আমাদের দেশ বাংলাদেশও যে অনেক বিশ্ববিখ্যাত মানুষের জন্ম দিয়েছে তা হয়ত আমরা অনেকেই জানিনা। আমাদের সকলের উচিত এইসব জগৎবিখ্যাত মানুষদের নতুন প্রজন্মের কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। এতে নতুন প্রজন্ম জগৎবিখ্যাত হবার অনুপ্রেরণা পাবে। আমরাও পারি -এই ধারনাটা তাদের মাঝে তৈরি হবে। খেয়াল করলে দেখবেন ভারতের ব্যাটিং লিজেন্ড টেন্ডুলকার শুধু নিজেই খেলেননি, তাকে দেখে আরও অনেক টেন্ডুলকার তৈরি হয়েছে ভারতের বুকে। ছোটবেলা থেকেই ভারতের যেকোন ক্রিকেট খেলোয়ারের মাঝেই স্বপ্ন থাকে সে বড় হয়ে টেন্ডুলকার হবে। এই স্বপ্নটা টেন্ডুলকার তৈরি করে দিয়ে গেছেন। আজ আমি বাংলাদেশের এমনই একজন জগৎবিখ্যাত বাংলাদেশি ব্যক্তিকে আপনাদের সামনে পরিচয় করিয়ে দিব। তার নাম সাইফুল আজম, তিনি ছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একজন অবসর প্রাপ্ত বৈমানিক। অবসর প্রাপ্ত বৈমানিক তো আরও অনেকেই আছেন কিন্তু তিনি কেন জগৎবিখ্যাত? পড়তে থাকুন।
লিভিং ঈগল সাইফুল আজমকে নিয়ে ইউটিউব ভিডিও দেখুন
জন্ম ও শিক্ষাজীবন
সাইফুল আজম ১৯৪১ সালে পাবনা জেলার খগড়বাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। নুরুল আমিন তার পিতার নাম এবং বাবার কর্মসূত্রে ছোটবেলা কাটে কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময় তার পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, বর্তমান বাংলাদেশে চলে আসেন। ১৫ বছর বয়সে তিনি উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করে উচ্চ শিক্ষার জন্য.১৯৫৬ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে যান।১৯৫৮ সালে তিনি পাকিস্তান এয়ার ফোরস ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হন। ১৯৬০ সালে তিনি পাইলট অফিসার হয়ে তার শিক্ষা সম্পন্ন করেন। একই বছর তিনি জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসেবে কমিশনপ্রাপ্ত হয়ে যোগ দেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে।
প্রশিক্ষন এবং কর্মজীবন
সাইফুল আজমের প্রাইমারি ট্রেনিং হয় মার্কিন সেনাদের প্রশিক্ষন বিমান সেসনা টি-৩৭ বিমান দিয়ে। আমেরিকার লুক এয়ার ফোরস বেজ, এরিজোনাতে এফ-৮৬ স্যাবরজেট এর উপর উচ্চ প্রশিক্ষন নেন। ঐসময় এফ-৮৬ স্যাবরজেট ছিল সবচেয়ে তুখোড় জঙ্গি বিমান। সমপর্যায়ের আরেকটি যুদ্ধ বিমান ছিল রাশিয়ার মিগ-১৫। এই কোর্সে তিনি সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে টপ গান হিসেবে পাশ করেন। অতঃপর তিনি পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ঢাকা কেন্দ্রে যোগ দেন ১৯৬৩ সালে।
পরবর্তীতে তিনি করাচির মৌরিপুর যেটা এখন মাশরুর এয়ার বেজ এর টি-৩৩ বিমানের প্রশিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের স্বাধিনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থান বিমান বাহিনীতে তার উপর উড্ডয়নের নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান টি-৩৩ বিমান নিয়ে পালিয়ে যাবার সময় নিহত হন যার প্রশিক্ষক ছিলেন সাইফুল আজম। একারনে পাকিস্থানের গোয়েন্দা বাহিনী তাকে রিমান্ডে নেয় এবং টানা ২১ দিন তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। ১৯৭২ সাল পর্যন্ত তিনি অজ্ঞাতস্থানে বন্দি থাকেন। তার নিজেরও পরিকল্পনা ছিল জেটবিমান ছিন্তাই করার, যার অংশ হিসেবে তিনি ৬ মার্চ স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন। পরবর্তীতে তিনি সফল হতে পারেননি। কিন্তু সাইফুল আজম আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন বৈমানিক হবার কারনে তাকে হত্যার সিদ্ধান্ত থেকে বিরত থাকে পাকিস্থান।
স্বাধিনতার পর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ১৯৭৭ সালে তিনি উইং কমান্ডার পদে উন্নীত হন। পর্যায়ক্রমে তিনি গ্রুপ কমান্ডার পদে পদোন্নতি পান। ১৯৭৯ সালে তিনি বাংলাদেশ বিমান বিহিনী থেকে অবসর গ্রহন করেন।
বিভিন্ন যুদ্ধে অংশগ্রহন এবং সাফল্য
১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে সাইফুল আজম পাকিস্থান বিমান বাহিনীর হয়ে অংশগ্রহন করেন। ভারতীয় বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান তিনি ভূপাতিত করেন এবং বিমানের পাইলট ফ্লাইট অফিসার বিজয় মায়াদেব যুদ্ধবন্দি হিসেবে আটক হয়। এই যুদ্ধে তিনি এফ-৮৬ স্যাবরজেট নিয়ে উড্ডয়ন করেন। ভারতীয় বিমান ছিল ফোল্যান্ড নেট জঙ্গি বিমান।
১৯৬৬ সালের নভেম্বর মাসে জর্ডানের বিমান বাহিনীতে পাকিস্থান বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে যান, আরব দেশের অনুরোধে পাকিস্থান থেকে কয়েকজন পাইলট পাঠানো হয়। সেখানে তিনি পাইলটদের প্রশিক্ষনের কাজ করেন। ১৯৬৭ সালের ৫ই জুন, আরব-ইসরায়েলি ৬ দিনের যুদ্ধ শুরু হলে ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর আক্রমনে মিশরিয় বিমান বাহিনীর অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে যায়। সেসময় ইসরায়েলের আক্রমন থেকে জর্ডানের মূল বেজ মাফরাকের প্রতিরক্ষার জন্য তার ডাক পরে। সাইফুল আজম হকার হান্টার বিমান নিয়ে তার বিচক্ষনতা এবং সাহসিকতার সাথে তার নিজের বিমানের চেয়ে আধুনিক এবং উন্নত প্রযুক্তির দুইটি সুপারসনিক ইসরায়েলি মিরাজ ফাইটার ভূপাতিত করেন। মনে রাখবেন শক্তির বিবেচনায় হকার হান্টার কিছুইনা ইসরায়েলি সুপারসনিকের কাছে।
একদিন পরেই তাকে ইরাকে বদলি করে পাঠানো হয়। আবারও সাইফুল আজম ইরাকি বিমান বাহিনীর পক্ষে উড্ডয়ন করেন এবং ডগ ফাইটে একটি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করেন। এরপর, আরও একটি ইসরায়েলি বোমারু বিমান তিনি ভূপাতিত করেন। দুইজন ইসরায়েলি পাইলটকেই যুদ্ধবন্দি হিসাবে নিয়ে যাওয়া হয়।
ইতিহাসে এই যুদ্ধ সিক্স ডে ওয়ার নামে বিশেষ পরিচিত।
সাফল্য এবং অনন্য সব বিশ্বরেকর্ড
- ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সাফল্যের কারনে তাকে পাকিস্তানের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক পদক সিতারা-ই-জুরাত দেয়া হয়।
- ১৯৬৭ সালের ৬ দিনের যুদ্ধে কৃতিত্ব স্বরুপ ইরাকি সাহসিকতা পুরস্কার নুত-আল-সুজাত পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
- ২০০১ সালে মার্কিন বিমান বাহিনী যুদ্ধক্ষেত্রে অনন্য অবদানের জন্য তাকে বিশ্বের ২২ জন লিভিং ঈগলসের একজন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
- ৪টি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার অনন্য বিশ্বরেকর্ড শুধুমাত্র তার একারই আছে।
- সাইফুল আজমের আটটি দেশের পৃথক বিমান বাহিনীর পরিচালনার প্রশংসাপত্র রয়েছে। দেশগুলো হলো- বাংলাদেশ, পাকিস্থান, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, রাশিয়া, চীন, ইরাক এবং জর্ডান।
- ১৯৬১ সালে লুক এয়ারফোরস বেস, এরিজোনাতে প্রশিক্ষনের সময় মার্কিন বিমান বাহিনী থেকে টপ গান উপাধি পান।
- সাইফুল আজম একমাত্র সামরিক পাইলট যিনি যুদ্ধে চারটি বিমান বাহিনীর ( বাংলাদেশ, পাকিস্থান, ইরাক এবং জর্ডান) হয়ে কাজ করেন সেই সাথে দুইটি ভিন্ন প্রতিপক্ষের (ভারত ও ইসরায়েল) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন।
- এককভাবে সর্বোচ্চ ৪টি ইসরায়েলি বিমান ভূপাতিত করার স্বীকৃতি স্বরুপ জর্ডান থেকে তিনি হুসাম-ই-ইস্তিকলাল সম্মাননা পান।
রাজনৈতিক জীবন
সাইফুল আজম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের ( বি এন পি ) হয়ে পাবনা-৩ আসন থেকে পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
অন্যান্য কর্মজীবন
অবসরের পরে আশির দশকে দুইবার তিনি সিভিল এভিয়েশন অথোরিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। বাংলাদেশ ফিল্ম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবেও দায়ত্ব পালন করেন। এছাড়া নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নাতাসা ট্রেডিং এজেন্সির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
মৃত্যু
সাইফুল আজম ২০২০ সালের ১৪ই জুন দুপুর ১টায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।১৫ই জুন তার জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় শাহীন কবরস্থানে তার মরদেহ সমাহিত করা হয়।তার মৃত্যুতে ফিলিস্থিনের কর্মীরা শোক প্রকাশ করেন।খ্যাতনামা ফিলিস্তিনি সাংবাদিক তামির আল মিশাল তাকে “আকাশের ঈগল” বলে অভিহিত করেন।
এরকম ব্লগ আরও পড়তে চাইলে অবশ্যই আমাদের ব্লগে নিয়মিত আসুন, আর ব্লগে লিখতে চাইলে দেরি না করে আজই রেজিস্ট্রেশন করুন।
ধন্যবাদ।
Really we don’t know that we have such legend. Thanks Mamun to introduce the great Fighter.
ধন্যবাদ বন্ধু পড়ার জন্য।