করোনাকালীন সতর্কতা হিসেবে প্রায়শই আমরা হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা এসিআই কোম্পানির হ্যান্ড রাবিং এলকোহল Hexisol ব্যবহার করে থাকি। রাস্তায় বের হলেই আমরা দুই এক ফোঁটা স্যানিটাইজার হাতে মেখে নিচ্ছি, সাথে থাকা বন্ধু বান্ধব বা ছোট সোনামনিদের হাতেও দিচ্ছি।  নিজেও সুরক্ষিত হচ্ছি, অন্যকেও করছি।  যদিও হেলথ প্রফেশনালদের মতে সবান পানি স্যানিটাইজার থেকে বেশি ফলপ্রসু কিন্তু তবুও স্যানিটাইজারের ব্যবহার বেড়েছে ব্যাপক।

তার বড় কারণ বাইরে বের হলো পানির সংস্থান পাওয়া অনেকক্ষেত্রে সম্ভব হয় না,  সেক্ষেত্রে এই উদ্বায়ী হ্যান্ড স্যানিটাইজার খু্ব ভালো একটি বিকল্প৷  কিন্তু তার বিপদও কিন্তু নেহাত কম নয়৷  ইদানীং  প্রায়শই আমরা দেখতে পাই হাত পুড়ে যাওয়া রোগীদের সংখ্যা হাসপাতালে বাড়ছে৷  তার জন্য দায়ী হতে পারে আপনার খুব পছন্দের নানাবিধ ব্র্যান্ডের হ্যান্ড স্যানিটাইজার৷  প্রশ্ন জাগতে পারে যে বস্তু আমাকে ভাইরাসের প্রতি সংবেদনশীল হতে বাধা দিচ্ছে তা কিভাবে আবার ক্ষতিকারক হতে পারে৷  আজকের এই আলোচনায় আমি তিয়াশ হাজির হয়েছি সেই বাকবিতন্ডায়।  কথা বলবো একজন ফার্মাসিস্টের দৃষ্টিকোণ থেকে।

শুরু করা যাক আমাদের খুব পরিচিত হ্যান্ড রাবিং সল্যুশন হেক্সিসল নিয়ে।  নীল বর্ণের এই লিকুইড পেয়ে যাবেন প্রায় সব ফার্মেসি বা ঔষুধের দোকানে।  হেক্সিসলের ব্যবহার নিদেনপক্ষে কমও নয়।  বিভিন্ন গবেষণাগারে বিশেষ করে মাইক্রোবায়োলজি সম্পৃক্ত ল্যাবের অন্যতম সাধারণ বস্তু এই হেক্সিসল।  কিন্তু তার মাঝে আছে কি যার জন্য এই বস্তু এত বহুল প্রচলিত।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার কী দিয়ে তৈরি করা হয়

5% Chlorhexidine Gluconate এবং 70% Iso-propyl alcohol এর মিশ্রণই হলো আমাদের এই হেক্সিসল৷ Chlorhexidine আমাদের বহুল ব্যবহৃত এন্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগের একটা উপাদান।  Chlorhexidine Gluconate একুয়াস মিডিয়ার উপস্থিতিতে Chlorhexidine উৎপাদন করে, যা অনুজীবের সেল স্ট্রাকচারের সাথে বাইন্ড করে তা ধ্বংশে ভুমিকা রাখে।

আমাদের হেক্সিসলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান Iso-propyl alcohol ,  এটিও অনুজীবের সেল ওয়াল ধ্বংশ করে দেয়।  কিন্তু মজার ব্যাপার হলো হেক্সিসলের এই উপাদানগুলো খুব উদ্বায়ী ধরনের হয়। উদ্বায়ী বলতে বোঝায় সেইসব বস্তুকে যা বাতাসের সংস্পর্শে সহজেই উড়ে যায়।  লক্ষ্য করে দেখবেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হেক্সিসল যাই ব্যবহার করুন না কেন হাতটা একটু ঘষামাজা করলে সেটা একদম নাই হয়ে যায়। এই বিশেষ বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী তাদের এই উদ্বায়িতা।

হেক্সিসলের মতোই বিভিন্ন ব্র্যান্ডের হ্যন্ড স্যানিটাইজারের মুল উপাদান হিসেবে থাকে এলকোহল। বিশেষত আইসোপ্রোপাইল এলকোহল বা ইথানল বা প্রোপানল বা এদের মিশ্রণ। বিভিন্ন কোম্পানি ভেদে এই স্যানিটাইজারের এলকোহলের পরিমাণ কম বেশি হতে দেখা যায়।  কিন্তু সচরাচর তার পরিমাণ ৬০% থেকে ৯৫% এর মধ্যে রাখা হয়ে থাকে৷  হ্যান্ড স্যানিটাইজারে থাকা এই এলকোহল মাইক্রোঅর্গানিজম রোধে বেশ কার্যকরী বলে প্রমাণিত।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিপদজনক কেন

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো এই এলকোহল নিয়ে আমরা এত ভালো ভালো কথা বলছি কিন্তু এর বিপদজনক দিকটাও কিন্তু ঠিক ততো পরিমাণেই। ক্যামিকেলের ক্ষতিকর গুণাবলি (যেমন দাহ্যতা,  জারণ ক্ষমতা,  রেডিয়েশন,  বিষাক্ততা, পরিবেশের ওপর প্রভাব ইত্যাদি) বোঝানোর জন্য আন্তর্জাতিক কিছু একক চিহ্ন ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যাদের আমরা বলে থাকব হ্যাজার্ড সিম্বল।

লক্ষ্য করলে দেখতে পাবেন প্রতিটা স্যানিটাইজারের বোতলের গায়ে রিং এর ওপর আগুন জ্বলছে এমন এক চিহ্ন দেয়া থাকে৷  হ্যাজার্ড সিম্বল অনুযায়ী যার অর্থ উপাদানটি প্রচুর দাহ্য।  অর্থাৎ আগুনের সংস্পর্শে এলেই এরা আপনাআপনি জ্বলে ওঠে।  এলকোহলের খুব মজার দুইটি বৈশিষ্ট্য হলো তার এই দাহ্যতা এবং উদ্বায়িতা।  এই দুইয়ে মিলে হ্যান্ড স্যানিটাইজার তৈরি করতে পারে জটিলতা।

আগুনের সংস্পর্শে এলেই হ্যান্ড স্যানিটাইজারে থাকা এলকোহল জ্বলতে শুরু করে। যাকে রসায়নের ভাষায় বলা হয়ে থাকে Combustion reaction তথা দহণ বিক্রিয়া। এই বিক্রিয়ায় আগুনের উপস্থিতিতে বাতাসে থাকা অক্সিজেন হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হেক্সিসলে থাকা এলকোহলের সাথে বিক্রিয়া করে উৎপাদন করে কার্বন ডাই-অক্সাইড ও বাষ্প। আর যেহেতু এলকোহল উদ্বায়ী তাই যে জায়গায় ব্যবহার করেছেন তার উপরিতলে বাষ্পাকারে এলকোহল থাকতে পারে।  তাই আপাত হাত শুকনো মনে হলেও আগুনের কাছাকাছি এলেই দহন বিক্রয়া শুরু হয়ে যেতে পারে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার

তাই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে, শুকোতে না দিয়েই  সাথে সাথেই আগুনের কাছে গেলে খুব সহজে আগুন লেগে যেতে পারে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা সমস্ত জায়গা জুড়ে৷ পাশাপাশি সার্ফেস ডিসইনফ্যাক্ট্যান্ট যা  দিয়ে আমরা প্রতিনিয়ত আমাদের আমাদের চারপাশ জীবাণুমুক্ত করছি তাতেও থাকে এলকোহল।  আর সেই সল্যুশন দিয়ে চুলা বা রান্নাঘরের সার্ফেস পরিষ্কার করা হতে পারে  আরো বিপদজনক।  সহজেই পুরো ঘরে ছড়িয়ে যেতে পারে আগুন।  পাশাপাশি আমরা ছোট শিশুদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করাচ্ছি তারা না বুঝে শোনে আগুনের কাছাকাছি চলে যেতে পারে।  তাছাড়া কোনো কারণে অতিরিক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করাও হতে পারে বিপদজনক।

কিভাবে আপনার ইমিউনিটি সিস্টেম বাড়াবেন জানতে এই ব্লগ পড়তে পারেন।

তাছাড়া লিকুইড সাবান ও হ্যান্ড স্যানিটাইজারে জীবাণুনাশক উপাদান হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে Triclosan.  এই ট্রাইক্লোসান একটি বেশ কন্ট্রোভার্সিয়াল ড্রাগ। এর উপকারী দিক হিসেবে রয়েছে এতটা এন্টিভাইরাল এবং এন্টিফাঙ্গাল (ছত্রাক প্রতিরোধী)  গুণ। তাই জীবাণুনাশক  উপকরণে দেদারছে ব্যবহৃত হতে দেখা যেত এই ট্রাইক্লোসান।  কিন্তু এর ক্ষতিকারক দিকও নেহাত কম না।  খুব স্বল্প পরিমাণের ট্রাইক্লোসান মানবদেহে তৈরি করতে পারে বেশ জটিলতা৷  এটি রিপ্রোডাকশন, ইমপ্যাক্ট সার্ভাইভাল অনেকাংশে রোধ করে।  যাতে শারীরীক ও মানসিক জটিলতা পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু কিভাবে ট্রাইক্লোসান এই ক্ষতিকর প্রভাব রাখে? চলুন জানা যাক।

Triclosan এর স্ট্রাকচার একটু খেয়াল করলেই দেখবেন এর সাথে আমাদের থাইরয়েড হরমোনগুলোর (ট্রাইঅডোথাইরোনিন, থাইরক্সিন)  সাথে মিলে যায়।  তো হরমোন কি? হরমোন আমাদের দেহের বিশেষ কিছু গ্রন্তি থেকে নিঃসৃত কিছু ক্যামিকেল স্টিমুলেন্ট যা আমাদের রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে প্রবাহিত হয়ে কোনো বিশেষ কাজ সম্পন্ন করে থাকে।  তো এই হরমোনগুলোর জন্য কিছু বিশেষায়িত রিসেপ্টর থাকে৷ আর হরমোন সেই রিসেপ্টরের সাথে বাইন্ড করে তার কার্যকরী দিক প্রকাশ করে।   বিজ্ঞানীদের ধারণা গঠণ কাছাকাছি হওয়ায় ট্রাইক্লোসান এইসব রিসেপ্টরের সাথে বাইন্ড করে জটিলতা সৃষ্টি করে।

হ্যান্ড স্যানিটাইজার

যেমন বলছিলাম এই ড্রাগটা খুব কন্ট্রোভার্সিয়াল, তাই FDA (FOOD and DRUG ADMINISTRATION)  Triclosan কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।  কিন্তু তারপরও কিছু ছোট কোম্পানিগুলো এই বিষাক্ত ক্যামিকেল হ্যান্ড স্যানিটাইজার ও লিকুইড সাবানে ব্যবহার করে আসছে। এসবের দীর্ঘমেয়াদী ব্যবহার প্রচুর জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে।

তাহলে বাঁচার উপায় কি

অতএব হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার হতে পারে প্রচুর বিপদজনক।  তবে তা থেকে বাঁচার উপায় কি? চলুন দেখে নেয়া যাক,

★ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা হেক্সিসলের পরিবর্তে সাবান ব্যবহার করুন।

★ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সাবান কেনার আগে দেখে নিন তাতে Triclosan ব্যবহার করা হয়েছে কিনা।  কোনোমতেই ট্রাইক্লোসান সমৃদ্ধ কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করতে যাবেন না।

★ হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা ডিসএনফ্যাক্ট্যান্ট ব্যবহার করলে তা সম্পুর্ণভাবে শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করুন।

★ বাইরে গেলে হ্যান্ড ওয়াশের ছোট প্যাকেট (লাইফবয় বা অন্যান্য ব্র্যান্ডের ট্রাভেল কিট হিসেবে স্ল্যাশেট হিসেবে পেয়ে যাবেন রিস্টোরএপল হ্যান্ড ওয়াশের মিনি প্যাকেট) এবং এক বোতল পানি সাথে রাখুন।

★ ছোট শিশুদের প্রতি অতিরিক্ত নজর রাখুন। কোনো ক্রমেই তাদের আগুনের কাছে ঘেঁষতে দিবেন না।

★ রান্নাঘরে হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা সার্ফেস ডিসইনফ্যাক্ট্যান্ট ব্যবহার থেকে বিরত থাকুন।

★ দুর্ভাগ্যক্রমে আগুন লেগে গেলে ঘাবড়াবেন না। নিজেকে শান্ত রেখে যতদ্রুত সম্ভব হেলথ প্রফেশনালদের সাথে যোগাযোগ করুন।

সর্বোপরি, ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন৷ কোরবানির ইদ বলে যত্রতত্র বাইরে না বেরিয়ে ঘরে থাকুন৷  নিজের ও নিজের পরিবারের সবার যত্ন নিন৷  আর অবশ্যই হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহারের পুর্বে সতর্কতাগুলো জেনে নিবেন।  কারণ আপনার জীবনের মুল্য অনেক।  আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি৷ দেখা হবে আবার কোনো নতুন বিষয় নিয়ে, তদদিন আমাদের সাথেই থাকুন।

অভ্র তিয়াশ

২য় বর্ষ, ফার্মেসী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

Previous articleবাংলা সাহিত্যে দেশ ভাগ
Next articleআমি কিভাবে ওয়ার্ডপ্রেস দিয়ে ওয়েবসাইট তৈরি করলাম পর্ব-০১
আমার জন্য জীবন মানে বই আর সোশাল মিডিয়া। বইতে বাঁচি, সোশাল মিডিয়তে শ্বাস নিই। দুইয়ের কোনোটিতেই একটু ভাটা পড়লেই মেঘ জমে আমার আকাশে। বৃষ্টিভেজা দিনে বা খর রৌদ্র দুপুরে ছাদের রেলিং এ হাতে বই নিয়ে বা জানালার ধারে একমনে প্রিয় তারকাদের প্রোফাইল ঘাটা, দুটিতেই সমান পারদর্শী। মাঝে মাঝে Indie pop গানের জগতে বা কখনো kpop নিয়ে মাতি। কখনো korean rom-com মুভি দেখে হাসতে হাসতে প্রেমে পড়ি, কখনো Titanic দেখে বিশাদরসে হাবুডুবু খাই। জীবন এভাবে চলছে। মন্দ কি?