সেই ১৯৮৫ সাল থেকে ঢাকায় আছি, সাধারণত দুই ঈদে গ্রামের বাড়িতে যেতাম- ঈদ করতে। ঈদে বাড়িতে যাওয়া তখনকার দিনে এক যুদ্ধের মত ব্যাপার ছিল। এখনও ঈদে বাড়ি যাওয়া এক প্রকার যুদ্ধই কিন্তু এখনকার সময় থেকে সেই যুদ্ধ অনেকটাই আলাদা। বারবার যানবাহন পালটে সারাদিন অনেক ঝামেলা করে ঈদের সময় আমরা বাড়ি যেতাম। আমাদের সময় ঈদে বাড়ি যাবার গল্প নিয়ে আমার আজকের এই ব্লগ।
আমার গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জের কামারখন্দ থানার চৌবাড়ি গ্রামে। ঢাকার রামপুরা থেকে আমার গ্রামের বাড়ি কম-বেশি ১৪৫ কিলোমিটার দুরত্বে হলেও আমরা রওয়ানা দিতাম খুব ভোর বেলায়। প্রায় ভোরের আলো ফোঁটার সাথে সাথে। সে সেই নব্বই এর দশকের কথা। আজ ২০২০ সালে প্রায় চল্লিশ বছর বয়সে সেই স্মৃতি কেন জানি খুব মনে পরছে।
বাসা থেকে বের হয়ে রিকশা কিংবা বেবি ট্যাক্সি নিয়ে মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে চলে যেতাম। তখনকার দিনে বেবি ট্যাক্সি নামে এক বাহন ঢাকার রাস্তায় পাওয়া যেত যা এখনও ঢাকার বাইরে অনেক এলাকায় গেলে দেখা যায়। এটা দেখতে প্রায় সিএনজির মতই। রঙ ছিল হলুদ মত।
বেবি ট্যাক্সি দুই স্ট্রোকের ইঞ্জিন, বেশ কালো ধোঁয়া হত আর এটা প্রচুর শব্দ করত। পরে ২০০০ সালের পর সম্ভবত তৎকালীন সরকার ঢাকা শহরে এটা নিষিদ্ধ করে। ঢাকায় চলা আরেকটা বাহনের নাম একই সাথে বলে রাখি যার না ছিল টেম্পু, যার আধুনিক রূপ এখনকার লেগুনা। এটাও বেবি ট্যাক্সির সাথে নিষিদ্ধ করা হয়। আরেকটা যান ছিল যার নাম ছিল মিশুক, বেকার যুবকদের এটা চালাতে উৎসাহিত করে টিভিতে বিজ্ঞাপনও দেয়া হত।
যাই হোক, মহাখালী গিয়ে আমরা বাসে উঠে পরতাম। সেই ছোট বেলার কথা। ভিড় আসলে খুব বেশি হত না বলেই মনে পরে। বাসের কন্ট্রাক্টরেরা ডেকে ডেকে বাসে তুলে নিত, অনেক সময় জোড় করেই তুলে নিত। বোকা-সোকা মানুষেরা যারা বাস চেনেনা তারা হয়ত না জেনে বুঝেই অন্য বাসে যাত্রি হয়ে যেতে পারে, এমন ঘটনা বিচিত্র কিছু না।
তখনকার সময় ঈদে বাড়ি যাবার গল্প সবারই কম বেশি হয়ত এমনই।
তবে বাসের গুনগত মান ছিল সেই মাপের। আমি তেমন ভাল কোন বাসে উঠেছি বলে মনে পরে না, সিট কাত করে হেলান দেবার কোন সিস্টেম কখনও দেখিনি, সামনের পা রাখার জায়গাও খুব সামান্য। মিনিবাস বলেও এক পদের বাস ছিল, যা দৈর্ঘ্য প্রস্থে কিংবা উচ্চতায় সব দিক থেকেই কম ছিল। ইঞ্জিনের উপরেও লোক বসানো হত। আর হ্যা, ভাড়া? ভাড়া যতদূর মনে পরে সিট প্রতি ৪০ টাকা ছিল যত দূর মনে পরে, ভুলও হতে পারে।
এসব বাসে উঠে বমি করাটা আমার স্বভাব ছিল, কমপক্ষে একবার বমি আমি করতাম। আসলে বাসে ঝাঁকি, অসম গতি, আশেপাশের পরিবেশ সব কিছু মিলে আমি বমি ঠেকাতে পারতাম না। বমি না হওয়ার ঔষধ, লেবুর সুঘ্রাণ, পয়সা মুখে দিয়ে বসে থাকা, জানালা খুলে দেয়া কিছুই আমার বমি ঠেকাতে পারত না। আমার বাবা-মা আর বোন মিলে চারজন একসাথে যেতাম, কেও বমি না করলেও আমি আছি।
রাস্তার অবস্থা খুবই খারাপ ছিল, ঝাঁকি খেতে খেতে অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। কতক্ষন লাগত আজ মনে পরে না, হয়ত চার খন্টা লেগে যেত। মহাখালী থেকে আমরা যেতাম ভূয়াপুর ঘাটে। অনেক সময় বাস থেকে নেমে আবার কিছুটা হাটতে হত।
আমার প্রবাস জীবন নিয়ে কিছু কথা পড়তে চাইলে এই ব্লগ পরে দেখবেন। আমার জীবন থেকে নেয়া কিছু কথা (প্রবাস জীবন)।
লঞ্চঘাটে গিয়ে টিকেট কেটে লঞ্চে উঠে যেতাম- যমুনা নদি পার হবার জন্য। লঞ্চ না পেলে বড় ট্রলারে করেও আমরা পার হয়েছি। ডিম সিদ্ধ, চানাচুর, ঝাল-মুড়ি, সন্দেশ-চমচম ইত্যাদি ফেরি করত অনেকেই।
আর হ্যা, লঞ্চে দেখা পেতাম ভিক্ষুকের। এরা গান গেয়ে ভিক্ষা করত। বেশ ভাল গান গাইত, যতদূর মনে পরে।লঞ্চগুলো দুইতলা সিস্টেমের ছোট লঞ্চ। ভাড়া ৫/৬ টাকা মাথা প্রতি। সময় লাগত প্রায় দুই ঘন্টা। গোটা জার্নির মধ্যে এই দুই ঘন্টা আমার খুব প্রিয় ছিল।
লঞ্চের ড্রাইভার উপর তলায় বসত হুইল হাতে আর ইঞ্জিন রুম ছিল নিচে। উপর থেকে চেইন বা সুতা টেনে ঘন্টা বাজিয়ে সিগন্যাল দিলে নিচের ইঞ্জিনে তার হেল্পার সেই অনুযায়ী একশন নিত। নিচের ইঞ্জিনের আসে পাসে সিট পরলে ভট-ভট শব্দে দুই ঘন্টা পার করা মুসকিল ছিল।
লঞ্চ থেকে নামতাম সিরাজগঞ্জ ঘাটে। নামার সাথে সাথেই এক অদ্ভুত বোধ হত আমার কেন জানি। নদির এপার আর ওপারের জনপদের মাঝে একটা সূক্ষ পরিবর্তন আমার চোখে পরত। বাহ্যিক দৃষ্টিতে শুধু ভাষার পরিবর্তন কিংবা মানুষের আচরণগত দেখা গেলেও আসলে এর চেয়ে বেশি কিছু ছিল। এটা বলে বোঝান যাবেনা। এটাই হয়ত রক্তের টান, মাটির টান, মাটির মায়া বা এমনই কিছু একটা। সঠিক শব্দ আমার মনে আসছেনা।
ঘাট থেকে আমরা সম্ভবত রিকশা করে সিরাজগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডে যেতাম, কখনও ট্রেন স্টেশন। খুব করে মনে মনে দোয়া করতাম যেন বাসে না উঠতে হয়, বমি করার ভয়ে। তবে বেশির ভাগ সময়ে সিরাজগঞ্জ বাস স্ট্যান্ডেই যেতে হত।
সেই বাস আমাদের নিয়ে যেত জামতৈল স্টেশনে। হয়ত ঘন্টা খানেক সময় লাগত। জামতৈল স্টেশন থেকে আমার গ্রামের বাড়ি কম বেশি ৩ কিলোমিটার হবে। স্টেশন থেকে যাবার রাস্তাটাও বেশ চ্যালেঞ্জিং। ওই তিন কিলোমিটার যাবার একমাত্র অবলম্বন ছিল ভ্যান। রিকশা ছিল বলে মনে পরে না। আর রাস্তা মাটির/বালির হবার কারনে ভ্যানের চাকা গেঁড়ে যেত।
বিকল্প আরেক উপায়ে আমরা যেতাম। সেটা হল একজন কুলি ঠিক করা হত, সে আমাদের ব্যাগ-বস্তা মাথায় নিত, আর আমরা সবাই হেঁটে যেতাম। বাড়িতে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় সন্ধ্যা বা অনেক সময় সন্ধ্যা হয়ে যেত। রোজার ঈদে যাবার সময় মনে পরে অনেকবার ইফতার পানি দিয়ে রাস্তায় করে নিতে হয়েছে।
বাড়িতে দাদা-দাদি ছিলেন, পাশের গ্রামে ছিল নানা বাড়ি। যাওয়া-আসা সব মিলে ৩ থেকে ৪ দিন আমরা ঈদের ছুটিতে গ্রামে থাকতাম। সেই সময়টা অন্য আরেকদিন শেয়ার করব। আজ আমাদের সময় ঈদে বাড়ি যাবার গল্প পর্যন্তই থাকুক।
ভাল থাকবেন সবাই।