পরের দিন অফিসে গিয়েই জানতে পারলাম আজকে আমার সাইট ভিজিট আছে, সাইটের এড্রেস আর কোঅরডিনেট নিয়ে গুগল ম্যাপে লোকেশন দেখলাম- দুরত্ব খুব বেশি না, অফিস থেকে ১০ কিলোমিটারের মত। ভয় পেয়ে গেলাম। ড্রাইভ করেই যেতে হবে, উপায় নাই। জনি আমাকে সাহস দিল। নিয়ম-কানুন মেনে গাড়ি চালাবি, আস্তে চালাবি কেও কিছু বলবেনা, আর ট্রাফিক রুলস মেনে চালালে কোন সমস্যা নাই, বের হয়ে যা কুইক। গাড়ির চাবি, ল্যাপ্টপের ব্যাগ আর জিপিএস নিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে অফিস পারকিং এ গেলাম। জিপিএস এ সাইটের লোকেশন সেট করে নিলাম। আমার প্রথম ড্রাইভিং শুরু হয়ে গেল।
আগের পর্বগুলো যারা পড়েন নাই তারা চাইলে পর্ব-০১ এবং পর্ব-০২ পড়ে আসতে পারেন, বুঝতে সুবিধা হবে আশা করি। যাই হোক আবার শুরু করা যাক।
বিসমিল্লাহ বলে গাড়ি স্টার্ট দিলাম। ড্রাইভ করা যে কি কঠিন কাজ মনে হচ্ছিল বলে শেষ করা যাবেনা। সামনে পিছে, ডানে বামে আবার জিপিএস এর পর্দায় তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে কুতুমুতু করতে করতে সাইটে পৌছে গেলাম, আলহামদুলিল্লাহ। মালেশিয়াতে হাইওয়ে তে কোন সিগন্যাল নাই। বেশিরভাগ রাস্তায় ৩-৪ টি লেন মিনিমাম আছেই। আগেই শুনে নিয়েছিলাম গাড়ির গতি যদি ৬০-৮০ কিমি/ঘন্টা হয় তাহলে ৩ নাম্বার লেনে চালাতে হয়, গতি যদি ৮০-১০০ কিমি/ঘন্টা হয় তাহলে ২ নাম্বার লেন আর ১০০+ স্পিডে যারা গাড়ি চালাবে তারা চালাবে তাদের জন্য ১ নাম্বার লেন বরাদ্দ। আমি একেবারেই আনাড়ি হওয়ায় ৩ নাম্বার লেনে গাড়ি চালাই। তবে আস্তে আস্তে যখন গাড়ি চালানটা আয়ত্বে চলে আসে ১ নাম্বার লেনেও গাড়ি চালিয়েছি আলহামদুলিল্লাহ। কোনদিন কোন এক্সিডেন্টে পরি নাই। সবই আল্লাহর রহমত। আর বাপ-মায়ের দোয়া। মনে আছে, প্রায় দিনেই গাড়ি স্টার্ট দেয়ার আগে আম্মাকে ফোন করে নিতাম, যদি এক্সিডেন্ট করে মরে যাই এই ভয়ে। ড্রাইভিং ছিল আমার জন্য এক বিভীষিকার মত।
মালেশিয়াতে এই ৭ মাস ছিলাম প্রায় ১৫০+ সাইট ভিজিট করেছি। মাঝে মাঝেই আমি এক কাজ করতাম। ড্রাইভ করার ভয়ে সাবকন্টাক্টরকে ফোন দিয়ে বলতাম “সাইট তো খুব বেশি দূরে না, আমাকে অফিসে এসে পিক করে নিয়ে যাও“। নিয়ে যেত আবার অফিসে দিয়ে যেত। ওই দিনের জন্য ড্রাইভিং থেক বেচে যেতাম। হাহা হা ।
ওখানে ড্রাইভ করতে গিয়ে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে যা শেয়ার করার জন্যই মূলত আমার এই লেখা। একে একে বলছি।
লেন মেইনটেইন করে ড্রাইভ করা
আমি যেহেতু কোথাও থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ড্রাইভিং শিখি নাই, অন্যেদের ড্রাইভিং দেখেই আমাকে শিখতে হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমে আসে লেন মেইন্টেইন করে ড্রাইভ করা। লেন মেইন্টেইন করে ড্রাইভ করাই না শুধু লেন চেঞ্জ করতে হলেও ইন্ডীকেটরে সিগন্যাল দিয়ে লেন চেঞ্জ করতে হবে। দেশে আসার পর বেশ পাকা ড্রাইভারকেও যখন আমি বলেছি সে আমার সাথে তর্কে জড়িয়ে পরে। কোনভাবেই আমি বুঝাতে পারলাম না লেন চেঞ্জ করার সময় ইনডিকেটরে সিগন্যাল দেয়ার প্রয়োজনীয়তা। তার ভাষ্য অনুযায়ী সিগ্ন্যাল দেয়া ত দুরের কথা, দুই লেনের রাস্তায় নাকি রাস্তার মাঝখান দিয়ে চলাচল করাই নিয়ম।
যার ফলাফল ঢাকা-চিটাগং হাইওয়েতে আমরা দেখতে পাই। দুই লেন থাকার পরেও তারা দুইলেনের মাঝ দিয়া চলাচল করে, সেকারণে, দুই লেন থাকলেও আমরা তার বেনিফিট নিতে পারছিনা। কি আজব রে বাবা ! এই জিনিষ দেখতে হলে শুধু বাংলাদেশেই আসতে হবে মেবি।
এ্যাম্বুলেন্সকে সাইড দেয়া
আমি একদিন ট্রাফিক জ্যামে আকটা পড়ে আছি। হঠাত খেয়াল করে দেখলাম আমার সামনের সব গাড়ি যে যতটুকু পারে ডানে সরে যাচ্ছে। আর আমার বামের লেনে যে আছে সে সাধ্যমত বামে চাপাই নিচ্ছে গাড়ী। পেছনে তাকিয়ে দেখি একটা এ্যাম্বুলেন্স আসছে। মুহুরতেই বুঝে গেলাম ঘটনা কি? আমিও ডান দিকে কাটলাম গড়িটা নিয়ে। নির্বিঘ্নে এম্বুলেন্সটা মাঝখান দিয়ে চলে গেল। কি সুন্দর ঘটনা। মনটাই ভরে গেল। আমাদের দেশের অবস্থাটা আর নাই বা বললাম। তবে হ্যা মটর সাইকেলের উৎপাত ওখানেও চরম।
চৌরাস্তার একদিকে জ্যাম থাকলে কি হয়
একদিন অফিস থেকে ফেরার পথে খেয়াল করলাম। সিগন্যালের কারনে অনেক লম্বা ট্রাফিক জ্যাম লেগে আছে। জ্যামটি চৌরাস্তা ছাড়ীয়ে আরও অনেক লম্বা হয়ে গেছে। বুঝলাম না কেন জানি সবাই সামনে কিছুটা ফাকা রেখে দিয়েছে। দূর থেকে আমি খেয়াল করছি ব্যাপারটা আর চিন্তা করছি। হায়, আমার দেশ হলে কি করতাম। সামনে সামান্য ২ফিট জায়গা পেলেই আমরা গাড়ি আরেকটু টেনে সামনে নিয়ে নেই আর এরা প্রায় ২০ ফিট ফাকা রেখে দিছে, বেকুব নাকি? সামনে আগাতে আগাতে বুঝলাম, যেহেতু এটা চৌরাস্তা তাই ওই রোডে যারা যাবে তারা যেন নির্বিঘ্নে যেতে পারে তাই গ্যাপ রেখে দিয়েছে। কি সুন্দর ভদ্রতা। আহা, আমরা কোথায় আছি!
গভীর রাতে রাস্তার সিগন্যাল
কিছুদিন রাতের বেলা সাইট ভিজিট করতে গিয়ে দেখেছি রাত ৩টা/৪টার সময়ো রাস্তায় লাল বাতির সিগন্যালে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সবুজ বাতি জ্বললে তারপর সিগন্যাল পার হচ্ছে। এমনকি এই দৃশ্য আমি আমাদের পাশের দেশ মায়ানমারেরও দেখেছি। আমাদের দেশে এরকম দেখতে পাওয়া এক প্রকার অসম্ভব। ও স্যরি, আমাদের দেশে ত রাস্তায় কোন সিগ্ন্যালিং সিস্টেমই নাই। অবাক ব্যাপার। দুনিয়ার কেও হয়ত বিশ্বাসই করবেনা শুনলে।
রাস্তার টোল আর টোল ফ্রি রাস্তা
মালেশিয়ার রাস্তায় প্রচুর টোল। আপনি যদি টোল ফ্রি যেতে চান সেই ব্যবস্তাও আছে। একটু ঘুরা পথে যেতে হতে পারে। আমি প্রায়ই চলাচল করি এরকম একটা রাস্তায় আই প্রতিদিন টোল দিতাম। একদিন হঠাত দেখি রাস্তায় টোল নাই মানে টোল প্লাজার গেইট ওপেন করে দিছে। অফিসে এসে লোকাল কলিগকে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা। সে যা বলল তা শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তার ভাষ্যমতে ওই রাস্তার খরচের টাকা সরকারের উঠে গেছে তাই সরকার এখন অইখান থেকে আর টোল নিচ্ছে না। রাস্তা টোল ফ্রি করে দিয়েছে। হায় হায় কয় কি? ১৯৯৮ সাল থেকে যমুনা সেতুতে টোল দিয়া আসতেছি। আজও আমাদের রাস্তার টাকা শোধ হয় নারে ভাই।
বলা হয় নাই, আপনি চাইলে তিনভাবে টোল পরিশোধ করতে পারেন। এক- ম্যানুয়ালি মানে আমরা যেভাবে দেই। দুই- টাচ এন্ড গো কার্ড সিস্টেম। আর শেষটা হল আপনার গাড়িতে ডিভাইস থাকবে, পেমেন্ট দেয়া থাকলে টোল প্লাজার গেট অটোমেটিক খুলে যাবে।
গাড়ি ফলো করলে কালার না, নাম্বার প্লেট দেখে ফলো করুন
আমি একদিন এক সাইট ভিজিট করে দেখি একই কন্ট্রাক্টরেরই পরের সাইট। আমি বললাম চল পরের সাইটে যাই। ও বলল তুমি আমার গাড়ি ফলো করে আস। ততদিনে আমি কিছুটা ড্রাইভিং শিখে গেছি আমি বললাম অকে নো প্রবলেম। লেটস স্টার্ট। আমি খেয়াল করলাম তার গাড়িটার কালার হালকা নীল, আমি স্টার্ট দিতে দিতেই সে বের হয়ে গেল। আমি বের হয়ে দেখি রাস্তায় একই কালারের অনেক গাড়ি! ব্যাটাকে ত আর খুজে পাইনা। বুঝলাম কালার না গাড়ির নাম্বার প্লেট দেখে ফলো করা উচিত ছিল। যাই হোক কিভাবে যেন খুজে বের করে সাইটে পৌছেছিলাম।
তুমুল বৃষ্টি এবং হঠাত থেমে যাওয়া
মালেশিয়া দ্বীপ রাস্ট্র হবার কারনে প্রায়ই বৃষ্টি হত। আর এটা যে সে বৃষ্টি নারে ভাই। তুমুল বৃষ্টি। গাড়ির উইন্ডশীল্ড ওয়াইপার দিয়ে মুছে কুল পাওয়া যায় না। অল্প পরেই মানে ৩০/৩৫ মিনিট পরেই আবার থেমে যেত। এরকম বৃষ্টি মানেই এক্সিডেন্ট। আমি প্রায়ই দেখতাম বৃষ্টির পর এক্সিডেন্ট করা গাড়ি রেকার দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। এরকম বৃষ্টি হলে আমি গাড়ি ইমারজেন্সি লেনে সাইড করে ইমারজেন্সি বাতি দিয়ে বসে থাকতাম। বৃষ্টি থামলে আবার শুরু করতাম যাত্রা। একদমই রস্ক নিতাম না।
হর্ন দেয়াটা এক প্রকারের গালি দেয়ার শামিল
রাস্তা মোটামুটি নিরবই বলা চলে। কেও কারো পেছনে পরলেই যে তাকে হর্ন দিতে হবে অযথা তা নয়। কেও ভুল করে ফেললে সে হর্ন খাবে এটাই নিয়ম। অথচ আমরা সামান্য করনেই হর্ন দেই এবং পারলে সারা রাস্তা হরনের উপরেই থাকি। অখানে কাওকে হর্ন দেয়া মানে কাওকে গালি দেয়ারই সামিল। আমাদের এই অভ্যাসটা চেঞ্জ করা খুবই জরুরী। ইদানিং অবশ্য আমাদের দেশে অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে বলতেই হবে।
এরকম বলতে থাকলে আরও অনেক কিছু আছে শেষ করতে আরও অনেক কিছু লিখতে হবে, লেখা অনেক লম্বা হয়ে যাবে। তবে পারকিং নিয়ে আসলে না লিখলেই নয় তাই আরেক পর্বে আমি পারকিং নিয়ে লিখব, আর ড্রাইভিং করা কালে আমার করা ভুলগুলো নিয়ে আরেকটা ব্লগ লিখব ইন্সাল্লাহ। ।
কিন্তু কেন আমাদের দেশে এই দুরাবস্তা এবং এথেকে মুক্তির উপায় কি এটা না লেখলেই হচ্ছে না। আমার সীমিত জ্ঞানে যেটুকু কুলায় আর কি!
কেন আমাদের দেশে এই দুরাবস্তা এবং এথেকে মুক্তির উপায় কি
আমি অনেক ভেবেছি কেন আমাদের দেশের এই অবস্থা? আমার দৃষ্টিতে এর কারন মনে হয়েছে একটাই। সেটা হল আমাদের দেশের ১০০% ড্রাইভার গাড়ি চালাতে পারে কিন্তু রাস্তায় কিভাবে গাড়ি চালাতে হয় সেটা জানে না। তারা ওস্তাদের কাছে ড্রাইভিং শিখে কিন্তু রাস্তায় চলাচল করতে হয় কিভাবে সেই শিক্ষা তাকে দেয়া হয় না। ঠিক আমি যেভাবে শিখেছি।
আমাদের এখানে প্রোপার ড্রাইভিং স্কুলিং সিস্টেম নাই। অথচ প্রায় বেশিরভাগ দেশেই কিছু নির্দিষ্ট সময় আপনাকে ড্রাইভিং স্কুলে শিখতেই হবে নইলে আপনি এপ্লাই করতে পারবেন না লাইসেন্সের জন্য। আর আমাদের এখানে আপনি গাড়ি চালাতে পারেন আর কিছু লাগবেনা, এপ্লাই করেন কিছু টাকা খরচ করেন। নির্দিষ্ট কিছু সময় পরে আপনি একটি ড্রাইভিং লাইসেন্সের গর্বিত মালিক বনে যান। কিযে মজারে ভাই। শুনেছিলাম কোন মন্ত্রি একবার বলেছিল গরু আর মানুষের মাঝে পার্থক্য করতে পারলেই তাকে লাইসেন্স দেয়া যায়।
তাহলে এখান থেকে উত্তরনের উপায় একটাই। আগের সব ড্রাইভিং লাইসেন্সধারীদের একটা ট্রেইনিং এর আওতায় আনা এবং প্রোপার ট্রেইনিং এর পরে তাদের নতুন লাইসেন্স দেয়া, আসলে গাড়ি চালানো ত সহজ এবং পুরানোরা এটা বেশ ভালই পারে, রাস্তায় চলাচলের নিয়ম কানুন টা শিখানই আসল উদ্দেশ্য। আর নতুন যারা লাইসেন্স নিতে চায় তাদেরকে প্রোপার স্কুলিং এর মাধ্যমে নিয়ে আসা। লাইসেন্স প্রদানের সিস্টেমে আরও নজরদারি বাড়ানো। কেও যেন দুই নাম্বারি না করতে পারে। আর আমার ওই পুরানো ডায়লগ, হাই স্কুলের সিলেবাসে রাস্তায় চলাচলের নিয়ম এমন কি ড্রাইভিং এর সাধারন নিয়মগুলো অন্তরভুক্ত করা উচিত।
আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। আবার আরেক পর্বে কথা হবে।