মজবুত করে।

ইহুদি জাতির ইতিহাস নিয়ে লেখা আমাদের আজকের পর্ব এখানেই সমাপ্তি ঘোষণা করছি। আমরা এরপর ২য় পর্বে আলোচনা করবো আধুনিক ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা এবং তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং ইসলামের দৃষ্টিতে ইহুদি জাতির ভবিষ্যৎ এবং দাজ্জালের আগমন সম্পর্কে। এছাড়াও থাকছে, ইহুদি জাতি ও ধর্মের পার্থক্য এবং হযরত দাউদ (আ) এবং সুলাইমান (আ) এর সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু ঐতিহাসিক ঘটনা।

Previous article২০২৪ সালে বাংলাদেশের সেরা দশটি ব্যাংক ও কোন ব্যাংক বেশি নিরাপদ?
Next articleইহুদি জাতির ইতিহাস, সেই শুরু থেকে আজকের দিন পর্যন্ত, পর্ব-০২
Md. Zakaria Ahomed
I am zakaria. I am small blogger. Side by side I am writing for others blog also. Feel free to knock me if you need me.